জাতপাত ও সংক্রমণ: ভারতে করোনা । মুকুল কেশবন
1 328
[১লা মে ২০২০ 'এখন আলাপ' ব্লগের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আজ থেকে আমাদের ব্লগের পাতায় নতুন অনুবাদ সিরিজ। অতিমারী করোনা-র পরবর্তী সময়ে কুসংস্কার ও সমাজ পরিস্থিতি সংক্রান্ত দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মূল রচনার বাংলা অনুবাদ নিয়ে এই সিরিজ।বাংলা ভাষায় প্রথম জেন্ডার ও নাগরিকত্ব বিষয়ে ব্লগ 'এখন আলাপ'-এ করোনার এই সময়ের এই অনুবাদ সিরিজে প্রথম অনুবাদ মুকুল কেশবন-এর 'কাস্ট এন্ড কণ্টাজিয়ন'। মূল ইংরেজি আর্টিকলটি ২৬ এপ্রিল ২০২০ 'দ্য টেলিগ্রাফ'-এ প্রকাশিত। ‘এখন আলাপ’-এ প্রকাশিত বাংলা তর্জমা করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য।]♦
মাইসোরে বসবাসকারী আমার প্রপিতামহ ছিলেন জাতপাতের ভেদাভেদে কঠোরভাবে বিশ্বাসী দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ এবং ছোঁয়াছুঁয়ির বিষয়ে তাঁর ছিল প্রচণ্ড খুঁতখুঁতানি। তাঁর স্ত্রী যৌতুক হিসেবে যে রূপোর বাসনপত্র পেয়েছিলেন তা বিক্রি করে তিনি শুরু করেছিলেন একটি আধুনিক উদ্যোগ – একটি গ্রামাফোনের দোকান। কিন্তু দোকানটি ভালো চলত না কারণ দোকানে বেশিক্ষণ সময় উনি দিতে পারতেন না। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে তাঁকে সব নিয়ম মেনে ভালো করে স্নান করতে হত। সেসব শেষ হতে হতে এগারোটা বেজে যেত। তারপর অনেক সময়েই এরকম হত যে কোনও অপরিষ্কার ব্যক্তির ছায়া তাঁর ওপর পড়েছে বলে তিনি মাঝরাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে এসে শুদ্ধ হওয়ার সেই ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া আবার শুরু করতেন।খুব একটা চেষ্টা না করেই যে আমি এই অসামাজিক, অস্বাভাবিক রুটিনে
সহজেই ঢুকে পড়তে পারলাম, তা থেকে আমার সন্দেহ হয়
হয়তো আমার মধ্যে এমন কিছু গাঁথা আছে যার ফলে
এই রুটিনে অভ্যস্ত হতে কোনও অসুবিধেই আমার হয়নি
এই কোয়ারান্টাইনের সময়ে আমার পূর্বপুরুষের এই প্রাত্যহিক কর্মসূচি নিয়ে ভাবছিলাম আমি। তাঁর কথা বিশেষ করে মনে পড়ে যখন দোকানে যাওয়ায় অসুবিধে থাকার জন্য বাড়িতেই জিনিস আনাতে হয় আমাদের। যিনি ডেলিভারি দিতে এসেছেন তিনি বেল বাজালে আমি দরজা খুলে তাঁকে বলি একপাশে সরে যেতে আর বাইরে এই জন্যেই রাখা একটা ছোট টেবিলে জিনিসগুলো নামিয়ে রাখতে। আগে থাকতেই ওখানে আমি ‘টিপ’ বাবদ রেখে দিই একটা কুড়ি টাকার নোট – কাছাকাছি আসার সব সম্ভাবনা মূলেই বিনাশ করি।এই কাহিনীর মূল বিষয় হল আমি এবং ডেলিভারি করতে আসা লোকটি কত কসরৎ করি যাতে আমাদের বিপজ্জনকভাবে কাছে না আসতে হয়। এই রুটিনে আমি এখন আশ্চর্য ভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব একটা চেষ্টা না করেই যে আমি এই অসামাজিক, অস্বাভাবিক রুটিনে সহজেই ঢুকে পড়তে পারলাম, তা থেকে আমার সন্দেহ হয় হয়তো আমার মধ্যে এমন কিছু গাঁথা আছে যার ফলে এই রুটিনে অভ্যস্ত হতে কোনও অসুবিধেই আমার হয়নি। বারবার করে হাত ধোওয়া, স্যানিটাইজার স্প্রে করা, মাস্ক পরা, বিভিন্ন কসরৎ করে অপরিচিত ব্যক্তির থেকে দূরে থাকা – সব যেন আমার সহজাত।করোনা ভাইরাস যে কোয়ারান্টাইনকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে,
তা ভারতীয় মধ্যবিত্তের মানসিকতার সহায়ক।
সবর্ণ দূরত্বের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছে সে
প্রধানত একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের মধ্যে বড় হলে কি মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রবণতা স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়ে যায়? শুচি এবং দূষণের প্রাত্যহিকতা – যা ‘দিশি’-রা আধুনিকতার শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বর্জন করতে শিখেছিল – আসলে কি শালীনতার আস্তরণের তলায় অপেক্ষা করে থাকে যেন ‘লঞ্চ’ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কোনও অ্যাপ? ভারতীয়রা যখন পশ্চিমী দেশগুলির মধ্যবিত্তদের দিকে তাকিয়ে দেখে যে তারা সামাজিক দূরত্ব আর আলাদা থাকার অর্থটাই ঠিক মত বুঝতে পারছে না, তখন তারা ভাবে এরা কি বেপরোয়া না বোকা! হয়তো এরা কোনোটাই নয়। হয়তো এদের সমস্যা হল এরা ভারতীয় নয়; আমাদের সভ্যতার প্রতিবর্ত ক্রিয়া এদের ক্ষেত্রে কাজ করে না।ইংল্যান্ডে ছাত্রাবস্থায় আমি দেখেছি যে খদ্দেররা সরাসরি ক্যাশিয়ার বা কাউন্টারে যিনি আছেন তাঁর হাতে টাকা দিয়ে দেন। আমার সহজাত প্রবৃত্তি ছিল কাউন্টারে টাকাটা রেখে দেওয়া, যাতে কোনও ছোঁয়া না লাগে। আমার মনে হত কোনও স্পর্শই স্বাভাবিক, রুটিন হতে পারে না। করোনা ভাইরাস যে কোয়ারান্টাইনকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, তা ভারতীয় মধ্যবিত্তের মানসিকতার সহায়ক। সবর্ণ দূরত্বের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছে সে।একমাত্র সবর্ণই স্বচ্ছন্দে আইসোলেট করতে পারে। যদি জ্ঞানের শ্রমিকরা হন এযুগের নতুন ব্রাহ্মণ এবং যদি পুরনো উচ্চবর্ণরা হন জ্ঞানের নতুন শ্রমিক, তবে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছনো যায় যে ভারতবর্ষে ডিজিটালে কাজ করার দুনিয়াতে একচেটিয়া অধিকার রয়েছে সবর্ণদেরই হাতে। মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে’র কথা ধার নিয়ে বলা যায়, ‘ব্লু-কলার’ কর্মচারী, রাস্তার দোকানি, শিল্পী, কৃষক ও ক্ষেতমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, স্ব-নির্ভর ব্যক্তি, সশরীরে কাজে উপস্থিত না হলে হবে না এমন কর্মীরা কিন্তু এই কোয়ারান্টাইনে ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত কাজের দুনিয়ার শূদ্র এবং অতিশূদ্র সম্প্রদায়।যদি ইন্টারনেটের বাইরে ‘অফলাইন’ থাকা গরীব মানুষ নতুন ‘শূদ্র’ হন
তাহলে মুসলমানরা—যাঁরা বর্তমান ভারতবর্ষে সামঞ্জস্যহীনভাবে গরীব
এবং নিরুপায়ভাবে মুসলমান হওয়ার দরুণ দ্বিগুণ ভাবে প্রতিবন্ধী—
তাঁরা হলেন নতুন দলিত
নতুন এই কোভিড-ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরোনো আদর্শের সব কলাকৌশলই ব্যবহার করে—ছোঁয়াচে রোগের এই মরশুমে আমার পূর্বপুরুষের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং আলাদা থাকার অভ্যেস সুবিধেই করে দিত। অপরিচিত ব্যক্তিকে ছোঁয়ার ক্ষেত্রে কোনও নির্দেশ তাঁর প্রয়োজন হত না। জাতিভেদ প্রথা আসলে এমন একটি শব্দ যা উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ এবং বৈষম্য—ভারতীয় সমাজের এই দুই প্রবণতার ওপর দখলের মিশেলে তৈরি হয়েছে। প্রথাটি অপরিবর্তনীয় নয়। ধনতান্ত্রিক আধুনিকতার মধ্যে মহান সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সংঘাতে সে পরিবর্তিত হয়েছে। যদি ইন্টারনেটের বাইরে ‘অফলাইন’ থাকা গরীব মানুষ নতুন ‘শূদ্র’ হন তাহলে মুসলমানরা—যাঁরা বর্তমান ভারতবর্ষে সামঞ্জস্যহীনভাবে গরীব এবং নিরুপায়ভাবে মুসলমান হওয়ার দরুণ দ্বিগুণ ভাবে প্রতিবন্ধী—তাঁরা হলেন নতুন দলিত। দলিত যদি হন সেই সম্প্রদায়ের মানুষ যাঁরা অচ্ছ্যুৎ, যাঁরা বর্ণাশ্রমের একেবারে এক প্রান্তে অথবা তার থেকেও দূরে কোথাও পর্যবসিত হয়েছেন, তাহলে বলা যেতেই পারে যে ভারতের মুসলমানেরা অর্থনীতিতে প্রান্তিক এবং রাজনৈতিক ও অস্তিত্বের সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যে অবদমিত, অবহেলিত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন, সেই প্রেক্ষিতে তাঁদের যুক্তিসঙ্গত ভাবেই ভারতের নতুন ‘পারিয়াহ্’ বলে মনে করা যেতে পারে।গত কয়েক মাস ধরে কোভিড-১৯-এর কারণে যে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে, তাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার সচেতন চেষ্টা করা হচ্ছে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে নিজামুদ্দিনে তাবলিঘি জামাতের সমাবেশ যে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে তাকে ব্যবহার করে ভারতের সোশ্যাল এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, রাজনৈতিক দল, বাসিন্দাদের ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশান, কেন্দ্রীয় এবং কিছু রাজ্য সরকার ওই ধর্মাবলম্বী সমস্ত মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উগরে দিয়েছে। জাতীয় স্তরের একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে আহমেদাবাদের একটি হাসপাতাল হিন্দু ও মুসলমান রুগীদের আলাদা ওয়ার্ডে রেখেছে। মেইনস্ট্রিম খবরের চ্যানেলে প্রায় বলেই দেওয়া হচ্ছে যে মুসলমানরা ‘করোনাজিহাদ’ নামে এক নতুন রকমের যুদ্ধের অনিষ্টকামী অগ্রদূত।ভারতবর্ষে করোনা হল একটি দূষণকারী অসুখ
যা শাস্ত্রীয় সতর্কতার মধ্যে দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হবে
নৈকট্য পরিহার করে এবং শুদ্ধিকরণের পদ্ধতি অবলম্বন করে তাকে আটকানো হবে
এ এমন এক বিপদ যা
জাতপাতের এই সমাজ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই
আমি যে পাড়ায় থাকি, সেখানকার মধ্যবিত্ত মানুষ এবং তাঁদের পরিচালিত রেসিডেন্ট্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশান এখন প্রশ্ন তুলছে যে এই কলোনিতে মুসলমান বিক্রেতাদের ঢুকতে দেওয়া উচিত কিনা। একজন প্রতিবেশী উচ্চস্বরে স্বগতোক্তি করলেন যে— যে মুসলমান ফল বিক্রেতা কয়েক দশক ধরে এখানে ফল বিক্রী করছেন তাঁকে আর ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে কি না কারণ—“এরা যে কোথায় থাকে কে জানে!” এই যে সাধারণ মধ্যবিত্ত ছুঁৎমার্গ – এর ভিত্তি হল গরীব মানুষের গা-ঘেঁষাঘেঁষি জীবন। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ এই আশঙ্কার ভস্মে ঘি ঢালে, কারণ মুসলমানরা তো গরীবদের মধ্যেও ভয়ঙ্কর – বিজাতীয় এবং বিপজ্জনক – তাদের আরও বেশি করে দূরে সরিয়ে রাখা দরকার। এই অদ্ভুত সময়ে আমরা যা দেখছি তা হল মুসলমানরা প্রাত্যহিক যে বৈষম্য সহ্য করে বেঁচে থাকেন তা রূপ নিচ্ছে প্রায় এক বিধিসম্মত পৃথকীকরণে এবং সংগঠিত ভাবে পরিহার করায়। ভারতবর্ষে করোনা হল একটি দূষণকারী অসুখ যা শাস্ত্রীয় সতর্কতার মধ্যে দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হবে। নৈকট্য পরিহার করে এবং শুদ্ধিকরণের পদ্ধতি অবলম্বন করে তাকে আটকানো হবে। এ এমন এক বিপদ যা জাতপাতের এই সমাজ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। ভেবে দেখুন, এই করোনার যুগে ‘নমস্কার’-ই হল কাউকে অভিবাদন জানানোর সবথেকে উৎকৃষ্ট উপায়। এটি আপনাকে ভদ্রতা দেখানোর সুযোগ দেয়, এমনকী অমায়িক বলেও মনে হতে পারে, কিন্তু হ্যান্ডশেক বা চুম্বনের অবাঞ্ছিত স্পর্শের উপকরণটুকু নেই। আমার প্রপিতামহ জানতেন দলিতদের থেকে ঠিক কতটা দূরে থাকলে তাদের চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া দূষণের হাত থেকে তিনি নিজেকে বাঁচাতে পারবেন। এই মহামারীতে যে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে তা হল ৬ ফুট বা ১.৮ মিটার। আশীষ নন্দী সম্ভবত বলতে পারতেন (কিন্তু বলেননি) যে কোভিড-১৯ আসলে একটি ‘দিশি’ সংক্রমণ যা চীনারা দৈবাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে। মূল ইংরেজি আর্টিকল: ‘কাস্ট এন্ড কণ্টাজিয়ন’, ২৬ এপ্রিল ২০২০ 'দ্য টেলিগ্রাফ'-এ প্রকাশিত‘এখন আলাপ’-এ প্রকাশিত বাংলা তর্জমা: সর্বজয়া ভট্টাচার্য
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
খুব সময়োপযোগী লেখা