কব হ্যায় হোলি?
0 524আজকাল বসন্তকালে প্রেমের উৎসব একের অধিক। আমরা যারা আটের দশকের শেষাশেষি প্রেমের ফাঁদে প্রথম পড়েছিলাম তখন আমাদের ছিল কেবল ফাগুন মাসের সর্বনাশা দোলযাত্রা। সুগন্ধী আবির, বুকের মধ্যে এক খাবলা ধুকপুক, একটা সা-যোয়ান চাঁদ আর মনকেমন করা বাতাস। আজ দোলযাত্রার ‘দিন গিয়াছে’। তার একছত্র আধিপত্যে থাবা বসিয়েছে ভ্যালেন্টাইন’স ডে। প্রেমের উদযাপন মন্দ কিছু নয়। আরও উৎসব আসুক। প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাক মানবসমাজ। আপত্তির কিছু নেই।
কিন্তু দোলযাত্রা বা হোলি নামক রঙিন প্রেমের উৎসবে একখানা নারী নিধনের মুখবন্ধও আছে। তা ভুললে চলবে কেন?
হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকাকে আনতাবড়ি মরতে হল কারণ বিষ্ণুকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল অসুরদের রাজা হিরণ্যকশিপু। দেবতার সঙ্গে টক্কর? হয় নাকি? মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে গেল।
প্রেডিক্টেবল স্টোরি লাইন! কাঙালের ক্ষমতায়নমেনে নেওয়া গেলেও অসুর মানে বদের অবতার। গল্পের শুরুতে তাকে এট্টু ক্ষমতার মায়া দেওয়া হয়েছে মানে সে নিজেকে দেবতা ভাববে? আসপদ্দা তো কম নয়!
তা সে যাক। হিরণ্যকশিপুকে শেষ পর্যন্ত মরতেই হত।
কিন্তু বোনটাকে মরতে হলো কেন? দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের এ এক মহাকাব্যিক বাই-প্রোডাক্ট বটে! নানান মহাকাব্যে এই মেয়ে পোড়ানোর ন্যারেটিভ! দহনের আগে গুছিয়ে বদনাম দেওয়া হয়ে থাকে। হোলিকা পোড়ানোর সাফাইও বুনে দেওয়া হলো গপ্পে। আর সেই হোলিকা দহনের উৎসব হলো মূল অনুষ্ঠানের মুখড়া। স্টার্টার। গো-বলয়ের ছোটি হোলি।
মেন মেনুতে রঙ আর প্রেম।
কৃষ্ণ আর রাধার প্রেম।
কিন্তু আমরা সেই লীলাকাহিনিতে না ঢুকে বরং সারথী কৃষ্ণের আখ্যানটিতে একটু উঁকি মারি।
কারণ, সিনেমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে গেলে ‘দর্শন’-এর ব্যাখ্যা অনস্বীকার্য। সে প্রসঙ্গেই গীতার প্রথম চ্যাপ্টার এসে পড়ে।
হিন্দু মাইথোলজিতে কোনো জাজমেন্ট ডে বা কায়ামাতের ধারণা নেই। তাই গীতাকে কৃষ্ণ কোনো ‘কমান্ডমেন্ট’ দেন না। কৃষ্ণ কেবল জগতের আর্কিটেকচারটা অর্জুনকে বুঝিয়ে দেন। সেখানে কোনো বিচারের ঊর্ধে উঠে, কেবল নজর বা ‘দর্শন’ করতে বলেছেন। এই ‘দর্শন’-এর ভাবনা আমাদের বেদেও আছে। আছে পুরাণে। তাই হিন্দু মন্দিরে ভক্ত চেয়ে থাকে মূর্তির পানে। অপর দিকে মূর্তিও চেয়ে থাকে ভক্তের পানে। পলকহীন।
সিনেমায় এই ‘দর্শন’ বিষয়টি আসে অনেক মাত্রায়। সেখানে দর্শন ছড়িয়ে আছে নানান স্তরে। এবং অবশ্যই তা বিচারবহির্ভূত নয়। দর্শক দর্শন করছে পর্দায় ঘটে চলা কাহিনি। কিন্তু আসলে সে দেখছে ফ্রেম। ফ্রেম নির্মাণ করেছে ক্যামেরার ‘দর্শন’।
ক্যামেরার দর্শনে লুকিয়ে আছে পরিচালকের নিজস্ব দর্শন।
মহাভারতের অন্য একটি আখ্যান টেনে এই ব্যাপারটা বোঝানো যেতে পারে।
মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রটি ‘দর্শন’ করছেন যে অন্ধ ভদ্রলোক, তাঁর নাম ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি প্রকৃত অরথে দর্শন করছেন না। এই কারণে নয় যে তিনি অন্ধ। তিনি দর্শন করছেন না কারণ তিনি বিচারের ঊর্ধে উঠতে পারেননি। মোহ, মায়া, ক্রোধ, ক্ষোভ, হিংসা ও স্মৃতি তাঁর বিচারবোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই তাঁর কোনো ‘দর্শন’ নেই।
বাঙালি হিরণ্যকশিপু বনাম ঝাড়পিটের অংশটা তেমন আপন করেনি। কিন্তু দোলপূর্ণিমার আগের দিন ‘বুড়ির ঘর পোড়ানোর’ নাম করে কাঠকুটো জ্বেলে জম্পেশ হইচই করে।
অর্থাৎ গো-বলয় বা নো-গো-বলয়, উৎসবে নারীনিধন ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে।
তবে মূল অনুষ্ঠানটি প্রেমেরই। সেদিন ফাগুনের নবীন আনন্দ! মাংস পোড়া খোশবাই সেদিন পাওয়া যাবে না। এমনিতেই বাঙালির মাথা খেলেন রবিবাবু। তাঁর আলখাল্লার ওম নিতে বাঙালি আজো শান্তিনিকেতনে যায় বসন্ত উৎসবে। ডাব-চিংড়ি আর ভদকা খেতে খেতে ‘হোলি হ্যায়’ বলে ফেলে জিভ কাটে। ছিঃ! ওসব আনকালচার্ড কাউবেল্টের উচ্চারণ। আমরা অন্যরকম। আমরা শৈল্পিক। আমরা ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’!
হিন্দি মূলধারার ছবিও হোলির ফ্রেমে প্রেম দিল। ওদের বাজারটা ধরতে হয়। বাজারে প্রেমের মার নেই, আর রঙ খেলার নামে নায়ক ও নায়িকার বিস্তর বিস্তারা দৃশ্য দেখিয়ে ফেলা যায় বিছানায় না শুইয়েও।
যৌবন ও যৌনতা। ভাঙ ও ভনিতাহীন শরীর। ভানু সিংগিকে ফেল মারিয়ে দেওয়া গানের রগরগে লাইন। বালাম পিচকারি জো তুলে মুঝে মারি!
সোজাসাপটা। ধর তক্তা মার পেরেক। পরত নেই। পানসেই বলা যায়।
তার চেয়ে আমি বরং একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। ১৯৭৫। শোলে।
গত চল্লিশ বছরে সারা পৃথিবী জুড়ে এ ছবি যা ব্যবসা দিয়েছে, সেটা মাথায় রাখলে এ ছবি মেনস্ট্রিমের পিতামহ। মূলধারার ছবির যা যা ফর্মুলা সব বোনা ছিল এ ছবিতে। কিন্তু তার অধিকও কিছু ছিল। দুই আউটসাইডারের নিরুচ্চারিত প্রেম ছিল। আর সে প্রেমের প্রেক্ষাপটে ছিল এক চিলতে হোলি।
আকিরা কুরোসাওয়ার সেভেন সামুরাই দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রমেশ সিপ্পি, সন্দেহ নেই। বাবার (জি.পি. সিপ্পি) টাকায় ছবি বানাতে এসে তিনি আভা-গার্দ ঘরানার সাথে পাঞ্চ করে দিলেন ওয়েস্টার্ন জনরা (genre)।
খাপে খাপ নাও হতে পারত। হল। কারণ রমেশ সঙ্গে পেলেন দ্বারকা দিভেচা নামক এক সিনেমাটোগ্রাফার। তাই সাবালক ‘ইন্ডিয়ান-ওয়েস্টার্ন’ এই ছায়াছবিতে মশলা ছাড়াও থাকল লম্পের মায়াবী আলোয় এক বিধবার মুখ। যুবতী ও সুন্দরী। আর তার সাথে আপাত নিরাসক্ত, খানিক বিষণ্ণ চোর যে রাতের ওম নিতে নিতে মাউথঅর্গানে তোলে বিষাদের সুর! নীলচে রাত। ভাঙনের পথে আসা পথিক। ভারতীয় বিধবার ধপধপে সাদা অঙ্গবস্ত্র ও নিভু নিভু হলদেটে আলো।
কাট। কাট। কাট।
বিধবাটির নাম রাধা। কি বাঙ্ময় নাম! অথচ সারা ছবি জুড়ে সে তার প্রেমিক জয়ের সাথে একটি শব্দও বিনিময় করেনি! জয় তাকে শাদি করতে চায় শুনে তার মুখে বুঝি একটা রেখা কেঁপেছিল। সেই ভঙ্গুর কাঁপন ক্যামেরায় ধরেই শটটা কেটে দিলেন পরিচালক।
দুটি বিপরীতধর্মী জুটি। ভিরু-বাসন্তী বনাম জয়-রাধা!
ভিরু আর বাসন্তীর প্রেমে শব্দের প্লাবন। হুল্লোড়, দুষ্টুমি, খুনসুটি, নাচ, গান, আলিঙ্গন! মেনস্ট্রিম প্রেম! গোলাপ ও টেডি!
সেই কমার্সের মহাসড়কেই পা রেখেছে চোর আর বিধবার প্রেম। সে প্রেম জুড়ে নৈঃশব্দের চরাচর। ছায়া ছায়া আলো। আর হোলির উদ্দাম আনন্দ-মাঝে এক অপূর্ব বিষাদের ফ্রেম!
হোলির দৃশ্যটি নিয়ে আরও অকপট হওয়ার আগে একটি বইয়ের উল্লেখ করব। সমাজনীতির বই। সে বই থেকে তিনটি থিয়োরি ধার নেব।
বইটির নাম The Presentation Of Self In Everyday Life। এরভিং গফমানের লেখা।
তিনটি থিয়োরি নীচে দেওয়া হল :
Front-stage behavior is the display meant for 'public' consumption. This depends on the audience, of course, and it is meant to make oneself look good. Backstage behavior is closer to the real self, less varnished, less an act.
Civil inattention is the process whereby strangers who are in close proximity demonstrate that they are aware of one another, without
imposing on each other – a recognition of the claims of others to a public space, and of their own personal boundaries.
Impression management is a conscious or subconscious process in which people attempt to influence the perceptions of other people about a person, object or event. They do so by regulating and controlling information in social interaction.
রাধার দর্শক কে? আর রাধা কাকেই বা দর্শন করে?
দুটি প্রশ্নেরই উত্তর ‘আমরা’।
যাদের আছে নিজস্ব বিচারসঞ্জিত দর্শন।
তাই রাধার Front-stage behavior-এ ‘ভালো মেয়ে’ হয়ে ওঠার দায় আছে। সে বিধবা। তার আছে look good for public consumption-এর দায়।
আর Backstage behavior-এ তার closer to the real self-এর কোনো সুযোগ নেই কারণ তার সামনে ক্যামেরা রোলিং! যতক্ষণ না পরিচালক ‘কাট’ বলছেন।
হোলির দৃশ্যে পুরো গ্রাম আনন্দে মাতোয়ারা। বাসন্তী চূড়ান্ত ভালো গান গায়। নাচেও। হোলির দিন দুশমনও এসে ‘গলে লগ যাতে হ্যায়’ বলে বাসন্তী ভিরুর গলাও জড়িয়ে ধরছে নাচের ফাঁকে ফাঁকে!
সব চরিত্র মাটির ‘পরে! কেবল রাধা অন্যত্র! তার অনেক উঁচুতে অবস্থান।
একটিমাত্র শটে সে দূরের মানুষ হয়ে দর্শন করছে গ্রামবাসীর আনন্দ। তার মুখ ভাবলেশহীন। তার নেই কোনো ক্ষোভ। নেই কোনো আকাঙ্ক্ষা। এই বুঝি গীতার চ্যাপ্টারের কৃষ্ণের দর্শন! অ-ধৃতরাষ্ট্রীয় দর্শন! রাধা ও কৃষ্ণের দর্শনগত মিলন!
উল্টোদিকে রাধার দর্শক আমরা, গ্রামবাসীরা। যারা আছি সমতলে।
জয়ও বাকিদের সঙ্গে সমতলেই! তাকে রাধাকে দেখতে হলে চোখ তুলতে হয়। মাথা ঘোরাতে হয়। আর নাচ থামিয়ে দু দণ্ড স্তব্ধও হতে হয়। তখন ফ্রেম জুড়ে শুধু সে আর রাধা। নাচ-গান-হুল্লোড় তখন ব্যাকফুটে! ব্যাকগ্রাউন্ডে! গ্রামবাসীদের কেউ রাধাকে যেন দেখতেই পাচ্ছে না! গ্রামের হিন্দু বিধবা যে আদতে একজন আউটসাইডার! তাই অদৃশ্য!
এর আগে জয়-রাধাকে আমরা দেখেছিলাম এক ফ্রেমে এক মায়াবী রাতে! সে রাতেও ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল সংগীত। মাউথঅর্গানের সুরের মূর্ছনা কেঁদে কেঁদে আছড়ে পড়ছিল ফ্রেম জুড়ে। আত্মরতিমগ্ন চোর ও বিধবা দেখছিল না একে অন্যকে।
পাঠক মনে করতে পারেন একটু আগে গফমানের Civil inattention-এর কথা বলছিলাম। মেনস্ট্রিম ছবিতে মেনস্ট্রিম হিন্দু একটি উৎসবে এইভাবে আউটসাইডারের (বিধবা ও চোর) প্রেমের দৃশ্য যে আঙ্গিকে বুনে দেন সিপ্পিজী, তাতে কাব্যময়তা ছাড়াও সমাজনীতির পাঠ থেকে যায়।
তাই চল্লিশ বছর পরেও ভারতীয় সিনেমায় হোলি বলতেই জয়-রাধা মনে পড়ে যায়!
জয় শেষ পর্যন্ত গ্রামের ইনসাইডার হতে পেরেছিল। রাধা হয়তো জয়ের স্ত্রী হয়ে আউটসাইডারের তকমা ঘোচাতে পারত। কিন্তু মৃত্যু এসে ওদের প্রেমকে দেয় অমরত্ব।
আমরা দর্শক মথিত হই এই চূড়ান্ত বিয়োগে।
এই আমাদের, গ্রামবাসীদের Impression management!
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply