• কম্প্রোমাইজ : থিয়েটার, বিনোদন ও #মিটু


    0    323

    December 20, 2018

     

    বর্তমানে একটা ট্র্যাডিশন ফলাও করে চলছে। সুতো দেখতে পেলেই ঘুড়ির পিছনে জনগণের লম্বা লাইন দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আদতে ঘুড়ি সুতো কেটে কোথায় পড়ে থাকল তার হিসেব রাখে কে? এই তো, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ২০১৭-এর মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ ফেসবুক দুনিয়া কেঁপে গেল - এক নাট্য ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ আনলেন অল্পবয়সী এক মহিলা থিয়েটার কর্মী।

    ওই সময় আমি মেতে আছি আমার নিজের দল ‘আত্মিক’-এর কাজে। গত বছরের শুরুতেই আমি আর আমার বন্ধু অঙ্কিতা মিত্র ‘বাতিল চিঠি’ বলে একটা নাটক করেছিলাম নিজেরাই। সেই সময় থেকেই নিজের দল করার ইচ্ছা। নিজের কাজ আর ভাবনা স্বাধীনভাবে করতে চেয়েই নির্দেশনা আর দল তৈরি। বন্ধুরা মিলে তৈরি হল 'আত্মিক'। ‘বাতিল চিঠি’ বা ওই বছরেই করা 'আত্মিক'-এর আরেকটা নাটক ‘কাস্টিং কাউচ’ দুটোতেই এই যৌন হেনস্থার বিষয়টা নানাভাবে তুলে আনতে চেয়েছিলাম। এটা যে শুধু সিনেমা বা বিনোদনের জগতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ছড়িয়ে আছে সমাজের সব জায়গায়, সেটাই আমাদের বলার ছিল। গত বছর ফেসবুকে ওই বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর আমরা থিয়েটার কর্মীরা বিপ্লবের বাজারে নতুন করে নিজেকে খুঁজে ও বুঝে পাওয়ার আশাতেই হয়ত জমায়েত হয়েছিলাম। উপস্থিত সভা ও জন সমাবেশে এমন কিছু প্রতিবাদী মুখ দেখেছিলাম, যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই অগুনতি অশালীন আচরণ ও হেনস্থার অভিযোগ আনা যায়। জনৈক নির্দেশক বিদেশ থেকে ফেসবুক লাইভ করেছিলেন ঘটনার বিরুদ্ধে - যদিও তার কিছুদিন পরেই, আমার সঙ্গে মতের অমিল হতে তিনি ও তাঁর দলবল ফেসবুকে আমায় ‘বেশ্যা- টেশ্যা’ ও এক পুরুষ নৃত্যশিল্পীকে ‘ছক্কা-টক্কা’ উল্লেখ করেন - তিনি বা তাঁর নন্দী-ভৃঙ্গীরা জানেন না যে ‘বেশ্যা’ বা ‘ছক্কা’ কোনও গালাগালি নয়।

    থিয়েটারে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে পথে নেমেছে 'উইমেন ফর থিয়েটার'-এর সমর্থকরা

    আসলে ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ পরিচিতি লাভ করার আগেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ওঠেনি তা নয়। উঠেছে, আবার নিভে গেছে। মেয়েদের প্রতিবাদ তবু তো সামনে আসে খানিক; কিন্তু অন্যান্য যৌন পরিচয়ের কর্মীরা কোনও বিচারই পান না। স্বভাবে লাজুক বা কমনীয় স্বভাবের পুরুষ অভিনেতা বা কর্মীরা মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন তাদের হেনস্থা বা হাসাহাসির শিকার হতেই হবে। নৃত্যশিল্পী হলে তো কথাই নেই। শরীরে পুরুষ, মনে নারী বা রূপান্তরকামী বন্ধুরা জানিয়েছেন, পাশে শুয়ে থাকা পুরুষ ‘কমরেড’ মেপে নিতে চেয়েছে তার স্তনের মাপ বা লিঙ্গকে। আসলে এর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করা উচিত সে ভাবনাই হয়তো কাজ করেনি। ফলে নিজেকে আরও পুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা, তিনি নিজেও যেমন চালিয়ে গেছেন, তেমনই হেনস্থাকারীরা যেচে দায় নিয়েছে সমাজ শোধরানোর। এমনই এক বন্ধুকে বলতে শুনেছিলাম, “নাটক করলে আমায় ছেলে হয়েই করতে হবে। আমি আমার মত হলে, আমায় কস্টিউম বানাতে দেবে, নয়তো বারবার শুধু হিজড়া সেজে, অশিক্ষিতদের হাসির খোরাক জোগাতে হবে। তার চেয়ে আমি আমিই থাকি। অভিনয় আমার দ্বারা হবে না।’’ শুনেছিলাম, ভিন রাজ্যের এই অভিনেতার দলের পুরুষ নির্দেশক তাকে দিনের পর দিন, নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আপন যৌন খিদে মিটিয়েছেন। যদিও সবার সামনে বিষমকামী স্ত্রী বা পুরুষ ছাড়া অন্যান্য যৌন পরিচয়ের দলকর্মীদের হেনস্থা করা, তাদের চলন বা ব্যবহার নিয়ে পাবলিক শেমিং করা ছিল সেই নির্দেশকের ‘পাস-টাইম’।  তবে কিনা, তখন ফেসবুক ছিল না। তবু, থিয়েটার ও যাপন পারস্পরিক দাম্পত্যে আছে সেই কোন কাল থেকেই। একটা নতুন নাটক তৈরি করার গোড়া থেকে নতুন সংসার পাতার আয়োজন। প্রোডাকশনে যুক্ত সকলের সঙ্গে পারস্পরিক আদান-প্রদান সম্পর্ক তৈরির সোপান। ফলে শো-এর চেয়েও বেশি ক’রে রিহার্সাল ও ওয়ার্কশপ আমার কাছে নাটকের প্রাণকেন্দ্র। থিয়েটার শেখায় Inhibition বা জড়তা কাটাতে। মানসিক নিষেধাজ্ঞা যেন চরিত্র থেকে আমাকে আলাদা না করে দেয়। তার জন্য রয়েছে বহু গেমস, কর্মশালা। প্রস্তুতির গোড়াতেই মাথায় গেঁথে দেওয়া হয় ইনহিবিশন যেন থিয়েটারের কাজে আমায় কাবু না করতে পারে। ঠিক এখানেই সরু সুতোর যে নিয়মরেখা তা টপকে ফেলতে কয়েক মুহুর্ত লাগে। রেসিডেন্সিয়ালে গিয়ে টানা বিছানায় পাশে আমার সহকর্মী শুয়ে থাকেন। কখনও ভাবিনি তিনি নারী না পুরুষ। সেই ভাবনা টাল খেয়েছে কখনও। সহ-অভিনেতা (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) জড়তাহীনতাকে কখনও নিজের মত  করে বানিয়ে নেন। বহুবার অস্বস্তিতে পড়েছি। কিন্তু ওই যে ইনহিবশন কাটিয়ে অভিনয় করার বাণী মন্ত্রের মত বেজে চলেছে কানে।

    'কাস্টিং কাউচ' নাটকের কিছু দৃশ্য

    যদিও নাটকের তুলনায় ফিল্ম বা ক্যামেরার সামনে কাজের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিজ্ঞতা বেশি। বিশেষ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘আপনি কতটা বোল্ড হতে পারবেন সেটা কিভাবে বুঝব?’ এ প্রশ্নের ছড়াছড়ি। তারপর আসে সান্ধ্য আসরে স্ক্রিপ্ট শুনতে ডাকার পালা। যেন মদের প্রথম চুমুক না পড়লে ভদ্রলোকেরা ঠিক বোঝাতে পারেন না, তাঁরা কত বড় ট্যারান্টিনো। না, মদ খাওয়া নিয়ে ছুঁৎমার্গ নেই আমার। কিন্তু অফিস স্পেসের বাইরে গিয়ে স্ক্রিপ্ট শোনানোর তাগিদ ও তাড়া এবং না শুনতে চাইলে, যে আমাকে তাদের এত পছন্দ  তাকে বাতিল করে দেওয়ার ট্র্যাডিশন কবে বন্ধ হবে? আউডডোর শ্যুটে যাবার আগে কেউ কেউ কেন জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি কি সিংগল নাকি বয়ফ্রেন্ড আছে?’ আছে বলার পর কি আমার পার্টনারকে ফ্রি ট্যুর স্পনসর করে তাঁরা আমায় সারপ্রাইজ দেবেন? নাকি ‘অক্যুপায়েড’ তকমা দিয়ে আমায় শ্যুট থেকেই বাদ দেবেন। আবার বলছি, এই ঘটনা সব জায়গায় নয়। তবে বহু জায়গায় তো বটেই।

    একটা মজার অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। বেশ কিছু বছর আগে একটি ফিল্মের অডিশনে ডাক পেয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সংলাপ ক্যামেরার সামনে বলার পর, আমায় ক্যামেরার সামনে নাম, বয়স, উচ্চতা ও ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স’ বলতে বলা হয় (যদিও থিয়েটারের ক্ষেত্রে এমনটা কখনও হয়নি আমার)। আমি সহ-নির্দেশককে সবই বলি। উপস্থিত অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর একবার আমার বুক-কোমর মেপে নেন সর্পিল চাউনিতে। হয়ত দেখে নিতে চেয়েছিলেন আমি মাপজোক ঠিক বলছি কিনা। কান গরম হয়ে গেছিল। অডিশনে যাওয়া আর এক মহিলা বলেছিলেন, ‘চাপ নিও না। এখানে এরমই হয়’। হয়তো নির্দিষ্ট চরিত্রের প্রয়োজনে, নির্দিষ্ট শারীরিক মাপের চরিত্রাভিনেত্রীই তারা খুঁজছিলেন। এক্ষেত্রে আমার একটা প্রশ্ন আছে। জানি না সেটা ‘ভাইটাল’ কি না - ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স’ মানে কী? কোন মানদণ্ডে জানা যায় যে শরীরের কোন অংশ ভাইটাল আর কোন অংশ নয়? বা এই জানার পিছনে হোতা কারা? মানে কে নির্বাচন করবেন আমার শরীরের কোন অংশ ভাইটাল? আর তার সঠিক পরিমাপ কী হওয়া উচিত? এই অলিখিত নিয়মের ভিত্তিতেই কি অনেকে ফোন করে বলেন, ‘একটা অভিনেত্রী দাও তো, বেশ ডবকা দেখতে?’ বা ‘ওকে দিয়ে চলবে না। নিমাই মাল। ব্রা পরে না স্যাণ্ডো গেঞ্জি বোঝা যায় না!’ পুরুষতন্ত্রের এই দিকটি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এ লেখা আর শেষ হবে না।

    মাঝেমধ্যেই ফেসবুক বা অন্য কোথাও কাজের জন্য যোগাযোগ করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একবার একটা ফর্ম পেয়েছিলাম। তাতে নিজের সম্পর্কে নানা তথ্যের বয়ানের শেষে লেখা ছিল ‘কম্প্রোমাইজ’। আমায় হ্যাঁ বা না-তে উত্তর দিতে হত। বেকুব হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এর মানে কী? খুবই তৎপরতায় যোগাযোগকারিণী জানিয়েছিলেন ‘আমার উত্তর হ্যাঁ হলে পারিশ্রমিকের অংক বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, কতটা শরীরী খেলায় আমি রাজি হব তা জেনেই আমায় প্রোডিউসারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। ততদিনে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছি। জেনেছি এগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। এর বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখে আর কিছু হবে না। আমি জানি এসব লেখালেখির পরেও কিছুই বদলাবে না। হয়তো আমি একের পর এক কাজ থেকে বাদ হতে হতে এই পেশাই কখনও ছেড়ে দেব বা মুখ বুজে মেনে নেবার দলে নাম লেখাব। কারণ প্রতিবাদ তো অনেক হল। কেউ শাস্তি পেল কই? মুম্বইয়ের মত এখানের ফিল্ম দুনিয়া কিছু মানুষকে বয়কট করার সাহসটুকুও দেখাতে পারলেন কই?  

    অডিশন শেষে সহ-নির্দেশকরা অপরিচিত মুখ দেখলেই ‘তুমি’ বা ‘এই অমুক জামা’ ইত্যাদি নামে ডাকতে পছন্দ করেন। আমার ‘যুক্তাক্ষরহীন’ নাম বহু বাঙালি জিভে আটকে যায়। ‘অমুক জামা’ বা ‘কী যেন? শবনম না কী যেন’ হয়ে থাকা আমি এইরকম অডিশন থেকে যেতে যেতে মনে মনে বলেছি – ‘মিটু’! ‘#মিটু’ ক্যাম্পেন নিয়ে পড়তে পড়তে বা দেখতে দেখতে অনুভব করছিলাম, পুরোটাই ক্ষমতার খেলা। বর্তমানে পুঁজি সেই ক্ষমতার দায় নিয়ে বসে আছে। বাংলা থিয়েটারে পুঁজি কম বলেই বোধহয় এখনও সেভাবে শোষক-শোষিতের সংখ্যা বারবার উঠে আসছে না, যেভাবে ফিল্ম বা টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে উঠে আসছে। হ্যাঁ, আদতে এই মুহুর্তে যা ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে তা হল ক্ষমতা। পুঁজির ক্ষমতা। নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বে না গিয়ে একজোটে এই ক্ষমতার অসুখের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সবাই মিলে। গদি সরে গেলে কাস্টিং কাউচে বসে থাকা ভদ্রলোক বা মহিলাটি কিন্তু বড়ই ভীতু!

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics