08-03-2024 18:03:43 pm
Link: https://ebongalap.org/1493-2
পুজো আসছে। প্রতিবছরই এই সময়টায় টিচার্স রুমের সাম্বাৎসরিক ডি.এ আর পে-কমিশন নিয়ে আলাপ-আলোচনায় অল্পবিস্তর ছেদ পড়ে। তার বদলে কে কোথায় পুজোর বাজার করল, কার কত খরচ হল সেসব নিয়ে পরস্পর খানিক কথা চালাচালি হয়। কখনো কখনো অলস-বিস্ময়ে ভাবি, একদল পরস্পর অতি চেনা মানুষ, একটাই ঘরে বসে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কীভাবে শুধু মহার্ঘভাতা আর অনাগত পে-কমিশনের কাল্পনিক হিসাব-নিকাশ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে!! ‘অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?’ তাই, পুজোর মুখে এই কিঞ্চিৎ স্বাদ-বদলটা নেহাৎ মন্দ লাগে না। হাতের বইটা মুড়ে রেখে আলোচনায় অংশ নিই। কলকাতার কোনো শপিং মলের থেকে পাড়ার দোকানে যে জামা-কাপড় তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যায় আর সেগুলো গুণমানেও অনেক ভাল হয় – সে বিরল সংবাদটি সকলকে জানিয়ে বিপুল আত্মশ্লাঘা অনুভব করি।
আলোচনাটা মাঝপথে ফেলেই ক্লাসে যেতে হয়েছিল। একাদশ শ্রেণিতে চল্লিশ মিনিট বাংলা পড়িয়ে ফেরার পথে টের পেলাম একটি মেয়ে পিছু নিয়েছে। রোগাপানা কালো-কুলো চেহারার একটা মেয়ে। খুবই কুণ্ঠিত স্বরে জানাল, কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলতে চায় ও এবং কিছু পরামর্শ চায়।
এটা আমার সঙ্গেই হয়। প্রতিবছর হয়। সেই কবে, ছোটবেলায় একবার ঠিক এমন করেই অনাগত পুজোর আনন্দটা মাটি করে দিয়েছিলেন ‘হক-স্যর’। পুরো নাম তাঁর -- ফজলুল হক। দর্শনে এম এ হক-স্যরকে মাঝে মাঝে কথায় পেত। তেমনই একবার, পুজোর ছুটি পড়ার আগের দিন ক্লাস নিতে এসে গল্প শোনাতে বসলেন। শোনালেন তিনি সেই বুড়িটার গল্প, সপ্তমীর সন্ধ্যায় ভিড়ে-ভিড়াক্কার শহরের ফুটপাথের এক কোনায় যে কটা হাঁসের ডিম আর শুকনো কয়েক আঁটি পুঁইশাক নিয়ে খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকে, পাশে নাক দিয়ে সিকনি-গড়ানো নাতনি। ওই ডিম আর শাক বিক্রি করলে তবে তাদের রাতের ভাতের ব্যবস্থা হবে। বললেন অষ্টমীর সন্ধ্যায় একটাও প্যাসেঞ্জার না পেয়ে বসে বসে ঝিমোতে থাকা বুড়ো রিকশাওয়ালার গল্প, যার ছেলের পুজোয় কোনো নতুন জামা হয়নি। শোনালেন ঢাকির সাথে কাশি বাজাতে আসা তার আট বছরের বাচ্চা ছেলেটার কাহিনি...। আর সেই সব হাবিজাবি গল্পকথা শুনে সেকী উথাল-পাথাল কান্না সেদিনের আমার সেই শিশুমনে।
মেয়েটার নাম হাবিবা খাতুন। মাস্টারমশাইকে একটু আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল সে। বুঝতে পারলাম, কী বলবে গুছিয়ে উঠতে পারছে না। সময় দিলুম ওকে খানিকটা। এই রকম মুহূর্তে ওই সময়টুকু ভারি প্রয়োজনীয়। তারপর কথা বলল হাবিবা। যা বলার সংক্ষেপেই বলল। আর ও যখন কথা বলছিল, লক্ষ্য করছিলাম, খুব ধীরে ধীরে ওর চোখ দুটো কেমন যেন সজল হয়ে উঠছে। সেই ছেলেবেলায়, বিসর্জনের দিন সন্ধ্যায় হ্যাজাকের আলোয় মা দুর্গার চোখদুটোকে যেমন ছলছল করতে দেখা যেত, অবিকল যেন তেমনটাই। আর ঠিক তারপরই ভোরের আলোয় ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দু ফুটে ওঠার মত নিটোল দুটো জলের বিন্দু ফুটে উঠল ওর দুই চোখের কোলে। আর আমি মনে মনে বললুম, গেল আমার এবারের পুজোটাও।
হাবিবার বাবার ক্যানসার। আর মাস ছয়েক, খুব বেশি হলে বছরখানেক বাঁচবেন। মা সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করেন। এক ভাই সহ ওরা চারজন মামার বাড়িতে আশ্রিত। মামার নিজের দুই মেয়ে। তিনিও দিনমজুর। তাঁর পক্ষে আর এতগুলো পেটের খরচ টানা সম্ভব হচ্ছে না। আর সেই অক্ষমতার প্রথম বলি হতে চলেছে হাবিবা। তিনি ওর বিয়ের চেষ্টা শুরু করেছেন। হাবিবা পড়তে চায়। ‘মামার কোনো দোষ নেই। উনি নিরুপায়। কিন্তু আমি এখন কী করব বলতে পারেন স্যর?’ এই ছিল হাবিবার শেষ প্রশ্ন।
স্টাফরুমে ফিরে এসে দেখলাম, চল্লিশ-হাজারি পঞ্চাশ-হাজারি মনসবদারের সক্কলে মিলে ‘বেতন কেন বাড়ছে না’ এই মর্মে সরকারের বাপান্ত করতে শুরু করেছেন আবার। যথারীতি। যাক, তবু বাঁচোয়া। অন্তত পুজো নিয়ে আদিখ্যেতাটা তো আর করতে হবে না।
ওই মাস্টারমশাইদের দলে একজন আছেন, হীরকরাজের ‘যক্ষ’ সম্প্রতি তাঁর ‘মগজ-ধোলাইয়ে’ সক্ষম হয়েছে, ফলত তিনি হঠাৎ-ই ভয়ঙ্কর রকম মুসলিম-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছেন। শুধু এই দেশের নয়, গোটা পৃথিবীর যাবতীয় দুর্দশার জন্য যে ‘ওরাই’ দায়ী, ওই জাতটাই যে হিংস্র এবং মারকুটে, ওদের তোষণ করে করেই যে এই রাজ্যটা অধঃপাতের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে, ইত্যকার মত উনি প্রায়শই স্টাফরুমে সরবে ব্যক্ত করে থাকেন। এবং প্রতিটি মন্তব্যের পর সকলের সম্মতি প্রত্যাশায় একবার করে বলেন, ‘ঠিক কিনা?’ (এটাও হীরক-রাজা সিনড্রোম) অনেকেই তাঁর কথায় মৃদু সম্মতি জ্ঞাপন করেন, বাকিরা চুপ করে থাকেন। শাস্ত্রে বলে, নীরবতা নাকি সম্মতিরই লক্ষণ। তা খুব একটা ভুল বলে না। কোনো দেশে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে যদি দীর্ঘদিন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বঞ্চিত করে রাখা হয় তাহলে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের অনেকেই হাতে বন্দুক তুলে নিতে পারে। তাতে সংখ্যাগুরুদের সুবিধাই হয়, কারণ এতে করে গোটা জাতটাকেই হিংস্র বলে দেগে দেওয়া যায় – এই খুব সহজ সত্যটা একদিন ওই মাস্টারমশাইকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলুম। বাকিদের এতদিনকার নীরব সম্মতি যে কতটা সরব হয়ে উঠতে পারে, সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলুম। এবং উপলব্ধি করতে পেরেছিলুম, হিংস্রতা ব্যাপারটা কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একচেটিয়া নয় মোটেই।
হঠাৎ মনে হল, হাবিবা তো ওই মাস্টারমশাইয়েরও ছাত্রী। সত্যি, ‘আমাদের’ জীবনে-যাপনে-বিলাসে-ব্যসনে কি অদ্ভুত ‘ওদের’ এই অনস্তিত্ব, তাই না?
হাবিবার কথা বলছিলাম মনখারাপের সঙ্গী এক বান্ধবীকে। তিনি একটা ছোটখাটো চাকরি করেন। সংসারও করেন, ছেলেমেয়েও মানুষ করেন। ওই যে চলতি কথায় বলে না, ‘দশভূজার মত’, অনেকটা সেরকমই। সবটুকু শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘মাসে হাজার দেড়েক টাকা পেলে ওর অন্তত দুটো প্রাইভেট টিউশন আর বই খাতার খরচটা হয়ে যাবে না? এক কাজ কর, ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা চেয়ে নিয়ে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দে। তবে একটা রিকোয়েস্ট আছে। আমার শ্বশুরবাড়ির লোক যেন এই ব্যাপারটা জানতে না পারে। বুঝিস-ই তো সব...।’
ছেলেবেলায় দেখতাম, প্রতিবছর ঠাকুর বিসর্জনের পরদিন সকালে পাড়ার মণ্ডপের ঢাকি ঢাক বাজিয়ে বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াত। বাড়ির কর্ত্রীরা যে যা খুশি হয়ে দিতেন, নাড়ু-নিমকি-বোঁদে বা নগদ দু’চার টাকা – সবই ওরা নিয়ে ঝোলায় কাঁধের ঝোলায় পুরত। ঢাকির কাঁধের ঝোলাটা সেই অল্প অল্প দানে আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে উঠত, আর তার ঢাকের বাজনাটা পাড়ার কোনো গলিপথে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেত দূরে। কেন জানি না, পুজোর দিনগুলোর তুলনায় বিসর্জনের পরদিনের সেই ঢাকের বাজনাটা ভারি ভাল লাগত আমার। ওই বাজনার মধ্যে যেন ঘরে ফেরার একটা আনন্দ লুকিয়ে থাকত, থাকত উৎসবের উদ্দাম হুল্লোড় শেষে শান্ত কিন্তু মহত্তম প্রাত্যহিকতায় ফেরার একটা নিবিড় মায়া।
বন্ধুনীর কথাগুলো কেন জানি না, ছেলেবেলার শোনা বিসর্জনের পরদিনের সেই ঢাকের বাজনার স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনল আমার কানে।
Link: https://ebongalap.org/1493-2