স্যার তোমরা কবে আমাদের স্কুল খুলে দেবে?
0 120২০২০ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছোট ছোট শিশুদের কলকাকলিতে বিদ্যালয় চত্বর মুখরিত হয়ে উঠেছিল। বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনসহ আনুষঙ্গিক কর্মকান্ড নিয়ে আমরা সকলে যখন মেতে আছি, ঠিক তখনই কানাঘুষো শোনা যেতে লাগলো বিশ্বের অনেক দেশেই নাকি ‘করোনা’ নামের একটি ভাইরাস তান্ডব শুরু করেছে, যা খুব শিগগির সারা বিশ্বে মহামারীর আকার নেবে। ধীরে ধীরে এই অসুখটির করাল থাবায় ভারতবর্ষের জনগণও আক্রান্ত হতে শুরু করল। যার ফলশ্রুতি হিসাবে ২৩শে মার্চ, ২০২০ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি ঘোষিত হল। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ঘোষিত হলো খুব তাড়াতাড়িই সব মিটে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কোভিড-১৯ পাকাপাকিভাবে আমাদের এখানে বাসা বেঁধে বসল। প্রাথমিক স্তরের কচিকাঁচারা পড়ে গেল এক দীর্ঘ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে। প্রাত্যহিক বিদ্যালয় কর্মকান্ডের স্তব্ধতা তাদেরকে গৃহবন্দী করে দিলো। খাঁচায় বন্দী পাখির মতো তারা ছটফট করে চলেছে এখনও। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে অভিভাবক-অভিভাবিকারাও তাদের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যত নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। শিশুদের জীবন থেকে শিক্ষাঙ্গনের প্রায় দেড়টি বছর চুরি হয়ে গেল। এর কোনো কৈফিয়ত কি আমাদের কাছে আছে?
আমাদের বিদ্যালয়টির অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রান্তিক স্থানে হওয়ায় এবং আর্থসামাজিকভাবে আমাদের শিশুরা অনেকটা পিছিয়ে পড়া বলে অনেক কিছু থেকেই তারা বঞ্চিত। অনেকেই অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। স্কুলের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথমদিকে মুষ্টিমেয় কিছু শিশুদের সাথে যোগাযোগ করা গেলেও ফল আশাপ্রদ নয়। শুরু হল বিকল্প পথের সন্ধান। এরই মাঝে আসতে থাকে একের পর এক ফোন। কোনো সময় অন্য প্রান্তের প্রশ্নকারীর কচি গলায় আকুল জিজ্ঞাসা, ‘ও স্যার, স্কুল কবে খুলবে গো ?’ আবার কখনো বা ভেসে আসে, ‘স্যার, বাচ্চাগুলোকে তো আর বাড়িতে রাখা যাচ্ছেনা!কবে স্কুল খুলছে বলতে পারেন?’ প্রথম ক্ষেত্রে, মিষ্টি করে বুঝিয়ে বলি। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, কিছুটা গর্বিত হই এই ভেবে যে, আমরা অভিভাবক-অভিভাবিকাদের কাছে এখনও যথেষ্ট ভরসার স্থল। ওনাদেরও বুঝিয়ে বলতে হয় আমাদের হাত-পা বাঁধা অবস্থার কথা। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া যে আমরা নিরুপায় তাও বুঝিয়ে বলতে হয়।
আমাদের স্কুলের আশেপাশে একটা সময় বেশ কয়েকজন করোনাক্রান্ত হন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই সুস্থ এখন। ছাত্রছাত্রীদের সাথে নিয়মিত চলভাষের মাধ্যমে যোগাযোগের প্রক্রিয়াটি বহাল রয়েছে। তবে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে শুধু আশ্বাস-বর্ষণই চলতে থাকে। এরই মাঝে মাথায় খেলে যায় একটি উপায় যা বাচ্চাদের সাথে যোগাযোগের একটি শক্তপোক্ত মাধ্যম বলে মনে হল। কপাল ঠুকে লেগে পড়লাম। বাচ্চারা কার্টুন দেখতে ভালোবাসে। সেই ধারণা থেকেই একটি ইউটিউব চ্যানেল চালু করলাম। নিজের ধারণা থেকে ছোট ছোট নাটকের স্ক্রিপ্ট বানিয়ে সেগুলিকে নির্বাচিত শিশুদের চরিত্রানুসারে এবং তাদের অভিভাবকদের সম্মতিসাপেক্ষে হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে পাঠালাম। ঐ সমস্ত আগ্রহী অভিভাবকরা বাড়িতেই শিশুদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে তার ভিডিও করে আমাকে পাঠালেন। সেগুলির এডিটিং করে ছোট ছোট দশ-পনের মিনিটের ছায়াছবি বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করতে লাগলাম। প্রথম দিকে কয়েকটি মজার ছবি বানালেও, পরবর্তীতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ‘আমার পরিবেশ’-এর পাঠ্যবিষয়বস্তুভিত্তিক স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণে সক্রিয় হলাম। এখন প্রধান অন্তরায় হল, শিশুদের কাছে ওগুলি পৌঁছাবো কীভাবে। এই বিষয়ে এগিয়ে এল আমাদের স্কুলের বেশ কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী। তারা তাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকা ঐ বয়সী বাচ্চাদের ভিডিওগুলো খেলার ছলে দেখিয়ে তার থেকে প্রশ্নোত্তরের তাৎক্ষণিক খেলা খেলতে লাগল। কয়েকদিন পেরোতেই দেখলাম এভাবে ভালোই সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল ফেলুদার সেই ডায়ালগ, ‘আছে আছে আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে’।
এ তো গেল শিশুদের সাথে যোগাযোগপর্ব। কিছুটা সিলেবাস আর কিছু তার বাইরের শিক্ষামূলক উদ্যোগ। কিন্তু স্কুল তো শুধু সিলেবাসের জন্য নয়, শুধু পড়াশোনারও জায়গা নয়। আমাদের বিদ্যালয়ে আমরা শিশুদের স্বরচিত গল্প, কবিতা ও ছবির সংকলন ‘রং বেরং’ বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করি বিগত সাত বছর ধরে। কিন্তু এই অতিমারীর কারণে গতবছর তা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি কচিকাঁচাগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদের এই নিষ্ফলা সময়ের জীবনযাপন ও স্কুলে আসার আকুতি-সম্বলিত অভিজ্ঞতাসমূহকে লিপিবদ্ধ করে ‘রং বেরং’ এর বিশেষ সংখ্যা ‘লকডাউন ডায়েরি’ ই-বুক আকারে প্রকাশ করতে চলেছি।
স্কুল চলাকালীন প্রতি বছর বার্ষিক পত্রিকার লেখাগুলি শিশুদের ক্লাসে বসিয়েই কর্মশালার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। অর্থাৎ শিশুদের রচনাগুলি যে স্বরচিত, তাতে সন্দেহ থাকেনা। কিন্তু বাড়ি থেকে পাঠালে ব্যাপারটির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। এইসব সাতপাঁচ ভেবেই আমরা শিক্ষকেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিই এই ‘লকডাউন ডায়েরি’ প্রকাশ করা হবে। এই ব্যাপারে স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছাত্রছাত্রীদের মতামত চাওয়া হয়। মোটামুটি সকলেই সম্মতি জানায়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বইয়ের আকারে প্রকাশ করে শিশুদের হাতে পৌঁছে দেওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। তাই ‘ই-বুক’ হিসাবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আবার আমাদের এই বার্তা শিশুদের কাছে স্কুলের গ্রুপ মারফতই পৌঁছে দেওয়া হয়। বলা হয় এই দেড় বছর বাড়িতে থাকাকালীন যা মনে হয়েছে, শিশুরা তাদের সেই মনের কথা সংক্ষেপে আমাদের লিখে জানাবে। এছাড়াও এই সময়ে বাড়িতে আঁকা ছবি থেকে ওদের পছন্দমত একটি ছবি আমাদের পাঠাবে। সময় দেওয়া হয় তিন দিন। আরও জানানো হয় লেখা ও ছবি পাঠাতে হবে স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমেই এবং যারা পাঠাবে তাদের সবাইকেই পুরস্কৃত করা হবে।
যথারীতি লেখা ও ছবি আসতে লাগলো। বেশিরভাগ লেখা পড়েই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবার জোগাড়! সকলেরই একই কথা, স্কুলে না আসতে পেরে মন খারাপ লাগছে। কিছু কিছু শিশু যারা স্কুলে আসতে স্বচ্ছন্দ ছিল না, তারাও লিখেছে ওই একই কথা। অনেকে লিখেছে সকাল ১০টা বাজলেই স্কুলে যাওয়ার জন্য তারা ছটফট করে। জোর করে যাদের মিড-ডে মিল খাওয়াতে হত, তারাও বলছে দুপুর দেড়টা বাজলেই নাকি তাদের নাকে মিড-ডে মিল রান্নার গন্ধ ভেসে আসে। আবার অনেকের কথায় বাড়িতে থেকে তাদের কপালে প্রচুর পরিমাণে বকুনি জুটছে। একটি বাচ্চা তো আবার আমাদের উদ্দেশ্য করে একটি চিঠিই লিখে ফেলেছে—অনেক কথা, যেমন ‘খুব গরম পড়েছে। আমি অনেক আম খাচ্ছি। তোমরা কী কী ফল খাচ্ছো’? কিন্তু চিঠির একদম শেষে আমাদের ব্রহ্মতালু ফাটিয়ে দেওয়া সেই একই প্রশ্ন, ‘স্যার তোমরা আবার কবে আমাদের স্কুল খুলে দেবে’?
মনে মনে ভাবি, ওরে তোদের কী করে বোঝাই, ইচ্ছা থাকলেও সবকিছুই আমাদেরও হাতের বাইরে! মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরাও তো পারতাম যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট ছোট করে কিছু ভাবতে। বিদেশে অনেক জায়গাতেই তো শিক্ষাঙ্গনকে সচল রেখেই সবকিছু চলছে। অতি সাবধানী হতে গিয়ে এই কচিকাঁচাদের জীবন প্রবাহকে আমরা স্তব্ধ করে দিচ্ছি কেন? যাদের জীবন নিয়ে এই সিদ্ধান্ত, সেটা চূড়ান্ত করার আগে শিশুদের সাথে কথা বলে ওদের মনোভাব বুঝে তা নিয়ে একটু গবেষণা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত না কি? ওরা যে ভালো নেই এই কথা তো অস্বীকার করা যায় না। আর তার সমর্থনেই এই জীবন্ত দলিল ‘রং বেরং’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ‘লকডাউন ডায়েরি’। এছাড়াও নেই-স্কুল এর সময়টায় শিক্ষকদের অভিজ্ঞতাও এই কাজের অংশ। শিশুদের আঁকা ছবি নিয়ে সাজানো এই বিশেষ সংখ্যাটি দিয়ে আমরা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টায় রয়েছি! ওদিকে স্কুলের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা-চরিত্রের অভাব নেই শিশুদেরও। মাসান্তে মিড-ডে-মিলের চাল-আলু বিতরণপর্বে অনেকেই জবরদস্তি চলে আসছে বাবা-মায়েদের সাথে। দূর থেকে কথা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছি। দেখছি স্কুল চলাকালীন বাচ্চাগুলোর চেহারার সেই জৌলুস এখন অনেকটাই ম্রিয়মান। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওরা ভালো নেই। স্কুলে আসার জন্য ওদের আকুলতা আমরা বুঝলেও আমাদের হাত-পা বাঁধা। একজন শিক্ষক হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে এটাই আশা যে শীঘ্রই এই ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply