যখন দুই বোনের স্লেট একটাই
0 149রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আশ্রমে যেমন আশেপাশের সবাইকে নিয়ে, পল্লীর সব মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এগিয়ে চলার স্বপ্ন ছিল, সেই আদর্শেই আমরা গড়ে তুলতে চাইছি আমাদের ‘চলমান পাঠশালা’।
আমি মেঘনা, আর আমার সাথে অভিষেক, সাবির, হীরক, শবনম, সায়ন্তন এবং আরো কয়েকজন বন্ধু, বিশ্বভারতীর কয়েকজন ছাত্রছাত্রী, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময় থেকেই বোলপুরে ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’-র বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। গত কয়েক মাস ধরেই শান্তিনিকেতনে একটি কমিউনিটি কিচেন পরিচালনা ও কোভিড আক্রান্ত গরীব দুঃস্থ মানুষের ঘরে ঘরে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছিলাম আমরা। আমাদের কিচেনে প্রত্যেকদিন প্রায় ৭০ জন আক্রান্ত বা দুঃস্থ মানুষের খাবার পৌঁছানোর আয়োজন ছিল। এছাড়াও বেশ কিছু পরিবারকে চাল-ডাল-আলু-আটা-নুন-তেল-মশলা-চিনি-দুধ ইত্যাদি সহ একটা রেশন দেওয়া হয়েছিল। লিভার ফাউন্ডেশনের তরফে আমাদের চারটি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দেওয়া হলে সেগুলো পৌঁছে লাগিয়ে দেওয়ার কাজটাও করেছি। এই কাজগুলো করার সময় একটা অদ্ভুত উপলব্ধি হয়েছে। মনে হয়েছে মানুষই আসলে মানুষের অক্সিজেন। অনেক বাড়িতে অক্সিজেনের দরকার শুনে ছুটে গেছি, কথা বলেছি রোগী ও পরিবারের অন্যদের সাথে। ভরসা দিতে চেষ্টা করেছি শুধু মুখের কথায়, অথচ নিজের চোখে দেখেছি সেইটুকু আশা-ভরসার কথাতেই, এমনকী অক্সিজেন না দিয়েই অক্সিমিটারের পারা চড়েছে উপরের দিকে। অবাক হয়েছি, এবং সবরকমভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উৎসাহ পেয়েছি আরো বেশি করে। বিশ্বভারতী আর অন্যান্য কলেজের ছাত্রছাত্রীরা মিলে তাই শান্তিনিকেতন লাগোয়া নানা পল্লীর শিশুদের সঙ্গে, তাদের জীবনের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ মজবুত করে তোলার চেষ্টা করছি। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আশ্রমে যেমন আশেপাশের সবাইকে নিয়ে, পল্লীর সব মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এগিয়ে চলার স্বপ্ন ছিল, সেই আদর্শেই আমরা গড়ে তুলতে চাইছি আমাদের ‘চলমান পাঠশালা’।
আর আছে এক গোলু, তাকে নাম জিজ্ঞেস করলেই এমনভাবে উত্তর দেয় যেন প্রত্যেকেরই জানার কথা ওর নাম গোলু। লেখার বেলায় সে শুধু "অ" জানে, কিন্তু মুখে বলার সময় তার কাছে উত্তর নেই এমন কোন প্রশ্নই হবেনা।
এলাকার মানুষও সাড়া দিয়েছেন আমাদের প্রচেষ্টায়। পাশে পেয়েছি পঞ্চায়েতকেও। অভিভাবকেরাও যারপরনাই আনন্দিত কারণ গত দেড়-দুই বছর ধরে তাদের বাচ্চাদের সাথে শিক্ষার যোগাযোগটা প্রায় বন্ধই বলা চলে। তাঁরা পাঠশালায় বাচ্চাদের রোজ পৌঁছে দেন এবং জিজ্ঞেস করেন পরেরদিন কখন আসতে হবে। আমরা সব কোভিড বিধি মেনে বাচ্চাদের মাস্ক-ক্যাপ-স্যানিটাইজার সরবরাহ করে চলেছি যাতে তারা সুস্থ অবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। বাচ্চারা নিজেদের উৎসাহেই সময়মতো এসে ক্লাসে যোগ দেয়। পড়তে এসে যে হাসি মুখ এবং উৎসাহ নিয়ে তারা বসে থাকে, সেটাই আমাদের চরম প্রাপ্তি।
পড়ার পাশাপাশি ছবি আঁকতেও খুব ভালোবাসে সায়ন। ছবির কল্পনায় বাকিরা এঁটে উঠতে পারেনা তার সাথে।
আমাদের চলমান পাঠশালায় এইমুহুর্তে আছে জনা তিরিশ বাচ্চা আর আটজন শিক্ষক-শিক্ষিকা। যাদের পড়াই তাদের বাস খোয়াই-এর কাছাকাছি দিগন্তপল্লীতে খাসের জমিতে। এদের বাবা মায়েরা বিভিন্ন কায়িক শ্রমে যুক্ত। লকডাউনে বেশিরভাগেরই কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, তার মধ্যে দীর্ঘদিনের অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাব। বহু শিশুই আক্রান্ত নানা রোগ-দুর্বলতায়। কিন্তু তাদের শেখার আগ্রহে কোনো ঘাটতি নেই। যেমন আমাদের দীপঙ্কর, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, তবু তার উৎসাহ দেখে কে বলবে তার শরীরে কোনো কষ্ট আছে! আর আছে এক গোলু, তাকে নাম জিজ্ঞেস করলেই এমনভাবে উত্তর দেয় যেন প্রত্যেকেরই জানার কথা ওর নাম গোলু। লেখার বেলায় সে শুধু "অ" জানে, কিন্তু মুখে বলার সময় তার কাছে উত্তর নেই এমন কোন প্রশ্নই হবেনা। এছাড়াও আছে ফুটফুটে তানিয়া। তানিয়া শুধু লিখতে জানে অ আ ই ঈ। তাদের দুই বোনের একটাই স্লেট। পড়াশোনার মাঝে এসে বোন যাতে বিরক্ত না করে, তাই সে বোনকে কোলে নিয়ে স্লেটে তার হাতে পেন্সিল দিয়ে শিখিয়ে দেয় কী করে লিখতে হয় বাংলা স্বরবর্ণ। কিম্বা ধরুন ক্লাস ফোর-এর সায়ন-এর কথা। তাকে তার বাবার নাম লিখতে বললে সে বলে সে জানে না। শুধু মায়ের নাম লেখে। লেখাতে গিয়ে বুঝলাম হয়ত তার ডিসলেক্সিয়া আছে, সে সব অক্ষর উল্টো লেখে। কিন্তু তাতে সে বিন্দুমাত্র দমবে না। পরপর কয়েকদিন বারবার পাশে থেকে অভ্যাস করানোর ফলে সে এখন অনেকটাই নিজে নিজেই ভুল বুঝতে পেরে ঠিকটা লেখার চেষ্টা করছে। আবার পড়ার পাশাপাশি ছবি আঁকতেও খুব ভালোবাসে সায়ন। ছবির কল্পনায় বাকিরা এঁটে উঠতে পারেনা তার সাথে। চলমান পাঠশালায় আমরা পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি অরিগামি, ছবি আঁকা, গল্প বলা, ওদের কল্পনাকে লেখায় রূপান্তরিত করানো, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক খেলা ইত্যাদির মাধ্যমে শেখার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে আবার সংযুক্ত করার চেষ্টায় আছি।
যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে তারা অধিকাংশই অক্ষর পরিচয়টাই ভুলে যাচ্ছে। আমরা মেতেছি অনলাইন শিক্ষার হুজুগে, আর ওরা আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছে কষ্টে অর্জিত অক্ষরজ্ঞান।
এই শিশুরা প্রত্যেকেই এত সম্ভাবনাময়, এত আগ্রহী, অথচ দীর্ঘ অনভ্যাসে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে তারা অধিকাংশই অক্ষর পরিচয়টাই ভুলে যাচ্ছে। আমরা মেতেছি অনলাইন শিক্ষার হুজুগে, আর ওরা আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছে কষ্টে অর্জিত অক্ষরজ্ঞান। শুধু অনলাইন সুবিধা ওদের নেই বলেই নয়, আমরা যে ভাবছি ইস্কুলকে অনলাইন প্লাটফর্মের গন্ডিতে আটকে রাখা যায়, তা কি সত্যিই সম্ভব? স্কুলে শুধু পাঠগ্রহণ হয় না, একটি শিশু বাকিদের সাথে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করতে শেখে। নিজের জিনিসকে ভাগ করতে শেখে। একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকতে শেখে। সেটা কি কোনও যন্ত্র দিয়ে সম্ভব? তার জন্য তো মানুষকে লাগে। আমরা যারা চলমান পাঠশালায় পড়াই, প্রতিদিন এটা বুঝতে পারি যে আসলে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য যন্ত্রের থেকেও বেশি প্রয়োজন মানুষের, রক্তমাংসের শিক্ষক-শিক্ষিকার। আমাদের সায়ন দীপঙ্কর গোলু তানিয়াদের একেকজনের প্রয়োজন যে একেক রকম, যন্ত্র তা বুঝবে কী করে?
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply