আমার রূপান্তরের যাত্রা ও রবীন্দ্রনাথ
0 266"শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহ্বান মন রয় না, রয় না রয় না ঘরে মন রয় না, চঞ্চল প্রাণ"...
গুরুদেবের এই গানের মতোই যেদিন থেকে অতল জলের আহবান পেয়েছিলাম, সেদিন থেকে ঘরে বা শরীরে এ মনটা থাকতে চায়নি। শরীর, মনের দ্বন্দ্ব থেকেই রূপান্তর কামনা - রূপান্তর।
কিন্তু কথা হলো জীবনটা কাব্যকথা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়', তাই একজন রূপান্তরকামী মেয়ের প্রতিপদে ঝলসে যাওয়া রুটি ছাড়া কিছুই মেলে না। আমার ক্ষেত্রেও তাই। বিন্দুমাত্র পৃথক নয়। আমার গল্পটা ঠিক তেমনিই-
জন্মগত ভুলশরীর, ভুল পরিচয় নিয়ে বাঁচতে শুরু করেছিলাম। ছোট থেকেই রান্নাবাটি, পুতুল খেলা, নারীসুলভ আদপে নিজেকে ভালো লাগত। বাড়িতে মা-কাকীমাদের সঙ্গ টাই স্বর্গ। বয়ঃসন্ধির কালে গিয়ে আমার সামনে অন্য দিগন্ত খুলল, অন্য এক আকাশ। আমার ছেলে বন্ধুদের মত আমার কোনো প্রেমিকা বা বউ চাই না। আমার প্রেমিক চাই - বর চাই - যার জন্য লুকিয়ে বউ সাজা ইত্যাদি ইত্যাদি। এতক্ষন সব ঠিক ছিল। অনেক বাচ্চাই তো পুতুল খেলে, পরে তারা সমাজের দেখানো পথে সঠিক পা ফেলে চলে। যখনই স্কুলে সবাই জানতে শুরু করলো, বিশেষত ছেলে বন্ধুরা, তখনই তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। আমার প্রশান্তি অবশ্য ছিল বান্ধবী মহলে।
ক্রমশ বাড়তে লাগলো রূপান্তরের ক্ষিদে। বাড়িতে, পরিবারে সবাই জানত 'ও অন্যরকম'। কিন্তু মানত না। যদিও মা সবসময় আমাকে বলতেন, জীবনে নিজের মতো করে বাঁচতে গেলে, শিক্ষা এবং অর্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। মা আমাকে ছোট থেকেই পাঠ দিয়েছেন, সৎ পথে চলার, পরিশ্রম করার। তবু আত্মীয়দের থেকে মাকেও নানারকমের কথা শুনতে হত। অবশ্য তাদেরকে দোষ দিইবা কেমন করে, তারা যে শেখানো বুলি বলে, শেখানো পথে চলে, শিক্ষক হলো 'সমাজ'। পাশাপাশি জীবনের নানা ওঠা-পড়াও তো থাকে। স্কুলের এক পার্ট টাইমার স্যারকে ভালো লাগা, প্রেমে-মোহের মাঝে দিক ভ্রান্ত হওয়া, চেনা মুখ গুলো বদলে যাওয়া ... আরো বহু কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চলাকালীন বেশ কিছু টিউশান শুরু করি। বাড়ীর আর্থিক অবস্থা ক্রমশ নামতে থাকে। নানান স্টেজ শো করতে শুরু করি, সঞ্চালনা, ভাষ্য পাঠ, গান, অভিনয়। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারিশ্রমিক মিলতো না। উঠতি শিল্পীদের যা হয় আর কি। ইতিমধ্যে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করি। এদিকে আরো প্রকট হতে লাগলো আর্থিক অনটন।
ক্রমশ খোলস ছেড়ে বেরোলাম, আর নানা পীড়নের শিকার হতে আরম্ভ হলাম। আত্মীয় পরিজনদের থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলো। এম.ফিল, পি.এইচ.ডি বা নেট - এর জন্য আর এগানো হলো না। একটা সম্মানজনক কাজ চাই - প্রথম ও প্রধান শর্ত হয়ে উঠল নিজের কাছে। এদিকে ধীরে ধীরে প্রাইভেট টিউশন গুলো উঠতে আরম্ভ হলো। ছাত্রছাত্রীদের থেকে কখনও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না পেলেও অভিভাবকরা মিষ্টি কথায় বিদায় জানাতে শুরু করলেন। বন্ধ হলো প্রায় সবরকম আর্থিক সংস্থান। তালিকায় শুধু সংযোজন হতে লাগলো - হোমো, ছক্কা, মউগা, লেডিস, হিজড়ে ..... সম্বোধন গুলো। নিজেকে লড়ার জন্য আরও প্রস্তুত করতে লাগলাম। রবীন্দ্রগান ও রবীন্দ্রজীবন চেতনা আমাকে প্রেরণা জোগাতে লাগল। সব কিছুর পরেও, সারাটা দিনের পরে ঘরে এসে গীতবিতানের সুরে জিজীবিষা আসতো।
"তবু শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে......
এরপর একটা নতুন দরজা - একটা নতুন অধ্যায় আমার জীবনে। ও.টি টেকনিশিয়ানের একটা ট্রেনিং এর সুযোগ এলো আমার কাছে। 'প্রান্তকথা' নামক একটি সমাজসেবী সংগঠনের 'সাতরঙ্গি' নামক একটি প্রকল্প শুরু হয় কৌশিক হোরের মধ্যস্ততায়। যার মূল কান্ডারি বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়। এই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ভুক্ত যুবাদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করা। এটারই একটি আলোচনা চক্রে উপস্থিত ছিলেন সমাজের নানা স্তরের প্রতিষ্ঠিত কিছু গুণীজন। ওই আলোচনা চক্রে ডাক্তার শতদল সাহা তাঁর প্যারামেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানে দুজন রূপান্তরকামী নারীকে পাঠগ্রহনের সুযোগ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। সেই দুজনের মধ্যে আমিও একজন। এরপর চলে ডাঃ সাহার আনুকূল্যে পাশকুড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ট্রেনিং পর্ব। ছয় মাসের থিওরিটিক্যাল প্রশিক্ষণের পরে, ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের পাকা আসে। কথা হয় অন্য কোনো হাসপাতালে আমাদের ইন্টার্নশিপ প্র্যাকটিক্যাল পর্বের ব্যাবস্থা করা হবে। কিন্তু, আমাদের ব্যাচের সকলের ইন্টার্নশিপ লেটার চলে আসে, তারা ১ মাসের অধিক সময় যাবত ইন্টার্নশিপে যোগদান করে, কিন্তু, আমার আর জিয়ার (আমার সহপাঠী) ইন্টার্নশিপ এর ব্যবস্থা হয় না। আর একবার প্রমান হলো লিঙ্গগত রাজনীতি বা লিঙ্গগত বৈষম্য।
ইতিমধ্যে আমি একটা ছোট্ট বুটিকে কাজ করতে আরম্ভ করি। কিন্তু, 'প্রান্তকথা' সংগঠনের বাপ্পাদিত্য বাবু হাল ছাড়েননি। আমার অদম্য ইচ্ছে-শক্তির চালিকা শক্তি তিনি। বোনের স্নেহে ভালোবেসে সবসময় পাশে থেকেছেন। ওঁর মধ্যস্ততাতেই কোলকাতার বুকে এক সুপার স্পেশালিস্ট হাসপাতালে আমি এখন ইন্টার্নশিপ করছি। হাসপাতাল থেকে স্টাইপেনের ব্যাবস্থা করেছে। পাশাপাশি প্রান্তকথা আমার মানসিক, অর্থনৈতিক সহায়তায় এখনো আজ অবধি নিরন্তর সহায়তা করে চলেছে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার ফলে প্রথমে মেডিকেল সংক্রান্ত বিষয়গুলি বুঝতে একটু অসুবিধা হত, কিন্তু তারপর চেষ্টা আর মনের জোরে তার অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এর পর আশা আছে আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হওয়ার পর বাংলা সাহিত্যে এমফিল ও পিএইচডি করার, যা বেশ কিছু বছর আগে পারিবারের আর্থিক অনটনের জন্য ইচ্ছা থাকলেও করা সম্ভবপর হয়নি।
এই রূপান্তরের যাত্রায় আমি পাশে পেয়েছি মাকে। পরিবার, আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে গিয়ে মা সোচ্চারে বলেছেন, তাঁর সন্তান যা, সেইভাবে কেউ তাকে স্বীকার করতে না পারলে মা তাঁদের সাথে আর সম্পর্ক রাখবেন না। তবু এখনো লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হতে হয়, অবমাননার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। প্রান্তিকতা কেটেও বুঝি কাটে না। তা সত্বেও 'সূর্য পোড়া ছাই' এ স্নাত হয়ে নব সূর্যোদয়ের প্রহর গুনছি। শব্দ শুনছি নতুন সমাজ বিপ্লবের। যেখানে সবার উপরে মনুষ্যত্ত্বের জয় গান হবে। তাই প্রদীপ তলে হে কালো, তা ভুলে শিখার আলোকেই ধ্রুব তারা মেনেছি।
আর তাই -
"...হে পূর্ণ তব চারণের কাছে যাহা কিছু সব, আছে আছে আছে..."
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply