• বারোয় বিয়ে, তেরোয় সন্তান : গৃহকর্মী থেকে খ্যাতনামা লেখিকা


    0    194

    March 8, 2019

     

    [মূল লেখাটি ‘দ্য বেটার ইণ্ডিয়া’-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত। লিখেছেন সাংবাদিক জোভিতা অরনহা। মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় লেখাটি অনুবাদ করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য।]

    বেবি হালদার

    কাশ্মীর উপত্যকায় জন্ম বেবী হালদারের। বেবীর যখন চার বছর বয়স, তখন তাঁর মা তাঁকে ফেলে চলে যান। বেবী বড় হচ্ছিলেন অত্যাচারী বাবা ও সৎ মা’র সংসারে। ক্লাস সিক্সে, সৎ মা’র কারণে তাঁকে ইস্কুল ছেড়ে দিতে হয়।

    “একটা বাচ্চা মেয়ের যখন ফ্রক পরে খেলাধুলো করার কথা, তখন তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে। শেষ হয়ে যায় তার শৈশব,” বলছেন বেবী হালদার। “আমাকে খেলার মাঝখান থেকে উঠিয়ে এনে একটা মণ্ডপে একটা লোকের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, ভেবেছিলাম বোধহয় কোনো পুজো হচ্ছে। তারপর আমাকে বলা হল যে ওই লোকটার সঙ্গে আমাকে চলে যেতে হবে।” বেবীর তখন ১২ বছর বয়স। তাঁর স্বামীর ২৬।

    বিয়ের প্রথম রাত থেকেই শুরু হয় অত্যাচার। বেবী বলছেন, “ওর ধারণা ছিল আমার দুটোই কাজ। সন্তান ধারণ আর রান্না করা।” ২০ বছর বয়সের মধ্যে বেবী তিন সন্তানের জন্ম দেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁর সন্তানদের জীবন তাঁর জীবনের মত হবে না। তাই, ১৯৯৯ সালে, ২৫ বছর বয়সী বেবী তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে দিল্লীগামী একটি ট্রেনে উঠে বসেন।

    দিল্লিতে এসে বেবী বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে শুরু করেন। পেশার কারণে এবং সিঙ্গল মাদার হওয়ার কারণে বেবীকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। নানা বাড়ি ঘুরে শেষ অব্দি বেবী প্রবোধ কুমারের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন। অধ্যাপক কুমার ছিলেন মুন্সী প্রেমচন্দের নাতি।

    বইয়ের তাক ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে বেবীর হাত মাঝেই মাঝেই তাক থেকে পেড়ে আনত বই। তার চোখ বইয়ের কয়েকটা পাতার ওপর ঘোরাফেরা করত। তারপর বই আবার পৌঁছে যেত যথাস্থানে। এই ঘটনা কিন্তু চোখ এড়ায়নি বেবীর তাতুসের। পোলিশ শব্দ তাতুস-এর অর্থ বাবা। এই নামেই প্রবোধ কুমার তাঁকে সম্বোধন করতে বলেছিলেন। একদিন তিনি বেবীর হাতে তুলে দেন একটি বই – আমার মেয়েবেলা।

    “বইটা পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল, যেন আমার কথাই এখানে লেখা আছে,” বলছেন বেবী।

    এর কিছুদিন পর, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে যাওয়ার আগে, নিজের ড্রয়ার থেকে প্রবোধ কুমার বেবীকে একটা ডায়েরি আর পেন দিয়ে যান। বেবী প্রথমে হতবাক - কী নিয়ে লিখবেন তিনি!

    বেবী লিখলেন তাঁর হারানো শৈশবের কথা, লিখলেন তাঁর প্রথম সঙ্গমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা, লিখলেন তেরো বছর বয়সের প্রসব যন্ত্রণার কথা, লিখলেন বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের ফলে শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষতের কথা। লিখতে লিখতে ফিরে এল (বোনের) স্বামীর বোনের গলা টিপে ধরার অবদমিত স্মৃতি।

    প্রায় কুড়ি বছর পর লিখছিলেন বেবী। প্রথম দিকে বানান, ব্যাকরণ নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু একটু একটু করে পুরনো অভ্যাস মনে পড়ে গেল। বেবী আরো লিখতে থাকলেন। বেবী বলছেন, “যত লিখতাম, ততই ভালো লাগত। মনে হত যেন অনেক দিনের কোনো ভার আমার বুকের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে।” প্রবোধ কুমার ফিরে এসে দেখলেন, বেবী’র একশো পাতার ওপর লেখা হয়ে গেছে!

    এটাই বেবী হালদারের প্রথম বই – আলো আঁধারি। প্রথম বার পড়ে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রবোধ। যে সমস্ত সাহিত্য-অনুরাগীদের লেখাটি দেখিয়েছিলেন তিনি, তাঁরা অনেকে অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন লেখাটির।

    বহু প্রকাশক নাকচ করে দেওয়ার পর, শেষ অব্দি কলকাতার একটা ছোট প্রকাশনী – রোশনি পাবলিশার্স – বইটি ছাপতে রাজি হয়।

    “একদিন একটা বই দেখিয়ে তাতুস আমাকে বললেন, ‘এটা তোমার বই। তুমি এটা লিখেছ।’ ছাপা বই আমার সামনে হাজির! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না!”

    ঝাড়ুদার থেকে পরিচারিকা থেকে পাশের বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা – বেবীর কাহিনি নাড়া দিয়েছিল সকলকেই। বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঊর্বশী বুটালিয়া। ২০০৬ সালে বইটি বেস্ট সেলার তালিকায় ছিল। বইটি ২১টি আঞ্চলিক এবং ১৩টি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

    আরো দুটি বই লিখেছেন বেবী। লেখা তাঁকে দিয়েছে আত্মপরিচয়, যা আগে  ছিলই না।

    অর্থনৈতিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত অবস্থায় পৌঁছে বেবী তাঁর তিন সন্তানকে (সুবোধ, তাপস, পিয়া) নিয়ে কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করেন।

    “এখন আমি বিশ্বাস করি, মানুষ সব পারে। আগে আমি পরিচারিকা ছিলাম। এখন আমি লেখিকা। আমি সবাইকে এটাই বলি যে, শুরু যে কোনো সময়েই করা যায়।”

    [উৎস: https://www.thebetterindia.com/162570/baby-halder-domestic-help-bestselling-author-child-marriage/]

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics