অতিমারীতে শিশুশিক্ষা ও নাগরিক সমাজ
0 172তবে কি এই দুই বছর ভারতের অধিকাংশ বাচ্চা কিছুই শেখার সুযোগ পাবে না? অনেকে হয়ত আর কোনোদিনই পাবে না, যা শিখেছে তাও ভুলে যাবে? আজ যাদের বয়স চার বা পাঁচ, নিরক্ষরতাই কি তাদের ভবিতব্য?
আমার কর্মজীবন কেটেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে। পদে-পদে অনুভব করেছি, তার ভিত্তিতে যে স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা তা কত উৎকটভাবে বৈষম্যমূলক ও বঞ্চনাকারী। ক্রমাগত মনে হয়েছে, এই রত্নগর্ভা রাজ্যের মানবসম্পদ নিয়ে আমরা হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছি।
অবসরের পর স্কুলশিক্ষা নিয়ে একটু জানার অবকাশ পেলাম। দু-তিনটি উৎসাহী ও সক্রিয় শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের সৌভাগ্য হল; তাছাড়া যুক্ত হলাম প্রতীচী ট্রাস্ট ও টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউণ্ডেশনের সঙ্গে। প্রতীচী ট্রাস্ট ফি-বছর শান্তিনিকেতনে প্রাথমিক শিক্ষক, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মীদের একটা বড় সমাবেশ করেন। সেখানে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও সমস্যা সম্বন্ধে প্রচুর শিখলাম। সবচেয়ে বড় কথা, জানলাম তাঁরা নিজেরা কতরকম উদ্ভাবন করছেন—শুধু শিক্ষাদানে নয়, সাধারণভাবে শিশুদের জীবন ও পল্লীজীবনে। দেখলাম চিন্তাগুলো কীভাবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।
এগুলো যে কেবল কথার কথা নয়, তা বুঝতে পারলাম বিভিন্ন জেলায় কিছু স্কুল ঘুরে। দেখলাম ‘শিক্ষা আলোচনা’ নামে প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠনটি নিজেদের খরচে ও উদ্যোগে নানা সমাবেশের আয়োজন করছেন; তাতে যোগ দিচ্ছেন সারা বাংলার উৎসাহী শিক্ষক। ‘সায়েন্স কমিউনিকেটর্স ফোরাম’ নামে বিজ্ঞান শিক্ষকদের সংগঠন একরাশ উদ্যোগ নিচ্ছেন, তার অনেকগুলি বেশ বড় মাপের ও নতুন ধরনের—কোনোওটি সরকারি সাহায্যে, কোনোওটি পুরোপুরি নিজেদের চেষ্টায়। উভয় সংস্থা বই ও রিপোর্ট প্রকাশ করছেন—কিছু সরাসরি শিক্ষণপদ্ধতি নিয়ে, কিছু শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত। সবগুলিই গঠনমূলক, নিছক নিন্দা বা অভিযোগ নয়। রাজনীতির কোনও আভাস নেই। এবং একটা সমাবেশেও দেখিনি শিক্ষকরা মাইনাপত্র দাবিদাওয়া নিয়ে একটা বাক্য উচ্চারণ করছেন। আলোচনার একমাত্র বিষয় শিক্ষাদান।
স্কুলগুলিতে গিয়ে কত রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে বলতে গেলে জায়গায় কুলোবে না। এক-একজন শিক্ষক কেবল স্কুল নয়, গোটা গ্রামের চেহারা পালটে দিয়েছেন—অবশ্যই গ্রামবাসীদের সক্রিয় সমর্থনে। বলা বাহুল্য, আমি গিয়েছিলাম সবচেয়ে উৎসাহী উদ্যোগী শিক্ষকদের স্কুলে। বহু জায়গার অবস্থা এমন নয়—কখনও কর্তৃপক্ষের দোষে, কখনও শিক্ষক বা স্থানীয় সমাজের, কখনও তিনটির মণিকাঞ্চন যোগে। তবে তেমনটা যে অবধারিত নয়, কত স্কুল নানা প্রতিকূলতার মধ্যে উজ্জ্বলভাবে সফল, কত শিক্ষক তাঁদের ‘জব ডেসক্রিপশন’ বহুগুণ ছাপিয়ে অসাধারণ কাজ করছেন, তা চোখে দেখে বুঝেছি।
সবচেয়ে বেশি বুঝেছি বাচ্চাদের দেখে। কতটুকু আর দেখেছি? সৌখিন ভাববিলাসের অভিযোগ উঠতেই পারে। তবে অনেক দিন ধরে সুযোগ পেলেই নিজের খেয়ালে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। আন্তর্জাল থেকে প্রচুর আকর্ষণীয় শিশুপাঠ্য বই নিখরচায় ডাউনলোড করা যায়, বাংলা সহ সব প্রধান ভারতীয় ভাষায় তথা ইংরেজিতে। এগুলি পাঠ্যপুস্তক নয়, কিন্তু বিষয়বস্তু, ভাষা, ছবি ইত্যাদি ধাপে-ধাপে বিভিন্ন পর্যায়ের শিশুদের উপযোগী করে তৈরি। বিশেষ করে ‘প্রথম বুকস’-এর ওয়েবসাইটে এমন বইয়ের রীতিমত সম্ভার আছে।
আশঙ্কা হয়, ভোটের উত্তেজনা, কোভিডের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ আর স্থানবিশেষে ইয়াসের তাণ্ডবে এই কর্মকাণ্ড অনেকটা ধুয়ে মুছে গেছে। খাস কলকাতায় পুরসভার স্কুলগুলিতে গত অক্টোবরের পর পাঠসামগ্রী বিতরণ বা পাঠনির্দেশনার আদৌ কোনও উদ্যোগ হয়নি। এই অমার্জনীয় অবহেলায় কর্তারা নির্বিকার, নির্বিকার নাগরিক সমাজ।
সদাশয় শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে ল্যাপটপে এই বইগুলি বাচ্চাদের অনেক দেখিয়েছি—ওদের চারদিকে ঘিরে দাঁড় করিয়ে, ওদের দিয়েই পড়িয়ে। ব্যাপারটায় ওরা মজা পায়, ল্যাপটপ থাকায় আরও বেশি। বরাবর দেখেছি, গোড়ায় হয়তো দু-চারটি বাচ্চা মুখ খোলে, কিন্তু এক ঘন্টার মধ্যে সকলে সমস্বরে যোগ দেয়, যারা অক্ষর চেনায় আড়ষ্ট তারাও একটু সড়গড় হয়ে ওঠে।
সপ্তাহে নিয়মিত মাত্র দু’ঘন্টা এভাবে খরচ করলে বাচ্চাদের সামনে একটা নতুন জগৎ খুলে যাবে। চাই শুধু একটা ল্যাপটপ। নেট সংযোগের দরকার নেই, আগে থেকে ডাউনলোড করে রাখা যায়। কিছু প্রাথমিক শিক্ষক সাধারণ সরকারি স্কুলে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই প্রচেষ্টায় সুন্দর ফল পাচ্ছেন। তাঁদের আমন্ত্রণে ‘প্রথম বুকস’-এর কর্মীরা কলকাতায় এসে কর্মশালা করে গেছেন।
লকডাউনের পর থেকেই মনে হচ্ছে, এই ছেলেমেয়েরা এখন কোথায়? ল্যাপটপের বাড়তি মজা দূরে থাক, ন্যূনতম লেখাপড়ার মত বৈদ্যুতিন সহায়তা কজনের আছে? থাকলেও তা কতটা কার্যকর হতে পারে? আমরা ধরে নিয়েছি, একটা স্মার্টফোন পেলেই কেল্লা ফতে। তাতে শিক্ষকের একতরফা বক্তৃতা শোনা যায়, ছাত্রের পক্ষে কিছু লেখা বা প্রতিক্রিয়া জানানো কতদূর সম্ভব? অথচ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র বাধ্য হয়ে তাতে পরীক্ষা লিখছে। আর বাচ্চারা? নিরিবিলি ঘরের বিরল সৌভাগ্য যদি জোটেও, ক্লাসে বসিয়ে যাদের একত্রে কিছু বোঝাতে বা করাতে উদ্যোগ লাগে, একা একা বসে তারা স্ক্রিনে মনোযোগ দেবে? পড়বে গুনবে গাইবে আঁকবে খেলবে? মাথায় কিছু ধরে রাখবে? এ বয়সে শেখার কার্যকর উপায় সমবেত বহুমাত্রিক অ্যাক্টিভিটি: শোনা-বলা-করার মধ্যে ফারাক নেই, সবটা একটাই সম্মিলিত ঘটনা।
যত প্রাথমিক শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করেছি, সকলে একমত যে অনলাইন লেখাপড়া অন্তত ওই বয়সে ফলপ্রসূ হওয়া অসম্ভব—রসদ আছে কি নেই সেটা প্রায় অবান্তর। তবে কি এই দুই বছর ভারতের অধিকাংশ বাচ্চা কিছুই শেখার সুযোগ পাবে না? অনেকে হয়ত আর কোনোদিনই পাবে না, যা শিখেছে তাও ভুলে যাবে? আজ যাদের বয়স চার বা পাঁচ, নিরক্ষরতাই কি তাদের ভবিতব্য?
মিড ডে মিলের সঙ্গে পাঠসামগ্রী বিলি করে উঁচু ক্লাসে খানিক উপকার হতে পারে; প্রাথমিকের শিশুদের কেবল অভিভাবকের নির্দেশে (যাঁরা প্রায়ই অল্পশিক্ষিত ও আজ বিশেষভাবে অভাবগ্রস্ত) কতটুকু হবে? কিছু রাজ্যে শিশুদের ছোট ছোট গ্রুপে সশরীরে শিক্ষাদানের একটা চেষ্টা হয়েছে। কর্ণাটকের ‘বিদ্যাগম’ প্রকল্পে তা হয়েছে সরকারিভাবেই। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে মন্ত্রীর আশীর্বাদে কিন্তু স্থানীয় বেসরকারি উদ্যোগে কয়েক লক্ষ বাচ্চা গেছে ‘লকডাউন স্কুলে’—তাও মোট ছাত্রসংখ্যার সামান্য ভগ্নাংশ। আশঙ্কা হয়, ভোটের উত্তেজনা, কোভিডের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ আর স্থানবিশেষে ইয়াসের তাণ্ডবে এই কর্মকাণ্ড অনেকটা ধুয়ে মুছে গেছে। খাস কলকাতায় পুরসভার স্কুলগুলিতে গত অক্টোবরের পর পাঠসামগ্রী বিতরণ বা পাঠনির্দেশনার আদৌ কোনও উদ্যোগ হয়নি। এই অমার্জনীয় অবহেলায় কর্তারা নির্বিকার, নির্বিকার নাগরিক সমাজ।
বরং গ্রামের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রে (সর্বত্র নয়) তুলনায় ভাল। সেখানে অভিভাবকগোষ্ঠী প্রায়ই একটু সোচ্চার ও উদ্যোগী। ফলে বহু শিক্ষক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়ে অন্তত কিছু শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
এই ব্যবস্থার মূল শরিক একদিকে অভিভাবক, অপর দিকে স্বেচ্ছাশিক্ষক। পরস্পরের প্রতি আস্থা বোধ করলে তবেই তাঁরা বাচ্চার দায়িত্ব দেবেন বা নেবেন। স্কুলের শিক্ষক যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন, পঠনপাঠনের পরামর্শ দিতেপারেন; কিন্তু তাঁর ভূমিকা অনুঘটকের, আর স্কুলের কোনও ভূমিকা নেই
তারও একটা মাত্রা আছে। আলাদা করে বা ছোট ছোট ভাগে ক’টি শিশুর দেখভাল করা যায়? সব শিক্ষক সমান দরদী নন, অনেকের ব্যক্তিগত অসুবিধাও আছে। বিলম্বে হলেও একটা চিন্তা তাই জোরদার হচ্ছে: কোভিডকালে শিশুশিক্ষার বিপর্যয় ঠেকাতে স্বেচ্ছাশ্রমের একটা আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কি?
আজ দুর্দিনে সমাজে একটা শুভ লক্ষণ নতুন দেখা যাচ্ছে। বহু মানুষ, বিশেষত ছাত্র-যুবারা, দুর্গতদের সাহায্যে একমনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকার ও রাজনীতির ছত্রছায়ার বাইরে সাধারণ নাগরিকদের এমন উদ্যোগ বহুকাল দেখা যায়নি। সেই ধাঁচে কি প্রত্যেককে অল্প ক’টি শিশুর লেখাপড়ার ভার নিতে উদ্বুদ্ধ করা যায়? এ কাজ সকলেই করতে পারে: যুবসমাজ, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, লকডাউনে ঘরবন্দী আরও কতজন।
‘আন্দোলন’ বললাম, কিন্তু সোচ্চার নাটকীয় কিছু করার দরকার নেই; কাজটা নিরিবিলিতে পাড়ায় পাড়ায় হতে পারে। শিক্ষকদের একটা গোষ্ঠীর মধ্যে এমন ভাবনা হচ্ছে জানি, হয়ত অচিরে প্রকাশ পাবে। প্রথমেই দরকার এই স্বেচ্ছাশিক্ষকদের জন্য বিশদ নির্দেশিকা তৈরি—কী শেখাবেন, কীভাবে শেখাবেন (ইচ্ছা করেই ‘পড়াবেন’ বললাম না): এঁরা তো প্রশিক্ষিত শিক্ষক নন। আরও অনেক ব্যাপার তাঁদের বোঝাতে হবে: মারধর গালিগালাজ নিষেধ, মিষ্টি খাওয়ানো নিষ্প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্লোগান-সাইনবোর্ড চলবে না। এবং ছিদ্রপথে কোচিং-টিউশনের পথ যেন না খুলে যায়।
দু’টি ব্যাপার বিশেষভাবে জরুরি। এক, কোনও অবস্থাতেই কোভিড বিধি একচুল শিথিল করা চলবে না। নিরাপদ দূরত্বে সব নিয়ম মেনে যে ক’টি বাচ্চা বসতে পারে, তাই বসবে। একজনেরও বিপদ ঘটলে তার দায় কে নেবে? সেই কারণেই দ্বিতীয় শর্তটা জরুরি। এই ব্যবস্থার মূল শরিক একদিকে অভিভাবক, অপর দিকে স্বেচ্ছাশিক্ষক। পরস্পরের প্রতি আস্থা বোধ করলে তবেই তাঁরা বাচ্চার দায়িত্ব দেবেন বা নেবেন। স্কুলের শিক্ষক যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন, পঠনপাঠনের পরামর্শ দিতেপারেন; কিন্তু তাঁর ভূমিকা অনুঘটকের, আর স্কুলের কোনও ভূমিকা নেই—সরকারি নিয়মে থাকতে পারে না।
কাজটা দায়িত্বের, কিন্তু একান্তভাবে সম্ভব। সন্তানদের লেখাপড়ায় এতদিন ছেদ পড়ায় অভিভাবক সমাজ উৎকণ্ঠিত, তাঁদের সহযোগিতা তাই আরও বেশি করে পাবার সম্ভাবনা। নিরাপদে ফলপ্রসূভাবে কী করে কাজটা করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষকগোষ্ঠী ইতিমধ্যেই ভাবছেন। ‘এবং আলাপ’-এর সহমর্মী শিক্ষকরাও সেই চেষ্টায় সামিল হতে পারেন, তাঁদের বর্তমান উদ্যোগকে সংযুক্তভাবে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply