'উঠে যাওয়া'
5 620মেনোপজ শব্দটা আমি জেনেছি অনেক পরে। সত্তরের দশকে আমাদের উত্তর কলকাতার সেই তিরিশ জনের সাবেকি সংসারে যে শব্দটি চালু ছিল সেটি হল, ‘উঠে গেছে’। সারাদিন সংসারের ঝড়ঝাপটা সামলাতে সামলাতে মা-কাকিমাদের মাসের ক’টা দিন বলতে শুনতাম, ‘এর মধ্যে আবার আমার হয়েছে, বাবা কবে যে উঠবে!’ তুলনায় বয়স্কা আত্মীয়াদের তাঁরা বলতেন, ‘তোমার তো উঠে গেছে, কি সুখের জীবন তোমার এখন!’ কৈশোরের শুরুতে এধরনের কথোপকথনের মানে আমার বোধগম্য হত না। একটু পাকামোর বয়সে পৌঁছানোর পর ‘মাসিক’ মানে যখন জানলুম তখনই জানলুম ‘উঠে গেছে’-র মানে।
আমার যখন মাসিক শুরু হল তখন বেশ বিরক্ত লাগত। দু’ পায়ের ফাঁকে বাড়িতে তৈরী মোটা ন্যাকড়া দিয়ে মোড়ানো তুলোর বোঝা নিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক চলাফেরা, স্কুল যাওয়া, দৌড়ঝাঁপে বেশ নাকানিচোবানি খেতে হত। সেই তখন থেকেই আমি ভাবতুম, ‘উফফ আমার কবে উঠে যাবে’! মনে মনে মায়েদের মুখের লব্জ ব্যবহার করতুম, ‘মেয়েদের এই এক জ্বালা! উঠে গেলে শান্তি!’ ‘উঠে যাওয়া’ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটা কৌতূহলও ছিল।উঠে গেলে জীবন কেমন হয়!এতদিনের মাসিক অভ্যাস যেদিন বন্ধ হয়ে যায় সেদিন কি একটু মনও কাঁদে?
মনে পড়ে কচি ঠাকুমাকে। কচি ঠাকুমা জামসেদপুর (আমরা তখন টাটা বলতুম) থেকে মাঝেমাঝেই আমাদের বাড়িতে থাকতে আসতেন। কচি ঠাকুমাকে আমরা কচি বলেই ডাকতুম। কচি ছিলেন আমার ঠাকুর্দার কাকিমা। সম্পর্কে বড় হলেও কচি বয়সে দাদুর থেকে অনেক ছোট ছিলেন। কচি ছিলেন বাল্যবিধবা। অল্পবয়সে বিধবা হওয়ার দরুণ কচির চুল কেটে দেওয়া হয়েছিল। কচি কালো ইঞ্চি পাড় দেওয়া সাদা থান পরতেন। এমনিতেই তিনি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সর্বদা বিব্রত থাকতেন, আর মাসিকের সময়ে তো প্রায় অদৃশ্য হয়ে আমার সেজকাকিমার কোনের ঘরে ঠাঁই নিতেন। ওঁর ভয় ছিল, সাদা থানে রক্তের দাগ যদি লেগে যায়, যদি বাড়ির পুরুষরা সে দাগ দেখতে পায়, বিশেষত যদি তাঁর ভাসুরপো অর্থাৎ আমার দাদু দেখতে পান, তাহলে কি ভয়ানক লজ্জার ব্যাপার হবে! প্রকৃতির দান এই ঋতুচক্র যেন বিধবাদের জন্য ঘোরতর অন্যায়! এই কচির যেদিন মাসিক বন্ধ হল সেদিন তার মুখে মুক্তির হাসি দেখেছিলাম। কাপড়ে রক্তের দাগ লাগার টেনশন থেকে মুক্তি, বিধবার যৌন জীবনজনিত লোকলাজ থেকে মুক্তি!
হ্যাঁ, এই উঠে যাওয়ার সঙ্গে যৌনজীবনের এক অদ্ভুত যোগাযোগ। আমাদের সমাজে সাধারণত মনে করা হয় মেয়েদের যৌনতার একমাত্র প্রয়োজন বাচ্চার জন্ম দেওয়া। তাই উঠে গেলেও যে মেয়েদের যৌনজীবন থেমে যায় না, সেকথা সমাজ সাধারণভাবে স্বীকার করে না। মেয়েরা নিজেরাও অনেকে মনে করেন উঠে গেলে বুঝি জীবন থেকে যৌন আনন্দের পাট চুকল। তাই মাসিক বন্ধের পরও যখন তাঁদের শরীরের দাবী থেকে যায় তখন অনেকসময়ই মেয়েরা অপরাধবোধে ভোগেন। অথচ উঠে গেলেই মেয়েদের নিশ্চিন্তে যৌনসুখ অনুভব করার কথা! অযচিত গর্ভধারণের যে আশঙ্কা সারাজীবন মেয়েদের স্বতস্ফূর্ত যৌন চাহিদায় সীমানা টেনে দেয়, উঠে-যাওয়া মেয়েদের জীবনে সেই সীমা লঙ্ঘনের মুক্তি এনে দিতে পারে। যদিও মনের গভীরে প্রোথিত যৌনতা ঘিরে নিষেধের কাঁটাতার মেয়েদের সচরাচর এই মুক্তির আনন্দ ভোগ করতে দেয় না। আর যে মেয়েরা সাহস করে যৌনজীবন চালু রাখেন তাদের কপালে জোটে দুশ্চরিত্রার তকমা।
মেয়েদের যৌনজীবনের সঙ্গে মাসিকের এই যোগাযোগের আরেকটি আশ্চর্যের দিক হল, যতদিন মেয়েদের মাসিক চলে ততদিন পরিবার, পরিজন মেয়েদের যৌনস্বাস্থ্যের যত্ন নেয়। কিন্তু যেইমাত্র মেয়েদের মাসিক উঠে যায় তখনই মেয়েদের যৌনস্বাস্থ্যের ধারণাটিও যেন বুদবুদের মত উবে যায়। অর্থাৎ মেয়েদের যৌনস্বাস্থ্যের যত্নও মেয়েদের মা হওয়ার ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। যতক্ষণ মেয়েদের ফলবতী হওয়ার সম্ভাবনা ততক্ষণ তাদের আদর আর কি! সেইজন্যই মাসিক হওয়ার শুরুতে মেয়েদের যত যত্নসহকারে প্যাড নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, পেট ব্যথা করলে দেখাশোনা করা হয়, দৌড়ঝাঁপ করতে বারণ করা হয়, মাসিক উঠে যাওয়ার সময় মেয়েদের শরীরের ততখানি যত্ন নিতে পরিবার অথবা নিকটজনদের দেখা যায় না। মেয়েরা নিজেরাও অনেকসময় জানেন না হঠাৎ তাদের কেন এত গরম লাগছে, কেনই বা তাদের মেজাজ এত তিরিক্ষে হয়ে আছে। অথচ প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো নারীর যখন শরীরে পরিবর্তন আসে তখন জীবনের আর পাঁচটা চাপের সঙ্গে নিজের শরীর এবং মনকে সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। সেসময় প্রিয়জনের সামান্য আদরও অনেকখানি শুশ্রূষা দেয় বৈকি!
ফিরে আসি আমাদের সেই সত্তরের দশকের বাগবাজার বাড়িতে। সে বাড়িতে মেয়েদের উঠে যাওয়া বোঝা যেত তার পুরোনো পরিস্কার কাপড়ের চাহিদা মিটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। সবমিলিয়ে প্রায় জনা পনেরো ঋতুবতী মহিলা বাস করতেন বাড়িতে। ফলে পুরোনো কাপড়ের সবসময় আক্রা। সে আমলে মধ্যবিত্তের সংসারে লোকে আজকালকার মত একটু রঙ উঠে গেলে অথবা ছিঁড়ে গেলেই জামাকাপড় বাতিল করতেন না। ফলে অতজন মহিলার পুরোনো কাপড়ের যোগান দেওয়া অনেকসময়ই মুশকিল হত। তাই উঠে গেলেই কাপড় যোগাড়ের ঝামেলা থেকে মুক্তি। আমাদের পাশের বাড়ির এক অবিবাহিত পিসির কথা খুব মনে পড়ে। পিসি বলতেন, ‘আমার তো আর বাচ্চা হবে না, আমার তো এখন উঠে গেলেই হয়, প্রতি মাসে পুরনো কাপড় যোগাড়ের হাত থেকে বাঁচি।’
আমার নিজের যেদিন উঠে গেল, সেদিনগুলো আমার জন্য যেমন কষ্টের, তেমনই মুশকিলের ছিল। আমার মা বলতেন, আমাদের তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়ার ধাত। ফলে চল্লিশের মাঝামাঝিই আমার উঠে যাওয়া শুরু হল। হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ গরম লাগতে শুরু করল, বান্ধবীরা বললে, তোমার হট ফ্লাস হচ্ছে, আমি ভাবতুম, আমার তো চিরকালই ভীষণ গরম বাতিক। অতএব কোন গরমটা আমার চিরকালিন বাতিকের ফল আর কোন গরমটা আমার উঠে যাওয়ার জন্য সে নিয়ে আমি খুব ধন্দে থাকতুম। মেজাজের ব্যাপারেও সেই একই গন্ডগোল। আমি পরম প্রিয়জনদের ওপর চিরকালই একহাত মেজাজ নিয়ে থাকি। ফলে, আমার কোন মুখ ঝামটাটি স্বভাবগত আর কোন মুখ ঝামটাটি মেনোপজগত, সেটি বুঝতে তাদের নাজেহাল অবস্থা।
আজ বছর পাঁচেক হল আমার উঠে গেছে। উঠে যাওয়ার কারণে আমার যে খুব মন খারাপ হয় তা নয়। ক্কচিত কদাচিত অবশ্য মনে হয়, আমার জন্য মাসকাবারিতে আর হুইস্পার আলট্রা(হ্যাঁ, সেই সাবেকি বাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক পুরোনো অভ্যাসের খোলস পড়েছে খসে, আমি কবে যেন পিসির বানিয়ে দেওয়া কাপড়ের ঢিপি ত্যাগ করেছি, শরণাপন্ন হয়েছি মাল্টিন্যাশনাল প্যাডের)লিখতে হবে না জীবনে। বেড়াতে গেলে, পথেঘাটে কোথায় পাল্টাব সে চিন্তা আমার এ জীবনের মত ঘুচেছে। আমার মত ভুলো মনের মানুষের ডেট মনে রাখার টেনশনও আর করতে হবে না। আমার বয়স হল। আমি মাসিকের বাঁধন থেকে মুক্ত। তবু মাঝে মাঝে যখন স্নানঘরে নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবি, কেমন ছিল আমার মাসিকের জীবন তখন নস্টালজিয়া আমার বুকে পাথর ভাঙে।
আমার আবার পুরোনো দিনের ওপর, পুরোনো কাঁথাখানি, ন্যাকড়ার পুঁটুলির ওপর বড় মায়া। কোনকিছুর পাটই জীবন থেকে উঠে গেলে আমার হৃদয়ে বর্ষা নামে!
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (5)
-
-
খোলাখুলি,সোজাসাপটা লেখা। ভালো লেগেছে। Menopause প্রসঙ্গে মেয়েদের যৌনজীবন-চাহিদা সম্পর্কে দিকপাত্ ও মতামত দারুণ প্রশংসনীয়।
-
বাঃ —
-
Thank you, Rangan!
-
খুব ভালো লেখা।
Leave a Reply
-
সাবলীল এবং দরকারী