আমাদের কোনও অনুশোচনা নেই !
0 244১
দু’দিন আগে বন্ধু উমর খালিদের দিকে তাক করা বন্দুক অল্পের জন্য ফসকে গেল। এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলো দিল্লীর জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পিএইচডি শেষ করা এই কৃতী ছাত্র। কথাটা ভুল লিখলাম, অল্পের জন্য মরতে গিয়েও মরল না উমর। আমাদের দেশে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া খবর নয়। বারবার কাউকে মেরে ফেলতে চেয়েও অপারগ হওয়া তার চেয়ে অনেক বেশি টিআরপি আনে।
২
গত বছর ঠিক এই সময়ে একজন অল্পের জন্য বেঁচে যান নি। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক গৌরী লঙ্কেশকে তাঁর নিজের বাড়ির সামনে গুলি ক’রে হত্যা করে কয়েকজন অচেনা দুষ্কৃতী। ‘অচেনা দুষ্কৃতী’ বললাম কারণ কিছু বিশেষ ‘সমাজের চোখে দুষ্কৃতী’দের অচেনা-অধরা থেকে যাওয়াটাও একটা বেশ লক্ষণীয় ট্রেন্ড হয়ে উঠছে আজকাল। সেদিনও সবাই জানত কেন গৌরী খুন হলেন; সবাই জানত কেন কালবুর্গি নিহত হয়েছেন; শুধু দেশের আইন কিচ্ছুটি জানত না। সেদিনও জানত না, আজও জানেনা। এই এক বছরে এতটুকু ঠাহর করেছে যে কালবুর্গি এবং গৌরীদের হত্যাকাণ্ডের আততায়ীরা হয়ত একই ব্যক্তিবর্গ হলেও হতে পারে; এখনও হলপ করে বলা যাচ্ছেনা যদিও!
তবে উমরের দিকে গুলি চালানো ব্যক্তিদের আমরা চিনতে পেরেছি। ঘন ঘন টিভির পর্দায় যারা মুখ দেখায়, মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা তাদের বেশ ভালোমতোই চিনে নিতে পারে। কোনও এক সূত্রে জানা গিয়েছে, যে দু’জন উমরের দিকে গুলি চালিয়েছে, তারা একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের নিয়মিত অংশগ্রহণকারী এবং সু(!)বক্তা। অতএব, জাতীয়তাবাদী সেলেব! শুধু তাই নয়, বিভিন্ন হোমরা-চোমরাদের সাথেও তাঁদের নিয়মিত ওঠাবসা। তুলনায় বিপরীতে থাকা নামগুলি- কালবুর্গি, দাভোলকর, উমর, গৌরী- কোনওটাই তেমন জমকালো ছবি মাথায় খেলায় না। আশ্চর্যের বিষয়, এই যে ব্যক্তিটি উমরকে মারতে গেলেন, বা আগেও যারা তাঁকে বা কানহাইয়া কুমার বা পানসারেকে মারতে গিয়েছিল, কারও মধ্যেই এতটুকু অনুতাপ বা অনুশোচনা নেই, যেন এমনটাই স্বাভাবিক।
এ মাসের ‘এখন আলাপ’ এর কিস্তি লিখতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আমায়। কারণ, একদিকে ভাবছি গৌরী-উমর কে নিয়ে, অথচ আমার বর্তমানের চারপাশের সাথে কিছুতেই মেলাতে পারছি না মাথার ভেতরের বাস্তবটুকু। গতকাল বার্লিনে নব-নাৎসিরা একটা মিছিলের ডাক দেয়, যার উদ্দেশ্য জনৈক নাৎসি-সেনাপতি রুডলফ হেস-এর মৃত্যুদিন স্মরণ। যে ব্যক্তির নির্দেশে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয় কয়েক মিনিটের মধ্যে, সেই রুডলফ হেস-কে মনে রেখে মিছিল বেরোয়! সামনের সারিতে হাতে ধরা ব্যানারে লেখা
“আমার কোন অনুশোচনা নেই” (Ich bereue nichts)
কিন্তু মিছিল বেশি দূর এগোতে পারেনা; তার আগেই চারদিক থেকে ধেয়ে আসে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের ঢল, যাঁরা ছুটির দিনে পথে নেমেছেন সমাজ আগলাতে। তাঁরা বোঝেন, অতীত ইতিহাস থেকে না শিখলে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে ক্রমাগত হোঁচট খেতে হয়। অনুশোচনার ঐতিহাসিক মূল্য না বুঝতে পারাটা ঐতিহাসিক ভুলে পরিণত হতে খুব একটা সময় নেয় না।
৩
এত কিছু হাবিজাবি আপাতভাবে অপ্রাসঙ্গিক কথা লিখছি, কারণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টায় মিল খুঁজে পাচ্ছি প্রচুর। গৌরী লঙ্কেশের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আসতে আসতেই অটলবিহারী বাজপেয়ী মারা গেলেন। মৃত্যুকালে ওনার বয়স হয়েছিল ৯৩, গৌরী-র ৫৫। যেদিন বাজপেয়ী মারা গেলেন, মুহূর্তের মধ্যে ফেসবুক ছেয়ে গিয়েছিল বাজপেয়ী-র কাব্যিক ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে সাফল্যের স্তব-স্তুতিতে। বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস! এই জাতি বাজপেয়ীকে মনে রাখল কেবলমাত্র তাঁর কবিতা এবং পাকিস্তান-বিরোধী অবস্থানের স্মরণে। তাঁর দেশদ্রোহিতার ইতিহাস কেউ মনে রাখেনি। ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দিয়ে স্বাধীনতার লড়াই থেকে হাত মুছে নেওয়া হিন্দুত্ববাদী এক নেতাকে আমরা মহান বলে ব্যাখ্যা করছি। দেশের ভার তাঁর হাতে কয়েক বছরের জন্য তুলে দিয়েও থামিনি আমরা। তাঁর মৃত্যুর পরে মহানায়ক বানিয়ে দিচ্ছি তাকে।
বিপরীতে, স্বাধীন ভারতীয় নাগরিকের নিত্যনৈমিত্তিক সংগ্রামের যোদ্ধাদের ‘ভিলেন’ বানাচ্ছি সেই আমরাই। গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুর পর বেশ কিছু খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানাবিধ জলঘোলা হতে থাকল। প্রশ্নের মুখে পড়ল তাঁর সাংবাদিকতার আদর্শ। একটি বারের জন্যেও কেউ জানবার প্রয়োজন বোধ করলেন না সত্যটি কী! উমরের ক্ষেত্রেও তাই। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ পেয়েও দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত গবেষণা করে দেশদ্রোহিতার আখ্যা লাভ করা আসলেই উল্লেখযোগ্য।
আমাদের বর্তমান ভারতবর্ষের কোনও অনুশোচনা নেই। নেই ইতিহাস থেকে শেখার, ইতিহাসকে মনে রাখার ন্যুনতম ইচ্ছাটুকু। শুধু আছে মিথ্যার পাহাড়, যার দায় গৌরী-দাভোলকার-পানসারে হত্যার দায়ের চেয়েও অনেক বড়।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply