• আসছে বছর আবার হবে


    2    160

    October 3, 2017

     

    আমাদের ছোটবেলায় ধারণা ছিল যা কিছু পুরোনো তার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমরা নতুনকে আনব, আর অতটা না পারলেও, নতুনের আসাটা অন্তত দেখব। কথা ছিল সেই বিপ্লবে শ্রমিক কৃষক সামনের দিকে থাকবেন, কিন্তু মধ্যবিত্তরাও ডি-ক্লাস হয়ে কিছু একটা করবেন। এই আগমনী আমাদের মাথায় গুণগুণ করত, বড়লোকদের বিসর্জন দেওয়াটা যে একটা জম্পেশ উৎসব হবে এই নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। আমাদের সুকান্ত ছিলেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন, আমরা জানতাম পেরাকে, পেনাঙে, টিনের খনিতে রবারের বনে মশলার দ্বীপে ঘুম ভেঙে ওঠা অগ্নিকোণের মানুষ, রক্তের পাঁকে শত্রুকে পুঁতে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমরাও দাঁড়াব। আমরা জানতাম বসিরহাটের নুরুল ইসলাম আর আনন্দ হাইতের প্রাণ ফালতু যায়নি। শহিদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ। এই বিসর্জন মানে এক নতুনের আগমনী।
    এর পর সত্তরের দশকে ঘটল এক দিগন্ত জোড়া বিসর্জন। আধা-নিরাপদে বেঁচে থাকার দশ ফুট বাই দশ ফুটের একেবারে চারপাশ জুড়ে বইতে থাকল রক্ত। উঠোন জুড়ে, খেলার মাঠ জুড়ে, পাড়ার মোড়ে লাশ। কেউ বন্ধু, কেউ ‘ওই দলের চেনা ছেলে’, কেউ গরিব মাতাল খোচর, কেউ প্রতিবেশী ট্রাফিক পুলিশ, তার বউয়ের কী কান্না... কিসের জন্য কি বিসর্জন সব কেমন গুলিয়ে গেল। বিসজর্নের চরিত্র নিয়েই একটা সন্দেহ এল মনে। তার কিছু কারণ ছিল। এক, এই প্রথম রক্ত, কাটা মুন্ডু, পুলিশের থেঁতলে দেওয়া আঙুল একেবারে সামনে এল। এত দিন বিপ্লব, হত্যা, টর্চার, সব কিছু নিয়ে একটা রোম্যান্টিকতা ছিল, এবার একটা ভয় ঢুকে গেল। ইকড়ি মিকড়িতে অমিতাভ চৌধুরি লিখেছিলেন, কাটতে কাটতে রক্তে লাল, বিপ বিপ বিপ্লব আসছে কাল। এবার রক্তের ছিটে জামায় লাগল. মাঝরাতে ভীতুরা চমকে উঠল।
    কিন্তু আমাদের ব্রিগেডে তখনও আগমনী গাইছিল অজেয় ভিয়েতনাম, পাড়ায় পাড়ায় অমর ভিয়েতনাম।  মাই লাইয়ের লাশের ভিড়ে মাথা তুলছিলেন নগুয়েন ভ্যান ত্রয়। চিনের সাতষট্টির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা আমরা জানতাম, গাইছিলাম শত ফুল বিকশিত হোক, শত আগাছা নির্মূল হোক।
    আশির দশকে বাজারকে সামনে রেখে বড়লোকরা ফিরে এল নির্মমভাবে। তার সামনে নানা দেশে গরিবদের সামনে রেখে নিমর্ম হয়ে ওঠা লাল দুর্গগুলো টুকরো টুকরো হতে লাগল। জানলাম, কীভাবে লালশাসকরা সবাই সবাইকে সন্দেহ করা, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইয়ের গোয়েন্দাগিরি, যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা সৈনিকদের সাইবেরিয়ায় মরতে পাঠিয়ে দেওয়া – এই সবকিছু ব্যবহার করেছিলেন, দেশের মানুষের কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য। অনেকদিন পরে পড়লাম, সবদিক থেকে দেউলিয়া রাশিয়ার মানুযকে লাল সালাম ভোলাতে বাজার কাজে লাগাল সালামি, মানে মাংসের টুকরো। আবার পাশাপাশি শুনলাম চীনের লালবাহিনীর রক্ত হিম করা অত্যাচারের কাহিনি, তখন আরেক বিসর্জনের বাজনা বাজল। ডুকরে ডুকরে কাঁদলাম। এ যে ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পুজোর আয়োজন। সেই চুক আর গেক, আলেক্সেই মেরেসিয়েভ, গোর্কি, এ দিকেলুসুন, চিংচিংমাই, কত আগমনী গেয়েছি। এ কেমন পুজো ছিল তবে? কাকে তুষ্ট করতে কাকে বলি দিলাম আমরা? আমাদের চারপাশে শক্ত কঠিন যে লালেরা তখন বলে চললেন, এই সব মিথ্যা, তাঁদের দেখে, আর একটা ছোট রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বা বিপ্লবের নামে নেতৃত্ব ফলানো কিছু নেতার চরিত্রকে চীন বা রাশিয়ার পরিসর আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে গুণ করে মনে মনে হিসেব করে বুঝলাম একটি বর্ণও মিথ্যে নয়। এঁদের হাতে ক্ষমতা হলে ঠিক এই হত।
    এই বিসর্জন সামলাতে যখন আমরা ব্যস্ত তখন চার দিকে বেজে উঠল বাজারের আগমনী। মধ্যবিত্তরা এই নতুন বিপণি-বিশ্বের নাগরিকত্ব পেয়ে মল-এর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে অঞ্জলি আর ভোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে ছেয়ে যাওয়া এই নতুন ভুবনে রবীন্দ্রনাথের সেই কাঙালিনী মেয়ে দাঁড়িয়েই রইল। কিন্তু ততদিনে মোটামুটিভাবে ‘দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া, ম্লান মুখ বিষাদ বিরস, তবে মিছে সহকার শাখা, তবে মিছে মঙ্গল কলস’ এই বোধের বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল। মেরিটে বিশ্বাসী, সংরক্ষণ-বিরোধী মধ্যবিত্ত তখন নিজেদের কল্পিত ‘বিপন্নতা’ নিয়ে ব্যস্ত। ঘরে ঘরে অনেকগুলো বোধের চির-ভাসান হয়ে গেল। অভাবনীয় ভাবে গরিবদের, ভিন্-ধর্মীদের পথের কাঁটা হিসেবে দেখা শুরু হল। নিজেদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ‘ভাবালুতা’ তাদের সর্বনাশ করেছে বলে আঙুল তুলল।
    এই পথে এল এক ভয়ানক নতুন পুজো। বলিদানের পুজো। আবার রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল, ‘এত রক্ত কেন?’ কিন্তু সেই প্রশ্ন আর অনুরণিত হল না, বরং মিডিয়ায় মিডিয়ায় নতুন রঘুপতিরা বলে চললেন, এখনও চলেছেন, “কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ?” আর গদির লোভে গদগদ নক্ষত্র রায়রা বলছেন, “বল কি ঠাকুর? আমি হব রাজা?”
    আজ বিসর্জনের কাল। ঈদের বাজার করতে যাওয়া মানুষ থেকে কলম ধরা গৌরী, বিসর্জন চলছে চলবে।  এ নয় যে বিসর্জনের কাল আগে আসেনি। কিন্তু তখনএকটা আগমনীর সুরের আগাম আভাস বাতাসে ভাসত। সেই সুর কানে আর বাজে না। রাশিয়া, চীন অনেককিছু গুলিয়ে দিয়েছে। ধনতন্ত্রের আক্রমণের ভয়ে কী এমন শাসন জারি করা যায় যে ইউক্রেনের মাকে আমাদের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মায়ের মত সন্তানের বিষ্ঠা থেকে ছোলা বেছে খেতে হবে, বা এক শিশুর মাংস খাওয়াতে হবে আরেক শিশুকে? কিংবা, কী সেই সমাজতান্ত্রিক জ্ঞানের ভিত্তি যা বলে ঠান্ডায় টেকার ক্ষমতা বীজের ভেতরের জিনের শক্তি নয়? তাকে ঝটাপট তৈরি করে দেওয়া যায়? এবং যার ফলে তৈরি দুর্ভিক্ষে মরে লক্ষ কোটি মানুষ? চীনে সামাজিক পরীক্ষার কী নৈতিক ভিত্তি যাতে লক্ষ লক্ষ পরিবার, মানুষ, মন ছারখার হয়ে যায়? কোথায় সেই সমাজতান্ত্রিক মানুষ? সমাজতান্ত্রিক দেশে তবে কেন নাৎসি বালালেরা খুন করে ইহুদিদের? প্রতিবেশীরা কেন তাদের চিহ্নিত করে খুনিদের হাতে তুলে দেয়? কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো হওয়ামাত্র আবার প্রতিবেশী পুড়িয়ে দেয় প্রতিবেশীকে, গতকালের সহকর্মীকে?
    প্রশ্ন ওঠে মানবতার ধারণা নিয়ে, মানুষের চরিত্র নিয়ে, জীবজগত আর প্রকৃতিকে ধ্বংস করার অধিকার নিয়ে, তার যোগ্যতা নিয়ে… নানান বিশ্বসেরা বিসর্জনের দিন যেন এসে গিয়েছে, প্যান্ডেলে তাই রক্তমাখা সিঁদুর খেলা চলছে…
    জানি না, কতদিন আর এই আকাশ বাতাস থাকবে। চাঁদের নার্সিংহোমে যে শিশু জন্ম নেবে কাল রাত্রে, তার কাছে কোনো ছাড়পত্রের খবর পাবেন কোনো কবি। আরও আরও বিসর্জনের বাজনা কানে আসে। শ্রমের প্রয়োজন কমছে বলে মানুষের প্রয়োজন কমছে। মহাদেশব্যাপী হত্যাশিবির আর অভাবনীয় নয়। পথ আটকে মেরে দিলেই হল। কে চিরজীবী হবে কে হবে না তার উত্তর থাকবে ব্যাঙ্কের তহবিলে, এখনই অনেকটা আছে।
    সব্যসাচী সেই গলির মোড়ের গাছটা নিয়ে অচিন্ত্যকুমারের কবিতা বলতেন, গায়ে কাঁটা তুলে দিয়ে… প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে আর প্রাণ থাকলেই মান আছে, সমস্ত বাধানিষেধের ওপরেও আছে অস্তিত্বের অধিকার। এত বয়স হল, নবমীর নিশি পোহাল বলে তবু কেন যেন আশাকে বিসর্জন দিতে পারি না। কলকল করতে করতে স্কুলে যাওয়া মেয়েদের দেখে, জেএনইউয়ের ছেলেমেয়েদের দেখে, এমনকী এই গতকাল পুলিশের মুখোমুখি বেনারস হিন্দু ইউনিভাসিটির ছাত্রীদের দেখে মনে হয়… “আসছে বছর আবার হবে।”

     
     



    Tags
     



    Comments (2)
    • কী অপূর্ব এক মনখারাপে ছেয়ে গেল আকাশ রংগনদা। এমন ‘পুরোটা’ লেখা অনেকদিন পড়িনি। এমনভাবে ‘শেষ কথা’ অনেকদিন কেউ বলেনি।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics