আমি জানি আমার মৃত্যুর পিছনে কারা
0 108গৌরী লঙ্কেশের দেহে তিনটে বুলেট লাগে, এবং উনি মারা যান। আমাকে সাতটা গুলি করা হয়েছিল, কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছি। আমি জানি আমি ভাগ্যবান। গৌরীর বীভৎস মৃত্যু আমাকে আরও কিছু সাদৃশ্যর কথা ভাবাল। আমি ওঁর পরিবার আর বন্ধুজন, আমার পাঠক, যে কোনও কেউ, এক জন মানুষকে, জানাতে চাই যে আমি যে এই রকম মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত দু:খ বেদনা, রাগ --- সব কিছু মেশানো একটা অনুভূতি, আমি সেটা বুঝি।
সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ পুরোপুরি সচেতন ছিলেন যে ওঁর শেষ আসন্ন কিন্তু উনি ওঁর খুনিদের চিহ্নিত করে যাননি। তিনি জানতেন ওঁর শত্রুরা কোনও একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বা দলের সদস্য নয়, একটা মানসিকতা আর আদর্শের অনুগামী। ব্যাঙ্গালোরে ৫ সেপ্টেম্বর ওঁর নৃশংস খুন সারা পৃথিবীর সাংবাদিকদের কানে বিপদঘন্টা বাজিয়েছে, বলেছে যে সাংবাদিকতা সবচেয়ে বিপজ্জনক পেশা হয়ে উঠছে, এমন কী বিশ্বের বৃ্ত্তম গণতন্ত্রেও।
আমি ওঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। আমার কয়েকজন সহকর্মী আর বন্ধুরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কারা মারল ওঁকে?’ এই প্রশ্নটা আমাকে পরলোকগত শ্রীলঙ্কান সাংবাদিক লসন্থ উইক্রেমাতুঙ্গের, যাঁকে ২০০৯ সালে কলম্বোতে খুন করা হয়, লেখা শেষ সম্পাদকীয়র কথা মনে করাল। উনি ‘সানডে লিডার’ সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন আর শ্রীলঙ্কার তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ রাজপক্ষের চক্ষুশূল ছিলেন। কারণ, লসন্থ তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়, অসামরিক তামিল নাগরিকদের ওপর শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনি দ্বারা মানবাধিকার ভঙ্গের সমালোচনা করেছিলেন। লসন্থকে অনেকবার শাসানো হয়েছিল, কিন্তু উনি শক্তিশালী শাসকদের কথা মেনে চলতে অস্বীকার করেন। শাসকগোষ্ঠীর সমর্থক কিছু সহকর্মী ওঁকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেছিল। তখন উনি লেখেন, ‘শেষ পর্যন্ত যখন আমাকে খুন করা হবে তখন সরকারই আমাকে খুন করবে’। এই সম্পাদকীয় ওঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। আট বছর পার হয়ে গিয়েছে। মাহিন্দ রাজপক্ষে আর শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নেই, কিন্তু উইক্রেমাতুঙ্গের পরিবার এখনও বিচারের অপেক্ষায়।
রাশিয়ান সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী আনা পলিতকোভস্কায়ার ঘটনাটাও এক। ওঁর চেচনিয়া থেকে পাঠানো রিপোর্ট নিয়ে রুশীরা খুশি ছিলেন না। ২০০৪ সালে যখন রুশ সেনারা আমাকে চেচনিয়ায় আটক করে রেখেছিল তখন আমার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, উনি আমাকে ছাড়াবার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০৬ সালে মস্কোতে নিজের বাড়ির সামনে ওঁকে গুলি করে মারা হয়। চারটে গুলি লেগেছিল। আনা যে রাশিয়ান শাসকদের আক্রমণের একজন প্রধান লক্ষ্য ছিলেন, এ কথা সবাই জানত। আনার মৃত্যু নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুটিনকে কিছু দিন জ্বলন্ত সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল, কিন্তু কোনও ক্ষতিই হয়নি। যাদের সন্দেহভাজন বলে ধরা হয়েছিল, তারাও পরে আদালতে ছাড়া পেয়ে যায়।
২০১৪ সালে করাচিতে আমার প্রাণহানির চেষ্টার কয়েক দিন আগে আমিও আমার সম্ভাব্য হত্যাকারী বলে তিন জনের নাম জানিয়েছিলাম। আমার কাঁধে, পেটে আর পায়ে ৬টা গুলি লেগেছিল। সপ্তম গুলিটি পিঠের নীচের দিকে লাগে। দুটো বুলেট এখনও আমার শরীরেই আছে। খুনের চেষ্টা নিয়ে তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন বসানো হয়। আমাকে বলা হয়েছিল এই কমিশনের সামনে না যেতে কিন্তু আমি ঠিক করি যে আমি আমার কথা বলব, কারণ সেটা আমার অধিকার।
তাই আমি সুপ্রিম কোর্টের জজদের সামনে আমার বক্তব্য রেকর্ড করলাম, একবার নয় দু’বার, আর যতটুকু পাওয়া গিয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে জোরালো প্রমাণগুলো দাখিল করলাম। আমাকে সুবিচার দেওয়ার বদলে নওয়াজ শরিফ সরকার আমার টিভি চ্যানেল, জিও নিউজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করল। কারণ জিও নিউজ আইএসআই সমেত পাকিস্তানি শাসন-প্রতিষ্ঠানের ভিতরকার শক্তিশালী অংশগুলির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিল।
গৌরী লঙ্কেশের বাবা ছিলেন সাংবাদিক। আমার বাবা কলাম লিখতেন আর লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক ছিলেন। গৌরীকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল একই।
কিন্তু একটা বড় তফাৎও আছে। আমি দাবী করতে পারি না যে পাকিস্তানে গণতন্ত্র আর মিডিয়া খুব জোরদার। কিন্তু গৌরী লঙ্কেশ বাস করতেন, কাজ করতেন, আর নাগরিক ছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে। তাহলে ঘটনাটা কি হল। ‘ওরা’ ওঁকে টার্গেট করার সাহস পেল কীভাবে? ওদের ভাবতে হল না যে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের বাসিন্দা গৌরীর সহকর্মীরা আর বন্ধুরা কী বলবে? ওদের কী ভয় নেই যে ওদের আসল চরিত্র প্রকাশ পেয়ে যাবে? আর ভারতীয় মিডিয়ার সামগ্রিক গণতান্ত্রিক বিবেক আর গর্বেরই বা কী হল? তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর এই সরাসরি আক্রমণের তারা কী ভাবে মোকাবিলা করছে?
গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পেছনে কারা আছে বোঝা খুব কঠিন নয়। ২০১৭-র মে মাসে দি ওয়্যার-এ প্রকাশিত ওঁর লেখাটা পড়ুন। উনি দেখিয়েছিলেন যে, “কর্ণাটকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তিনি বেশ কিছু কংগ্রেস, বিজেপি এবং জনতা দলের এমএলএ-দের সমালোচনা করেছিলেন, যাঁরা মিডিয়ার স্বাধীনতা দমন করতে হাত মিলিয়েছেন। তিনি শক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীর দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মিডিয়াকেও ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি লিখেছিলেন, কণ্ণড় ভাষায় নিউজ চ্যানেল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সব কিছু আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। এরাও ভিন্ন মতাবলম্বী বক্তাদের চিৎকার করে থামিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একই রকম উগ্র, মার্কামারা জাতীয়তাবাদীদের থেকেও বেশি দেশপ্রেমী আর মিনিটে মিনিটে ব্রেকিং নিউজ করার সময় সব কিছুকে বাড়িয়ে বলার প্রবণতায় ভোগে।
বিশিষ্ট কণ্ণড় লেখক কে মারুলিদাসাপ্পার মতে, যিনি একেবারে শিশু বয়স থেকে গৌরীকে চিনতেন, গৌরী কর্নাটকে সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে জোরদার ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন যারা দাভোলকর, পানসারে আর কালবুর্গিকে মেরেছে, তারাই এবার গৌরী লঙ্কেশকে মারল। এটা লক্ষ্য করা জরুরি যে দু’জন বিজেপি নেতার দুর্নীতি নিয়ে ২০০৮ সালে লেখা একটা প্রবন্ধের জন্য, গৌরীকে ২০১৬ সালে মানহানির মোকদ্দমায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া, লঙ্কেশের হত্যাকে ‘গণতন্ত্রের হত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রাণ হারানোর পরেও গৌরি সোশাল মিডিয়ায় ঘৃণার আক্রমণের শিকার হয়ে চলেছেন। কেউ কেউ ওঁর মৃত্যুকে কাশ্মীরি মিলিট্যান্ট বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আশিস সিং, যাঁকে টুইটারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফলো করেন, টুইট করেন: ‘বুরহান ওয়ানির পরে গৌরী লঙ্কেশকেও মারা হল, কী শোচনীয়’।
গৌরী লঙ্কেশের হিংস্র হত্যা ভারতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার মিডিয়ার জীবনে একটি দু:খের দিন। আমি, একজন পাকিস্তানি সাংবাদিক, আমার এক জন সহ-সাংবাদিকে যে চরম বলিদানের দাম দিতে হল, তাতে গভীরভাবে দু:খিত আর ক্রুদ্ধ। উনি আমাদের মতই ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। এই মতবাদ গোটা দুনিয়ার সাংবাদিকদের সমানভাবে শত্রু। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টের মতে, পাকিস্তান ও ভারত সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার জন্য ১০টি সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক দেশের মধ্যে পড়ে। দুটি দেশের পক্ষেই এটা লজ্জার বিষয়। অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়া, দক্ষিণ এশিয়ায় অঘোষিত সেনসরশিপ চালু করার বিপজ্জনক পন্থা হয়ে উঠেছে। এই ভাবে ছাড় পেয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশগুলিতে দুর্নীতি আরও বাড়বে। আমরা যদি দুর্নীতি আর উগ্রপন্থার থেকে রেহাই পেতে চাই তবে এই শয়তানদের বিরুদ্ধে যাঁরা আওয়াজ তোলেন তাদের সমর্থন করতে হবে। তাই গোরী লঙ্কেশের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা জরুরি। কেবল তাহলেই দুনিয়ার কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠান উইক্রেমাতুঙ্গে বা পলিতকোভস্কায়ার মত সাংবাদিকদের খুন করতে সাহস পাবে না, যাঁরা জীবিত অবস্থায় তাঁদের খুনিদের নাম জানিয়েছিলেন।
গৌরীর শেষ লেখা আর টুইট আমাদের বলে, ‘আমি জানি আমার মৃত্যুর পেছনে কারা।’ এরা শাস্তি পাক বা না পাক, আমাদের সমবেত দায়িত্ব হল, এদের খুঁজে বের করা আর চিহ্নিত করে নিন্দা করা। মিডিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদের সুরক্ষা বন্ধ হোক, সালাম গৌরী লঙ্কেশ।
অনুবাদ : শঙ্কর সেন
[মূল লেখাটি গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কোনো পাঠকের কাছে হামিদ মীরের ইমেল আইডি থাকলে আমাদের পাঠাতে পারেন। ধন্যবাদ]
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply