মাদার টেরেসার 'নোবেল লেকচার' ও গর্ভপাত অধিকার বিষয়ে দু-চার কথা
1 535পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ দ্বারা নির্ধারিত বিভিন্ন শ্রেণির ইংরাজি পাঠ্যসূচীতে এমন কিছু অধ্যায় আছে, যার পাঠ লিঙ্গ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়৷ তা না হলে ছাত্রছাত্রীদের মনে যৌন-হিংসা বা আন্তঃলিঙ্গ সম্পর্ক নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি হবে। উদাহরণ হল, সপ্তম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের গল্প ‘দ্য স্টোরি অফ প্রোসেরপাইন’ বা ‘দ্য বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট’। কিন্তু এগারো ক্লাসে মাদার টেরেসা-র Nobel Lecture পড়ানো হল সবচেয়ে বড় বালাই। কারণ, এটি কোনো গল্প বা ফিকশন নয়, যার বহুবিধ পাঠ সম্ভব। এটি বক্তৃতা, যা সাধ্বী টেরেসা ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকালে অসলো শহরে দিয়েছিলেন। এখানে একজন ক্যাথলিক ক্রীশ্চান সাধিকা ও সমাজকর্মী নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে সামাজিক অবক্ষয়কে দেখেছেন ও নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে তা থেকে মুক্তির জন্য কিছু নিদান দিয়েছেন। নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে গেলে যে কেউ এর নাগাল পেতে পারেন।
পড়াতে গিয়ে দেখা যায়, মানবপ্রেম সম্পর্কে তাঁর কিছু ধারণা গ্রহণযোগ্য হলেও, বাকিটা স্থূলভাবে লিঙ্গ-সাম্য-পরিপন্থী৷ যেমন, তিনি সেই সব পরিবারের সমালোচনা করেছেন, যেখানে বাবা-মা দুজনেই কাজে বেরোন বলেই নাকি ছেলে-মেয়ে ড্রাগের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে!
‘Young parents are in some institution and the child takes back to street and gets involved in something…’
অবক্ষয়ের এরকম এক অতিসরল কারণ তিনি খুঁজে পেয়েছেন।
কিন্তু এই বক্তৃতায় সবচেয়ে সমস্যাজনক কথাগুলি টেরেসা বলেন গর্ভপাত নিয়ে। এ’বিষয়ে তাঁর বিস্তারিত আলোচনা শুধু গর্ভপাত-অধিকার-আন্দোলনের উল্টোপথে হাঁটে না, বরং এ'দেশের বর্তমান গর্ভপাত-আইনেরও বিরুদ্ধে যায়।
তিনি বলেন-
‘The greatest destroyer of peace today is abortion, because it is a direct war, a direct killing, a direct murder by the mother herself.’
বলেন, ঈশ্বর নিজের হাতে যে ভ্রূণকে আকার দিয়েছেন, তাকে কোনো কারণেই নষ্ট করা যায় না৷ পাশ্চাত্যকে ভর্ৎসনা করে বলেন, আফ্রিকা বা এশিয়ার দরিদ্র শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করার আগে ইউরোপীয়দের উচিত নিজেদের মহাদেশে গর্ভপাতের মাধ্যমে শিশুহত্যা আটকানো।
নারীকে গর্ভপাতের অধিকার না দেওয়া , ধর্মীয় বিধি চাপিয়ে গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ দেগে দেওয়া - সবই সম্ভবত আসে নারীকে সন্তানধারণের যন্ত্র মাত্র ভাবার সামাজিক বদভ্যাস থেকে৷ পিতৃতন্ত্রের এমনই প্রভাব যে নারী নিজেও তার মা হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে গৌরব করে। সন্তানহীন বা পুত্রহীন মেয়েদের চরম গঞ্জনা সইতে হয়।
কিন্তু অন্যদিকে, অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত সন্তান তো এসেই যায়। এসে যেত অতীতেও। তখন লুকিয়ে হাতুড়ে পদ্ধতিতে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে প্রাণ দিতেন অনেকে। অথবা জন্ম দিতে বাধ্য হলেও সেই শিশুকে পরিত্যাগ করতে হত কুন্তীর মতো। ‘মহাভারত’-এর প্রসঙ্গ এল বলে বলি, কোনো নারীবাদী যদি ‘মহাভারত’-এ শান্তনু-জায়া গঙ্গার সাতবার সন্তান-বিসর্জনের ঘটনাকে রূপক হিসেবে ভাবেন, অষ্টমবার শান্তনু বাধা দিতে এলে গঙ্গা কর্তৃক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘটনা ভাবেন, তাহলে তিনি ‘মাতৃত্ব আবশ্যিক নয়, বরং একটি চয়েস’ - এই মতের সপক্ষে উপাদান সংগ্রহ করতে পারবেন মহাকাব্য থেকেই৷ অষ্টবসুর কাহিনী ভুলে যাওয়া হচ্ছে না, কিন্তু পুরাণের ‘বিনির্মাণ’ তো হয়েই থাকে আধুনিক কালে।
যাইহোক, ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, পর্তুগালের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলি তাদের গর্ভপাত-বিরোধী আইন চালু করেছিল নিজেদের উপনিবেশগুলিতেও৷
সর্বপ্রথম গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন সংস্কার করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯২০ সালে৷ এ’ঘটনা সম্ভব হয়েছিল, কারণ আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই-এর মতো মার্ক্সীয় নারীবাদী তখন ছিলেন সোভিয়েত মন্ত্রকে। বিংশ শতকের শেষ দিকে প্রায় ৯৮% রাষ্ট্রেই গর্ভপাত নানা শর্তসাপেক্ষে আইনি হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু একশো বছরের লড়াই-এর পর ‘কন্ট্রাসেপটিভ’-এর ব্যবহার যেমন আজ সমগ্র বিশ্বেই স্বীকৃত, তেমনটা গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ঘটতে এখনও বাকি আছে। এখনও বেশ কিছু দেশে গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের লড়াই চলছে। আর্জেন্তিনায় ২০১৮ সালে নিম্নকক্ষের ছাড় পেলেও সেনেট-এ অল্প ভোটে হেরে গর্ভপাত বিল প্রত্যাখ্যাত হয়।
অ্যাবরশন-এর অধিকার কেন জরুরি?
নৈতিকভাবে নারীর নিজের শরীরের উপর অধিকার থাকাই উচিত। যেহেতু নারীই দশ মাস শিশুকে গর্ভে ধারণ করেন এবং তারপর সন্তান-প্রতিপালনের দায়িত্বও সামাজিক ভাবে মূলত মায়ের উপরেই ন্যস্ত হয়, তাই কখন তিনি মা হবেন, কোন পরিস্থিতিতে মা হবেন না, আদৌ মা হতে চান কিনা-তা স্থির করার অধিকার তাঁর থাকা উচিত। বাস্তবক্ষেত্রে এমন অনেক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যখন গর্ভপাত জরুরি হয়ে পড়ে। কখনও কখনও ভ্রূণ মায়ের স্বাস্থ্য ও জীবনের পক্ষে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে৷ কখনও আবার হয়ত মায়ের গর্ভাবস্থা তাঁর যৌন নিগ্রহের ফল, সুতরাং তা অনভিপ্রেত। কখনও হয়ত জানা গেল, ভ্রূণের জিনগত গণ্ডগোল আছে, সে জন্মালেও অচিরেই মারা যেতে পারে। এছাড়া মায়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সন্তানের পক্ষে প্রতিকূল হতে পারে বলে বা স্রেফ সন্তান না চেয়েও কেউ গর্ভপাত করাতে পারেন। আমাদের দেশে কুড়ি সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতে কোনো অনুমতি লাগে না৷ একুশ সপ্তাহ থেকে মাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে। ভারতের গর্ভপাত আইন, ১৯৭১, অনুযায়ী- ১) মায়ের বা ভ্রূণের জীবনের ঝুঁকি থাকলে ২) ধর্ষণজাত অনভিপ্রেত শিশু হলে ৩) বাবা বা মায়ের নিরোধ-ব্যবস্থা কোনো কারণে অকার্যকর হয়েছে বলে সন্তান এলে, সেই ভ্রূণকে ২১ সপ্তাহ হওয়ার আগে নষ্ট করা যায়।
ভ্রূণের কারণে মায়ের জীবনের ঝুঁকি প্রসঙ্গে আয়ারল্যান্ডে বসবাসকারী ভারতীয় ডেন্টিস্ট সবিতা হলপ্পানভর-এর মর্মান্তিক মৃত্যুর উল্লেখ করতেই হয়। তিনি সতেরতম সপ্তাহে বুঝতে পেরেছিলেন, সেপটিক মিসক্যারেজ হতে চলেছে। গর্ভপাত চেয়েছিলেন। কিন্তু গোঁড়া আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত আইন ছিল বড়ই কড়া৷ মায়ের জীবনহানি ঘটতে চলেছে, এমনটা প্রমাণ না করতে পারলে গর্ভপাতের ছাড়পত্র পাওয়া যেত না। দুর্ভাগ্যক্রমে, দন্ত-চিকিৎসক সবিতা নিজে বুঝলেও, অন্য ডাক্তাররা বুঝতে পারেননি যে রক্তে ইনফেকশন ছড়াচ্ছে দ্রুত। বোঝা গেল যখন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ সবিতা মারা যান ২০১২ সালের অক্টোবরে। আয়ারল্যাণ্ডে অনেক টানাপোড়েনের পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে গর্ভপাত বিষয়ক নতুন বিল পাস হয়। তারপর আইন পাশ হয় ডিসেম্বরে। নতুন গর্ভপাত-আইন কার্যকর হয়েছে ২০১৯ এর জানুয়ারি থেকে। এই আইন অনুসারে বারো সপ্তাহ পর্যন্ত মা অনুমতি ছাড়াই গর্ভপাত করাতে পারবেন। তারপরেও আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন গর্ভপাতের আর্জি নিয়ে, বিশেষত যদি তাঁর জীবনের ঝুঁকি থাকে৷
টেরেসা যখন বলেন অ্যাবরশনের মোকাবিলা করতে হবে অ্যাডপশন বা দত্তক-গ্রহণের মাধ্যমে, তখন তিনি শুধুমাত্র ভ্রূণের শিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হওয়া নিয়েই চিন্তিত। গর্ভাবস্থায় মায়ের জীবনের কোনো ঝুঁকি যে ঘটতে পারে, তা তিনি স্বীকার করতে চান না৷ অথচ সবিতার মৃত্যুর মতো ঘটনা প্রাচীন কাল থেকেই ঘটে আসছে।
বস্তুত, গর্ভপাত যথেষ্ট নিরাপদ একটি প্রক্রিয়া৷ ওষুধের মাধ্যমে সম্ভব না হলে, যদি সার্জারির মাধ্যমেও গর্ভপাত ঘটাতে হয়, তাহলেও তা অন্যতম নিরাপদ একটি সার্জারি, যদি তা সঠিক পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হাতে ঘটে। কিন্তু WHO-এর তথ্য অনুসারে, প্রতি ছ’টি মাতৃ-মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে একটি ঘটে হাতুড়ে পদ্ধতিতে গোপন অ্যাবরশনের ফলেই। তাই ‘Right to Safe Legal Abortion’ একটি আন্দোলনের স্লোগান হয়ে উঠেছে। গোঁড়া আইনের চোখ-রাঙানির ভয়ে বা লোকলজ্জার ভয়ে, গোপনে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে এই অসহায় মৃত্যুগুলোও যেন টেরেসার চোখ এড়িয়ে যায়।
১৯৯৫ সালেও পোপ দ্বিতীয় জন পল বলেছিলেন, গর্ভপাত নিয়ে চার্চের মনোভাব ‘unchanged and unchangeable’ থাকবে৷ তিনি বলেন -
‘No circumstance, no purpose, no law whatsoever can ever make licit an act which is intrinsically illicit.’
সাধ্বী টেরেসার বক্তব্য যে এই রক্ষণশীল ক্যাথলিক ভাবাদর্শেরই অনুগামী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এগারো ক্লাসে এমন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হয়, যাদের চরিত্র ও মতাদর্শ গঠনের প্রক্রিয়াটি নিরন্তর চলছে৷ এমন বয়সে যদি ছেলেদের মাথায় ঢুকে যায় যে সন্তানধারণে পরিবারের নারীরা বাধ্য, মেয়েদের মাথায় যদি ঢুকে যায় যে ‘গর্ভপাত পাপ’, তাহলে তা তাদের সচেতন, সাম্য-কামী নাগরিক হয়ে ওঠার পথে অন্তরায় হবে। এই অধ্যায় যদি পড়াতেই হয়, তবে যোগ্য সম্পাদনার মাধ্যমে আলোচ্য অংশগুলি বাদ দিয়েই তা পাঠ্যতালিকায় রাখা সমীচীন।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অতি মূল্যবান আলোচনা|