• ইতিহাসে মেয়েরা ও স্কুলস্তরে সিলেবাস


    0    133

    September 5, 2018

     

    -“ইতিহাসের প্রশ্ন এবার কে করছেন ম্যাডাম?”

    -“ভালো করে নারীদের ভূমিকা টা পড়ে নিবি। একটা তো লেগেই যাবে!”

    ইতিহাসে নারীদের ভূমিকা নিয়ে যে চ্যাপ্টারে যা আছে তা নিয়ে মহিলা শিক্ষিকা প্রশ্ন করবে এমন অলিখিত সাজেশনের চল বিদ্যালয়ে বরাবর। এবারে একটা মোক্ষম প্রশ্ন এসেই পড়ে - কেন সিলেবাসে জেন্ডার জরুরি? আর কতটাইবা তা সুনিশ্চিত করা যায় সিলেবাসে?

    শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের সহযোগিতাই বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে থাকে। মোটের উপর একটি সর্বভারতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি-র দ্বারাই স্কুলবই প্রস্তুত হয়ে থাকে। তবে ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কালানুক্রমিক কাঠামো যা কোনো ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ অন্তত সেই সময়কালের পরিধি পেরিয়ে যেতে পারেন না এবং প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ইতিহাস অবশ্যই একটা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এবারে প্রশ্ন সেই ইতিহাসের কালানুক্রমিক কাঠামোর। আসলে আমরা যে সামাজিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে তা মূলত বঞ্চনার। তাই জানা জরুরি ঠিক কোথায় মূল সত্যের ঝান্ডা গেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সত্যের মূল খুঁজে পাওয়া যাবে ধারাবাহিকভাবে লিখিত ইতিহাসে।

    প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি, এই ১২ বছরের অধ্যয়নে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী নিশ্চিত করতে পারে না আসলে নারীদের ইতিহাসে স্থান কোথায়। ইতিহাস বই এর ১০০ পাতার মধ্যে ৫ পাতা জুড়েও নারীদের আলাদা আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক ইতিহাস নেই। বিচ্ছিন্নভাবে রূপকথার গল্পের মত সে  জানতে পারে এক যে ছিল ম্যারি আঁতোয়ানেত, এক যে ছিল ঝাঁসির রানি, এক যে ছিল রাজিয়া সুলতানা, এক যে ছিল মাতঙ্গিনী বা এক যে ছিল কল্পনা দত্ত।

    রাণি ঝাঁসি রেজিমেণ্টে মেয়েরা

    প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাসে আদিম যুগ ও নানা সভ্যতার ধারণা, যুদ্ধ ও ধর্মের বাইরে বেশ কিছু মানচিত্র ও ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিতি হওয়া ছাড়া ইতিহাসের আলাদা করে কিছু অস্ত্বিত্ব নেই। ইতিহাসের নানা মহান ব্যক্তিত্ব যেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেখানে নারীদের অবস্থান দুই থেকে দশ লাইন। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রে বেশ কিছু মেয়েদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে ইতিহাসের গল্পের সূত্রধর হিসেবে, যেমন ফতেমা, সাবিনা, মীনা-র প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত হয়েছে  ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস গ্রন্থটি শুরু হচ্ছে ভারতে মুঘল শক্তির পতন ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির অনুপ্রবেশের ফলে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেখান থেকে। সূচিপত্রের নির্দেশিকা অনুসারে নয়‌টি অধ্যায় – ১) ইতিহাসের ধারণা, ২) আঞ্চলিক শক্তির উত্থান, ৩) ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, ৪) ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র, ৫) ঔপনিবেশিক শাসনের সহযোগিতা ও বিদ্রোহ, ৬) জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক বিকাশ, ৭) ভারতের জাতীয় আন্দোলনের আদর্শ ও বিবর্তন, ৮) সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশভাগ, ৯) ভারতী সংবিধান ও গণতন্ত্রের কাঠামো।

    গোটা বইতে কোনও পৃষ্ঠা বা ব্যবহৃত ছবি কোনও জাতীয় নেত্রীকে কেন্দ্র করে মুদ্রিত হয়নি। নেই তেভাগা আন্দোলনের কোনও নেত্রী বা শহীদের পরিচয়। রাণি ঝাঁসী বাহিনী-র অধিনায়িকা লক্ষ্মী স্বামীনাথন (সায়গল)-এর নামোল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। নবম –দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে নারীদের ভূমিকা নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই। সমাজ গঠনে তাদের হাতে হাত মেলানোর আলোচনা গায়েব। ভারতের সমন্বয়বাদী সংস্কৃতিতে এসে পড়েছে যৎসামান্য মীরাবাঈ প্রসঙ্গ, যা থেকে চার-পাঁচ লাইনের টীকার বেশী কিচ্ছুই লেখা সম্ভব নয়। কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে লক্ষীবাঈ উজ্জ্বল নয়। সুলতানিযুগে রাজিয়া পড়তে গিয়ে ছাত্ররা হোঁচট খায়। আসলে, যে ছাত্র পরিবারে মা বা মেয়েদের অবদমন দেখে এসেছে তার চোখে পুরুষের পোশাকে এক নারী সিংহাসনে বসত, অসিচালনা করত এসব বর্ণনা খানিক রূপকথাই মনে হওয়ার কথা! সুলতানি যুগের ইতিহাসে রাজিয়া কে তারা ব্যতিক্রমী বা বিচ্ছিন্ন ইতিহাসের দেহাংশ ভাবতেই। অন্যদিকে, আলাউদ্দিন খলজির রাজ্যবিস্তারে পদ্মিনীর উপাখ্যান খুবই অপ্রাসঙ্গিকভাবে উত্থাপিত, যার সাথে ছাত্রদের জ্ঞান বা যুক্তির বিকাশের কোন বাস্তব যোগ নেই। উত্তর-বৈদিক যুগ থেকে একটানা সেন যুগ পর্যন্ত সমাজে নারীদের অবস্থান উঁচুতে ছিল না এই ধারাবাহিক একঘেয়ে বর্ণনা ছাত্রদের নারীদের অবস্থা নিয়ে করুণা করতে শেখায়। নারীদের কৃতিত্ব তাদের কোথাও উৎসাহিত করে তোলার মত স্পেস পায় না সিলেবাসে। 

    একাদশ শ্রেণিতে সমাজের গতিময়তার প্রেক্ষিতে স্ত্রীধন ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে সামান্য কথাবার্তা রয়েছে। মিশরের রানি নেফারতিতি ফ্যারাওদের সমান ক্ষমতা ভোগ করতেন তার স্বামীর সাথে। ইতিহাসে তাকে এক ‘রহস্যময়ী’, ‘সুন্দরী’ নারী হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে যার মমি পর্যন্ত নিখোঁজ এই বলে ইতি টেনে দেওয়া আছে। ইতিহাসের পাতায় বলা আছে সিজার তার ‘রূপে মুগ্ধ হয়ে’ তাঁকে বিবাহ করেন, আবার আন্তনিও তার ‘রূপে মুগ্ধ হয়ে’ বিবাহ করেন। একজন সম্রাজ্ঞীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহার নিঃসন্দেহে অবমাননাকর। অন্যদিকে নারীদের  সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতেও একই চিত্র। রানী দুর্গাবতীর বর্ণনাতেও মুঘলদের হাতে নির্যাতন ও অসম্মানের থেকে নিজেকে বাঁচাতে নিজেই নিজেকে ছুরিকাহত করে হত্যার উল্লেখ রয়েছে কেবলমাত্র। নুরহাজানকে ‘অপরূপ রূপ-লাবণ্যের অধিকারী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইতিহাসে। দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে চতুর্থ অধ্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রাধান্যের প্রতিক্রিয়ায় জ্যোতিবা ফুলে বা আনি বেশান্তের কৃতিত্ব আরও বিস্তারে হওয়ার কথা ছিল!

    একজন নারী যে আসলে রূপের ডালি এবং সেটাই তার ব্যক্তিত্ব তথা নারীত্বের (বিবাহের?) মাপকাঠি, এ এক ভয়ানক ক্ষতিকর ধারণা যা ধীরে ধীরে পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে দিয়েও শিশুমনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। নারীর আত্মসম্মান বলতে কী বোঝায় তার ধারণা নিয়ে স্পষ্ট কিছুই বলা নেই। তাই তারা সেটাই শেখে যেটা ঠাকুমা-মা-মাসি শেখান। নারীর ব্যক্তিসত্তার উপর জোর দেওয়া, পরিবারে বা সমাজে একজন ছাত্র/ছাত্রী যে অবদমন দেখছে তার মূল কারণ ও বাস্তব বিষয়ে ধারণা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু সিলেবাসের পড়ায় সে কোথাও সেই সামাজিক অবস্থানের বিপরীত বা বিশ্লেষণাত্মক কিছুই দেখে না। উচ্চমাধ্যমিকের প্রজেক্টে ‘নারীবাদের ইতিহাস’ টপিক দেওয়া হলে ছাত্র বলেই ফেলে ‘ওয়াই করে কি হবে, অন্য টপিক দ্যান কেনে!’

    এটা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে ওঠা বিচারধারা যা সে অর্জন করেছে এই দেশের সমাজ, পরিবার এবং বলা বাহুল্য এমনকী সিলেবাস থেকেও! মেয়েদের ইতিহাস, তাদের অধিকারের লড়াই এর কথা জানা তার কাছে সময় নষ্ট হওয়ার সামিল। সিপাহী বিদ্রোহ বা ফরাসী বিপ্লবে নারীদের ভূমিকা সামান্য কয়েক লাইন মুখস্থ করলেই যেখানে নম্বর মেলে সেখানে এ নিয়ে আলাদা চিন্তা–চর্চার কী প্রয়োজন! অথচ, নারীদের সম্মান করার পাঠটা ছাত্রসমাজের কাছে সিলেবাসের মাধ্যমে পৌঁছতে পারত। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা-র গুরুত্ব বোঝার শিক্ষাটা তাদের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভীষণ প্রয়োজনীয় ছিল। নারীদের নিজেস্ব প্রতিভা ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে অর্জিত সাফল্যের কাহিনী পাঠ্যবইতে বর্ণিত থাকলে সহজ হত সেই বোধ গড়ে ওঠা। যে সমাজে প্রতিনিয়ত নারীদের ব্যক্তিত্বের বদলে শরীরের সৌন্দর্য্য ও বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদানের প্রথাগত স্বীকৃতি, সেখানে কিছুটা পরিবর্তন আগামীর ছাত্রছাত্রীরাই আনতে পারে, কিন্তু তারা সকলে যদি ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার তৈরী হয় তবে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?

    সিলেবাস নির্মিত হোক মানবিক সম্পদের যথার্থ বিকাশের কথা মাথায় রেখে। বিপুল সংখ্যায় মেয়েরা যারা হেলায় গৃহকোণের শোভা হিসেবে পড়ে রয়েছে তারা নিজেদের অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে শিখুক, মর্যাদা বজায় রাখতে শিখুক, তাদের মনোবল বাড়ুক এমন দৃষ্টান্তের অন্তর্ভুক্তি হওয়া দরকার সিলেবাসের বইগুলিতে। আগামী দিনে স্কুল স্তরের শিক্ষাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের আওয়াজ তুলতে সাহায্য করতে পারে এমন ভাবে তৈরি হোক স্কুলের সিলেবাস।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics