23-05-2024 23:20:05 pm
Link: https://ebongalap.org/adolescence-gender-in-schools
অনেকগুলো বছর হয়ে গেল, বিদ্যালয় শিক্ষার সাথে যুক্ত আছি। দশ থেকে আঠারো বয়েসি শিক্ষার্থীদের এই অতি-সংবেদনশীল সময়ের সাক্ষী আমরা। ওদের জীবনের ভাঙা-গড়া মূহুর্তের, ওদের দু-চোখ ভর্তি স্বপ্নের কাছে আমাদেরকেই তো অভিভাবকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হয়। তাই, একদিকে যেমন এইসব ছাত্রছাত্রীদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে আমাদের সম্মিলিত সাফল্য বলে দেখি, তেমনি বহু ছাত্রছাত্রীর স্কুল থেকে হারিয়ে যাওয়ার ব্যর্থতা আমাদেরকে গ্রাস করে। দুঃস্বপ্নের কাছে পরাস্ত হয়ে, অভাবের সাথে যুঝে উঠতে না পেরে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা চোরাস্রোত বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে, ওরা যখন কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তখন সে দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত ভাবি-ই বা কী করে! আবার নতুন করে ভাবতে বসি। পড়ানোর সাথে সাথে, জীবনের অমূল্য-পাঠে আমাদের ভুলচুকগুলোকে মেরামত করার চেষ্টা করি।
এসবের থেকে যে সহজ উপলব্ধি হয়েছে এই আঠারো বছরের শিক্ষক জীবনে তা হল, সব পড়ুয়াদের আত্মবিশ্বাসের একটা কাঠামো তৈরি করা দরকার। আর এই নির্মাণের অন্যতম ভিত্তি — তাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা। নিজেদের কথা নিজেরা বলতে পারা, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে পারার এই স্ব-অধিকার বোধ যে বিদ্যালয় পরিসরে যত সুরক্ষিত, সেখানে পড়ুয়ারা ততটাই আত্মবিশ্বাসী! আত্মবিশ্বাসই যাবতীয় শেখার পথকে মসৃণ করে বছরের পর বছর। ফলে, একটি বিদ্যালয়ের লক্ষ্যই থাকে পড়ুয়াদের আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ভাষার উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়।
"
সব পড়ুয়াদের আত্মবিশ্বাসের একটা কাঠামো তৈরি করা দরকার।
আর এই নির্মাণের অন্যতম ভিত্তি —
তাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা।
"
একবার, বছর দশেক আগে, একদল অভিভাবক কার্যত বিদ্যালয়ে এসে আমার উপর চড়াও হয়েছিলেন এই অভিযোগ নিয়ে যে আমি আমার দশম শ্রেণীর ছাত্রীটিকে এমন কী শিখিয়েছি যে তাকে কিছুতেই বিয়েতে রাজি করানো যাচ্ছে না। প্রথমে তাঁদের অভিযোগ ছিল, তারপরে সেটা কাকুতি-মিনতি হল। মুসলিম পরিবারের ওই পিতৃহীন ছাত্রীর জন্য সুপাত্র হাতছাড়া হবার ভয়ে তাঁরা বললেন, “স্যার, ছেলের বাড়ি থেকে ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। আপনি শুধু ওকে রাজি করিয়ে দিন!” বিয়েটা আটকাতে পারিনি আমি। কিন্তু ছাত্রীটি অনার্স গ্র্যাজুয়েট হয়ে প্রথম ফোন করেছিল আমায়। আত্মবিশ্বাসের পরীক্ষায় কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল সে।
এরপর প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছি সুন্দরবন-হিঙ্গলগঞ্জের প্রত্যন্ত একটা স্কুলে। স্কুলের প্রথম দিনেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার দেখে। প্রাথমিকভাবে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ২০০৯ সালের আয়লা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে স্কুলের অধিকাংশ অভিভাবক ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন জীবিকার টানে। যাঁরা রয়ে গেছেন, একফসলি জমিতে চাষবাস করে তাঁদের দিন গুজরান অসম্ভব। তাই ঘরে ঘরে বিড়ি বাঁধার কাজে পরিবারের সদস্যদের সাথে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সামিল। তবে কি এই কারণেই বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট? আরো গভীরভাবে খুঁজতে গিয়ে অন্য তথ্য সামনে চলে এল। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা নয়। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বিদ্যালয়ের চরম উদাসীনতাও বিদ্যালয়-ছুট হওয়ার অন্যতম কারণ! টিফিন পিরিয়ড হলেই দল বেঁধে স্কুলের ছাত্রীদের একটা বড় অংশ হাতে ছুটির দরখাস্ত নিয়ে আমার সামনে হাজির হত। ‘শরীর খারাপ’, ‘পেটে ব্যাথা’, ‘বাড়িতে কাজ’ — মোটামুটি সবার চিরকুটে একই রকম বয়ান। একদিন এদের সবাইকে নিয়ে একটা ফাঁকা হলঘরে বসলাম। খুব সহজ পরিবেশে জানতে চাইলাম স্কুলে ওদের মূল সমস্যাটা ঠিক কোথায়। প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে ওরা কথা বলল। জানালো স্কুলে ওদের টয়লেট-টা কতটা ভয়ংকর নোংরা। সারাদিনে ওরা স্কুলের টয়লেট ব্যবহারই করে না। টিফিনের পর বাড়ি চলে যাওয়ার একটা বড় কারণ স্কুলের এই অস্বাস্থ্যকর টয়লেট। ফলে সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে সারানো হল ছাত্রীদের টয়লেট। দিন তিনেকের মধ্যে ওখানে জলের ব্যবস্থাও পাকাপাকি হল। ঝাড়ুদার নিযুক্ত হল সপ্তাহে একদিন। এবং অবিশ্বাস্যভাবে আমার কাছে ছাত্রীদের ছুটির দরখাস্ত কমে গেল ৯০ শতাংশ! এখন তো টয়লেটে বালতি বা মগ ভেঙে গেলে, ফিনাইল কম পড়লে, সামান্য জলের সমস্যা হলে ওরা হেডস্যারের টেবিলের সামনেই হাজির হয়। সেদিনের ঝুঁকে থাকা মাথাগুলো আজ উঁচু করে অকপটে নিজেদের টয়লেটের সমস্যার কথা বলে। নিজেদের কথা নিজেরা বলতে পারে। তাই, ভাষার অধিকার ওরা পেয়েছে বলেই মনে হয় আজ। এখন ওদের অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী লাগে স্কুলে!
"
সেদিনের ঝুঁকে থাকা মাথাগুলো
আজ উঁচু করে অকপটে
নিজেদের সমস্যার কথা বলে।
"
“আমরাও খেলব স্যার” — ফুটবল খেলার আবদার নিয়ে স্কুলের বেশ কিছু ছাত্রী একদিন হাজির হয়। স্কুলে ছেলেদের ফুটবল লীগ আগেই চালু ছিল। কিন্তু তাই বলে মেয়েদের ফুটবল লীগ শুরু করা? তার উপর গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা সর্টপ্যান্ট-জার্সি পরে মাঠে নামতে পারবে তো?- এসব অনেক প্রশ্নই মাঠের বাইরে ছিল। কিছু ছাত্রীর অভিভাবককে ডাকা হল স্কুলে। চলল দীর্ঘ আলোচনা। পোশাকের দ্বিধা কাটিয়ে তাঁরা অবশেষে সম্মতি দিলেন ফুটবলের। স্কুলের মেয়েরা হইহই করে নেমে পড়ল মাঠে। ফলে, স্কুলে প্রথমবারের জন্য শুরু হওয়া ছাত্রীদের লীগ-ফুটবলে এক এক করে নাম লেখালো ৩৫ জন। শরিফা, আঞ্জুরা, কুঞ্চুমরা সর্টপ্যান্ট আর জার্সিতে স্বচ্ছন্দ হতে মাত্র দিন দুয়েক সময় নিল। তারপর মাঠ দাপিয়ে শুরু করল ফুটবল। ওদের শরীরী ভাষায় যে আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠতে লাগল দিনে দিনে তাকে থামিয়ে দেবার কোনো শক্তি ছিল না ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের।
"
“আমরাও খেলব স্যার”
— ফুটবল খেলার আবদার নিয়ে
স্কুলের বেশ কিছু ছাত্রী একদিন হাজির হয়
"
ছাত্রীদের এই উৎসাহ দেখে সেবছরই স্কুলের এন্যুয়াল স্পোর্টস-এ বেশ কিছু মিক্সড ইভেন্ট শুরু করা গেল স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষকের উদ্যোগে। এমনিতে কো-এড স্কুল। ছেলেমেয়েরা একসাথেই পড়ে। কিন্তু একসাথে খেলাধুলা করাটাও আমাদের জরুরি বলে মনে হল। তাই ‘মিক্সড ইভেন্ট’ জনপ্রিয় হতে সময় নিল না। যে লিঙ্গসমতার পাঠ শ্রেণীকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকে, তাকে খোলা আকাশের নিচে, উন্মুক্ত মাঠেও আনা দরকার ছিল সেদিন। এবং সফল হয়েছিল আমাদের এই উদ্যোগ! অভিভাবকদের দল ভীড় জমাতে শুরু করছে এখন খেলার দিনগুলোতে।
সুস্থ শরীর সুস্থ মনের জন্ম দেয়। অসুস্থ মন, সুস্থ শরীরকেও ব্যতিব্যস্ত করে। এই বিষয় নিয়ে স্কুলে অভিভাবকদের তিনটে মিটিং ডাকা হয়েছিল। প্রথম মিটিং-এ শুধু মায়েরা ছিলেন। পরের মিটিং-এ শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের পুরুষ অভিভাবক। তারপরের মিটিং-এ উভয়েই। বয়ঃসন্ধির সমস্যা, মেয়েদের ঋতুকালীন সমস্যা নিয়ে চলেছিল খুব স্বাস্থ্যকর আলোচনা। আর ঠিক তার পরের বছর শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে স্কুলের ছাত্রীদের উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হল স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা উভয়েই ক্লাসে ক্লাসে ছাত্রীদের শেখালেন যে মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় ঘটনা। এ কোনো অসুখ নয়। তাই ‘শরীর খারাপ নয়, পিরিয়ড হয়েছে’ এই ভাষার চর্চা শুরু হল স্কুলে। এবং কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রীরা অকপটে ‘পিরিয়ড হয়েছে’ এটা স্যার বা ম্যাডামকে অনায়াসে বলতে শিখল। কিন্তু একটা সমস্যা হল যে, স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনটা স্কুলের ঠিক কোথায় বসানো হবে। এই নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে বিস্তর আলোচনাও হল। শেষমেশ ঠিক হল, মেশিন লোকচক্ষুর আড়ালে নয়, সাধারণ জায়গাতেই থাকুক। আর তাই স্কুলের ফার্স্ট-এড-বক্সের পাশেই রাখা হল ভেন্ডিং মেশিন। মাত্র কয়েকদিনের প্রাথমিক সংকোচ কাটিয়ে এই ভেন্ডিং মেশিনটাকে আর পাঁচটা মেশিনের মতই মনে করতে শুরু করল স্কুলের ছেলেমেয়েরা।
"
স্কুলের ছাত্রীদের উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হল
স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন।
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা উভয়েই ক্লাসে ক্লাসে ছাত্রীদের শেখালেন যে
মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় ঘটনা।
"
আসলে যত আড়াল, ততই অন্ধকার। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। যত সংকোচ ততই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। ছাত্রছাত্রীদের বয়ঃসন্ধির এই সময়, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখাটা ভীষণ জরুরি। তাই তাদের শরীরের পরিবর্তনশীল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক ঘটনাগুলিকে প্রকাশ করার জন্য, শিক্ষক-অভিভাবক যৌথভাবে, একটি ‘সাধারণ ভাষা নির্মাণ’ স্কুলের পক্ষ থেকেও অত্যন্ত আবশ্যক। বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবক শিক্ষক-শিক্ষিকারা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই ওই কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। মনের হাজার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, জড়তা কাটিয়ে উঠবার জন্য ভাষাটাই দরকার। আর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই ভাষার অধিকারটুকু তুলে দেবার জন্যই আমরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
Link: https://ebongalap.org/adolescence-gender-in-schools