• স্মৃতির গুমঘরে শৈশবের বসন্তমালতী


    0    246

    January 1, 2019

     

    ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় মলিনা দেবী, তাঁর প্রতিবেশিনী স্বামী ভোলাতে একটু সাজগোজের পরামর্শ দিলে, জবাবে খানিকটা অসহায়মুখ করেই বলেছিলেন ‘যৌবনের রং-ঢং আর আসেনা ভাই’। সংলাপটা মনে পড়লেই ঢং করে ঘণ্টা বাজে স্মৃতির গুমঘরে। এই ঢং শব্দটা যে কতদিন শুনি না। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন ঢং চারদিকে ঢংঢং করে বাজত। আমরা ইস্কুলমাঠে ছড়া কাটতে কাটতে খেলতাম

    ঢঙী ঢং করে

    ঢঙী কচুপাতায় রং করে

    ঢঙীর কানে নেই দুল

    ঢঙীর মাথায় গোঁজা ফুল

    ঢঙী যখন, তখন কোনো মেয়ের কথাই বলা হচ্ছে নিশ্চয়। তবে কেমন সেই মেয়ের সাজের ধরন, যার কানে দুল নেই, অথচ মাথায় ফুল গোঁজা? সেসব প্রশ্ন আমাদের মফস্বলি মাথায় কখনো উদয় হয়নি। আমাদের মতো পরিবারে চাল-ডাল-তেল-নুনের বাইরে যা কেনা হত তা হল বই। বই-ই ছিল আমাদের প্রসাধনী, ডিসকভারি চ্যানেল কিংবা বাড়ির ডিজাইনার আইটেম। এর বাইরে যা আসত, সেখানেও দেখা হত জিনিসটা যেন আমাদের চরিত্র নষ্ট করতে না পারে, অর্থাৎ ঢঙী করে তুলতে না পারে। একেবারে বাঁধা ছিল বসন্ত মালতী, কেয়োকার্পিন আর সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন। বসন্ত মালতী নামটা বোধহয় সেই শৈশবের প্রথম লগ্নজিতা, যে কুহুস্বরের মতো গেয়ে গেয়ে পাগল করে দেয় ‘বসন্ত এসে গেছে!’ বসন্ত তো তখন একমাত্র ছিল পুরাতন ভৃত্যতে – ‘কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত আমি বসন্তে মরি’ , আর ছিল ভাব সম্প্রসারণে – ‘If winter comes can spring be far behind?’

    এ দু’য়ের বাইরে যেমন বসন্ত করাঘাত ক'রে ফিরে গেছে, তেমনি ব্রাত্য ছিল সাজগোজ, ফ্যাশন অর্থাৎ যাবতীয় রং-ঢং। তখন পোশাক বা প্রসাধনী কেনার সময় দেখা হত কতদিন চলবে। প্রায়ই জামা কেনা হত দু’ সাইজ বড়, যাতে আরও দু’টো বছর হেসেখেলে চলে যায়। এমনকি জুতো পর্যন্ত! সেসব জামা জুতো পরে লটরপটর করতে করতে আমরা যেমন অকুতোভয়ে বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধ বাসরে গিয়েছি, অতটা সাহস ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে যাওয়া শহীদদেরও ছিল কিনা সন্দেহ। সাবান কেনা হত গীতায় বর্ণিত আত্মার মতো; আগুনের কথা বাদ দিন, অন্তত জলে যা গলবে না, এবং ছুঁড়ে মেরে দু-চারটে ছিঁচকে চোর ঘায়েল করা যাবে। এমন ‘ভ্যালু অ্যাডিশন’ বহুজাতিক সংস্থাগুলোও ভাবতে পারবে না। এগুলো মাখতে আমাদের ভাল লাগত কি না সেসব আমাদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি, আমরাও ভাবিনি। আর ভেবেই বা কী করতাম? বিশ্বায়ন-পূর্ব মফস্বলে হাজার চ্যানেল দূরের কথা, টিভিই ঢোকেনি।  পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে কয়েক মাইল হেঁটে গেলেও কোনও বিউটি পার্লার চোখে পড়বে না। মনে রাখতে হবে সে এক আশ্চর্য ক্রান্তিকাল! পায়ে আলতা পরানোর নাপতিনীরা উধাও হয়ে গেছেন, সে জায়গায় কোন নতুন রূপসীপীঠ তৈরি হয়নি। সব্যসাচী, অগ্নিমিত্রা এরাই বা তখন কোথায়! তাই যা পাচ্ছি তা-ই সোনামুখ করে মাখা বা পরা ছাড়া আর উপায় কী?

    তবে মাখতে যতই চটচটে হোক, বোরোলিন প্রিয় ছিল অন্য একটা কারণে। সেটা রোববারের বোরোলিনের সংসার। খাসির মাংস, ভাত আর বোরোলিনের সংসার – রোববারের দুপুরের একদম উত্তম-সুচিত্রা জুটি। আর সেখানেই শ্রাবন্তী মজুমদারের মাদক গলার প্রেমে পড়া। আমার মতো আরও অনেকেই। তবু তারাই আবার বলত ‘মহিলা কি ঢঙী না? বড্ড ঢং ক’রে কথা বলে’ তখন বুঝলাম ঢং কথাটা অত খারাপ না। ঢং মানে স্টাইল। আগেই বলেছি, বই ছিল সে সময়ের একমাত্র প্রসাধনী। শেষের কবিতা কবেই পড়া হয়ে গেছে। ফ্যাশন-স্টাইল-মুখ-মুখশ্রী গেঁথে গেছে মনে। তাই খারাপ তো লাগলই না, বরং জীবনের প্রথম ‘বিউটি টিপস’ পেলাম, সে ঐ ঢঙীর কাছ থেকেই –

    “শীতকালে তেল মাখার সময় তো রোজ পাওয়া যায় না। তাই এক মগ ঈষদুষ্ণ জলে কয়েক ফোঁটা  নারকেল তেল মিশিয়ে গায়ে ঢালুন। দেখবেন সমস্ত ময়লা বেরিয়ে ত্বক একদম ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেছে”।

    আহা! শুনলেই মনেরও সব ময়লা বেরিয়ে পরিষ্কার হয়ে যেত।

     

    বসন্তমালতী, কেয়োকার্পিন আর বোরোলিন - এই ত্রিশক্তির বাইরে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকল শিঙ্গার কুমকুম। সেটা দিয়ে কপালে টিপ আঁকা অত সহজ ছিল না। একে তো স্কেল ছাড়া একটা সোজা লাইনও টানতে পারিনা (পরবর্তী কালে এঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এ যে কারণে মুশকিলে পড়তাম), সেখানে একটা নির্ভুল গোল আঁকা কী যে বিভ্রাট! আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপ পরা তো একটা অপরাধের মধ্যে পড়ে, কারণ তাহলেই বিদ্যেবতী কন্যা ঢঙী হয়ে পড়বে! রবিঠাকুর যে শিখিয়ে গেছেন ‘অসভ্য দেশের মেয়েরাই মুখে চিত্তির করে’...। সেই আমি কিনা বাবার কাছে একটা লিপস্টিক চেয়ে বসলাম!  কারণ আর কিছু নয়, আমাদের ছোট শহরে ততদিনে টিভি এসেছে কতিপয় ধনী বাড়িতে আর সেইরকম একজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখেছি ‘মহানগর’ সিনেমা চলছে আর মাধবী মুখার্জি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছেন। আমার সেই বালিকাবেলায় দৃশ্যটি অনুদিত হল এইভাবে – লিপস্টিক আসলে মেয়েদের নিজের সঙ্গে চলা সংলাপ। সাধ হল এমন সংলাপের অংশীদার হতে।

    তো বহু সাধ্য-সাধনার পর বাবা এনে দিলেন একটি লিপস্টিক। রংটি যাকে বলা হত ন্যাচারাল কালার। সেটি পরলে ঠোঁটটা শুধু চকচক করত, তার বেশি কিছু নয়। এর আগে পর্যন্ত আমার গর্বের জিনিস ছিল ‘সরি ম্যাডাম’। এটা আর কিছু না, হেয়ার ব্যান্ড। এটাকে কেন ‘সরি ম্যাডাম’ বলা হত তা কে বলবে? এখন যোগ হল একটা লিপস্টিক। এর কিছুদিন পর কলকাতা থেকে একটি মেয়ে এল । আমাদের পাশের বাড়িটা তার মামারবাড়ি। তার মামা এসে একদিন কাঁচুমাচু মুখে জানাল, ভাগ্নী পুজোয় ফলস চোখের পাতা আর ফলস নখ চেয়েছে। এই পোড়া শহরে কোথায় পাওয়া যাবে ওসব? কিন্তু পাওয়া গেল সত্যি। আমাদের শহরটা বদলাচ্ছে বুঝতে পারলাম।  এখানে এখন ফলস চোখের পাতা আর নখ পাওয়া যায়। দুদিন বাদে হয়ত ফলস.. ডেঁপো  কেউ কেউ বলল।

    সব হয়ত পাওয়া যেত, কিন্তু আমাদের জামাকাপড় বরাবর কেনা হত কলকাতা থেকে। আর সেইসময়ই জানতে পারতাম এবারের পুজোর ‘ইন থিং’ কি। সে বছরের হিট সিনেমার নামে ড্রেস উঠত। একটা রবিঠাকুরের জোব্বা টাইপের ড্রেস হল একবার। তার নাম ‘সনম তেরি কসম’। পরার পর বন্ধুরা বলল তোর তো খুব ঢং বেড়ে গেছে। আর একবার উঠল নুরি চুড়িদার, নুরি সিনেমার নামে। তার কামিজের কোমরে দড়ি বাঁধা। সেই চুড়িদার মহা আনন্দে বছর দুই পরার পর সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম চুড়িদারের একটা পা আরেকটার থেকে আধহাত লম্বা! সেটাই পরে গেছি দিনের পর দিন। সত্যি সত্যি ঢঙী হলে  কি এমনটা হতে পারত?

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics