• মানুষ চেনার কর্মশালা : 'হিউম্যান লাইব্রেরি কলকাতা চ্যাপ্টার' বিষয়ে কিছু উপলব্ধি


    0    64

    February 2, 2019

     

     

    ‘চেনা সহজ নয়, চিনতে লাগে ভয়’... কলেজবেলার তুমুল প্রিয় গানের লাইনটায় সোৎসাহে মাথা আমরা সকলেই নেড়েছি হয়তো, কারণ বয়ঃসন্ধি সবে সবে পার করা সেই সময়টাতেই আমরা তো কিছু ঠেকে কিছু দেখে বুঝতে শিখছি, মানুষ চেনা সহজ মোটে নয়! কিন্তু আজ যুগখানেক পার করে এসে বুঝতে পারি, পংক্তির দ্বিতীয় অংশেই লুকিয়ে আছে সারসত্য – চিনতে লাগে ভয়।

    চেনা কঠিন, তাই চেনার এত আয়োজন। খোপে খোপে রেখে নাম ধাম বর্ণ সেঁটে শ্রেণিবিভাগ। আর সেই খোপের এতটুকু নড়চড় হলেই ভয়। সেই ভয় থেকেই সন্দেহ, সেই ভয় থেকেই অবিশ্বাস, সেখান থেকেই বিভেদ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, হত্যা। এই খোপগুলো ছোটবেলাতেই আমাদের চিনিয়ে দেওয়া হয়। আর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে দেওয়ালের উচ্চতাও। দেওয়ালের আড়াল থেকে আমরা অপরকে চিনি, এমনকী নিজেকেও। আর তাই দুই চেনাই রয়ে যায় অধরা।

    ২০০০ সালে দুই ভাই রনি এবং ড্যানি আবেরগেল-এর উদ্যোগে ডেনমার্কের কোপেনহ্যাগেনে শুরু হয়েছিল একটা ছোট্ট আন্দোলন, মানুষ চেনার। নাম ‘দ্য হিউম্যান লাইব্রেরি প্রজেক্ট’। মানব পাঠাগার। কুসংস্কার, মিথ, আর চেনা খোপের বাইরে বেরিয়ে মানুষকে চেনার উদ্যোগ। কী ভাবে হবে সেই চেনা? কথা ব’লে, এবং তার চেয়েও জরুরি, কথা শুনে। ১৮ বছর আর ৮৪ দেশ ঘুরে সেই আন্দোলনের হাওয়া এই শীতকালে এসে লেগেছে আমার শহর কলকাতায়। এক দিনের ইভেন্টে ১২ ‘জন’ বই-এর কথা শোনার আয়োজন ছিল গত ৬ জানুয়ারি। এই লেখা সেই ‘ইভেন্ট’-এর বিবরণী ঠিক নয়, বরং এক দিন এই পাঠাগারে কাটিয়ে এসে যে সব ছেঁড়া ছেঁড়া প্রশ্ন-কথা ইত্যাদি মাথায় জমা হল তাদেরই একটা সংহত রূপ দেওয়ার চেষ্টা।

    কেমন সে পাঠাগার? এই পাঠাগারে ‘বই’ হলেন এক এক জন মানুষ, আর বইয়ের উপাদান হল তাঁর জীবন। বইয়ের ‘প্রচ্ছদ’ ও ‘শিরোনাম’-এ থাকবে সেই মানুষটির অনন্যতার কিছু আভাসমাত্র। ‘পাঠক’ শুনবেন বইয়ের কাহিনী, প্রশ্ন তুলবেন, নিজের খোপে বন্দি ধ্যানধারণাকে যাচাই করে নেবেন। কথোপকথন হবে উন্মুক্ত, সব রকম প্রশ্নের থাকবে অবাধ অধিকার।

    মানুষকে শোনার, চেনার এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক। কারণ মানুষকে খোপে পুরে বিচার করার প্রক্রিয়াটিও তো রাজনৈতিক। খোপ অনুসারে বদলে বদলে যায় আর্থসামাজিক অবস্থান, বদলে যায় সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা। দেশের অর্থনৈতিক ডামাডোলের সময়ে ‘সংখ্যালঘু’ খোপে মানুষকে পুরে দিয়ে জনরোষের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, ‘মা’ খোপে ঢুকিয়ে যুগ যুগ ধরে নারীর ব্যক্তিসত্ত্বাকে বেঁধে রাখা যায় নিগড়ে। এই খোপ যখন ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের এই কাঠামোটিও। সহমর্মিতা আদ্যন্ত রাজনৈতিক একটি আবেগ, আর তাই যাতে মানুষ সহমর্মী না হয়ে পড়ে তার জন্য চেষ্টার অন্ত নেই বিশ্বসংসারে।

    এই প্রচেষ্টার সম্পূর্ণ উলটো মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে মানব পাঠাগার প্রকল্প, সহমর্মিতা তৈরিই যার লক্ষ্য। নারী তথা নারীবাদী হিসেবে তাই এই আঙ্গিকটি নিয়ে কৌতূহল জমা হয়েছিল। দুপুর ১২টা থেকে ৩টে সময়কাল। রবীন্দ্রতীর্থ অডিটোরিয়ামের পিছনের মাঠে রঙিন ছাতার তলায় গোল করে বসার জায়গা। ১২টি ‘শিরোনাম’ থেকে বেছে নিতে হবে দু’টি। পাঠের সময়সীমা বাঁধা, ২৫ মিনিট।

    মাদকাসক্তির অন্ধকার থেকে মূলস্রোতে ফিরতে চাওয়া এক মানুষ আমার প্রথম পাঠ। ছোটখাটো চেহারার তিতলিকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি শাড়িতে বিশেষ স্বচ্ছন্দ নন। আঁচল-খোঁপায় ব্যতিব্যস্ত, খোলামেলা ভয়ডরহীন ব্যক্তিত্বের সাক্ষী বহন করে তাঁর প্রাণখোলা হাসি। কথন শুরু হয়। আত্মপ্রত্যয়ী, ছটফটে মানুষটির শারীরভাষা আস্তে আস্তে অন্য গল্প বলতে শুরু করে। জানতে থাকি, ভাঙা পরিবারে একা একা সময়ের আগেই বড় হয়ে যাওয়া এক ভীষণ সংবেদনশীল মেয়ের গল্প। “ছোটবেলা থেকেই খুব সেন্‌সিটিভ ছিলাম জানেন তো, একটুতেই খুব আঘাত লেগে যেত।” আর এই আঘাত-যন্ত্রণার পৃথিবী থেকেই ক্ষণেকের মুক্তি দিত মাদক। চারপাশের পৃথিবী যত জটিল হতে থাকে, তার আঘাত এড়ানোর চেষ্টায় আরও আরও বেশি করে মাদকের ভুয়ো রঙিন জগতকে আঁকড়ে ধরার গল্প বলে চলেন তিতলি। ২৫ মিনিট শেষ হয়ে যায়, তাঁর কথা ফুরোয় না। সেশন শেষে তিতলি জড়িয়ে ধরেন তাঁর দুই শ্রোতাকে, ফোন নম্বর চেয়ে নেন নিজেই। জানান, এই প্রথম নিজের লড়াইয়ের কথা প্রকাশ্যে বললেন তিনি। লজ্জা, ভয় ও সামাজিক বাধার অনেকটা দুস্তর পথ এই ২৫ মিনিটে পেরিয়ে এলেন। ভালো লাগল তাঁর। 

    তিতলির এই ভালোলাগা রাজনৈতিক। কারণ তাঁর কথনও রাজনৈতিক। মাদকাসক্ত শুধু নয়, নারী হিসেবেও তিনি এ সমাজে প্রান্তিক, এবং সে কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিতে কেউই ছাড়েনি, সে তাঁর পরিবারই হোক বা প্রেমাস্পদ। তাঁর কথন খুব গোছানো নয়, বয়ান আগেপিছে ঘুরতে থাকে, ঘটনাপরম্পরা রক্ষিত হয় না। কিন্তু সব ছাড়িয়ে বারবার উঠে আসে একটাই কথা, কেউ সেধে যেচে মাদকাসক্ত হয় না। তিতলির কাহিনীতে সামাজিক লজ্জা আছে, কারণ সমাজের চোখে মাদকাসক্ত মানেই ‘ভিলেন’। মাদকাসক্তের ‘সংশোধন’ প্রয়োজন বলে দেগে দিলে যে সামাজিক অসংবেদনশীলতার পরিবেশ তাঁকে এই রাস্তায় ঠেলেছে তার সংশোধনের আর প্রয়োজন পড়ে না।

    ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ক্যারল হানিশ-এর যুগান্তকারী নিবন্ধের নাম ‘দ্য পার্সোনাল ইজ্‌ পলিটিকাল’। সেকেন্ড ওয়েভ নারীবাদের সূচনামুহূর্ত থেকে পরবর্তীকালে নারীবাদী রাজনীতির অন্যতম স্লোগান হয়ে উঠেছিল বাক্যবন্ধটি। ‘ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক’। পৃথিবীর যে কোনও কোণে যে কোনও সময়ে যে কোনও প্রান্তিক মানুষ যখন উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলেন, নিজের চারপাশের খোপের দেওয়াল ভেঙে নিজেকে উন্মুক্ত করে দেন, তাঁর সেই উচ্চারণ রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। দেওয়ালের আড়ালে যে শোষণ চলে তার খতিয়ান দেওয়ালের বাইরে এসে পড়লে তৈরি হয় সহমর্মিতার পরিসর। আর তাই দেওয়ালকে ‘ব্যক্তিগত’ নাম দিয়ে ভাঙ্গন থেকে দূরে রাখার সামাজিক প্রকরণ।

    ঠিক তেমনই রাজনৈতিক তনুশ্রীর কথন। আমার দ্বিতীয় ‘বই’ তনুশ্রী রূপান্তরিত নারী। জন্মেছিলেন দেহে পুরুষ লিঙ্গের পরিচয় বহন করে। খুব ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর শরীর পুরুষের হলেও মন নারীর। তবে শরীর-মনের এই দ্বান্দ্বিকতা তাঁকে প্রথম ধাক্কা দেয় কৈশোরে, যখন একটি জনপ্রিয় গানের প্রতিযোগিতায় তাঁকে অডিশনের আগেই ছেঁটে ফেলা হয় তাঁর গলা যথেষ্ট ‘পুরুষোচিত’ নয় এই অজুহাতে। চাকরি করতে গিয়ে ‘মেয়েলি’ হওয়ার অপরাধে ধর্ষিত হন, আবার ‘পুরুষ’ হওয়ার অপরাধে হাসপাতালে ধর্ষণের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু পেতে কালঘাম ছুটে যায় – কারণ “পুরুষের আবার ধর্ষণ হয় নাকি!” দীর্ঘ দিনের অধ্যবসায়ে টাকা জমিয়ে লিঙ্গ রূপান্তর, থিয়েটারে সুযোগ পাওয়া, কাজ শিখতে শিখতে ফিরে পাওয়া আত্মবিশ্বাস – তনুশ্রীর গল্প যথার্থই ফিনিক্সের পুনর্জন্ম মনে করায়।

    প্রশ্ন আসে শ্রোতাদের থেকে, তনুশ্রী উত্তর দেন হাসিমুখে। এক পুরুষ প্রকাশ করেন, তনুশ্রীর মত যৌন হেনস্থা তাঁরও ঘটেছিল, কাউকে কোনও দিন বলার সাহস পাননি। কথন শেষে ৫-৬ জন শ্রোতার ছোট্ট দলটির মধ্যে দেখি অদ্ভুত বন্ধুতার এক পরিসর তৈরি হয়েছে। সবাই সবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, জড়িয়ে ধরছেন কেউ কেউ, কারও চোখে জল। এঁদের অনেকেরই সে দিন অনেক ভুল ধারণা ভেঙেছে। ধাক্কা লেগেছে অনেক দিনের সযত্নলালিত সংস্কারে।

    সেই বদল কি এবার তাঁদের সামাজিকতায় চারিয়ে যাবে? একবেলার পরিসরে আরও একটু সহমর্মী কি সত্যিই হয়ে উঠতে পারলাম আমরা শ্রোতারা? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত খোঁজা বৃথা। তবে ব্যক্তিগতকে রাজনৈতিকের পরিসরে এনে উন্মুক্ত করলে একটা ধাক্কা তো পড়েই। শোনার একটা অভ্যাস তৈরি হয়। আমাদের দেশ-কালে সহমর্মিতা সহজে আসে না, তাকে চর্চা করতে হয়। তনুশ্রী, তিতলি ছাড়াও ‘বই’ যাঁরা ছিলেন, তাঁদের গল্প শুনতে না পারার আক্ষেপ থেকে যায়, আশপাশ থেকে সেই আক্ষেপ ধ্বনিত হতে শুনি অনেক শ্রোতারই গলায়। এই একবেলার অনুশীলনে সহমর্মিতার চর্চায় কিছুটা হলেও হয়তো এগিয়ে গেলাম আমরা, মানব পাঠাগারের শ্রোতারা।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics