চোদ্দ থেকে ষোল হতে চলল গৃহবন্দী হয়ে
3 182এই যে লেখাটি লিখতে বসেছি, সন্ধ্যা শুরুর বৃষ্টিভেজা আবহে, অতিমারী না থাকলে এই সময়ে আমার এই বেশ বড় এবং আসবাবপত্রহীন ঘরটিতে কিশোর-কিশোরীদের মুখরতা আপনাকে মুগ্ধ করে রাখত। অবশ্য আপনি যদি সেই গোত্রজাত হন, যাঁরা বিশ্বাস করেন আপনারা সবাই কৈশোরে সাধুপুরুষ ছিলেন আর এই একবিংশীয় প্রজন্ম উচ্ছন্নে গেছে, তবে আপনার মনে হত এই ঘরটিতে শৃঙ্খলাহীন ছেলেমেয়েদের উৎপাত চলছে। সে যাই হোক, এখন আমার পড়ানোর ঘরটি ফাঁকা। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সৌজন্যে এই ঘরে গত উনপঞ্চাশ দিন কারো পদছাপ পড়েনি। আমিও গৃহবন্দী আর আমার ঐ 'অক্সিজেন সিলিণ্ডার'রাও গৃহবন্দী। হোয়াটসঅ্যাপে আবদারী বার্তা আসে, "ও দাদা, পড়ানো শুরু করে দাও না গো, ঘরে দমবন্ধ হয়ে আসছে!"
স্কুলে যেমন শিক্ষকমাত্রই স্যার অথবা ম্যাডাম, প্রাইভেট টিউশনির পরিসরে চলে দা(দা) বা দি(দি)। ভালোই লাগে। একটা আত্মজনের ডালপালা পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ে এমন ডাকাডাকিতে, তা আবার মান্যতা পায় রাখীপূর্ণিমার দিনটিতে—হাত ভরে ওঠে বন্ধন-স্মারকে। অবশ্য 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' সম্বোধন যে সম্পূর্ণ ব্রাত্য তেমনটাও নয়। দু’বছর হতে চলল, এই নাইন থেকে কলেজ, চোদ্দ থেকে একুশে পা-এর দলকে কোভিড যেন উড়ে বেড়ানোর দুটো ডানা ছেঁটে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যেভাবে খাঁচার ভেতর পাখিগুলোকে ঢুকিয়ে দেয় পাচারকারী। পড়াশোনায় মনোযোগী যে, সে আতঙ্কিত পরীক্ষা ক্রমশ দূরত্ব কমাচ্ছে অথচ সিলেবাস এগোচ্ছে না। পড়াশোনায় অমনোযোগী যে, তার রাতের বিছানায় চোখের জলে বালিশ ভেজে—এভাবে কতদিন ভালোবাসার মানুষটাকে না দেখে থাকা যায়! দুটোই চূড়ান্ত সত্য। সাইকেলটা বারান্দার এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে কতদিন ধরে, একমাত্র সে জানে সওয়ারির অব্যক্ত বেদন। স্যারের কাছে পড়তে না ঢুকে দল বেঁধে গ্রাম-চরকি আর হলুদ সর্ষে খেতে সেলফি তোলার মজা কী করে বুঝবে পিতা-মাতা-গুরুজন। তারা তো 'পাউট' মানেই জানে না। সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই ছবি স্ট্যাটাসে দেবার আগে ইংরেজি শিক্ষককে হাইড করতে ভুলে গেলে—“কেন তুমি আজ পড়তে না এসে এইসব করে বেরিয়েছ? তোমার গার্জিয়ানকে কাল সকালেই ফোন করে জানাব।" তাতে অবশ্য ভয় নেই, কারণ শিক্ষকমশাই বাবার ফোন নম্বর নিয়েছিলেন যেদিন, দুটো ডিজিট এদিক-ওদিক করে দেওয়া হয়েছিল। হাজারবার চেষ্টা করলেও লাইন ঢুকবে না। বেস্টুর জন্মদিন কামিং, রোজ স্ট্যাটাস দিয়ে জানান দেওয়া—আর বাকি পাঁচ দিন। রাত বারোটা থেকে চলবে ফোন কল আর মেসেজ করে শুভেচ্ছা জানানো। 'হ্যাপি ল্যান্ডিং ডে', 'শুভ পয়দা দিবস! এবার ট্রিট দিতে হবে কিন্তু ভাই' ইত্যাদি। রোস্টার হিসেবে ক্যারিমিনাটির ধারেকাছে আর কোনো ইউটিউবার নেই অথবা বিটিএসের নতুন গান নিয়ে তর্ক, স্যারকে লুকিয়ে ব্যাগের আড়ালে মোবাইলে অপেক্ষারত ক্রুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণকে মেসেজ— "কখন ছাড়বে বুঝতে পারছি না। বকেই যাচ্ছে জীবনানন্দ নিয়ে। স্যার ছাড়লেই যাচ্ছি। চলে যেও না প্লিজ। রাগ করে না সোনা!"—লেখা হবে রোমান হরফে, সঙ্গে অনেক চুম্বন-ইমোজি।
বসে বসে ছেলেমেয়েরা মিম বানায়—আমরা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেব তখন আমাদের বয়স হবে আশি।
পড়ানো ছাড়াও নবপ্রজন্মের মনস্তত্ত্ব বোঝেন যে দাদা বা দিদি, তাঁর জনপ্রিয়তা সেই অঞ্চলে কোনো টিভি তারকার থেকে কম নয়। 'হতচ্ছাড়া লকডাউন এসে সব শেষ করে দিল বস'। 'গেমখেলা'র নেশা মারাত্মক হয়ে গেল কারো। তাই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি। বসে বসে ছেলেমেয়েরা মিম বানায়—আমরা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেব তখন আমাদের বয়স হবে আশি। হাসি পায় প্রাথমিক অভিঘাতে, পরক্ষণেই ছাত্র-অন্তপ্রাণ প্রাইভেট টিউশনজীবীর বুক মুচড়ে ওঠে, একটা ছেলে বা মেয়ে চোদ্দ থেকে ষোল হতে চলল গৃহবন্দী হয়ে!
আমরা চোখের সামনে দেখি বাজার খোলা, মদের দোকান খোলা, বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে, পৌরভোটের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে বড়খোকা-বড়খুকিরা, শুধু মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আয়োজন করতে গেলে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে গেলে করোনা-গ্রাসের কথা মনে পড়ে এদের! পরীক্ষা বাতিলের খবরে ৭৮ শতাংশ উল্লসিত হলেও, বাকি ২২ শতাংশের মনের কথা জানার চেষ্টা করেছেন কেউ? সেই 'পরীক্ষা দিতে চাওয়া'দের নিয়ে কথা বলতে দেখলাম না যে! মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে না-পারা সৌগত ফোনে বলছিল,
-স্যার, ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা এটা। সেটাই দিতে পারলাম না আমরা, ভাবতেও পারছি না।
একটা গোটা প্রজন্মকে 'মূর্খ' অতএব প্রতিবাদহীন বা যোগ্য চাকরিপ্রার্থী হতে না পারার ষড়যন্ত্রে কোভিডকে কাজে লাগানোর সবরকম এই বন্দোবস্ত আমাদের কারো কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না। অবশ্য তাতে কার কী বা আসে যায়। আমাদের ভোটের কতটুকু মূল্য? ওই তো বাইশ শতাংশ। এতে পাত্তা দিলে করেকম্মে খেতে হবে না কোনও রাজনৈতিক দলকে।
যিনি স্বাভাবিক সময়ে তিরিশ জনের বেশি পসার জমাতে পারেননি, করোনাকালে তাঁর উপার্জন নেমে এসেছে একদম শূন্যে। যতই অনলাইন মাধ্যমে পড়ানো চলুক না কেন, সম্মান দক্ষিণা দিতে আসার মত সুযোগ বহু অভিভাবক করে উঠতে পারছেন না।
আমরা যারা মধ্যমেধার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, মোটামুটি বছর পঁচিশের আগে যাদের না ছিল মেধার জোর এবং না ছিল বাবার ব্যাঙ্কের জোর, তারাই কমবেশি প্রাইভেট টিউশনকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি (মেধার জোর থাকলে একটা কোনো সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা 'ক্র্যাক' করতে পারতাম, আর পয়সাওয়ালা পিতা থাকলে কী করতে পারতাম না, সেটাই ভেবে দেখার)। তাতে কারো উপার্জন যথেষ্ট ভদ্রস্থ, বাড়ি-গাড়ি সবই জুটেছে, কারো ক্ষেত্রে এতটা না হলেও স্বচ্ছল জীবনের স্বাদ দিতে পেরেছে গৃহশিক্ষকতা। আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়াই বলে প্রাইভেট টিউশনের একটি বঙ্গীয় প্রতিশব্দ ব্যবহার করি—স্বনিয়োজিত শিক্ষকতা। অনেকে বুঝতে না পেরে ভুরুটুরু কুঁচকে মানে জানতে চান। আমাদের কেমন কাটছে এই করোনা-জীবন? যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, তখনও আমরা সব ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ঠিকমত সম্মান দক্ষিণাটা (মানে মাস মাইনেটা) পেতাম না। আমরা ধরে নিই একটা ব্যাচে পঁচিশটি ছেলেমেয়ে থাকলে নানা কারণে পাঁচ জনের টাকা পাব না। অর্থাৎ প্রতি একশ জনে পাওয়া যেত আশি জনের টাকা। বাকি কুড়িজন 'ইনকাম ট্যাক্স অফিসার'! কিন্তু কতজন শিক্ষকের কাছে একশ জন শিক্ষার্থী পড়ে, সেটাও ভেবে দেখার। যিনি স্বাভাবিক সময়ে তিরিশ জনের বেশি পসার জমাতে পারেননি, করোনাকালে তাঁর উপার্জন নেমে এসেছে একদম শূন্যে। যতই অনলাইন মাধ্যমে পড়ানো চলুক না কেন, সম্মান দক্ষিণা দিতে আসার মত সুযোগ বহু অভিভাবক করে উঠতে পারছেন না। কারণ, কোনো অভিভাবক কাজ হারিয়ে ঘরে বসে আছেন, কারো পরিবার অসুখে-মৃত্যুতে বিপর্যস্ত, আবার কিছু সুযোগসন্ধানী এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেমালুম 'মাস্টারের টাকা মেরে দিচ্ছেন', সেটা বলাই বাহুল্য। পরিচিত প্রৌঢ় টিউশনজীবী দাদার ফোন আসে,"এভাবে কতদিন চলবে জানি না। তোমার বৌদির গলব্লাডার স্টোন, অপারেশন করানোটা জরুরি। হাতে যে টাকাই নেই। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে সবজি বাজার করতে হচ্ছে।" আমি জানি ব্যাঙ্কে তাঁর সঞ্চয় সামান্যই। একটা বড় অঙ্কের টাকা সারদা কোম্পানির গ্রাসে চলে গেছে। এখন মফস্বলের প্রৌঢ় গৃহশিক্ষকের সংসার চলে না!
অনলাইনে আর যাই হোক পড়াশোনাটা হতে পারে না। এটা আমার অভিমত। সাময়িক বিকল্প হিসেবে হয়ত মন্দ না, তবে বিকল্প কি আর আসল-সম হতে পারে? পড়ানো তো আর হেলিকপ্টার থেকে ঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন নয়! আমি তাই ব্যক্তিগতভাবে গুগল-দর্শনে আস্থা রাখার চেষ্টা করিনি। কেউ কেউ বলেছেন এভাবেই ক’টা দিন পড়ালে কী আর ক্ষতি হবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তো আগের মতোই চলবে সব কিছু। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি নানা কারণে। তার মধ্যে অন্যতম, আমার চোখের আড়ালে ছাত্র বা ছাত্রী আদতে কী করছে তা জানতে না পারার অস্বস্তি। তাছাড়া, নানা ছাত্রের নানা বাড়ির নানা দৃশ্য ও শ্রাব্যের নমুনা ইতিমধ্যে ভাইরাল হতে দেখেছি। আমি চাইনি সমাজমাধ্যমে হাসির খোরাক হয়ে উঠতে। জীবনটাকে সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বাস করা এক ঝাঁক কিশোর-কিশোরী বহুবর্ণের উচ্ছ্বাস নিয়ে, আনকোরা আবেগে সাইকেলের ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে বাজারপ্রার্থী বৃদ্ধের হৃৎকম্প বাড়িয়ে অবশেষে এসে পৌঁছবে শিক্ষকের দোরগোড়ায়, অতঃপর চলবে ক্ষণিকের আড্ডা, প্রেমে পড়া বারণ জেনেও দৃষ্টিবিনিময়ে বুকের ধুকপুকানি, স্যারের আগমনে পরীক্ষা বৈতরণী পারাপারের ছলাকলা বিদ্যার্জন। কোনো শিক্ষক আবার ভাবসম্প্রসারণের পংক্তির ব্যাখ্যায় বুঝিয়ে দেবেন পরীক্ষার মার্কসবাদের থেকেও বড় সত্য মানুষের পাশে থাকার প্রকৃত আনন্দের স্বরূপ। অনেক পরে সেই ছাত্রদলের কেউ স্বেচ্ছাসেবী হয়ে খাবার পৌঁছে দেবে আর্তের হাতে—জীবনের এই জয়গান-বার্তা অনলাইনে দেবে, এমন শক্তি ইন্টারনেট পাবে কীভাবে?
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (3)
-
-
Sir lekhata khub vlo laglo. Ebar 1st yr clg e vorti hoyechi. Puro bochor kete glo. Kono teacher k samne dekhini. 😖
-
Sir…লেখাটা পড়ে সত্যিই খুব ভালো লাগলো…বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে…আগে সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবতাম “তারাতারি পড়তে হয় যেতে হবে না হলে sir পড়ানো শুরু করে দেবেন “…আর এখন ঘুম থেকে উঠে ভাবি WhatsApp status a কে reply দিলো…..Instagram a কতোজন follow request পাঠালো ….এই সব …..আর আমাদের জীবনের এক মূল্যবান সময় (14-18)গৃহবন্দি হয়ে ….youtube a carryminaty ar video দেখে আর BTSএর গান শুনে কাটিয়ে দিলাম ….SIR এর কাছে পড়তে গিয়ে বন্ধু দের সাথে আড্ডা মারা …Schoola class off করে সারা স্কুল ঘোরা…. আর জীবনের প্রথম Bord exam এ বসার অনুভূতি …. এই সব জীবনের কিছু সেরা আনন্দ উপভোগ করতে পারলাম না ।।।
Leave a Reply
-
Just darun sir 😍 🔥❤️😍