মেয়েদের ব্রতকথা কতটা মেয়েদের?
0 439“এলে? এসো ভাত তৈরি; খেয়ে আমায় উদ্ধার করো। তারপর আবার কোনদিকে বেরুতে হবে বেরোও। বোশেখ মাসের দিন সকলের মেয়ে দেখো গে যাও সেজুঁতি করছে, শিবপুজো করছে – আর অতবড় ধাড়ি মেয়ে- দিনরাত কেবল টো টো..”
বাংলার ব্রত কেবল দুর্গারা করে, আর অপুরা ব্রতের প্রসাদ পায়। অপুদের মঙ্গলের জন্যই তো ব্রত। ভাইয়ের মঙ্গল কামনা বাংলার ব্রতকথার একটি বড় দিক। সে ভাই যদি ভাত না দেয়, কিংবা বলে ‘খেটে খাও, বসিয়ে খাওয়াতে পারব না’ (ক্ষেত্রপূজার ব্রত), তবু এয়োরা বলবে ‘পুণ্যিপুকুরে ঢালি জল/ বাপ ভায়ের হোক অশেষ মঙ্গল’। আমি তো ছেলেদের শিবরাত্রির ব্রত ছাড়া আর কোনও ব্রত করতে দেখিনি। আর শিবরাত্রির ব্রতের মধ্যে বেশ একটা ‘মাচোগিরি’ আছে। প্রহরে প্রহরে শিবের মাথায় দুধ-ঘি-মধু ঢালার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার মেয়েদের চোখে নিজের জায়গাটা বুঝে নেওয়া আর নিশি জাগার নিষিদ্ধ আনন্দ!
তবে আর অন্তত একটি ব্রত পাচ্ছি- মনোরথ দ্বিতীয়া, যেখানে সদাগরের ছেলে শশাঙ্ককুমার এই ব্রত করে তার মানসী রাজকুমারী কৃষ্ণাবতীকে পেয়েছিল। আষাঢ় মাসে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির এই অতি কঠিন ব্রতটির দেবতা চন্দ্রদেব। চাঁদ, প্রেম, বিয়ে - মানে বোঝাই যাচ্ছে, ছেলেরা যদি ব্রত করেই তবে তা সংসারের মঙ্গল-টঙ্গল জাতীয় মেয়েলি তুচ্ছু ব্যাপারের জন্য নয়, তারা করবে ইশক-মহব্বত-পেয়ারের জন্য। কিন্তু এত প্রেম এবং তারপর বিয়ে - এসব পর্ব চুকলে যদি সন্তান না আসে, তবে ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকে ছোটা কিংবা ব্রত করার দায় কিন্তু মেয়েদেরই। বন্ধ্যা নারীর জন্য আশ্বিন মাসে জিতাষ্টমী ব্রতের বিধান। বন্ধ্যা পুরুষের জন্য বলা বাহুল্য এমন কোন ব্রত নেই। কারণ মর্দ কো যেমন দর্দ নেহি হোতা, তেমনি পুরুষমানুষ তো বন্ধ্যা হয় না!
তবে দুর্গার সেজুঁতি করা নিয়ে একটা খটকা আছে। বোশেখ মাসে সেজুঁতি করে না বলে সর্বজয়া দুর্গাকে অভিযোগ করছে, কিন্তু আদপে সেটি বৈশাখের ব্রতই নয়, সেটি অঘ্রাণের ব্রত। বিভূতিভূষণ সেটা জানতেন না - তা হওয়া খুব অসম্ভব মনে হয়। এটা একান্ত কুমারী মেয়েদের ব্রত। লেখাই আছে – ''এই ব্রত পালনে কুমারীগণের সর্ববিধ মনস্কামনা পূর্ণ হয়। কার্তিক সংক্রান্তি হইতে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত প্রতিদিন বিকালে সেজুঁতির পূজা করিবে।''
বাংলার ব্রতকথায় সারা বছর জুড়ে যেসব ব্রত চালু আছে তার মধ্যে সেজুঁতির চমৎকারিত্ব আছে। এখানে অন্য ব্রতের তুলনায় ঘরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি - ৫২ টি। সেই ৫২ ঘরে ছড়িয়ে আছে কুমারী মেয়েটির ভবিষ্যৎ নারীজীবন। সেখানে আছে মেয়েদের ছাঁচে ঢালা জীবনের আবশ্যিক জিনিসপত্র - বঁটি, খ্যাংরা, আম কাঁঠালের পিঁড়ি, আয়না, কাজললতা, বেড়ি, পানের বাটা, সিন্দুরচুপড়ি, রান্নাঘর। এ যুগের কিশোরীর বার্বি ডল হাউসের দেশজ সংস্করণ যেন – আজকের এই পুতুলগুলোতেও তো ঝাঁ-চকচকে মোড়কে মেয়েদের সাজুনি-গুজুনি-স্বামীসোহাগিনী হওয়ার কথাই চুপি চুপি বলে দেওয়া হয়।
মেয়েদের ব্রতকথা কিন্তু এর একটু বেশি কিছু বলে। যখন পশ্চিমে ইকোলজি-র ধারণা তৈরিই হয়নি সেই সময় বাঙালি মেয়েরা প্রতি বৈশাখে পৃথিবীপূজা ব্রত করেছে। এই ব্রতের ফলাফল হিসাবে লেখা আছে, “আমরা সবাই পৃথিবীর উপর বাস করি। মা যেমন সন্তানের অত্যাচার বুক পাতিয়া নেন, পৃথিবীদেবীও তেমনি আমাদের শত অত্যাচারেও বিচলিত হন না। যে পৃথিবীমাতা আমাদের এত করেন, তাহাকে সন্তুষ্ট রাখিলে সংসারের মঙ্গল সাধিত হইয়া থাকে।”
এত সুন্দর যে ব্রতের উদ্দেশ্য, তার মন্ত্রটি কিন্তু সেই নারীজীবনের চরম পরাকাষ্ঠার ছাঁচেই ঢালা-
“এসো পৃথিবী, বসো পদ্মপাতে,
তোমার পতি শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম হাতে
তিনি বৈকুণ্ঠেশ্বর নারায়ণ, আজকে পূজব তার দু’চরণ
খাওয়াব ক্ষীর, মাখন, ননী যেন জন্মে জন্মে হই রাজার রাণী
নাওয়াবো দুধে মাখাব ঘি জন্মে জন্মে হব রাজার ঝি।।”
কার্ত্তিক মাসে যমপুকুর ব্রতে পুকুরে ও গাছে জল দেবার প্রথাও আছে। এ দুটিও পরিবেশ রক্ষায় মেয়েদের সদর্থক ভূমিকা তুলে ধরে নিঃসন্দেহে। মনে পড়ে যায় হালে আমাদের দেশের ‘চিপকো’ বা কেনিয়ার ‘সবুজ বন্ধনী’ আন্দোলনে মেয়েদের বিশেষ অবদানের কথা। এই ব্রতের ছড়া দুটিতে যথেচ্ছ পাখি মারা, পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার অতি জরুরি প্রসঙ্গও আছে, কিন্তু গরুর রচনা শ্মশানে যাবার মতো ঘুরে ফিরে সেই বাপ ভাই বা স্বামীর উন্নতি কামনাও রয়েছে -
পুকুরে জল দেবার ছড়া
সুষনি কলমি ল ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে
মারল পক্ষী, শুকোয় বিল
সোনার কৌটো রূপোর খিল
খিল খুলতে লাগল ছড়
আমার বাপ-ভাই(বা স্বামী)হোক লক্ষেশ্বর।।
গাছে জল দেবার ছড়া
কালো কচু সাদা কচু ল ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে
...
খিল খুলতে লাগল ছড়
আমার বাপ-ভাই হোক লক্ষেশ্বর
লক্ষ লক্ষ দিল বর
ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর।।
আবার সেজুঁতি ব্রতের ছড়াতে বারবার আসে সতীন প্রসঙ্গ -আয়না: আয়না আয়না আয়না সতীন যেন হয়না
উদবেড়ালী: উদবেড়ালী খুদ খা স্বামী রেখে সতীন খা
বেড়ি: বেড়ি বেড়ি বেড়ি সতীন বেটি চেড়ি
ছাতা: ছাতা ছাতা ছাতা খা সতীনের মাথা
পাখি: পাখি পাখি পাখি সতীনকে ঘাটে নিয়ে যায় তেতলায় বসে দেখি
কুলগাছ: কুলগাছটা ঝাঁকড়ি সতীন বেটি খেঁকড়ি
খট্টা ডুমুর:
খট্টাডুমুর মতো মাজাখানি
হই যেন স্বামী সোহাগিনী
হিংসেয় মরে সতীন কানি
দিনরাত পড়ুক চোখে পানি
তালগাছ: তালগাছেতে বাবুই বাসা সতীন মরুক দেখব খাসা
থুতু ফেলা: থুতকুড়ি থুতকুড়ি সতীন বেটি আঁটকুড়ি
ব্রতকথার একটি বৈশিষ্ট্য যদি ‘সতীন-ফিক্সেশন’ হয়, অন্যটি তবে ‘সাত-ভাই ফিক্সেশন’। প্রায় সব ব্রতেই দেখতে পাই সাত ভাইয়ের বোন হবার আকুতি -
পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা, কে পূজেরে সকাল বেলা
আমি সতী ভাগ্যবতী সাত ভায়ের বোন লীলাবতী
জল ঢালি তুলসীবিল্বমূলে শ্বশুরকুল ভরুক ফলে-ফুলে
পুণ্যিপুকুরে ঢালি জল বাপ-শ্বশুরের হক মঙ্গল
এ পূজলে কি ফল হয়? বাপের দুঃখ কভু না রয়
স্বামীর মঙ্গল অচিরে হয় সাবিত্রী সমান সতী হয়
সব ব্রতকথাতেই ঘুরেফিরে এক গল্প। সাত ভাইয়ের কোলে এক বোন। অর্থাৎ সাত সাতটি ছেলে হবার পর ‘ফর-আ-চেঞ্জ’ একটি মেয়েকে জায়গা দেওয়া যায়। আবার সে মেয়েটিও ঠিকঠাক মেয়ে হয়ে ওঠে যদি সে ব্রত করে।
এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম উমনো ঝুমনো। গরিব বামুনের ঘরে তারা মোটে দুটিই বোন। সৎমা নয়, কিছু নয়, তবু তাদের জঙ্গলে ছেড়ে এসেছিল তাদের বাপ, দুটো পিঠে খাবার অপরাধে। এ বড় ভয়ানক গল্প। নিজের জন্মদাতা পিতার হাতে কন্যা ধর্ষণ ও অসহায় মায়ের তা মুখ বুজে মেনে নেওয়ার খবর মিডিয়ায় প্রায়ই আসে, উমনো ঝুমনো যেন এক বিন্দুতে সেই বিষাদসিন্ধু দর্শন। এই গল্পটির মধ্যে মেয়েদের জীবনে অরণ্য ও সূর্যের ভূমিকা খুব চমৎকার উঠে এসেছে, যা অতি আধুনিক ইকো-ফেমিনিজিমের অনুধাবনের বিষয় হতে পারে।
জঙ্গলে হিংস্র শ্বাপদের মুখে কচি মেয়ে দুটিকে ফেলে বাপ যখন চলে গেল, তখন তারা বটবৃক্ষকে মিনতি করে বলেছিল
"হে বটরূপী নারায়ণ তুমি দু-ফাঁক হয়ে যাও, আমরা আশ্রয় লাভ করি"
বৃক্ষ দু-ফাঁক হয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর তারা ইতু পুজো করে অশেষ ধনের অধিকারিণী হল।
অগ্রহায়ণ মাসের এই ইতুব্রত আসলে সূর্যের পুজো। ‘ইতু’ কথাটি এসেছে মিত্র থেকে। আর অসূর্যম্পশ্যা মেয়েদের সূর্যের থেকে বড় মিত্র আর কে আছে? এখানে লক্ষ্যণীয় যে উমনো ঝুমনো নিজেরাই বুদ্ধি আর সাহস দিয়ে বিপদের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল আর তাদের প্রার্থনায় অন্য কিছু না, ছিল বাপ-মার দুঃখ ঘোচাবার ইচ্ছে। সেই হিসেবে বলতে পারি বাংলার ব্রতকথায় নারীর ক্ষমতায়নের এটাই প্রথম প্রতিশ্রুতি। কারণ এই ব্রতের ফলাফলে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ‘এই ব্রত করিলে নারীগণ সুখ-সম্পদের অধিকারিণী হন’। আর, সবচেয়ে বড় কথা, সেই সুখ-সম্পদ তাদেরই নিজস্ব অর্জন।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply