আমার মায়ের গান ও কিছু না-বলা কথা
4 1048♦
উনিশ বছরে অল্প দিনের চেনা এক মানুষকে বিয়ে করেছিল আমার মা। এই বিয়ের জন্য মাকে পালাতে হয়েছিল নিজের বাড়ি থেকে।
কেন?
মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের কট্টর ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবার সে কালে একজন অ-ব্রাহ্মণ পুরুষকে তাঁদের জামাই হিসেবে ভাবতে পারেননি। মেয়ে যে এভাবে নিজের জেদে বিয়ে করতে পারে এ ছবি দুঃস্বপ্নেও তাঁরা দেখেননি।
মা বিয়ের পর চলে এল কলকাতায়। জেলখাটা স্বদেশী পরিবার। কংগ্রেসের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট লাবণ্যপ্রভা দত্ত-র বাড়ি। আপাতদৃষ্টিতে খোলামেলা পরিসর। সেটা সত্তরের দশক। মায়ের বিয়ের পর বাড়িতে লোকজন কমে আসতে থাকে। বলতে গেলে মা-বাবার দাম্পত্য। বিয়ের পরে পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিল মা। স্নাতক, স্নাতকোত্তর। আর, মনে ছিল গান শেখার অদম্য ইচ্ছে।
যৌথ পরিবারে, অনেক ভাই বোনের সংসারে আলাদা গান শেখা হয়নি মায়ের। তবে পাশের বাড়ির বন্ধু যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শিখতে বসতো তখন সব ফেলে নূপুর কান পাততো পাশের বাড়ির দেওয়ালে। সেখান থেকেই শুনে শুনে গান শেখার অভ্যেস।
নূপুর আমার মা। আমার মামা বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, তখন বাড়িতে গান শোনার চল ছিল। কিন্তু তার সবটাই রেডিওর মাধ্যমে। আমার দিদিমা গান শুনতে ভালবাসতেন। দাদু সেতার বাজাতেন। সে কালে 'জেনে শুনে বিষ করেছি পান'; 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি'; বিশেষ করে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের গলায় রবীন্দ্রনাথের গানগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক বেশি। নৃত্যনাট্য আর গীতিনাট্য হতো পাড়ায় পাড়ায়।
গান দিয়ে নিজেকে মেলে ধরার সুপ্ত ভাবনা নিয়ে মা কলকাতায় এসেছিল। সৌভাগ্যক্রমে ভর্তি হল দক্ষিণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দক্ষিণী শুধু গান শেখার প্রতিষ্ঠান ছিল না; কেমন ক’রে যেন শিক্ষার্থীদের ভাবনা, রুচিবোধ তৈরি করার কাজটাও করে দিতো। বহু মানুষকেই মজা ক’রে বলতে শুনেছি সত্তর দশকের কলকাতায় অ্যান্ডারসনে সাঁতার শেখা, আর দক্ষিণীতে গান শেখা তখনকার মেয়েদের 'স্টেটাস সিম্বল' হিসেবে দেখা হতো। বাঙালি মেয়ে রবীন্দ্রনাথের গান জানলে সে যে সংস্কৃতিমনস্ক হবে, বিয়ের বাজারে তার যে কদর হবে এ কথা নিশ্চিত জেনে বহু অভিভাবক রবীন্দ্রনাথের গান শেখা বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করেছিল।
আমার মা-র ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের বাজারের বিষয় খাটেনি। মায়ের ইচ্ছেতেই মা বাবার সঙ্গে দক্ষিণী চিনেছিল। একা বাইরে যাওয়া, মুর্শিদাবাদের মেয়ের কলকাতার রাস্তা চেনাও খানিকটা এই গান শেখার জন্য। দক্ষিণীর পর ঋতু গুহ-র কাছে মায়ের সংগীত চর্চা। সব মিলিয়ে মেয়ে মানুষ করার সঙ্গে সঙ্গে গান চর্চার বিষয়টা মায়ের জীবনে বড় হয়ে উঠেছিল।
কণ্ঠের গুণে মা গানের জগতে নিজের জায়গাও করে নিয়েছিল। কিন্তু এই জায়গা ছিল সীমিত।
যৌথ পরিবার না হলেও আমার মা-বাবার সঙ্গে আরেকটি মানুষ আমাদের বাড়িতে থাকতেন। তিনি আমার বাবার দাদা পার্থ বসু। শান্তিনিকেতনে পুলিনবিহারী সেনের কাছে তাঁর উচ্চতর শিক্ষা। পুলিনবিহারী সেনের কাছেই তাঁর রবীন্দ্রচর্চার দীক্ষা। তাঁর মতো করে রবীন্দ্রনাথের গান খুব কম মানুষই বুঝেছেন। ব্রাহ্মসমাজ, আনন্দবাজার পত্রিকা-র শিল্প-সংস্কৃতির দায়িত্ব তাঁর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভবানীপুরের এই মধ্যবিত্ত বাড়িতে মা-বাবার দাম্পত্যের সঙ্গে পার্থ বসু, গীতবিতান আর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আরেকটা সমীকরণ সমান্তরালভাবে মায়ের জীবনে চলেছিল। ভাই-বউ আর ভাসুরের সম্পর্কে একজনই রাজা। সেই রাজার নাম রবীন্দ্রনাথ। আর আমার জ্যাঠাবাবা পার্থ বসু যেন তাঁর অতন্দ্র প্রহরী।
মায়ের অনুষ্ঠান। মা হয়তো গাইতে চাইছে 'তাই তোমার আনন্দ আমার পর'। নাহ, সে চলবে না। সন্ধেবেলার অনুষ্ঠান। সন্ধেবেলার রাগের ওপর রচিত গান গাইতে হবে।
- 'অশিক্ষিতদের মতো গান গেয়ো না। একটা লোক সারাজীবন দিয়ে গান লিখে গেছে। না জেনে, না বুঝে গান গাইলেই হলো?'
গলা চড়িয়ে এই কথাগুলো বলতো আমার জ্যাঠা বা 'জ্যাঠাবাবা'; এই নামেই ডাকতাম আমি তাকে। মা বেচারি ওই নির্দেশেই চলতো। আসলে ওই কথাগুলোর মধ্যে ভুল কিছু ছিল না - আমার মা বোধ করি এরকমটাই ভাবতো। এই ভাবনা মায়ের গান গাওয়াকেও অনেক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ করেছিল। মা স্বল্পশ্রুত রবীন্দ্রনাথের গান, ধ্রুপদাঙ্গ, খেয়ালাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত অনায়াসে গেয়ে দিত। পূজা পর্যায়ের গানের পরেই ফস করে প্রকৃতির গান গাওয়া যাবে না জ্যাঠাবাবার এমন হুকুমে যুক্তি খুঁজে মা সেটাই আজীবন মেনে এসেছে। অপ্রচলিত বেয়ারা তালের ব্রহ্মসংগীত রান্নাঘরে খুন্তি নাড়তে নাড়তেই গেয়ে যেতো মা। জ্যাঠাবাবা জোর করেই ওই গানগুলো তুলতে বলতো।
কলকাতায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। মায়ের ছোট্ট বাগানে জুঁই আর পাতাবাহার আকাশ জলের ছোঁয়ায় আহ্লাদিত। জ্যাঠাবাবা অফিস থেকে এসে বসে পড়লো 'নাও নীলাঞ্জনছায়া ধরো।'
‘রিমঝিম ঘন ঘন রে’ গাওয়া যাবে না এক্কেবারে। আসলে পরে বুঝেছি 'নীলাঞ্জনছায়া'-য় ওই শেষে 'চিত্ত মোর পন্থহারা কান্ত বিরহ কান্তারে' বর্ষার এই বিষণ্ণ পরিণতির বেদনা আমাদের পরিবারের সকলের একলা হাহাকারের জায়গায় নিয়ে যেতো। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এমন যন্ত্রণা 'রিমঝিম ঘন ঘন রে' -তে মিলবে না।
বর্ষার এই নিভৃত আসরে মায়ের আর একটা গানের কথা মনে আসছে। আজও আমাদের বাড়ির উঠোনে রাতের বুক চিরে ঝরে পড়ে সেই গান। 'হায় জানি সে নাই জীর্ণ নীড় জানি সে নাই নাই...' কেদারার মধ্যম এত তীব্র লেগেছে ওই সময়ের বর্ষা রাতে যে মা চলে যাওয়ার পরেও সেই মধ্যম বেজে ওঠে আমার বাড়ির আজকের উঠোনে। রান্নাঘরে। উঠোনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
গানের প্রসঙ্গে, মায়ের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে দেখছি ফিরে ফিরে আসছে একটা শব্দ - 'রান্নাঘর'। মা ভীষণ ভাল রাঁধতেন। শাড়ির মতোই রান্না মায়ের শখ ছিল। কণ্টিনেন্টাল থেকে বাঙালি সবই খুব নিখুঁতভাবে করত মা। কিন্তু মায়ের জীবনে এই শখ কেবল শখই ছিল না। চিরটাকাল তো রান্নাঘরের তাপে একটু একটু করে পুড়েছেও আমার মা। মায়ের গানের অনুষ্ঠান ছোট হোক বা বড় - রান্নাঘরে তো মাকে যেতেই হতো। বাবার দশটা-পাঁচটা অফিসের ঠিক দশটার ভাতের থালা, আমার স্কুলের খাওয়া, টিফিন। জ্যাঠাবাবার ফরমাশ মতো দুপুরের খাওয়া। টিফিন। বিকেলে আমায় স্কুল থেকে আনা। তারপর গান - সবার শেষে, সব হারাদের মাঝে। খানিকটা সেরকমই। মায়ের গানের জন্য এই পরিবারের কেউ আলাদা করে মা-কে এগিয়ে দেয়নি। বলেনি তো, থাক সংসার। তুমি এই দিনটা শুধু গানের জন্য দাও। বরং আমি আমার জন্মদিনের দিন মা রেকর্ডিং করতে গেছে কেক বানিয়ে দেয়নি বলে মুখ ফুলিয়েছি। আসলে তখনও বড় হইনি। পরিবার প্রথায় ভাবতে শিখেছি মা শুধু দেবে। করে যাবে। মা গান গায়, স্ত্রী গান করে এটা ফর্সা মেয়ের গুণের মতোই যেন সমাজে গ্রহণযোগ্য।
গান চর্চার এই ধারায় জ্যাঠাবাবার মতো মানুষের জন্য বহু গুণী মানুষ আমাদের বাড়িতে এসেছেন। সেখানে মায়ের যত্ন করে রান্নার পাশে গানও ছিল। সুচিত্রা মিত্র, জয় গোস্বামী, বুদ্ধদেব গুহ। আরও কত নাম। জয়দা 'বড় বিস্ময় লাগে' শুনে মা-কে লম্বা চিঠি লিখেছিলেন।
এভাবে বহু মানুষের মধ্যে মা গানের জন্য মিশে গিয়েছিল। মা অনুষ্ঠানে গেলে খুব মন দিয়ে সব শিল্পীদের গান শুনতো। কাউকে মনে হলে ডেকে বলত 'তুমি রেডিও স্টেশনে পরীক্ষা দাও’, ‘তুই দক্ষিণীতে ভর্তি হয়ে যা’, ‘আপনি এত ভাল গা’ন রবীন্দ্রসদনে পরীক্ষা দিন না কবিপক্ষের জন্য’... কোনও ধরণের ঈর্ষা মায়ের মধ্যে কাজ করেনি। আমাদের বাড়িতে মায়ের উৎসাহে ধৈবত শিল্পীগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ। ধৈবতে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, নতুন কণ্ঠদের এক জায়গা নিয়ে আসা। নিয়মিত মহলা সব মায়ের জন্য, আমাদের এই বাড়ি ঘিরে। আপনাকে প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের হাত ধরে থাকার অভ্যেস ছিল মায়ের বরাবরের। বাবার সহযোগিতাও ছিল। তবে বাবা আর জ্যাঠাকে অনেক সময় ধৈবতের মহলা নিয়েও রাগারাগি করতে দেখেছি মায়ের ওপর। 'অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে...’ ‘বাইরের ঘরে বসতে পারছি না' বা 'মোহনবাগানের খেলা দেখা হলো না এই গানের রিহার্সালের জন্য'।
মা কোনওদিন চিৎকার করা, প্রতিবাদ করার মানুষ ছিল না। নিজের যা করার আপ্রাণ চেষ্টা করত করে যাওয়ার। অনিশ্চিত একধারার সাহস কাজ করতো মায়ের মধ্যে। এই জোর গান থেকেই গাওয়া।
আমার জ্যাঠা তখন দেশ পত্রিকার শিল্প সংস্কৃতি পাতার দায়িত্বে। নৃত্যনাট্য 'চন্ডালিকা'-য় মায়ের গলায় প্রকৃতির গান শুনে সমালোচক বিশ্বজিৎ রায় এক অনুচ্ছেদ শুধু মায়ের গায়কী নিয়ে লিখেছিলেন। বাড়ি ফিরে সম্পাদক মহাশয় বললেন,
- 'তোমার গানের এক প্যারা জুড়ে প্রশংসা, সব কেটে দিয়ে এক লাইন রেখেছি। এর বেশি আমার পাতায় অসম্ভব'।
মা-র সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল। কী বা করতে পারতো মা! খারাপ লাগা আরও ছিল। সে সময় রবীন্দ্রনাথের গানের সমঝদার হিসেবে পার্থ বসুকে সবাই গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ থেকে নামকরা আয়োজকরা এলেন রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন কণ্ঠের সন্ধানে। দেখলাম জ্যাঠাবাবা অন্য একজনের নাম বলে দিলেন। মা-র নাম একবারের জন্য কোথাও না, অথচ বন্ধুদের সামনে মা-র গানের প্রশংসা করতেন। অদ্ভুত লাগে ভাবতে! মায়ের গানের রশি কি জ্যাঠাবাবার হাতে ধরা থাকতো? ওর আদর্শের সম্মান রাখতে গিয়ে বাইরে মায়ের গান গাওয়া সীমিত হয়ে গিয়েছিল। পার্থ বসুর চাঁচাছোলা কথা মানতে না পেরে তখন গানের জগতের বহু মানুষ মা-র গান থামিয়ে নিজেদের আক্রোশ মেটাতো, এমন উদাহরণ প্রচুর আছে।
গানের জন্য বেদনা জীবনের বেদনায় মিশে গিয়েছিল - পূজার গানে মায়ের আর্তি, প্রেমের গানে এমন হাহাকার মা তো তার জীবন থেকেই পেয়েছিল। মা-কে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের সারমর্ম। ক্যান্সার ধরা শরীরে নিয়ে মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগে পাঁজাকোলা করে তাঁকে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়েছিল। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ গান। মৃত্যু এক্কেবারে দরজায়।
মা বলে গিয়েছিল একের পর এক- 'চোখের জলে লাগল জোয়ার...হল কানায় কানায় কানাকানি এ পারে ওই পারে...'
জীবনের সঙ্গে শেষবারের মতো এক হাত কথা করে নিয়েছিল মা সেই গানেই। 'ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছো আরো কী তোমার চাই...’ তারপর মা কথা বলতে পারেনি। শেষের কথা শুধু গানে!
তারপর সব চুপ! মা আর তার গান...আর কেউ কোথাও নেই।প্রাণের আগে কণ্ঠ হারিয়েছিল আমার মা।
মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে মা তখন একজন গায়ক(গায়িকা নয়); যার স্বামী, সন্তান, বন্ধু, প্রেম কিচ্ছু নেই।
----
[ফিচারড ইমেজ-এ ব্যবহৃত ছবিটি তুলেছেন ঋকরুদ্র মন্ডল]
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (4)
-
-
আহা রবিঠাকুর ছুঁয়ে বড় হওয়া নিজের ছোটবেলা কে ও কি মধুর ভাবে হাতে পেলাম আবার। প্রনাম সেই সুরের সাধিকাকে।
-
অসাধারণ লিখেছেন শ্রাবস্তী ।মা কে পেলাম।
-
Ekhane likhte chai.. Kibhave Pathabo?
Bishoi ki apnara nirbachan Koren?
Leave a Reply
-
অসাধারণ লেখা!