দাঙ্গা ও যৌনপল্লীর মেয়েরা
0 421বছরের শেষ মাসের প্রথম সপ্তাহে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে দেশজুড়েই আলোচনা হয়। ঠিক পঁচিশ বছর আগে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক ও সামাজিক মিলে মিশে বাঁচার প্রতিশ্রুতিও জোর ধাক্কা খায়। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর পরিচয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিশানার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে পরিচয় ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর গর্বের ও ঐক্যের উৎস, অন্যদিকে এই পরিচিতির কারণে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে এবং মানুষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে যায় মানুষকে যখন একক পরিচিতির আলোয় দেখা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে লাল বাতি অঞ্চল থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ দেখার সূত্রে আলাপ হওয়া মেয়েদের পরিচিতি নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা অসংলগ্নভাবে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
বছরখানেক আগে একটি নাবালিকা মেয়েকে মুম্বাইয়ের এক বিখ্যাত যৌন-পল্লিতে উদ্ধার করতে এসে রেশমার সঙ্গে মুম্বাই পুলিশের এসআই র্যাঙ্কের অফিসার বিবেকের পরিচয়। প্রথম সাক্ষাতেই অবশ্য এক ঘণ্টার বেশি কথা হয়। বিবেক ঐ নাবালিকা মহিলার গতিবিধি জানতে চায়। রেশমা অবশ্য প্রথম সাক্ষাতে লালবাতি এলাকার মাসিদের নির্দেশ অনুসারে পুলিশকে খুব বেশি কিছু জানায়নি, কিন্তু রেশমার টানে বিবেক যৌন-পল্লিতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে। মাসে বেশ কয়েকবার আসে। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। রেশমার কাছে প্রতি রাতেই কত রকমের মানুষই আসে, কিন্তু পুলিশ বিবেক যেন বেশি সময় দাবি করে। রেশমার উপর ধীরে ধীরে একটু জোরও খাটাতে শুরু করে। এমনি করে লালবাতি এলাকায় বিবেক রেশমার বাবু হয়ে ওঠে। সারাদিন চোর-পুলিশ দৌড়ঝাঁপের পর মানসিক শান্তির জন্য বিবেক রেশমার শরণাপন্ন হয়। অন্যদিকে পুলিশি পেশায় নানান ঝুঁকি ও ব্যর্থতার কারণে জন্মজাত পুরুষালি ইগোর অগ্নিরোষ মাঝেমধ্যে ঝরে পড়ে রেশমার উপর। রেশমার সঙ্গে কথার ফাঁকে ফাঁকে, কখনো একটু নেশার ঘোরে বলে থাকে, “শালে লোগ যব তক হিন্দুস্তান নেহি ছোড়েগি, এই সব চলতা রাহেগা। আজ এক এককো কবরস্থান ভেজা’। রেশমার এসব কথায় কান দিত না।
২৬ শে নভেম্বর মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার দিন তিনেক পরে বিবেক রেশমার কাছে আসে। টানা ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করার পর ক্লান্তি, গ্লানি ও একরাশ বিরক্তি যেন রেশমার উপর ছুঁড়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে মুসলমানদের বাপ-বাপান্ত করে গালিগালাজ। সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে তামাম মুসলমানকে এক বন্ধনীতে বেঁধে ফেলেই চুপ করে থাকেনি, এ দেশের আরো মুসলমান মা ও মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারলে সে নাকি শান্তি পাবে। পেশার কারণে অচেনা মানুষদের কাছে রেশমাকে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হতে হয়, সে মুসলমান হওয়ার কারণে মুসলমান মা বোনেরা ধর্ষণের শিকার হবে শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে। এক লহমায় রেশমা ফিরে যায় চার বছর আগের একটা দিনে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলা থেকে এক দূর-সম্পর্কের মামার প্রতারণার ফলে ষোল বছর বয়সে পাচারের শিকার হয়ে মুম্বাইয়ের যৌন-পল্লিতে রেশমার পা পড়ে। রেশমা জন্মেছিল এক মুসলমান পরিবারে। এখানে এসে রেশমার আব্বার দেওয়া ফতিমা নাম পালটে নিতে হয়। রেশমার মতো অনেকেই নাম পাল্টে আছে। পেশার খাতিরে রেশমার ধর্মীয় পরিচয়কে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছে। রেশমা অবশ্য বলে, “আমি আর কোনও ধর্মের নয়, তবে উৎসবে মেতে উঠি। সেবার গণপতি উৎসবে খুব মজা করলাম, দেওয়ালিতেও আতসবাজি নিয়ে মেতে উঠলাম”। উৎসবের দিনগুলো বেশ ভালো লাগে, এ পাড়ায় লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়, অর্থাৎ বাড়তি কিছু আয়। পদ্মা নদীর পাড়ের জীবনের সঙ্গে আজকের জীবনের অনেক ফারাক, তবে ছোটবেলার ঈদের দিনের কথা মনে পড়ে যায়, নতুন পোশাক আর হাতে তৈরি সিমুইয়ের স্বাদ এখনো ফিরে ফিরে আসে। শহরে ঈদ পালিত হচ্ছে শুনি, কিন্তু কেন যেন মেতে উঠতে পারি না।
পরিচিতি চেপে রেখে রেশমা যেন হাঁপিয়ে উঠছিল। স্বেচ্ছায় একদিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্ধার হোমে এসে আটকে থাকে বছর-খানেক। মূল স্রোতে ফেরা কঠিন। রেশমা ভাবল এখানে হয়ত একটু মুক্ত বাতাস পাবে। যৌন-পেশা থেকে মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য মুক্তিকামী নানা কর্মসূচী নেওয়া হয়, অথচ প্রতিদিন সংস্থার প্রধান যে ধর্মালম্বী সেই প্রথা অনুসারে পূজা পাঠ ও প্রার্থনা হয়। রেশমার এইসব আচারে রুচি আসে না, কিন্তু মুক্তমনাদের এই আচরণ তাকে বাধ্য করে ধর্মীয় পরিচিতি আবার লালিত করতে। রেশমার জীবনের আবার এক নতুন সংঘাত শুরু হয়। রেশমা নিজের ধর্মীয় পরিচিতিকে যত দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, অন্যরা তাদের ধর্মীয় পরিচিতির ঢাকনা রেশমাকে পরিয়ে দিচ্ছে।
ভাগলপুর দাঙ্গার উপর ভিত্তি করে সাংবাদিক দেবাশিস আইচের লেখা ‘দাহননামা’-তে ভাগলপুর যৌন-পল্লিতে মিলেমিশে বাঁচার ছবি দেখা যায়। সেলমা, নুর, ফতেমা, আশা, মল্লিকা ও মালতি বছরের পর বছর মিলেমিশে থেকেছে। সালমা, নুররা ছট পুজোর উৎসবে মেতেছে ‘খারাপ রোগে’ মা মরে যাওয়ার পর থেকেই, হাসিনা মৌসির কাছে মানুষ হয়েছে রঘুবীর।
মূমূর্ষু রোগীর যেমন রক্তের প্রয়োজনে রক্তদাতার ধর্ম পরিচিতি নিয়ে মাথা ঘামান না, তেমনি যৌনতার জন্য যখন পুলিশের বড়বাবু থেকে রিকশাওয়ালা মাসভর হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে যৌন-পল্লীতে, তখন লালবাতির মেয়েদের ধর্মীয় পরিচয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ভাগলপুরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অথচ দাঙ্গার সময় দেখা গেল এক ভিন্ন চিত্র। শহরের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে হাসিনা মৌসি দরজা বন্ধ করে প্রাণরক্ষার জন্য আল্লার কাছে মোনাজাত করছে। এরই মধ্যে ‘জয় বজরংবলি’ আওয়াজে ছোট্ট গলি মুখরিত। মাথায় জয় শ্রীরাম ফেট্টি এবং হাতে মশাল, টাঙ্গি আর অন্যান্য অস্ত্র। অন্য মেয়েদের বাঁচাতে মৌসি প্রথম নিচে নেমে আসে, ততক্ষণে ধংসলীলা শুরু হয়েছে। আবছা আলোয় মৌসি ততক্ষণে চিনে ফেলেছে চেনা মুখগুলো। এ পাড়াতে প্রায় দেখা যেত এই দলের অনেকেরই। মৌসির উপর পিছন থেকে শাবল দিয়ে আক্রমণ, সঙ্গে একটা চিৎকার ‘শালে রেন্ডী ভাগ’। কিছুক্ষণের জন্য একটা নিস্তব্ধতা। মৌসির দেহটা নালার উপর ঢুলে পড়ল। মাথার খুলিটা ফেটে হাঁ হয়ে গিয়েছে । ফতেমা, সালমা, নূরদের চুলের মুঠি ধরে বার করে ঘরগুলো ভেঙ্গে তছনছ করে দিল বা আগুন লাগিয়ে দিল।
রঘুবীর চোখের সামনে মাসির নৃশংস খুন হয়ে যাওয়া মন থেকে মানতে পারে না। মুসলমান মৌসির কাছে মানুষ হওয়া রঘুবীরের গলায় তীব্র শ্লেষ ‘হারামখোর সব। হররোজ এখানে আসত।... বাবু লোগ ভি ছিল’। জানি না তাঁদের নিজেদের শরীরের কোন রসের প্রভাবে দাঙ্গাবাজদের কাছে মৌসি, হাসিনা ও সালমার মুসলমান পরিচিতি এতো বেশি করে উঠে আসে। শেষ রাতে রঘুবীরই মৌসির দেহ স্নান করিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসে।
গত কয়েক বছর ধরে খিদিরপুরের মুন্সিগন্জ এলাকার দুর্গাপুজো নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এবছর একটু বেশিই হয়েছে। মহরমের কারণে বিসর্জন একদিন পিছিয়ে দেওয়া হবে বলে সরকারি ঘোষণার ফলে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়—দিদি কি কেবল মুসলমানদের ভোটেই জেতে! পদ্ম-ভক্ত কুল অবশ্য রাখঢাক না করেই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে। এমনকি বিষয়টিকে কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পেক্ষাপটে এই পূজা নজর কেড়েছে। যৌনকর্মীদের এলাকার যুব সম্প্রদায় বেশ কয়েক বছর ধরে এই পূজোর আয়োজন করছে। পেশায় ঠিকা শ্রমিক সালাউদ্দিন পূজা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। এই পুজোর কোষাধ্যক্ষ বিকাশ আবার ঈদের সময় নিয়ম করে রোজা রাখে এবং ঈদ পালন করে। পূজা কমিটির আরেক সদস্য জাহাঙ্গীর ফি বছর পূজার দিনগুলো উপবাস করে কারণ তাকে পুরোহিতের সঙ্গে বসতে হবে যে। দীর্ঘদিন ধরে এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করছে। খিদিরপুর অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা একেবারে হয়নি তা বলা যাবে না, তবে সালাউদ্দিনের কথায় “এখনও পর্যন্ত ‘ভগবানের আশীর্বাদে’ এই অঞ্চলে কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা নেই"। মহরমের দিন বির্সজনকে কেন্দ্র করে কৃত্রিমভাবে যে উত্তেজনা শহরে সৃষ্টি করা হয়েছিল তা কেমনভাবে এই এলাকার বাসিন্দারা মোকাবিলা করল তা দেখে শিখতে পারে শহর ও দেশের বাসিন্দারা। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল মহরমের সবরকম প্রস্তুতি পূজা প্যান্ডালের সামনে হচ্ছে। অনেকেই দেখা গেল পূজার কাজে যেমন সক্রিয় তেমনি তাজিয়ার প্রস্তুতিতে সমানভাবে হাত লাগাচ্ছে। মহরমের উদ্যোক্তারা জানালেন একসঙ্গে পূজা চলছে বলে এবার নিরামিষ বিরিয়ানি বিলানো হবে।
শহরে শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন ঠাণ্ডা ঘরে ঘাম ঝরাচ্ছে, আয়েশা বিবি, পূজা রায়রা কিন্তু নির্বিবাদে সিঁদুর খেলে দুর্গা বিসর্জনের পথে পাড়ি দিয়েছে। মহরমের তাজিয়াও তৈরি।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply