• আদি ও অনন্ত মা


    2    486

    April 14, 2018

     

    ছবি : The Better India 

    ‘মা, তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না?’

    ‘আমি যাব না৷ আমার যেতে নেই।’

    মল্লিকা ধরের অনন্ত আগামী উপন্যাসের সেই আশি হাজার বছর আগের মাকে মনে পড়ছে৷ তীশ... তীশ আর খুমানের পুত্র—তার নামও খুমান৷ খুমানের প্রশ্নের উত্তরে তীশ বলেছিল, যে, তার যেতে নেই৷ খাবারের অভাবে, বৃষ্টির অভাবে আর অজানা কারণে মৃত্যুতে ছোট হয়ে আসা দলকে বৃদ্ধা তীশ ভাগ করে ছড়িয়ে দেয়—পূবে... পশ্চিমে... উত্তরে৷ মল্লিকার গল্পের আশি হাজার বছর আগের প্রাচীনতম সেই মানবগোষ্ঠীর সন্তানেরা অনন্ত আগামীর পথে চলতে থাকে৷ তীশ একটি করে শঙ্খ তুলে দেয় সবার হাতে৷ সেই শঙ্খের শব্দে একে অপরের খবর পাবে৷ একলা তীশের হাতেও একটি শঙ্খ৷ তীশকে যেতে নেই৷ ক্লান্ত, শ্রান্ত তীশের কাজ শেষ৷ একলা গুহায় একলা অতি জরাগ্রস্ত তীশ৷ খুমানের গুহায়৷ পুত্র খুমানদের শঙ্খ বাজছে৷ দূরে দূরে... আরো দূরে৷ শঙ্খ বাজে তীশেরও...

    বুধবার হাটের থেকে বাজার এসেছে৷ বত্রিশজনের সংসারের সারা সপ্তাহের বাজার৷ গলায় দড়িবাঁধা একটা চ্যাপ্টা লাল শিশিতে, চারশো গ্রাম সরষের তেল, গায়ে মাখার-রান্না করার৷ ঠোঙাতে জিরে মরিচ, ঠাকুমার সুপুরি-তামাক, ঠাকুরের বাতাসা, এমনি কত কি! ঠাকুমা ঠোঙা ফেলে ফেলে কাঠের সিন্দুকে সেসব গুছিয়ে রাখে৷ আঁচলের চাবি ঘুরিয়ে তালা দেয়৷ মা ঠোঙাগুলো ভাঁজ করে করে গুছিয়ে রাখে৷

    --“ঠোঙা কি হবে মা? ভাঁজ করে করে রাখছো কেন?”

    উত্তর পাওয়া যায় বৃহস্পতিবার৷ লক্ষ্মীপূজা সেদিন, লক্ষ্মীশূন্য এ বাড়িতেও৷ সেদিন মায়ের উপোস৷ অনাহারের দীনতা নেই সেদিন উপোসে৷ লক্ষ্মীশূন্য রান্নাঘরে, রান্নার দায় নেই৷ অন্নপূর্ণাহীন খাবার ঘরে শিশুদের দেওর-ভাসুরদের খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব নেই৷ সেদিন মা মুক্ত৷ ফুলবাগানের মধ্যে ঠাকুরঘরে সকালে পূজার কাজ করে ঘট পাতবে মা৷ তারপর সারাটা দুপুর, তার সারা সপ্তাহের প্রতিক্ষিত সময়৷ তখন যত্ন করে ভাঁজ করা ঠোঙার এপিঠ ওপিঠ পড়বে মা৷ নিচের ত্রিকোণ-ত্রিকোণ করে আঠামারা, ভাঁজ করা আংশিক বিকশিত লেখাও৷ ‘বিদ্যেধরী বউ’ বলে ঠাট্টা করবে না কেউ তখন৷ কারণ সেদিনই সন্ধেবেলা প্রদীপের আলোয় লালপাড় শাড়িতে ঘোমটাপরা এ বউটির পিছনে বসে সবাই জোড়হাতে শুনবে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’৷ এই প্রথম নিজের বাড়িরই বধূ পাঁচালী পড়ছে৷

    —“তোমার আবার ঘোড়ায় চড়তে ইচ্ছে করে না মা? তোমার যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনবার হাত ভেঙেছে বল তুমি৷”

    স্কুল থেকে ফেরার পথে পারানি নৌকায় বই ফেলে দিয়ে তুমি যে নদীবাঁধের উপর থেকে সড় সড় করে, স্লিপ খেলে নদীতে পড়ে যেতে তেমনটি ইচ্ছে করে না আর? আমার একদিনও ষাঁড়ের পিঠ থেকে লাফিয়ে জলে পড়া হল না তোমার মতো৷ গরুর বাঁটে মুখ দিয়ে বাছুরের সঙ্গে দুধ খাওয়া হল না ভাগাভাগি করে৷ আমিও যদি দুধের বোনকে কোলে নিয়ে সাতসকালে বেরিয়ে, ভিন গাঁয়ে কুকুর বাচ্চা খুঁজে খুঁজে দিনের শেষে বাড়ি ফিরতাম—৷ কার সাহস বেশি মা? আমার না তোমার? –আর ঐ পাঁঠাবলি খেলাটা? গৃহকর্ম পছন্দ নয় বলে রাখাল হয়ে মাঠে থাকার সময়ের নির্বোধ দুষ্টুমি৷ তোমার আর তোমার বাল্যসহচর কেশবমামার খেলা, পাঁঠাবলি৷ তুমি পাঁঠা সাজবে, কেশবমামা দেবে বলি৷ তার হাতে হাঁসুলি৷ কিন্তু তোমার পাঁঠা হতে ভয় হচ্ছে দেখে, মামাই পাঁঠা হয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো৷ তোমার হাঁসুলি তুলতেও ভয়৷ তখন মামা গামছায় ঢেকে নিলো নিজের শরীর৷ এবার নির্ভয়ে তুমি বলি দিতে পারতে৷ কিন্তু তারপরেও তোমার ভয় যখন, তাহলে তো তোমাকেই পাঁঠা হতে হয়৷ কেশবমামা খুব সাহসী৷ তুমি ভয়ে কাঁপছ৷ পাঁঠার পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক৷ মামার নির্দেশ—একটু ভ্যাঁ ভ্যাঁও যেন করো তুমি৷ তুমি অবিকল তাই করছিলে৷ এবং তারপর... নেমে এলো ভোঁতা হাঁসুলি—কিন্তু ব্যর্থ নিশান৷ বীরের৷ পাঁঠাটা! নড়াচড়া করে ফেলেছিল যে৷ ঘাড়ে নয়, কাঁধে এসে লাগলো হাঁসুলি৷ একটা গভীর ক্ষত৷ রক্ত! রক্ত! তুমি চীৎকার করে কাঁদছ আর মামা বলছে—“ভ্যাঁ ভ্যাঁ কর৷ ভ্যাঁ ভ্যাঁ কর৷”

    আহা, কী স্বাধীনতা! আহা এবার এমনি করে, “দাও মোরে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া করে৷”

    লক্ষী, সতী এক বউ-এর নিত্যদিনে ঘরের দরজায়, উঠোনে গোবর ছড়ানোর, পাঁচালী পড়ার ব্রতকথা শেষ হয়৷ লক্ষীর বরে তার দুঃখ শেষ হয়েই পাঁচালী সমাপ্ত হয়৷ যে ঘোমটাপরা বউ পাঁচালী পড়ছিল এতক্ষণ, তার দুঃখও শেষ হবে একদিন৷ কিন্তু দুঃখ কি শেষ হয়? বিশ্বময় পথ চিনছে তীশের সন্তানেরা—তীশের দুঃখ কি শেষ হয় তাতে?

    পূজার শেষে পড়তে বসা৷ টিমটিমে টেমির আলোয় আমরা তিন ভাইবোন৷ দুটো বই আদ্যন্ত রিডিং পড়া শেষ৷ তারপরেই পাওনা একটা করে গল্প৷ পড়া তাই জেট গতিতে চলত৷ বিবেকানন্দ-সুভাষচন্দ্র-সূর্য সেন-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণকাহিনী-যাজ্ঞবল্ক-সীতা-সাবিত্রী-শৈব্যা—মুখস্থ হয়ে গেল সব৷ পাশের ঘর থেকে আসে রেডিওর খবর৷ শুনতেই হবে মায়ের৷ আমাদের ঘরটা দলচিঘরের লাগোয়া৷ দলচিঘর হল একান্নবর্তী পরিবারের ড্রয়িংরুম যেখানে কেবল ভিতর/বাইরের পুরুষদের অধিকার৷ খবরটা এখান থেকেই আসে৷ একটা রেডিও মানে একরাজ্য মানুষের আসর৷ হুঁকোটানা বিড়ি খাওয়া দড়ি পাকানোর আসর৷ আর বেড়ার ঘরের এপারে তখন অন্নহীন প্রোষিতভর্তৃকা এক মেয়ে তার অর্ধভুক্ত তিন সন্তানের রক্তে বুনে দিচ্ছে স্বপ্ন৷ মেয়ে আর বড় ছেলে হবেই ডাক্তার৷ ছোট ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ার৷ ক্লাস সেভেনে উঠে বিয়ে হওয়া গ্রাম্য মেয়ের পেশা-অভিধানে হয়তো ওই দুটি মাত্র পেশাই ছিল৷ না হলে নির্ঘাৎ একটি সন্তানও নাসায় বিজ্ঞান গবেষণা করে নোবেল পেত৷ আমরা বিশ্বাস করতাম, আমরা ওসব হব৷ অন্তত হওয়াটা কিছু অসম্ভব নয়!

    বাইরে থেকে কাতর আবদার—‘ও সায়দি, থারমেন্টারডা এটটু দেও না৷’

    মা সেজবউ৷ তাই সেজদি এবং সেটাই আঞ্চলিকতায় সায়দি৷ থার্মোমিটার জিনিসটার এ বাড়িতে আবিষ্কার সেজদির এবং প্রয়োগ সেজদি ছাড়া অসম্ভব৷ পাড়ায়, বাড়িতে কার কত বয়স সে সব নির্ণয় করার নিয়ম ছিল ওঠাপড়ার বছরের (বাংলাদেশ ভাগ) আগে না পরে, অমুক ঝড়ের আগে না পরে—এভাবে৷ তারপরের অধ্যায়ে, মায়ের বিয়ের বছর অথবা আমাদের জন্মদিনের সময় হিসেবে, সায়দি হয়ে উঠলো সবার জন্মপঞ্জিকা৷ অথবা ‘ও সায়দি উন্যে গোরদির সোকালে গোবর ভাঙা যাবে?’ ন’কাকিমা জানতে চায় আগামীকাল সকালে ঘুঁটে বানানো যাবে কি না৷ –‘উন্যে গোরদিন’ বল কেন মা? ‘কালকের দিন’ বল না কেন?’

    --‘তোর জ্যাঠামশায়ের নামে আটকায়৷’ কালিপদ জ্যাঠামশাইকে আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না, কিন্তু বাপরে! কী ধ্বনিজ্ঞান! কী মর্যাদাবোধ!—‘কালকে’ বলতে পারবে না মায়েরা৷ পৃথিবীর কোথাও না কোথাও, বেঁচে থাকা অথবা না বেঁচে থাকা ঐ অতুল সম্মানীয় মানুষগুলোর খাতিরে মায়েরা সুজিকে বলবে হাটের খুদ, ঘরমোছা ‘ন্যাতা’কে বলবে ‘পোচ’৷ অদেখা অচেনা আসল নাম মনে না আসা, সেই সুবোধ বা নেতাই জ্যাঠাদের জ্যাঠামো এ, না কি সমাজ-পরিবারের জ্যাঠামো, কী চেপে বসেছিল মায়েদের ঘাড়ে—কে জানে! ‘রাখে হরি মারে কে’ সিনেমাটার নাম মায়েরা বলত—‘দলির বাবার ঐ নাম রাখে কেজ আর মারে কেজ৷’ দলি, মানে ডলিদির বাবার নাম হরি৷ হরি জ্যাঠামশাই৷

    আজ ন’কাকিমা জানতে চায়, উন্যেগোর দিন সোকালে গোবর ভাঙা যাবে কি না৷ সারা বছরের গোবরে জল ঢেলে ঢেলে, পা দিয়ে চটকে চটকে, হাতের ছাপ ফেলে ঘুঁটে করে শুকোতে দেওয়া হবে, আর কি না বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দেবে সব? সায়দির ঘুঁটে তো ভেজে না কোনোদিন? মা যে আবহাওয়ার খবর শুনতো নিয়মিত৷ অনেক পরে আসে আমাদের ঘরেও রেডিও৷ বি.এ. পাশ করার আগে তার নব্‌ ঘোরানোর অনুমতি পাব না তাই জানা ছিল৷ যদিও মাধ্যমিকের পর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিলাম৷

    একান্নবর্তী পরিবারে অন্য কোনো মায়েরা শাসন করতে পারত না নিজের ছেলেমেয়েদের৷ কেউ না কেউ ব্যাগড়া দিতই৷ জ্যাঠা-কাকা-বাবা শাসন করত৷ কিন্তু এ ব্যাপারে মায়ের আইনই ছিল শেষ কথা৷ তার সন্তানদের গায়ে হাত তোলার ক্ষমতা ছিল না কারও৷ কিন্তু এক্ষেত্রে, তার ক্ষমতা ছিল সীমাহীন৷ পিটুনির সময় চুলমাত্র নড়ার সাহস হত না আমাদের৷ আর তাতেই ঘটে গেল বিচ্ছেদ—অভাবের তিন আজন্ম সহচরের সঙ্গে৷ –চুরি, মিথ্যাচার আর শ্ল্যাঙরা আর আমাদের ছুঁতে পারল না৷ ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ হয়ে গেছে তারা৷ অন্য কারো অধিকার ছিল না আমাদের আড়াল করার৷ কী এক অজ্ঞাত কারণে বাবারও ছিল না সে অধিকার৷ কথায় কথায় ছড়া কাটা মা বলতো—‘শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে’৷ –বাবা তো ভালইবাসতো আমাদের! তবু কেন এমন বলত মা? অন্য বাচ্ছাদের চেয়ে মায়ের কারণেই মূলত সংসারে আমাদের মর্যাদা ছিল বেশি৷ অবশ্য সামান্য ক’বিঘে এক ফসলী জমির চাষটুকু ছাড়া একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য ছিলেন আমার বাবা৷ সেকারণেও হতে পারে৷ কিন্তু অনুপস্থিত তিনি দু’টি মাস ছাড়া৷ তাই আমাদের ভূবন জুড়ে মা৷

    ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে, আমার মা স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন দেখল পরের বোনটি দাঁড়িয়ে আছে পথে, শাড়ি নিয়ে৷ সেদিনই হয়ে গেল মেয়ে দেখা৷ ‘শুভস্য শীঘ্রম’৷ খবর পাঁচকান হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই রীতি৷ অবস্থাপন্ন দাদু তার তিনটি মেয়েকে ভেবেচিন্তে বিয়ে দিয়েও সুখী দেখতে পারেননি৷ তারপরে তো তাঁর সর্বহারা অবস্থা৷ ঠিক করলেন স্ট্রাটেজি বদলাবেন৷ যে প্রথম চাইবে তাকেই দেবেন এ মেয়ে৷ অবশ্য সেটাই তার সর্বাপেক্ষা ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত৷ কারণ সর্বাপেক্ষা ভালো ছিল মায়ের বিবাহ৷ চাকুরীরত জামাই৷ থাকলই বা দূরে দূরে যুদ্ধে অথবা বর্ডারে৷ কখনও হাত তো তোলেনি বউ-এর গায়ে৷ সারা গাঁ ঘুরে এমন নিদর্শন মেলা ভার৷ অবশ্য ‘মেনিমুখো’ তেমন ছেলের সামাজিক মর্যাদাই বা থাকে কোথায়? কিন্তু মৃত্যুর সামনে বুক চিতিয়ে চাকরী করা জামাই যদি মেয়ের গায়ে হাত না তোলে, তবে তা অহংকারেরই বটে৷

    সংসারে বত্রিশজন, তাই খাওয়াই জোটে না অর্ধেকদিন৷ তবু ভালো বিয়েই তো হল৷ বাবা, মাকে নিয়ে থাকতে পারতেন চাকরীস্থলে৷ কিন্তু তাহলে সংসারে টাকা পাঠানো কমে যাবে৷ মা কখনো কখনো হয়তো থাকতে পারত বাবার কাছে৷ কিন্তু আমাদের পড়াশুনার কারণে তাও বন্ধ হল৷ ডিফেন্সে ইলেকট্রো-মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার বাবার পদোন্নতি হচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের অবস্থা তথৈবচ৷ মা বলল, সব কষ্ট মেনে নিতে তিনি রাজি, কিন্তু পড়াশুনার টাকা দিতে হবে বাচ্চাদের শেষ পর্যন্ত৷ শেষ পর্যন্ত মানে কি? তবু মায়ের সাধ অপূর্ণ রইল না শেষ পর্যন্ত৷ উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায়, পেয়ে গেল সন্তানেরা৷

    সেভেনে ওঠা গ্রাম্য মেয়ে, যে আশৈশব বিয়ের কথায় শুনেছে—‘পচা কাঁঠাল মুচি খদ্দের৷’ পড়তে বসলেই তাড়া খেয়ে শুনেছে ‘মেয়ের পাল, পড়ে কী হবে?’—সে ওই সিক্স উত্তীর্ণ বিদ্যায় এত শিখল কী করে? আমাদের গরু চরানো খড়ি ওঠা গা, ফাটা পা গরমজলে ঘষতে ঘষতে মা যখন বলত—‘অঙ্গারো শতধৌতেন মলিনত্বং ন মুঞ্চাতি’—আমরা বিস্ময়ে হতবাক হতাম৷ পরে সেসব মুখস্থ হয়ে যায়৷ রসনাতৃপ্তির আজকের এই বিপুল আয়োজনের মধ্যে এখনো সেই ক্ষুধাতুর দিনের বেদবাক্য মনে পড়ে—‘খাওয়ার জন্যে বাঁচিনা মোরা, বাঁচার জন্য খাই/সে জন অতীব মূর্খ যে করে খাওয়ার বড়াই৷’—বেদবাক্য? কী জানি? বেদ কি বাংলায় লেখা? এ লাইনদুটি এখনো দেখিনি, পড়িনি কোথাও৷ নিরন্ন দিনে এ যে কী ব্রহ্মাস্ত্র ছিল আমাদের কাছে! অন্যের খাবার, রসনাতৃপ্তির খাবার এবং নিমন্ত্রণবাড়ির খাবারে আমরা হতে পারলাম সম্পূর্ণ নির্মোহ৷

    বাবা ভালো চাকরী করে৷ পঙক্তি ভোজনে বত্রিশ জনের সঙ্গে আমরা থাকি বছরে ছয়মাস অর্ধউপবাসে৷ আর তাতেই পৃথিবীর দিকে উচ্চশিরে, সোজা চোখে তাকানোর অমূল্য মুকুট যেন পরাল মা দীর্ঘ সাধনায়৷ নিজেকে তো মনে হয় পৃথিবীর সেরা সুখী মা—যখন পেটভরে খেতে দিই সন্তানকে৷ কিন্তু মুকুটটা কি দিতে পারবো পুত্রকে? আত্মহোমের বহ্নি ছাড়া কি সে মুকুটের অধিকার হস্তান্তরিত হতে পারে?

    মেয়ের বয়স চার, ছেলের তিন৷ ছোট ছেলের ছ-মাস৷ বিদ্যুৎ-রাস্তা-পানীয় জলহীন গ্রাম৷ নিকটতম রেল স্টেশন চারটি নদীর ওপারে৷ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পায়ে হেঁটে৷ বৃহৎ পরিবারের একটিমাত্র পুরুষ, যে ওইসব নদী পেরিয়ে চাকরী করতে যায়, সে আমার বাবা৷ আর বছরে একটিবার বাড়ি আসে৷ বাকিরা ওসব নদীপারের ভিনদেশের গল্প-ছবি জানতেও চায় না৷ খবর বলতে, হুঁকোর আওয়াজ পেরিয়ে আসা, সন্ধের রেডিওর বিক্ষিপ্ত আধা-আধা কাটা-কাটা স্বর৷ খবরের কাগজ বা বই মানে ওই বুধবার হাটের ঠোঙা৷ গোটা ভারতবর্ষের গ্রাম-মফস্বল এমনকি শহরেও তখন আধুনিক ‘পরিবার পরিকল্পনা’ ভাবনা, বর্তমানের মহাকাশ যাত্রার মতই দুরূহ৷

    আমার গ্রামও চলছিলো নিজের নিয়মে৷

    স্থায়ী আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ মানে ঠাকুরঘরে প্রবেশ নিষেধ৷ ছিছিক্কার৷ নির্লজ্জের একশেষ! কানাকানি! লজ্জা! লজ্জা! তবু জিতে গেল মা৷ চারপাশে তখন ঘটে চলেছে বহু সন্তানের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এক অন্য লড়াই৷ লোকচক্ষুর আড়ালে অথচ প্রতি ঘরে ঘরে৷ গর্ভস্থ শিশু এবং মায়ের জীবন, এক নিকষ অন্ধকারের টানাপোড়েনে, জীবন মৃত্যুর নিষ্ঠুর খেলায় তখন৷ মৃত্যু বিভীষিকাময় সংসার, ছোট সংসারের তাগিদে৷ মা পারল৷ আমি কি পারতাম? পেরেছি আমি এমন কোনো কঠিন কাজ? ক্ষুধার্ত শিশুর মুখের খাবার থেকে টাকা বাঁচিয়ে, বাবার দেওয়া খাম পোস্টকার্ড মাত্র কেনার টাকা, তাই বাঁচিয়ে গোটা সংসার, স্বামীর অমতে এক দায়িত্ববোধহীন দেওরকে সঙ্গে নিয়ে যে অসম্ভবটি সম্ভব করেছিলেন সেদিন মা, তার বুঝি কোনো তুলনা হয় না! হতে পারে না যেন৷ তারপর, অসম্ভব রূপকথার স্বপ্নে স্বপ্নে ভরে ওঠে দিন৷ স্বপ্নময় বাল্য, কৈশোর, যৌবন৷ রাতের রূপকথারা সত্যি সত্যি একটু একটু করে ধরা দিতে দিতে দিনের আলোয় কাছে এসে দাঁড়ায়৷

    তীশ দেখতে পেয়েছিল—অজানা রোগ গ্রাস করছে তাদের জনপদকে৷ তীশই প্রথম দেখেছিল, বৃষ্টি পড়লে বীজ থেকে চারা জন্মে চারদিক ভরে ওঠে গাছে গাছে আর ফলে ফলে৷ সে সব বীজ কুড়িয়ে রেখেছিল তীশ৷ সন্তানদের যাত্রাপথে সঙ্গে দিয়েছিল৷ নতুন জায়গায় কাজে লাগবে বলে৷ “তুমি যাবে না কেন মা? আমার যেতে নেই৷”

    তীশের শঙ্খ বাজে—তীশের আকুতি-আকাঙ্ক্ষা ঝরে পড়ে আমার মায়ের সুরে৷ পুত্র খুমানের শঙ্খ বাজে যতবার আমরা ভাইবোনেরা বলি—“তুমি যাবে না কেন মা৷” পিতা খুমানের গুহায় বন্দি মায়ের চেতনা—

    যেতে নেই—যেতে নেই—

    পুত্র খুমানরা কেউ মরুভূমি পেরোয়—কেউ বন—কেউ সমুদ্র৷ ভিন্ন পথ, ভিন্ন অভিজ্ঞতা তাদের আলাদা করে৷ ভিন্ন জীবন, ভিন্ন বোধ তাদের অচেনা করে পরস্পরের কাছে৷ তবু খুমানের শঙ্খের সুরের মতো আমরা বার বার ফিরে আসি মায়ের কাছে৷ তীশ গুহার লতাপাতা সরিয়ে উঁকি দেয়—চিনতে পারলেই আনন্দে আত্মহারা হয়, পরমুহূর্তে না চিনতে পারার বেদনায় ম্লান হয়ে গুহায় বিলীন হয়৷ গুহার অন্ধকারে অন্ধকারে গন্ধ নিয়ে চেনা পুত্রকন্যাদের খোঁজে৷ গুহামুখের অদৃশ্য গণ্ডির এপারে আমরা৷ ‘তুমি কেন যাবে না মা?’ উত্তর একটাই—‘আমার যেতে নেই।’ ‘কেন যেতে নেই?’ খুমানদের শঙ্খ বাজে দূরে আরো দূরে৷ অবিরাম৷ খুমানরাও মায়ের শঙ্খ শোনে৷ কোলাহলে সব শব্দ মিলেমিশে যায়৷ খুমান কান পাতে—চেতনা জুড়ে বাজতে থাকে—‘যেতে নেই—যেতে নেই৷’ ‘কেন যেতে নেই?’ ‘আমার যেতে নেই৷’

    ‘কেন যেতে নেই মা?

     

    © এবং আলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্লগার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখা পুনঃপ্রকাশের জন্য www.ebongalap@gmail.com –এ ইমেল করুন।  

     
     



    Tags
     



    Comments (2)
    • কালকের দিন > উন্যেগোর দিন, সুজি > হাটের খুদ , ন্যাতা > পোচ, ভাষাতাত্ত্বিক এই বদলগুলো কেবল তো নতুন শব্দের জন্ম নয় । অন্যকে সম্মান জানানোর জন্য নিজেরদের মত করে গড়ে তোলা শব্দ । “রাখে হরি মারে কে” -এর মত আস্ত একটা প্রবচন বদলে যায় গ্রামীণ ওই নারীদের নিজস্ব বাচনে । তার পরেও তাদেরকে ওইসব সম্মানিত পুরুষদের কাছে মাথা নোয়াতে হত সবক্ষেত্রে , নোয়াতে হয় এখনও। এ এক অব্যক্ত মর্ম বেদনা । কিভাবে যে এই তান্ত্রিকতার জন্ম ও বহমানতা কি জানি !

      • বাণী বসুর ‘খনামিহিরের ঢিপি’র প্রথমপর্বে, সমাজের এ দিকটা নিয়ে দারুণ এক প্রত্নকাহিনি আছে l কীভাবে নারীপ্রাধান্য থেকে পুরুষপ্রাধান্য এল..তার বিশ্বাসযোগ্য আখ্যান পাই, ওই উপন্যাসের প্রথমাংশে l

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics