06-02-2024 11:06:37 am
Link: https://ebongalap.org/ardhek-akash-ashim-chattaraj
১
আমি ওদের কোনোদিন কিছু বলিনি৷ ওরাও আমাকে কিছু বলেনি৷ মানে ওই বোকামোটা করার আগে৷ তার আগে তো ওদের সাথে আমার পরিচয়ই ছিল না৷ তবে বোকামিটা করার পর বলতে বাকি রাখেনি কিছু৷ কিন্তু ওদের বলার ভঙ্গি ছিল এত সুন্দর যে রাগ করা তো দূরের কথা, মনে হয়েছিল আমি ঈশ্বর, সেই বোকা মানুষটা, যে সবার মনে যা খুশি গুঁজে দিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে—হায় হায় আমি এ কী করলাম! আমার সৃষ্টি যে আমারই বশে থাকছে না৷
ওরা কারা! ওরা ওরা, এছাড়া সত্যিই ওদের কোনো পরিচয় শুধু আমার কাছে কেন, কারো কাছেই ছিল না৷ দৃশ্যত ওরা দু-জন৷ কার্যত?
জানি না এটা ওদের জীবনের গল্প না আমার৷ তবে গল্পের শুরুটা এখান থেকেই৷
২
আমি যখন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে থার্ড ইয়ারে পড়ছি, ওরা এখানে পড়তে এল একই বিভাগে৷ সিনিয়ারদের মধ্যে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে আসা সুন্দরীদের নিয়ে কানকানি তো চিরকালের ঐতিহ্য৷ কিন্তু ওদের নিয়ে গুঞ্জনটা গুজগুজ ফিসফিস থেকে হয়ে উঠল ঝড়৷ সব বিভাগের এক-দু' পিস সুন্দরী প্রতি বছরই ছেলেদের হৃদয়ের ধন হয়ে ওঠে৷ সেই ধনেরা কেউ হয় আগেই বাঁধা পড়ে আছে অথবা ধরা দেয় বা অধরাই থাকে৷ কিন্তু দুই ডাকসাইটে সুন্দরী এক ডিপার্টমেন্টে পড়ে, হোস্টেলে এক ঘরে থাকে, একটা সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ায়, কোনোদিন এ সাইকেল চালায় ও পিছনে, কোনোদিন ও সাইকেল চালায় তো এ, ছেলেদের পাত্তা দেওয়া দূরের কথা, ওদের কোনো মেয়ে বন্ধুও নেই—এটা একটা নতুন গল্প৷ জানা কথা নতুন গল্প হজম হতে সময় লাগে৷ হতাশ প্রেমিকেরা কেউ খোঁচা মেরে ওদের বলে ঢাক-কাঁসি, কেউ বলে বাঁশ-বাঁশি৷ মেয়েরা বলে বেশি-বেশি, রূপের দেমাক! আমি শুধু দেখি আর ভাবি, একসাথে থাকে বলেই হয়তো ওদের উপস্থিতির উজ্জ্বলতা ওদের সৌন্দর্য্যকে ছাপিয়ে যায়৷ তাই ওরা কোথাও না থেকেও সর্বত্র থাকে৷ অনেক গল্প রটে ওদের নিয়ে, তারপর রণক্লান্ত গল্পগুলো সময় হজম করে নেয়, শুধু আমার ওই বোকামিটার জন্যে চোঁয়া ঢেকুরটা হয়ে ওঠে আজীবন উপরি পাওনা৷
৩
ওদের বাইরের গল্প বাইরেই হারিয়ে গেল, কিন্তু কী করে যেন ওদের ভিতরের গল্পটায় ঢুকে পড়লাম আমি৷ সে হয়তো আমার স্বভাব দোষ৷ বাইরেটা নিয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই, আড়াল থেকে ভিতরে ঢুকে পড়াই আমার স্বভাব৷
আমি একলা থাকতে ভালোবাসি৷ শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি একলা মানুষদের আশ্রয় দেয়৷ একলা মানুষ রবীন্দ্রনাথের এই একমাত্র রাবীন্দ্রিকতাটুকুই তখনো অবশিষ্ট ছিল শান্তিনিকেতনে৷ পূর্ণিমার খোয়াই, বসন্তের ভোরে মেঠো পথ, শীতের কুয়াশায় পাশের গ্রামের খেজুরের রস, গ্রীষ্মের তাড়ি আর বর্ষার অপূর্ব ক্যাম্পাস একলা মানুষের ভূস্বর্গ৷ এমনই এক বর্ষার দিনে, মেঘ জড়ানো ক্যাম্পাস অথচ বৃষ্টি নেই, আমি বেরিয়ে পড়লাম হোস্টেল থেকে৷ চীন ভবনের সামনে দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ ভবনের পিছন থেকে নারী কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে এল—'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার'৷ খুব সুরেলা গলা৷ চীন ভবনের পিছনে একটা বড় চাতাল আছে৷ সেখানে মাঝে মাঝে সাহিত্য সভা, ছাত্রদের রাজনৈতিক সভা হয়৷ আওয়াজটা সে দিক থেকেই আসছে৷ আমার তো মরলেও স্বভাব যাবে না৷ চলো আড়াল থেকে দেখে আসি কে গাইছে৷ শুনেও আসি ভালো করে৷ পায়ের শব্দ না করে ওখানে গিয়ে থামের আড়াল থেকে দেখি ওই জুটির একজন নাচছে একজন গাইছে৷ যখন মুগ্ধ হয়ে দেখছি হঠাৎ পশ্চিম আকাশে মেঘ সরে গেল আর এক চিলতে ভেজা আলো পড়ল ওদের গায়ে৷ সেটাই হল কাল৷ ওই অপ্রত্যাশিত আলোর মায়ায় মনে হল ওরা গাইছে না নাচছে না, আসলে ওরা বইতে পারছে না ওদের দুটি শরীর, সুরে তালে ওরা এক হতে চাইছে৷ সেদিন প্রথম মনে হল ওরা দুই নয়, আসলে ওরা এক৷ শান্তিনিকেতনে এত অনুষ্ঠান হয়; ওরা কোথাও নাচে না গায় না৷ ওদের সবটা শুধু নিজেদের জন্যে৷ ঘটনাচক্রে দুটো শরীর নিয়ে জন্মেছে৷
আমি ওই দ্বিবিধ-এক এর প্রেমে পড়ে গেলাম৷
৪
কিন্তু প্রেম নিবেদন করব কাকে? দুজনকেই? হাস্যকর! দুজনের কেউ বিশ্বাস করবে না৷ ফলে আমি আরও একা৷ হয়তো ভিতরের এই চাপ থেকে মুক্ত হতেই ওই বোকামোটা করে ফেললাম৷ সংযুক্তা বলে একটা অত্যন্ত কাঁচা কবিতা লিখে ছেপে ফেললাম ছাত্র ইউনিয়নের পত্রিকায়৷ সেই বর্ষার দিনে যা ভেবেছিলাম আর এতদিন ধরে মনে মনে যে বিশ্বাস পাকা হয়েছে তার খুব দুর্বল একটা প্রকাশ৷ সকলে ধরে ফেলল এই সংযুক্তা কারা৷ আমার ধারণা সম্পাদকেরা ইচ্ছা করে ওই বাজে কবিতাটা ছেপেছিল আমাকে ফাঁসাতে৷ ছেলে বন্ধুরা বলল—তুই গাড়োল শালা৷ ওরা লেসবি জানিস? একটা বিকারকে রোমান্টিসাইজ করছিস! জানিস আমার প্রেমিকা বলেছে ওদের রুমের ভিতর থেকে আদুরে শব্দ আসে! ওদের দুজনের গায়ে নখের দাগ! এ গল্প আগেও শুনেছি, গা করি নি, মনে হয়েছিল এসব ছেলেদের না পাওয়ার ঈর্ষা৷ কিন্তু আজ হৃদয় পুড়ছে কেন? ঈর্ষা? না না, আমি বিশ্বাস করি না ওই কথা৷ কেন বিশ্বাস করব? কেন ভাবব না ওরা এক নারী, ঘটনাচক্রে দুটো শরীর নিয়ে জন্মেছে? আর নখের দাগ? আমরা কি নিজেকেও নিজের নখে বিক্ষত করি না?
৫
সকলে কবিতাটা ভুলে গেল৷ আমিও হয়তো ভুলেই যেতাম৷ কিন্তু ভুলতে দিল না ওই দুজন৷ ওরাও তো বুঝেছে এই সংযুক্তা কারা৷ একদিন শালবীথির পথ ধরে খাঁ খাঁ দুপুরে হাঁটছি৷ পিছন থেকে একটা সাইকেল এসে জোরে ব্রেক কষল আমার সামনে৷ ওরা৷ ওরা! ইতিমধ্যে খবর পেয়েছি ওরা কবিতাটা পড়েছে৷ আমি তো ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম! কিভাবে অপমান করবে কে জানে৷ চড়-থাপ্পড় লাগিয়ে দেবে নাকি! দেখলাম ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে৷ সেদিন যে সাইকেলটা চালাচ্ছিল প্রশ্ন করল—বলুন তো কে সংযুক্তা এক আর কে দুই? বললাম—জানি না৷ যে পিছনে বসেছিল এবার সে বলল—যে চালাবে সে সংযুক্তা এক, আর পিছনে যে বসে থাকবে সে দুই, তবে প্রতিদিন হিসেবটা একই রকম থাকবে না কিন্তু! মনে রাখবেন৷—বলে দুজনে খিলখিল করে হেসে চলে গেল৷ এরপর থেকে দেখা হলেই প্রশ্ন—আজ কে এক? আমাকেও উত্তর দিতে হয় যে চালাচ্ছে৷ ওরা দেখা হলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, একই প্রশ্ন, একই খিলখিল হাসি, কিন্তু আমার সাথে বন্ধুত্ব করার কোনো আগ্রহ দেখায় না৷ যদি সত্যি ওরা আমার বন্ধু হতে চাইত, গল্পটার পরিণতি হত অন্যরকম৷ একদিন বর্ষায় রিমঝিম বৃষ্টিতে গেলাম খোয়াইয়ের সোনাঝুরি বনে৷ মোরাম রাস্তা দিয়ে হাঁটছি৷ ক্যানেল পেরিয়েছি কি পেরোইনি, খিলখিল হাসির কোরাস৷ শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা৷ লক্ষ্য অনিবার্য ভাবে আমি৷ দুজনে জাপ্টাজাপ্টি করে বৃষ্টিতে ভিজছে মেঘের ছায়াঢাকা অন্ধকারে পশ্চিমের একচিলতে ভেজা রোদ্দুরের মতো৷ আমার বুক পুড়ে যায়, বৃষ্টি শুধু সান্ত্বনা৷ একজন হাত নেড়ে বলল—কী? আজ কে এক কে দুই! আমি বললাম—সাইকেলে চাপলে বুঝব!—আজ আমরা সাইকেলে আসিনি৷ জবাব না দিয়ে এগিয়ে গেলাম আরও একা হতে৷ ওরা জানে না সাইকেলটা এখন তিনজনের৷
৬
দশ বছর পর৷
কিছুদিন স্কুলে পড়িয়ে এখন কলেজওয়ালা বরাত জোরে৷ বরাত জোরে লেখক হিসেবে একটু-আধটু নামও হয়েছে৷ না, কবি নই৷ সেই কবিতাটা লেখার পর আমি কবিতা লিখিনি লিখব না পণ করে৷ এখন আমি গল্প-টল্প উপন্যাস-টুপন্যাস লিখে থাকি৷
একদিন এক নতুন অধ্যাপক, আমাদের থেকে একটু ছোট, আমাদের বিভাগেই জয়েন করল৷ প্রথম আলাপে বেশ বিস্মিত হয়ে বলল—আপনি এই কলেজে তা তো জানতাম না৷ আমি তো আপনার ভীষণ ফ্যান৷ অবশ্য তার জন্যে আমার বউকেই ধন্যবাদটা দিতে হবে৷ ও আমাকে প্রথম আপনার লেখা পড়িয়েছিল৷ একদিন কিন্তু যেতে হবে আমার বাড়িতে৷ বউকে সারপ্রাইজ দেব৷
আমি ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে (লেখকদের তার থেকে বেশি ফোলাতে নেই, দেশের আইন তাই বলে, ছত্রিশটা নেতাদের জন্যে বরাদ্দ) আমার কলিগদের কালো মুখগুলো দেখে নিলাম৷
ইতিমধ্যে ওই নতুন অধ্যাপকের বউকে নিয়ে অনেক গুঞ্জন৷ বউ অপূর্ব সুন্দরী এবং দেমাকি৷ সুন্দরী দেমাকি না হলে আবার সুন্দর কিসে? সে সবসময় ঘরে বন্দী থাকে৷ বরের জন্যে নাকি! কিন্তু বরকে তো সন্দেহবাতিক বলে মনে হয় না৷ যদি হত যেচে একজন লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইত না যে তার ফ্যান৷ পরে শোনা গেল সে বরের সাথেও বেরোয় না৷ কিন্তু সুন্দরী বউকে নিয়ে কোন বর বাইরে না বেরোতে চায়! সুন্দরীর বাহির বলতে একচিলতে বাগান নিজের হাতে করা৷ আর সে বাগানের ফুটন্ত ফুল দেখে তাকে কেউ হাসতে দেখেনি৷ কেউ বুঝতে পারে না বাগান কেন এত বিষণ্ণ!
এসব শুনে তো আমার মন উচাটন৷ কবে ডাক আসবে? কবে আমি প্রকাশ্যে যাব আর ফিরব সেই নারীর গোপন আড়ালটুকু নিয়ে! কিন্তু ডাক আর আসে না৷ কলিগরা টিপ্পনি কাটে—কী হল? ফ্যানের সাথে দেখা করার ডাক এখনো আসেনি? যা সব গল্প শুনছি এমন ফ্যানটিকের সাথে তো দেখা করতেই হবে! নাকি বর্ডার লাইন বাধ সাধছে? কী আর করব! কী বলব ওদের! সম্পর্কের কোন বর্ডার লাইনগুলো পেরিয়ে আজও আমি যুদ্ধ করে চলেছি! কী করে বোঝাব ওদের চোখে না দেখেও ওই নারীর মধ্যে যে আমি নিতে যাওয়া বারুদের গন্ধ পাচ্ছি৷ আমাকে যেতেই হবে৷ কেন শান্তিনিকেতনের সেই ছবি, সেই চীন-ভবনের বারান্দা, সেই খোয়াই আবার নতুন করে আমাকে আক্রান্ত করছে! কেন কেন? কেন নিভে যাওয়া প্রদীপের পোড়া সলতের এত গন্ধ! আমি অস্থির হই, আমি ছটফট করি, রাত্রে ঘুম আসে না, বউ ছেলেকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে না৷ আমার সব স্বার্থপরতা দিয়ে আমি সেই নারীকে দেখতে চাই৷ কেননা আমি জানি আমার পূর্বপরিচিত আর তাদের বন্ধুবান্ধবরা ছাড়া কেউ আমার লেখা পড়ে না৷
অবশেষে ডাক এল৷—সরি স্যার, গোছগাছ করতে একটু দেরি হয়ে গেল৷ কাল সন্ধেয় আমার বাড়ি আসুন৷ বউ তো আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে৷আবার কলিগদের দিকে তাকালাম৷ এবার আইন না মেনে আঠাশ ইঞ্চি৷ সেদিন বেশ সেজেগুজে পকেটে একটা দামী কলম নিয়ে বেরলাম৷ বলা যায় না, অটোগ্রাফ-টটোগ্রাফ৷ আর ফটোগ্রাফি তো ঘরে ঘরে৷ একে ওকে শুধিয়ে ঠিক দরজায় খটখটালাম৷ কলিগ দরজা খুলে আমাকে দেখে ভিতরের দিকে তাকিয়ে বলল—কে এসেছে দেখে যাও৷ ভিতর থেকে প্রশ্ন এল, —কে?—আরে দেখেই তো যাও কে?
আপনি বসুন, আমি ওকে নিয়ে আসি৷
আমি বসলাম৷ একটু পরে দুজনে বেরিয়ে এল৷
—এই যে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আর এই তোমার লেখক৷
ওকে দেখে চমকে উঠলাম! এতদিন পর আকাক্ষা এমন ধ্রুবসত্যি হয়ে ওঠে নাকি! ও আমাকে দেখে বিস্মিত হল না, আনন্দিতও হল না৷ বিষণ্ণতার অবিচল ইতিহাস হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল৷
—তোমরা দুজনে গল্প করো, আমি চা-টা করে আনছি৷ বলে বর চলে গেল রান্নাঘরে৷
—বসো৷
ও বসলো৷ নিভে যাওয়া আলোর ছায়া৷ কোথায় সেই প্রাণ! এক চীন ভবন এক সাইকেল এক সোনাঝুরি প্রাণ! অনেকক্ষণ নীরব থেকে বললাম—বাকি অর্ধেক কোথায়?
—জানি না৷ খবর রাখি না৷ হয়ত অন্য কোনো অর্ধেকের সাথে৷
মনে পড়ল আমার বাড়িতেও অর্ধাঙ্গিনী আছে৷
Link: https://ebongalap.org/ardhek-akash-ashim-chattaraj