04-06-2024 12:26:02 pm
Link: https://ebongalap.org/18-or-21-girls-marriage-age
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করবার জন্য সরকার নতুন আইন পাশ করবার প্রস্তাব এনেছে। ‘এবং আলাপ’ সব মানুষের সমান অধিকার লাভের অংশ হিসেবে জেন্ডার নিয়ে কাজ করে। আমাদের মনে হয়েছে, এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। আলোচনা মানেই পক্ষ নেওয়া নয়, বিতর্ক গণতন্ত্রের মূল কথা, তাই আমরা এই আলোচনা শুরু করছি এবং আপনাদের ডাকছি এই আলোচনায় যোগ দেওয়ার জন্য। আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা করে যে বিষয়গুলোকে দেখা ও প্রশ্ন করা জরুরি মনে করছি, সেগুলো আপনাদের কাছে তুলে ধরছি, যাতে আপনারা বিষয়টাকে খতিয়ে দেখতে পারেন। আমাদের চারপাশে চটজলদি পক্ষ নেওয়ার গাজোয়ারি বাধ্যতার যে আবহ তৈরি হয়েছে, আমরা মনে করি তার ফল ভয়াবহ হতে চলেছে। যে যেখানে আছি ‘ভাবা প্র্যাকটিস করা’ খুব জরুরি।
মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর প্রস্তাব দেখলে প্রথমে মনে হয় অতি সাধু প্রস্তাব। ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে না গিয়ে যদি ২১ পর্যন্ত মেয়েটি বাপের বাড়ি থাকে তবে সেটা তার পক্ষে ভালো হবে। একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। বাড়তি তিন বছর বাপের বাড়ি থাকলেই কি একটি মেয়ের নানান কিছু করবার চয়েস বাড়বে? এই বয়স অবধি বাপের বাড়ি থাকলে তার কলেজে পড়ার বয়স হবে, চাকরি করবার বয়স হবে। আমরা যদি চার দিকে দেখি তাহলে নানান রকম পরিবার দেখব। কিছু পরিবার মেয়েদের শিক্ষার, চাকরির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, তারা কিন্তু এমনিতেই মেয়েদের কলেজে পড়াচ্ছে, ১৮ হলেই পার করে দিচ্ছে না। এমনকী অনেক মা-বাবা মেয়েকে বলছে চাকরি করা দরকার। তার জন্যে ২১ বছরে বিয়ের আইন দরকার হচ্ছে না। অন্য দিকে যে পরিবারগুলো মেয়েদের জন্য খরচ করাটা বাজে বিনিয়োগ মনে করে, তারা যখন বাধ্য হবে আরও তিন বছর মেয়েকে ‘পুষতে’, তখন তারা কি চাইবে এই তিন বছরে খরচ করে পড়াতে? নাকি আরও আরও বাড়ির কাজ করিয়ে নিয়ে খরচ উশুল করে নেবে? আর ‘আইনের ফেরে’ পড়ে এই ‘বাড়তি দায়ের’ জন্য মেয়েটার জীবন দুর্বিষহ করে দেবে?
২১ বছর অবধি বাপের বাড়ি থাকলেই কি মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ বাড়বে? সব ক্ষেত্রে তো তা মনে হয় না। মনে হয়, মেয়েদের শিক্ষার জন্য আরও অনেক কিছু দরকার, যে বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ কিন্তু আমরা তেমন ভাবে দেখছি না। সেই উদ্যোগ না নিয়ে, স্কুলে মেয়েদের জন্য যথেষ্ট ক্লাসরুম, বাথরুম না বানিয়ে, সরকারি স্কুলগুলোতে বছরের পর বছর শিক্ষক না নিয়োগ করে, পাঠ্যবইয়ের যোগান নিশ্চিত না করে, বিয়ের বয়স বাড়ানোর উদ্দেশ্য মেয়েদের আরও শিক্ষিত করা, এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন নয় কি?
আমাদের দেশে গরিব মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই বাড়ির কাজে, ক্ষেতে, বিড়ি বাঁধায়, বাবুর বাড়ি কাজ করায়, মা-কে মোট বইতে সাহায্য করায় এমনকী যৌন পেশায় প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে চলে। মেয়েদের কাজের অধিকার এবং জীবিকা অর্জনের অধিকার একটা খুব জরুরি দাবি। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে বিয়ের আগে বা পরে মেয়েদের চাকরিতে যোগ দেওয়া নিয়ে এখনও অনেক পরিবারে অসম্মতি দেখা যায়। তথাকথিত শিক্ষিত ছেলেরাও জাঁক করে বলে, ‘আমার বউকে চাকরি করতে দেবো না’। সমস্ত তথ্য থেকেই এ কথা পরিস্কার যে যত মেয়ে পড়তে আসে, তার অধিকাংশই চাকরি অবধি যেতে পারে না, পরিবারের ভেতরের কাজেই জীবন কাটায়। এইসব বিষয়ে কোনও কাজ না করে, কেবল বিয়ের বয়স বাড়িয়ে হবেটা কী!
আমাদের দেশে কিন্তু মেয়েদের বিয়ের বয়স এমনিতেই ওপরের দিকে উঠছে। গ্ড় বয়স প্রায় আঠারোর কাছাকাছি এসেছে। কাজেই এই দিকে যে খুব একটা সংকট ছিল তা নয়। মেয়েদের সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্মহারও কমছে, কারণ মেয়েরা আর বছর বছর বাচ্চা নিতে রাজি নয়। কিন্তু এই করোনার সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অনেক পরিবারে আবার ১৪-১৫ বছরের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার একটা প্রধান কারণ, দারিদ্র্য। পরিবারে রোজগার নেই, আয় নেই, খাদ্য নেই—তাই দাও মেয়েটাকে পার করে। প্রশ্ন হলো, এই সামাজিক সংকটের মোকাবিলা না করে, আইন দিয়ে কি এটা আটকানো যাবে? আমরা কিন্তু দেখলাম না যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কোনও বড় সরকারি সহায়তা এল। উল্টে কিছু রাজ্যে দেখলাম এমন নতুন শ্রম আইন হয়েছে যাতে শ্রমিকদের কম পয়সায় বেশিক্ষণ খাটানো যাবে। তাহলে তাদের ভালো, তাদের মেয়েদের ভালো চাওয়া হচ্ছে, এটা পরিবারগুলো বিশ্বাস করবে কী করে?
মেয়েদের বিয়ে পেছোনোর সব যুক্তিগুলোর মধ্যে একটা বোধ আছে, পড়াশোনা হোক বা চাকরিতে ঢোকা, যা করার বিয়ের আগে সেরে নিতে হবে। আমরা চারপাশে দেখি সমাজের সব শ্রেণির মেয়েদের মধ্যেই এই মনোভাব যে যা মজা করার বিয়ের আগে সেরে নিতে হবে। তারপর জেলখানায় ঢুকতে হবে। বহু বিয়েতে এটাই বাস্তব যদি না হতো, তাহলে এই মনোভাব এত ছড়াত না। প্রশ্ন হলো, ১৮-র জায়গায় ২১ বছরে বিয়ে হলে তো এই সমস্যার কোনও সমাধান আমাদের মিলছে না। একটা মেয়েকে কেন ধরে নিতে হবে বিয়ে মানেই স্বাধীন জীবন শেষ?
আমাদের সমাজ সত্যিই আশ্চর্য! মেয়েদের বিয়ে নিয়ে এত আলোচনা, তার মধ্যে আমরা একবারও কেউ যৌনতার কথা তুলছি না। একবারও শুনিনি যে, যে মেয়েদের নিয়ে এত কথা হচ্ছে তারাই বলেছে যে আমাদের বিয়ের বয়স পিছিয়ে ২১ হোক এটা চাইছি। চারপাশে কিন্তু আমরা উল্টোটাই দেখছি। আমাদের দেশে যে মেয়েদের পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যা তেমন হয়তো নেই, তাদের বাবা-মায়েদেরও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পেছনে একটা প্রধান কারণ, যৌন সুরক্ষার আভাব। পরিবারে কথা বললে বাপমায়েরা প্রথমেই বলে একবার বয়স হয়ে গেলে (মানে শরীরে নারীত্বের চিহ্ন ফুটে উঠলে) মেয়েকে ছেলেদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল। বিপদ দু-ধরণের: হয় রেপ হবে, নয় মেয়ে পালিয়ে যাবে। প্রথম ক্ষেত্রে মেয়েটির সম্মতির প্রশ্ন নেই, দ্বিতীয়টিতে আছে, কাজেই অনেক পরিবারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি বেশি লজ্জার। চারদিকে যে অনার কিলিং দেখি, রেপও তার কারণ হতে পারে, কিন্তু মেয়ে সম্মতি দিয়ে যৌনতা করছে, এটা নাকি চূড়ান্ত লজ্জার!
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি ১৪/১৫ বছর থেকেই যৌন ইচ্ছা থাকে, সমাজের জন্য তো শরীর-মন অপেক্ষা করে না। আমাদের দেশে তথ্য বলে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিয়ের বাইরে যৌনতার সুযোগ থাকলেও, মেয়েদের অধিকাংশেরই যৌনতার একমাত্র পথ বিয়ে। তাই বেশ কিছু মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এই সংখ্যা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারে বেশি কারণ সেখানে দারিদ্র্যের বন্দিত্ব থেকে বিয়ে একটা মুক্তির স্বপ্ন দেখায়। আমরা জানি পাচারকারীরা অনেক সময় র্স্মাট ছেলেদের আড়কাঠি হিসেবে ব্যবহার করে। বাড়তি তিন বছর এই যৌনতাহীনতায় মেয়েদের বাধ্য করাটায় লাভ হবে কার? সম্ভব হবে কত দূর? পাশাপাশি যৌনতাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা ছেলেদেরও ক্রিমিনাল হিসেবে দাগিয়ে দেয়। আইন এই ব্যাপারে পরিস্কার নয় বলে, বাড়ি থেকে পালানো মেয়েরা এখন যায় হোমে আর ছেলেরা যায় জেলে। দুজনের সম্মতির ভিত্তিতে পালালে ছেলেটি কেন জেলে যাবে, সেটাও পরিস্কার নয়। পসকো আইন বলে ১৬ বছর যৌন সম্মতির বয়স। এই আইন বলবে ২১-এর আগে যৌনতা নয়। এর ফলে কী কুমারী মাতৃত্বের বাড়তি সংকট তৈরি হতে পারে?
যে সমাজে কন্যাকে দায় মনে করা হয়, সেখানে তো বিয়ের বয়স তিন বছর বাড়লে পরিবারের এ কথা মনে হতেই পারে। তবে মেয়েরা যে কোনও পরিবারে কোনও বয়সেই ‘দায়’ নয়, সে কথা প্রমাণ করার ‘দায়’ মেয়েদের নেই। যে পরিবারে প্রায় জন্ম থেকেই ঘরের, ক্ষেতের অধিকাংশ কাজ মেয়েরা করে, বিয়ের আগে ভাই-বোন সামলায়, মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগায়, আবার বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী দেওর ননদ, ভাসুর, বাচ্চাকাচ্চা সবাইকে সামলায়, তারা কেন প্রমাণ করতে যাবে তারা দায় নয়? বরং বিয়ের আগে বাপের বাড়ির আর বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির সবচেয়ে বড় সহায় মেয়েরাই।
আমরা যারা ‘এবং আলাপ’-এ আছি, তারা এই আলোচনায় উৎসাহী। কিন্তু আমাদের সবার প্রতিক্রিয়া ঠিক এক নয়, যেটা সংগঠনের সুস্থতার লক্ষণ। একুশে আইন কথাটা আপনারা কেউ কেউ হয়তো জানেন। সুকুমার রায়ের কবিতা থেকে নেওয়া। সেই কবিতায় একুশে আইন খুব একটা সুবিধের আইন নয়। তাই আমাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল যে এই নাম দিয়ে আমাদের মধ্যেকার এক ধরনের বিরোধী ঝোঁক আমরা প্রকাশ করছি কি না? আমরা তাই একটা প্রশ্ন চিহ্ন দিয়ে তর্কের অবকাশ রেখেছি। তবে এ কথাও ঠিক আমাদের এই আলোচনায় বড় কিছু সন্দেহ উঠে এসেছে। তার একটা কারণ হলো, আইনকানুন, সমাজ কিছুই সম্পর্কশূন্য নয়। আমরা একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যখন নানা সম্প্রদায়ের ওপর অকারণে নানা আক্রমণ নেমে আসছে। সমাজে নানা বিভেদের নতুন নতুন ছুতো তৈরি হচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা স্বাধীন মতে ভিন্ন বর্ণে–ধর্মে–প্রেমে বিয়ে করলে, তাদের খাপ পঞ্চায়েত থেকে নানা হানাদার, থানাদার আর ধর্মের ঠিকাদাররা খুন পর্যন্ত করছে। এই সময়ে এই আইনের কথা হঠাৎ উঠে এল কেন? জনসংখ্যা এই মুহুর্তে বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে না, দেখাই যাচ্ছে। বাকি সব কাজ না করে কেবল এই আইন দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন কিছু হবে না। তবে এই আইনের ওপর এত জোর কেন?
Link: https://ebongalap.org/18-or-21-girls-marriage-age