04-06-2024 12:32:42 pm
Link: https://ebongalap.org/arundhati-ray-in-translation
আমাদের অনুবাদ সিরিজের তৃতীয় কিস্তিতে অনুবাদে অরুন্ধতী রায়। গত ১৭ই এপ্রিল DW News কে দেওয়া অরুন্ধতী রায়ের টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতীর বক্তব্যে উঠে এসেছে এই মুহুর্তে করোনা সংক্রমণকে উপলক্ষ্য করে ভারতব্যাপী ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসা থেকে গণহত্যালীলার আশু সম্ভাবনার আশঙ্কা।
সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করে তার বাংলা অনুবাদ করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য।
প্রথমেই যে প্রশ্নটা করতে চাই, যেহেতু আমরা গোটা পৃথিবীতে লকডাউনের ভয়ানক কিছু পরিণতি দেখছি আর ভাইরাসের ফলে কী কী হতে পারে সেই চিন্তাও আছে, আপনি নিজের দেশের – ভারতবর্ষের অবস্থা সম্পর্কে কী জানাতে চান, বিশেষ করে সেখানে যে বৈষম্য রয়েছে তা তো সমস্যাকে আরও বাড়িয়েই দেবে?
অরুন্ধতী: সংখ্যার দিক দিয়ে দেখলে কোভিড কিন্তু ভারতবর্ষে এখনো মহামারীর আকার নেয়নি, যদিও সংখ্যাগুলো একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু এখন আমরা ভারতে যা দেখতে পাচ্ছি সে সম্পর্কে আমরা সবাই অবগতই ছিলাম, এখন সেটা চোখের সামনে চলে এসেছে। শুধু কোভিডের সঙ্কট নয়, আমাদের আক্রমণ করছে বিদ্বেষের সঙ্কট, খাদ্যের সঙ্কট। ভারতবর্ষে লকডাউন আদপেই লকডাউন নয়। এখানে শারীরিক দূরত্ব নেই, শারীরিক সংকোচন আছে মাত্র।
"
শুধু কোভিডের সঙ্কট নয়, আমাদের আক্রমণ করছে বিদ্বেষের সঙ্কট, খাদ্যের সঙ্কট।
"
তবে এটা মুসলমান বিদ্বেষের সঙ্কট। এর কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে দিল্লীর হত্যাকাণ্ড – ডিসেম্বর মাস থেকে মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের ফল – আর এখন, কোভিডের আড়ালে সরকার ছাত্রদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করছে, উকিলদের বিরুদ্ধে, প্রবীণ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, অ্যাক্টিভিস্টদের এবং বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। দু’জনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার এই আগুনে আঁচ দিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে কী বলতে চান?
অরুন্ধতী: এটাই তো তাদের কাজ। আর এস এস – মোদি নিজে যে সংগঠনের সদস্য ছিলেন, বিজেপি’র যেটি প্রধান সংগঠন – তারা তো বহুদিন ধরেই বলে আসছে যে ভারতের একটি হিন্দু রাষ্ট্র হওয়া উচিত। এই মতাদর্শীরা ভারতের মুসলমানদের সঙ্গে জার্মানির ইহুদিদের তুলনা করেছেন। আর এরা যে ভাবে কোভিডকে ব্যবহার করছে তা জার্মানিতে টাইফাসকে যেভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কাজেই এই সরকারকে আমার কিছু বলার নেই। আমার যদি কিছু বলার থাকে, তা হল ভারতবর্ষের মানুষের কাছে, পৃথিবীর মানুষের কাছে। আমি তাঁদের বলব, আপনারা এটাকে সামান্য মনে করবেন না। কারণ সত্যি কথা বলতে আমরা একটা গণহত্যার দিকে এগোচ্ছি। এই সরকারের এটাই পরিকল্পনা ছিল। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুসলমানদের জনরোষের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে, অত্যাচারের জন্য তাদেরই বেছে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখন এই ভাইরাসের প্রসঙ্গে তাদের যে আলাদা করে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার ফলে সরকারের পরিকল্পনা এখন সবার সামনে চলে এসেছে, রাস্তায় তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে এবং এর সঙ্গে জুড়ে আছে ভয়ানক হিংসার আশঙ্কা। নাগরিকত্ব আইনের আওতায় ডিটেনশন সেন্টার বানানো শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু এই অসুখের সঙ্গে বিষয়টাকে জুড়ে যা তৈরি হবে তার দিকে পৃথিবীর নজর রাখা উচিত। আসলে এই আশঙ্কার কথা যত বলি কমই বলা হবে।
"
এরা যে ভাবে কোভিডকে ব্যবহার করছে
তা জার্মানিতে টাইফাসকে যেভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল
সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে
"
যদি এই অবস্থা গণহত্যার দিকে এগোয় তাহলে সেটা খুবই ভয়ঙ্কর। আপনি প্রায় এই প্রসঙ্গেই সম্প্রতি একজায়গায় লিখেছেন যে এই যে ট্রাজেডি আমাদের দোরগোড়ায়, এটা বাস্তব, এটা বিশাল, কিন্তু এই সঙ্কট নতুন নয়। এই সঙ্কট যেন একটা ট্রেনের ভগ্নাবশেষ, যা বহুদিন যাবত ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে রেললাইন ধরে। তাহলে কারা এতদিন চোখ বন্ধ করে ছিলেন এবং কাদের চোখ এবার খোলা দরকার যাতে আপনার এই আশঙ্কা শেষ অব্দি বাস্তবায়িত না হয়?
অরুন্ধতী: আমি এটা বলেছিলাম আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রসঙ্গে, কিন্তু নিঃসন্দেহে এই ক্ষেত্রেও কথাগুলো প্রাসঙ্গিক। কাদের চোখ বন্ধ? পৃথিবীর চোখ। সব আন্তর্জাতিক নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই পরিকল্পনার অংশ। তিনি নিজেকে স্টেট্সম্যান হিসেবে দেখাতে চান, কিন্তু যখন হিংসা ছড়িয়ে পড়ে তখন উনি চুপ করে থাকেন। দিল্লীর হত্যাকান্ডের সময়ে ট্রাম্প এখানে ছিলেন, কিন্তু উনি কোনও মন্তব্য করেননি। কেউই কিছু বলে না। এবং ভারতের মূলধারার মিডিয়া এখন গণহত্যাকারীর মতন। টিভি সাংবাদিকরা যেন নিজেরাই একেকটা ‘লিঞ্চ মব’। আমরা দেখেছি রোয়ান্ডাতে কী ঘটেছে এবং মিডিয়া সেখানে কী ভয়ানক ভূমিকা পালন করেছে। সেই একই জিনিস আমরা ভারতবর্ষে দেখতে পাচ্ছি। এটা খুবই ভয়ের।
"
ভারতের মূলধারার মিডিয়া এখন গণহত্যাকারীর মতন।
টিভি সাংবাদিকরা যেন নিজেরাই একেকটা ‘লিঞ্চ মব’।
"
আর আমি তো এখনো খাদ্য সঙ্কটের কথা বলতেই শুরু করিনি। এই সঙ্কটে দেশের লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত। চার ঘন্টার নোটিশে ১৩০ কোটি মানুষকে লকডাউনে পাঠিয়ে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী আটটা নাগাদ ঘোষণা করলেন, বারোটা থেকে লকডাউন শুরু হয়ে গেল। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় – বাড়ি ফেরার উপায় নেই, খাবার নেই। অনেকে কয়েকশ’ কিলোমিটার হেঁটে নিজেদের গ্রামে পৌঁছলেন, সেখানেও তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হল না। এবং সঙ্কট এখন বাড়ছে। এই খাদ্যের সঙ্কট আরও বাড়ছে।
১৭ই এপ্রিল,২০২০ DW News কে দেওয়া অরুন্ধতী রায়ের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার।
লিপিবদ্ধকরণ ও অনুবাদ: সর্বজয়া ভট্টাচার্য
Link: https://ebongalap.org/arundhati-ray-in-translation