• এ হামি কেমন হামি


    0    2077

    June 1, 2018

     

    - দাদা, দুটো চল্লিশের শোয়ের টিকিট দু’খানা…

    - কাকু, এই সিনেমাটা এখন শো তো? 

    কেউ সময়ের ছলে বলেন, কেউ দেওয়ালে লাগানো পোস্টার দেখিয়ে ইশারায় টিকিট চান। ‘হামি’ সবাই দেখতে চায় শহরতলির সিনেমাহলে কিন্তু ‘হামি’ চাইতে কেউ চায় না। ‘কাউন্টারে গিয়ে কি বলবি? দুটো হামি দিন?’ ছবির প্রিমিয়ারে পরিচালক শিবপ্রসাদ বলেছেন নির্দ্বিধায় হামি চাইতে, ‘উপরে’, ‘নীচে’ যেখানেসেখানে হামি চাইতে বলেছেন পরিচালক, মুচকি হেসে। হোয়াটস্অ্যাপে এই নিয়ে রসিকতার ছয়লাপ। অথচ এও বলা হয়েছে যে হামি হল ছোটদের বড় ছবি। ছোটদের নিয়ে ছবি আর ছোটদের ছবি—দুটোকে সমার্থক ধরে বেশ কিছু বাবা-মায়েরা ট্যাঁকে করে ছানাদেরও এনেছেন। 

    শিবপ্রসাদ-নন্দিতার দশম ছবির নাম ‘হামি’, চুমু নয়। কেন নয়? মনে করিয়ে দেন ইস্কুলের কাউন্সিলার, ওরফে অপরাজিতা আঢ্য—‘চুমু’ কথাটায় একটা ‘সেক্সুয়াল’ টান আছে, যাকে চিত্রকারেরা ভনিতায় বলেছেন ‘প্যাশনেট কিসিং’। হামি হল নিকশিত হেম—কামগন্ধ নাহি তায়। অর্থাৎ খেলার ছলে যা দেওয়া হয়ে থাকে, যাতে একটা ‘স্নেহের স্পর্শ’ থাকে—যার মধ্যে বস্তুত একটা ‘নিষ্কাম’ ‘সারল্য’ আছে, হামি হল তাইই। গল্পের মুখ্য চরিত্র একরত্তি মেয়ে চিনিকে বন্ধু বোধিসত্ত্ব হামি খেয়েছে। চিনির উচ্চবিত্ত মা-বাবাকে কাউন্সিলর বলছেন, ব্যাপারটা নিতান্ত ছেলেমানুষি, ‘এটাকে সিরিয়াসলি নেবেন না’। ছবি শেষও হয় এই দিয়েই—বাচ্চাদের হামি ‘adult’ চুমু নয়। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা ইস্কুলে—অর্থাৎ তাদের ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাটে তাদের আলাপচারিতা বড়দের মাপকাঠিতে দেখলে চলবে না। হেডমিস্ট্রেস যেমন বলেন, ‘ওদের ওয়ার্ল্ডটা খুব ইনোসেন্ট’।  

    হাততালি হাততালি হাততালি! আবেগময় সমাপ্তি, মরালময় গল্প, পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা বাচ্চাদের রিনরিনে গলার সুপারহিট গান ‘খোলা টিফিনবক্স’- সোমবারের প্যাচপেচে গরমে, ভরদুপুরে, চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বঙ্গবাসী বেরিয়ে আসে সিনেমার শেষে। জনৈক কুচুটে নারীবাদী হাফ-টাইমে তাদের পপকর্ন-কোলা-ছোলাভাজায় মেশা উক্তি নোট করে নেয়, ‘উফ! কি বানিয়েছে! সব বাবা-মাদের দেখা উচিত!’ নিশ্চই উচিৎ। নইলে সব্বাই মিলে বুঝবে কেমন করে যে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট আকছার হয়েই থাকে, নিশ্চিত,  কিন্তু এখানে নয়, অন্য কোথাও,  অন্য কোনোখানে। রাণীকুঠি বা কাঠুয়া—এসব ঘটেনি তা কে বলছে? কিন্তু যত রটে, তত ঘটে না। গুজবও তো ছড়ায়! বস্তুত, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের গুজব এই ছবির এক বড় অংশ। দুগ্ধপোষ্য ইনোসেন্ট ডিসনিল্যান্ডকে ছারখার করার দরকার কি? গাড়িতে যেতে যেতে হেডমিস্ট্রেস কাউন্সিলরকে বলেন, ‘আমাদের সময় এত সিসিটিভি কোথায় ছিল?... আমরা কি পারি না সেই গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনতে?’ ব্যাস। এক দৃশ্যে দুই পাখি—‘হামি’ ছবির সারমর্ম এইটিই: ইস্কুল, সমাজ, পরিবার, এবং সমস্ত সামাজিক ইন্সটিটিউশনের ভিতটা আরেকটু শক্ত করা। ফ্রয়েডের মুখে ছাই দিয়ে ইস্কুলের লাইসেন্সড কাউন্সিলর বাচ্চাদের সেক্সুয়ালিটির গল্পটা একধাক্কায় নাকচ করে দেন। সিসিটিভিহীন ইস্কুলে ‘গুরু-শিষ্য’ সম্পর্ক দেখিয়ে দেয় পুরানো সেই দিনের কথা যখন রেপ, মলেস্টেশান, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ইত্যাদির বালাই ছিল না। এই শহুরে প্যারানইয়ার অপর পিঠ সেই ফেলে আসা দিনগুলি—‘হামি’র মরাল নং এক: ইন্সটিটিউশনের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।  

    ‘ইন্সটিটিউশন’ কথাটাকে নিতান্ত বিজাতীয়-ঘরানার তর্কবিলাসী অলপ্পেয়েরা ফুকল্ডিয়ান না কি যেন বলে থাকে। ‘গুরু-শিষ্য’ কথাটাও তাদের হাইলি সাসপিশিয়াস মনে হয়। তারা এতে রাজনীতির গন্ধ পান। এসব লোকেদের জন্য বোধয় এছবি নয়। ইন্সটিটিউশন কথাটা অবশ্যি বলা হয়না সিনেমায়। বলা হয় ‘সিস্টেম’। পরম্পরা আর কি! এই দেখুন, এতেও যদি রাজনীতির গন্ধ পান তবে আর কি বলি! মানে সমাজের বুনিয়াদ যাকে বলে, যে ট্রাডিশন সমানে চলিয়া আসিতেছে, এ হল তারই একরকম সওয়াল। বোধিসত্ত্বের জনক লাল্টু বিশ্বাস তো বলেনই, তিনিও কচি বয়সে ইস্কুলের দেওয়ালে ‘দুষ্টু ছবি’ আঁকতেন,  মেয়েদের বিরক্ত করতেন, লুকিয়ে দেখতেন, ‘দুষ্টু’ কথা বলতেন, অনেক সময় যাকে আমরা সাদা বাংলায় ‘ইভ টিসিং’ বলি, নারীবাদীরা এই এক্সপ্রেশন নিয়ে যতই নাক কুচকান না কেন! তা, দিনকাল বদলেছে। এখন সবাই সবকিছু ‘বেশি সিরিয়াসলি’ নেয়। হা হতোস্মি! সেই আদমও নেই, সেই ইডেনও নেই।

    ‘দুষ্টু’ কথাটা যেন হামিরই পরিপূরক। পেরেন্টস-টিচার মিটিঙে এক গার্জেন বলেন, স্কুলে সেফটি সারকলের কথা বলে হবেটা কি? টিচারদের ট্রাস্ট করা যায় না, আর ‘নন-টিচিং স্টাফ? দুষ্টু!’ দুষ্টু ছবি, দুষ্টু কমেন্টস, দুষ্টু নন-টিচিং স্টাফ—কতটা বলবেন আর বলবেন না, কতটা বললে মরালিটি ক্ষুণ্ণ হবে না, তাই নিয়ে চিত্রনাট্যে হেব্বি তালগোল পেকেছে। যা ছিল টিফিনবক্সের গল্প, তার মধ্যে কান ধরে একটা খুব বড় সমস্যাকে ঢুকিয়েছেন পরিচালকেরা। গল্পের সাথে তার কোনো সরাসরি যোগ নেই, কিন্তু মধ্যবিত্ত মরালিটির এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ: চাইল্ড মলেস্টেশন, রেপ, সেস্কুয়াল অ্যাসল্ট—অনেকটা যেন আরবান মিথ। হয় তো বটেই,  কাগজে আর টিভিতে? কিন্তু আমাদের বাড়িতে হয় না। আমাদের স্কুলে হয় না। আমাদের গানের ক্লাসে, পাড়ায়, পারিবারিক অনুষ্ঠানে হয় না। অনেক সময় আমরা চাই না যে গালে কেউ চুমু,  সরি সরি, ‘হামি’ খাক- হোক না তখন সাত বছর বয়েস! চাই না কেউ জড়িয়ে ধরুক। কিন্তু এগুলো ঠিক শ্লীলতাহানি নয়। সেসব তো খবরে হয়। খুব ‘সিরিয়াস কিছু’ হলে হয়।

    যখন খুব শম্বুকগতিতে হলেও একধরনের awareness তৈরি হচ্ছে, তখন ‘হামি’ ছবিতে বাচ্চাদের শরীর ছোঁওয়ার অধিকার আর সারল্য নিয়ে এমন একটা গল্প লেখা হল, যেখানে বিষয়টা শেষমেশ ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’র মোড়কে ঢুকিয়ে দেওয়া গেল। শান্তি: শান্তি:। আমার সিনেমা দেখার পার্টনার ইন ক্রাইম বান্ধবী আরামের নিশ্বাস ফেলল—ব্যাপারটা শেষমেশ নাস্টি, সরি, ‘দুষ্টু’ হয়নি। বাচ্চাদের সাথে নিয়ে এসেছেন যে দর্শকরা, তাঁরাই বোধহয় একটু বেকায়দায় পড়লেন—বাড়ি গিয়ে যদি একরত্তি পুচকি বোধিসত্ত্বের মত জানতে চায় শ্লীলতাহানি মানে কি, বা চিনির মত জিগ্যেস করে প্রেগনেন্সি কাকে বলে—চূর্ণী গাঙ্গুলির মত গপ্প বানাবেন তাঁরা নাকি গার্গীর মত বোধিসত্ত্বের মায়ের পদাঙ্ক ধরে কষে এক থাপ্পড় দেওয়ার প্রস্তুতি নেবেন। কতটা পাকলে বাচ্চারা পাকা হয়, এটা এই সিনেমার এক মস্ত বড় প্রশ্ন। প্রশ্নটি খুব মানানসই,  কিন্তু উত্তর যে বড় রিগ্রেসিভ!

    একদিকে সিনেমার শেষে বাচ্চাদের ওয়ার্ল্ড রেইনবো ঝলমলে থাক গোছের আবেগ আছে,  অথচ ট্রেলারে বোধিসত্ত্বকে রাজা, চিনিকে রাণী আর অজাতশত্রুকে গুপ্তচর বলে পরিচয় করানো হয়। কাউন্সিলার যতই বলুন, অজাতশত্রু তো বলেইছে, এই হামি সেই হামি নয়! ‘এটা বয়ফ্রেণ্ড গার্লফ্রেণ্ড হামি!’ তবে? এই পলিটিকালি কারেক্ট থাকার প্রচেষ্টা আর বার বার মরালিটির কুয়োয় ঝাঁপ দেওয়ার ফলে দারুণ লাভ হয়েছে স্টিরিওটাইপগুলির। বস্তুত তারাই এই গল্পের তারকা। লাল্টু বিশ্বাসকে আমরা আগেও দেখেছি ‘রামধনু’ সিনেমায়। এবারেও তিনি এক প্রজন্ম আগের বাংলা মিডিয়াম মধ্যবিত্তের প্রতিভূ।  উল্টোদিকে চিনির বাবা মা—দিল্লীফেরত অধ্যাপক-অধ্যাপিকা। বোধিসত্ত্বর মা বাবার মতন তাঁরা সালমান খান আর ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ দেখেন না। তাঁরা এমনি দিনে ওয়াইন পান করেন, খুশির দিনে শ্যাম্পেন। বলা যেতে পারে যে শেষে তো তাঁরা চালভাজা এবং বোধিসত্ত্ব- দুটিকেই আপন করে নেন। কিন্তু এখানেই মজা। এই সিনেমার সব প্রতিপক্ষই ছায়ার সাথে যুদ্ধ করার মত। আপনি ভাববেন এই তো দিব্যি অপোজিট আর্গুমেন্ট রেখেছে, কিন্তু ওই যে, সুকুমার রায় বলেছেন, ছায়াবাজি! যতই দু’পক্ষকে দেখান না কেন, পরিচালকেরা এক দিকের পাল্লা ভারিই রেখেছেন। এটা অবশ্য খুবই সাটল, ওই হামি আর চুমুর পার্থক্যের মতই আর কি! উচ্চবিত্ত অধ্যাপক স্কুলের কাউন্সিলরকে তেড়ে এসে জিজ্ঞেস করেন যে কি আক্কেলে তাঁরা একটা হেজিপেজি উঠতি ফার্নিচার ব্যবসায়ীর ছেলের পাশে তাঁদের মেয়েকে বসিয়েছেন। নাকে ঝামা ঘষে দেন কাউন্সিলর, ‘ছিঃ! আপনি না অধ্যাপক! এই কথাটা কি করে বললেন!’ ব্যাস, আর অমনি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ ফাঁস হয়ে গেল। আর যাই হোক, রোজ রোজ যাঁরা মদ্যপান করেন তাদের একেবারে ভালোমানুষ দেখানোটাও একটা যথেষ্ট ইম্মরাল কাজ। 

    সিনেমার পুচকিদের মতন আমাদেরও চাচাজান ছিলেন, যাঁরা সযত্নে আমাদের বড় করেছেন। কিন্তু ঘরপোড়া গরু তো, ছোটবেলার বিভিন্ন বয়েসের শারীরিক নির্যাতনগুলো এখনো স্বপ্নে হানা দেয়। না, ক্লাস স্পেসিফিক আক্রমণ নয়, বরং পরিবার, ইস্কুল এই সব পবিত্র সামাজিক ইন্সটিটিউশন, থুড়ি, সিস্টেমের থেকেই এসেছে সেসব। সিসিটিভিহীন যুগেও ইহা বর্তমান ছিল বলিয়াই সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখেরা মনে করিয়া থাকেন। স্কুল ইউনিভার্সিটির অভিজ্ঞতা বলে, ‘গুরু-শিষ্যা’ সম্পর্কগুলোও নিতান্ত সোজা নয়। বলতে পারার যুদ্ধ তাই অজানা নয়। আমি জানি ছোট ছোট ‘অস্বোয়াস্তি’ কেমন বেমালুম হেসে উড়িয়ে দিতে শেখানো হয়। আমাদের যাদের ছোটবেলাগুলো ডিসনিল্যান্ডে কাটেনি, যথেষ্ট ‘পাস্তা-পেনি’ প্রিভিলেজড হওয়া সত্ত্বেও,  তাদের মনে হতেই পারে যে এত লাক্সারি কি আছে আমাদের, যে আমরা এখনো এসব নিকশিত হেমের গল্প বলতে পারি?

    রুমালের ‘সি’,  বেড়ালের ‘নে’ আর মরালিটির মা—এই নিয়ে হল সিনেমা। এতে চনমনে গান আছে, সামাজিক বার্তা আছে, কালোজাম ভার্সেস স্প্যাঘেটির লড়াই আছে, স্টিরিওটাইপের ছয়লাপ আছে,আর আছে ভরপুর মরালিটি। এমনি প্লটের মাঝে খানিকটা জায়গা খালি করে কান ধরে সোশ্যাল মিডিয়া আর রিউমারের অপকারিতা নিয়ে একটা ‘লেসন’ও আছে। তাতেই আপামর জনতা কাত। তাও, প্রাতঃস্মরণীয় কালো মাষ্টারের এক অমোঘ উক্তি দিয়ে শেষ করি, টংলিং উপন্যাসে যিনি চাঁদকে বলেছিলেন যে পাউরুটি জিনিসটা একটা খাদ্যবস্তু হতেই পারে না। কতগুলো ফুটোকে পাশাপাশি ময়দা দিয়ে জুড়লেই কি আর খাবার হয়?  ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান’—আর বেশি বলব না বাপু!

     

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics