• মেন উইল বি মেন : নজরে কেনউড ওয়াশিং মেশিন


    0    158

    April 3, 2019

     

    বিজ্ঞাপন সংস্থা বিজ্ঞাপন তৈরি করেন মানুষের (বাজারের) মনে ছাপ রেখে যেতে৷ পণ্য যদি ভাল বিককিরি হয় তাহলে কলকারখানার লাভ৷ বিজ্ঞাপন সংস্থারও লাভ৷ মুনাফা হবে কারখানার, মুনাফা হবে বিজ্ঞাপন সংস্থার! বাজারের পরিসর বাড়বে৷ ধনতন্ত্রের এটাই মূল কথা৷ বাজার বাড়া মানে বেশি বেশি মানুষকে বাজারমুখী করা৷ বেশি মানুষ যেটা দেখে খুশি হবে, সেটাই বিজ্ঞাপনের কাহিনিতে ঠুসে দেওয়া - এই সহজ সরল নীতি বিজ্ঞাপনের৷ আর তাই বিজ্ঞাপনের ভাষা বা গল্প দেখে আন্দাজ করা যায় মূলধারার সমাজের চিত্রটা৷

    ওয়াশিং মেশিন নামক কলটির বহুল ব্যবহার বেড়েছে ইদানিং৷ সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করার চেয়ে কলের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে মানুষের৷ কারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে৷ পাল্টে গেছে পণ্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও৷ চাইতে আজ আর আমাদের কুণ্ঠা নেই৷ বরং বেশি চাওয়াতেই এক রকমের ক্ষমতা প্রদর্শন লুকিয়ে আছে৷ টাকার ক্ষমতা দেখাতে আজ আর লজ্জা নেই৷ ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ নিয়ে যে সুখি সে আসলে একজন হেরে যাওয়া মানুষ! চাহিদা যখন আছে, যোগান তো তখন থাকবেই! এই চাহিদা-যোগানের পাটিগণিত নিয়েই তো বাজার! তাই থরে থরে পণ্যের যোগান!

    তবে পণ্যের যোগান আবার অধিক হয়ে পড়লে বাজারে পণ্যতে পণ্যতে লেগে যেতে পারে হাতাহাতি! ‘কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই’-এর হাহাকার তখন ছেয়ে ফেলে বাজার! সঁপিতে চাইলেই তো হল না! যার কাছে সমর্পণ করতে মরিয়া এ দ্রব্য, তার মনকে দ্রব করতে চাই কিছু কৌশল! এই কৌশলের নামই বিজ্ঞাপন!

    কথা হচ্ছিল ওয়াশিং মেশিন নিয়ে৷ এবার শুরু করা যাক কেনউড কোম্পানির ‘মেন উইল বি মেন’ বিজ্ঞাপন সিরিজ-এর আলোচনা৷

     

    বিজ্ঞাপন সংস্থাটির কাজ, আমরা আগেই বলেছি, মানুষকে বোঝানো – ‘কিনতে’ হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়! বিজ্ঞাপনটি বাজারে ছাড়ার পর, ওয়াশিং মেশিনের মার্কেট শেয়ার যেন বুক ফুলিয়ে বলতে পারে 'দ্যাখো আমি বাড়ছি মাম্মি!'

    দেখলেন মজা? আমার বক্তব্য বোঝাতে আমি কেমন ঝপাত ঝপাত ক’রে দু’টো পপুলার বিজ্ঞাপনের কপি চুরি করলাম! ব্র্যান্ড বিল্ডিং/পজিশনিং-এ এই ‘রিকল ভ্যালু’-র মূল্য অপরিসীম৷ কেনউড ওয়াশিং মেশিন এর বিজ্ঞাপনের আলোচনা হাটে ফেললেই লোকেরা যেভাবে হেসে উঠছে তাতে বুঝতে হবে এই ‘মেন উইল বি মেন’ কপিটি লোকেরা খাচ্ছে৷ বিজ্ঞাপন এর সার্থকতা এখানেই!

    অথচ এই পজিশনিং করায়ত্ত করতে পেরোতে হয়েছে প্যারাডক্স এর পাহাড়! কিরকম?

    দেখুন, ওয়াশিং মেশিন আদতে একটি ঘরেলু আইটেম৷ বিয়ার, গাড়ি, সিগারেট, বাইক, হাইকিং বুটস হলে তাও কথা ছিল! মাচো ইমেজ-এর মুচমুচে খানকয়েক পুরুষ জোগাড় করে ফেললেই হয়ে যেত কেল্লা ফতে! তা না! এ হল এমন এক সামগ্রী যা বাড়ির পুরুষটি ব্যবহারই করবে না! ব্যবহার করবে বাড়ির গিন্নি! এই স্টিরিওটাইপ মাথায় রেখেই বিজ্ঞাপনের গল্পটি বোনা হয়েছে! পণ্যটি না হয় মেয়েলি, কিন্তু পণ্যটি ক্রয় করার সিদ্ধান্ত কার হাতে? কেন, অবশ্যই ঐ পপকর্ণ খেতে খেতে "মেল বন্ডিং" -এ সামিল পুরুষটির হাতে! কারণ স্বামী রোজগার করেন৷ বাহির সামলান৷ স্ত্রী সামলান ঘর! সেখানেই তো তাকে মানায় ভাল! মহানুভব স্বামী কাপড় কাচার কল কিনেছেন, স্ত্রীকে ভালবাসেন বলেই না! যার হাতে ‘পার্স স্ট্রিং’, তার মন জুগিয়ে কপি লেখা তো অবশ্য কর্তব্য!

    অর্থাৎ এ ঘরেলু পণ্যের বিজ্ঞাপনের ‘টারগেট অডিয়েন্স’ পুরুষ! এই দ্বন্দ্বটির মোকাবিলা করতে তাই সাহায্য নিতে হয়েছে এমন এক ন্যারেটিভ-এর যা কালোত্তীর্ণ - টাইম টেস্টেড!

    কী সেই ন্যারেটিভ?

    মনে করুন গোপাল ভাঁড়ের সেই গল্প! যে সব পুরুষেরা স্ত্রীকে ভয় পায় তারা একটি লাইনে ঠেলাঠেলি করছে৷ অন্যদিকে একা এক খর্বকায় মানুষ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে! তাকে প্রশ্ন করা হল যে স্ত্রীকে কেন ভয় পায় না৷ সে দৃপ্ত কণ্ঠে বলল 'অত সত বুঝি না! বৌ বলে দিয়েছে, যেদিকে ভিড় সেদিকে খবরদার যাবে না!' এই ন্যারেটিভ সমানে চলিতেছে! সবাই ভালবাসছে৷ আর ভালবাসছে বলেই না নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিনভর হোয়াটসঅ্যাপ-এ 'বিবাহিত পুরুষ মানেই অত্যাচারিত, স্ত্রী-র ভয়ে ভীত' ন্যারেটিভ-এর জোক পাঠান!

    এই ন্যারেটিভের ভিতর এক অতি সূক্ষ্ম রাজনীতি ঢোকানো আছে! সে রাজনীতি হল নারীর আর আলাদা শক্তি বা ক্ষমতার দরকার নেই! তথাকথিত ক্ষমতায়ণ ছাড়াই সে পুরুষকে চালিত করে! একবার বৌ হয়ে যেতে পারলেই সে স্বামীকে অর্থাৎ প্রকারান্তরে পুরুষকে পায়ের তলায় রাখবে! বিয়ের পর পুরুষ তাই বৌ-এর ভয়ে কাঁপে! হাতের লোম খাড়া হয়ে যায়, বুক ধুকপুক করে! যেমন হচ্ছিল বিজ্ঞাপনের স্বামীটির!

    এইবার আসি এই বিশেষ বিজ্ঞাপনটির কাহিনির বিন্যাসে! গল্পের শেষটা যেভাবে হল, তাতে গল্পের শুরুর কথোপকথনগুলো ফিরে দেখলে মনে হবে আরে এ তো পুরুষ নয়, ও তো দুষ্টু ছেলে!

    সেই ছোটবেলায় ছোট্ট হাতের থাবা দেখিয়ে শিশুটি বলত 'এই দ্যাখো বাঘের হাত, ঘ্যাঁও! কপট ভয়ে শিশুটির বাবা-মায়েরা সিঁটিয়ে যেত! বলত! ওলেবাবালে!

    এই বিজ্ঞাপনের পুরুষটিও ঐ ‘দুত্তু’ ছেলের মতন বলছে কত না শাসনের কথা! কিন্তু আসলে তো শিশু! যেই না সতীর্থরা পাল্টা ভয় দেখিয়েছে ওমনি সে শান্ত ছেলেটির ভয়ে মুখ শুকনো! বুক ধুকপুক!

    দুষ্টু খোকা কিনা!

    অভিনব না হোক, ত্রাস সৃষ্টি করা নারীই আসলে পুরুষকে দাবিয়ে রাখে, এই ন্যারেটিভ সব স্বামীরই পছন্দ! এবং হয়ত বা নারীরও! নয়ত এই সংক্রান্ত রুচিহীন 'মিম' মহিলারাই বা কেন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেন হাসতে হাসতে? নাকি নিজের ছদ্ম ক্ষমতার 'মিম' দেখে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে আরাম হয় তাঁদের? আমি জানি না!

    বেশিরভাগ মানুষ যে এই ন্যারেটিভ খাবে, তা জানেন মেন উইল বি মেন-এর কপি লেখক! তাই না প্যারাডক্স-এর পাহাড় ডিঙিয়ে বিজ্ঞাপনটির পাহাড় পরিমাণ রিকল ভ্যালু!

    বাজারের পছন্দমতন কাহিনি না বললে ব্র্যান্ড বাপু কল্কে পায় না!

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics