হারানো রিংটোন
3 565আমার জন্মের আগে থেকে তার বসবাস। যেমন ভারিক্কি চেহারা তেমন কণ্ঠস্বর। তার প্রজাতিদের ঠিকানা আর পরিচয়লিপি নিয়ে ধুমসো বই লেখা হয়েছে, যা তাক থেকে এক হাতে নামাতে গেলে কব্জির শিরা শিউড়ে ওঠে। তার দাপটই আলাদা। সদরঘর থেকে ডাকলে তিনতলার ছাদ অব্দি এক দৌড়ে হাজির।
টেলিফোন আমাদের সঙ্গে ঘুরঘুর করবে এমন কোনদিন ভাবতেই পারিনি। আমরা জানতাম ফোন একটি কাজের যন্ত্র, যাকে দেখলেই বাচালতা খাবি খায়। অকাজের খেজুরালাপ বা হাঁটু-ছড়ে-আসা বয়সীদের আদেখলাপনার প্রতি ফোনের সামান্য মায়াদয়া নেই। দাদুর চেম্বার টেবিলে থিতু টেলিফোনটি বাড়ির কুচোদের পাত্তা না দিলেও পড়শিদের প্রতি যথেষ্ট উদারতা দেখাত। পাড়ায় তখন সব বাড়িতে ফোনের চল ছিলনা। শুধু বিত্ত দিয়ে ব্যাপারটাকে দেখলে চলবে না, প্রয়োজন দিয়ে মাপতে হবে। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে অধিকাংশ বিপৎকালীন ডাকাডাকির উৎসস্থল ছিল আমার দাদু। আমরা অনেক ঝুলোঝুলির পর সাফল্য পেলে মাঝখানের বার্তা বাহকটুকু হওয়ার সুযোগ পেতাম – ‘হ্যালো, হ্যাঁ আছেন, ডেকে দিচ্ছি’ - ব্যস ওটুকুই মহার্ঘ্য! তারপরেই কালচে রিসিভারটি হাতছাড়া।
ফোনের দৌলতে আমাদের বাড়িতে সারাক্ষণ কোনও না কোনও ঘরে আড্ডার ক্ষেত্র তৈরি হত। সদ্য বিবাহিতা কাকিমার ফোন ছলছল দেশের বাড়ি; মিঠুদির চাকরি পাওয়ার উচ্ছ্বাস; মনিদার দিদিমার অসুখ আখ্যান; সব আমাদের সদর ঘরের টেবিলে জমত । ফোন তো কিছুক্ষণের, তারপর চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরের ঘরে জমাটি আলোচনা। আমরা ভাজা-মাছ-উল্টে-খেতে-পারিনা মুখ করে আড়ি পাততাম, আর নাকের ডগায় খোলা রাখতাম পাঠ্য। অ্যান্টেনা সজাগ করে সে সব শুনতেই হত, না হলে পাকামি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে!
একটু বড় হতে না হতেই ঠিকানার পাশাপাশি ৫৫৩৩১৪ মুখস্থ করেছিলাম। হারিয়ে গেলে বা কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলে ওটাই তো ফেরত আসার চাবি। যে বাড়িতে আমি বড় হচ্ছিলাম সেখানে পপিন্স কিনতে গেলেও সঙ্গে লোক পাঠানো হয়; ফলে অমন সব বিপদ যে চট করে আমার রাস্তা কাটবেনা সেটা বিলক্ষণ জানা ছিল। ঠিক কী কী ঘটাতে পারলে ফোন ব্যবহার করার যুতসই কারণ পেতে পারি সে নিয়ে আমাদের জল্পনা আর অজুহাত তখন তুঙ্গে!
স্কুলে গিয়েই আমি ফোন নম্বর অকাতরে বিলি করতে শুরু করেছিলাম। হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতাম যদি আমার ডাক আসে, কিন্তু যারা ডাকতে পারে তাদেরও তো আমারই হাল। অভিভাবকদের পটিয়ে ফোনের দ্বারস্থ হতে গেলেই হাজার প্রশ্ন। ‘এমন কী দরকার যে কাল স্কুলে বলা যাবেনা’ – এমন সব দাবড়ানির সঙ্গে এঁটে ওঠার বুদ্ধি বা স্পর্ধা তখনও গজায়নি। কখনো সখনো আত্মীয়রা দয়া-দাক্ষিণ্য করে কথা বলতে চাইলে সাময়িক সম্মান জুটত, বাকি সময় দূরভাষ মানেই দূরবর্তী।
যাতে ঝামেলা এড়িয়ে ফোন ব্যবহার করতে পারি, তার জন্য রীতিমত প্রশিক্ষণ নিতে হতো - ফোনের নাগাল পেতে গেলে ছুটি থাকতে হবে, দুপুরে বাড়ির বড়দের আলসেমিকে ঘুম পর্যন্ত এগোতে হবে, তারপর স্কুলের খাতার পেছনের পাতা থেকে সেই নম্বরটি(কখনো নিষ্পাপ, কখনো নিষিদ্ধ) আঙুলে চাপিয়ে বৃত্তাকারে ঘোরাতে হবে। অন্য দিকে ভুল গলা ‘হ্যালো’ বললেই বিনা বাক্য ব্যয়ে লাইন কেটে দেওয়ার মতো তৎপরতা চাই, - ব্যস ওইদিনের মতো গপ্পো শেষ। ঘুণাক্ষরেও তক্ষুনি আর ডায়াল করা চলবেনা। তবে বার বার সুযোগ ফসকে যাচ্ছে দেখলে পরের ধাপ প্রয়োজন, আরেকটু আঁটঘাট বাঁধতে হবে।
চারটে ছাদ টপকে একজন কড়ে আঙ্গুল আর বুড়ো আঙ্গুল টানটান করে একটা ‘L’ বানিয়ে দেখাবে, অমনি যে দেখলো তাকে কালক্ষেপ না করে পৌঁছতে হবে ফোনের কাছে, এবার যতক্ষণ না বেজে উঠছে ততক্ষণ গলা শুকোবে, দুটো কলার বোনের সংযোগস্থল পর্যন্ত হৃৎস্পন্দন উঠে আসবে, অথচ অন্যের কাছে সহজ মুখে ড্রয়ার ঘাঁটার অভিনয় করতে হবে। কপাল ভাল হলে সেসময় ঘরে শুধু তার ফোন আর আমি। ব্যাপারটা যে ব্যাটে-বলে হল এই উত্তেজনার চোটে আদ্ধেক কথা বলাই হবেনা, দ্বিপাক্ষিক খান কতক হ্যালো আর খাপছাড়া ফিসফিস। কি কথা বলা গেলো তার থেকেও জরুরি তাকে এক ঝলক শুনতে পেলাম। পুরো সময়টা দরজায় চোখ রাখা আবশ্যিক, কারণ ধরা পড়লেই ল্যান্ডলাইন নিমেষে ল্যান্ডমাইন হয়ে যেতে পারে।
ওই অনিশ্চিত ব্যাবধানের মধ্যেও আমরা মোরাম বিছিয়ে নেওয়া অভ্যেস করে ফেলেছিলাম। একটা আনুমানিক রাস্তা তৈরি হতো যা অদেখার কুশল বাহক। বাবুজি, আমার বড় জেঠু, হয়ত দিদিরা না ফেরা অব্দি পায়েচারী করছে – কাকার চুলের আবির না দেখা অব্দি জানতে পারছিনা কলেজ ভোটে কারা জিতল – মা’র ফোন, আমি হয়ত চানে, যতক্ষণ না আবার রিং হচ্ছে টেনশন দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছি কিন্তু ধরে নিচ্ছি আছে, নিশ্চয়ই ভালো আছে!
ইন্দিরা গান্ধীকে যেদিন হত্যা করা হল, সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই শুনেছিলাম, ফোন এসেছিলো, মা-বাবার ফিরতে রাত্তির হবে, সব ট্রেন নাকি বন্ধ। উলুবেড়িয়া থেকে শ্যামবাজার লম্বা পথ ওরা কিভাবে আসবে বছর পাঁচেকের আমি বুঝতেই পারছিলাম না। মাঝে মাঝেই কদ্দুর পৌঁছলো জানার উপায় নেই। দাদু আমার কাছে থাকবে বলে সন্ধেবেলা রুগী দেখছে না, বড়মা লুচি আর আলু ছেঁচকি বানিয়ে আনছে, সবাই কিছুটা জোর করে আমার কাছে সহজ হলেও বিশ্বাস করছে ওরা ঠিক নির্বিঘ্নে ফিরবে। ফিরেও ছিল। শুধু ওই দিন মা আর ‘ক্ষীরের পুতুল’ পড়ে শোনানোর অবস্থায় ছিলনা।
অপেক্ষা এবং ধৈর্যের একটা অনুশীলন স্থিতফোনের জমানায় আমাদের রপ্ত করতে হয়েছিল। ফোন তখন পিছু নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করায় বিশ্বাস করত না। যা বলার এক-আধবার বলবে, শুনলে ভাল, না হলে সারাদিনের (কখনো আজীবনের) মতো গেল। একটি অচেনা গলা দশমীর বিকেলে ফোন তোলা মাত্র বলেছিল, তোমার দিদিকে বোলো, ‘যার আবাহন ছিল না তার আবার বিসর্জন কিসের’... তারপরেই লাইন কেটে দিয়েছিল। দিদি তাকে চিনেছিল কিনা বুঝিনি, নিজেকে একটা অমীমাংসিত সংলাপের মধ্যবর্তী সুতোর মতো লেগেছিল। অস্পষ্টতাও একটা ভাষা আর তা পড়ার জন্য আমরা ধৈর্য শিখছিলাম।
যে উত্তরটা এখুনি চাইছি পাবনা, যে তথ্যটা না জানা পর্যন্ত সব নখ খেয়ে ফেলছি সেটি মিলবেনা, যার গলা শুনব বলে গোটা অস্তিত্ব কান হয়ে ওঠে তাকে ধরতে পারবনা – তাও সেই সব নৈঃশব্দ্য আমরা বইতে পারতাম, হ্যাঁ চিন্তা হত, কষ্ট হত, কিন্তু পারতাম। অজস্র ‘না’ এর সঙ্গে আমাদের বাধ্যতামূলক সহবাস ছিল। স্থিতফোন যুগে আমরা সবাই স্থিতধী ছিলাম তা বলব না, কিন্তু তথ্য না পেলেও নিজেদের সামলানোর একটা চর্চা ছিল।
ফোন হাঁটতে শেখার পর থেকে আমাদের না জানার গণ্ডি উধাও হতে শুরু করেছে, আমরা এক জায়গায় বসে আছি আর ফোন দৌড়ে গিয়ে খবর আনছে, খবর দিচ্ছে, কথা বলে বা লিখে চোখ-কানের ওপর আছড়ে পড়ছে। শপিং মলে যেই সে র্যাকের পেছনে ঢাকা পড়ছে অমনি স্পীড ডায়ালে আঙুল ঠেকাচ্ছি, দু’টো টিউশনের মাঝে সন্তান ডিমসেদ্ধ খেল কিনা জেনে নিচ্ছি, মেয়ে অফিসের মিটিং-এ ব্যস্ত তাও তেত্রিশ বার মিসড কল রাখছি, মেসেজ করছি, একটা তথ্য পেলে আরেকটা খুঁজছি, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। অনিশ্চয়তা নিতে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। সামান্য দেরি, অপ্রাপ্তি, মৌনতা আমাদের সমস্ত শান্তি উপড়ে নিচ্ছে, ধরেই নিচ্ছি এখুনি দুঃস্বপ্নের কলার টিউন শুনতে হবে।
কানের নাগালে থাকলেও আমরা তাকে চোখে হারাচ্ছি, ভিডিও কল করছি। আমাদের অবিদিত, অকথিত, অমীমাংসিত কিচ্ছু নেই। আমাদের কোন অনুমান নেই, থাকলেও তাতে আস্থা নেই। আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রযুক্তি তৎপর। কিন্তু তাতে প্রশ্নপত্র দৈর্ঘ্যে বাড়ছে, ফুরোচ্ছে না। অন্যের ঘড়ি থেকে শুরু করে ভূগোল সব নির্ভুল টুকে ফেলেও আশ্বস্ত হতে পারছিনা। যার পদক্ষেপ জরিপ করছি, তার সঙ্গে চলতে পারছি কি?
সম্ভবত অগুনতি তথ্যের নিচে আমরা চাপা পড়ছি আর ফোন একাই এগিয়ে যাচ্ছে...
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (3)
-
-
কয়েক বছর আগের কথা বলতে হলে ফোন পাওয়াটা খুব ধৈর্যের ব্যাপার ছিল । কিন্তু, এখন ছোটো বড়ো সকলের কাছেই ফোন সহজ বিষয় হয়ে উঠেছে ।
-
সত্যি এখন খুব সহজেই সকলের কাছে খবর আদান প্রদান হচ্ছে ঠিকই । কিন্তু মানুষের ধৈর্য শক্তি কমে যাচ্ছে ।
Leave a Reply
-
দারুন লেখা, সময় যেন থমকে দাঁড়ায়, অনুত্তমার লেখায়। লেখা যে কখন বুঝতে পারিনি। সেই ছবির ক্যানভাসে ফিরে আসে হারান সময়।