04-06-2024 12:23:12 pm
Link: https://ebongalap.org/babri-masjid-riot-and-its-aftermath-in-metiabruj
শ্রমিক আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমি মেটিয়াবুরুজে আসি ১৯৯০ সালে। সপরিবারে বাস করতে শুরু করি বাঁধাবটতলার বাবুলের গলিতে ১৯৯১ সাল থেকে। যিনি ঘর ঠিক করে দিলেন, তিনি ছিলেন বন্ধ কার্ডবোর্ড কারখানার শ্রমিক, আমাদের এক কমরেড। বাড়িওয়ালা জিইসি কারখানার শ্রমিক। আমাদের ঘর তিনতলায়। দোতলায় সপরিবারে থাকতেন হিন্দুস্থান লিভারের এক শ্রমিক। একতলায় অনেকগুলো লাইনঘর—তাতে থাকতেন যাঁরা, কেউ ব্রেথওয়েটে, কেউ গার্ডেনরীচ জাহাজ কারখানা জিআরএসই-তে, কেউ অন্যত্র কাজ করতেন। একজন এক্স-মিলিটারিম্যানও ছিলেন, তাঁর স্ত্রী আয়ার কাজ করতেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এক মিলিটারি জওয়ানের সঙ্গে। গোটা পাড়াতেই ছিল কারখানা শ্রমিক এবং নানান ধরনের গায়েগতরে খাটা মহিলা ও পুরুষের বাস।
পাড়াটাকে লোকে বাবুলের গলি বলে চিনত, আবার কেউ বলত পঞ্চাননতলা, কেউ বলত তেঁতুলতলা। আসলে ওই পাড়ার তেমন কোনো নামই ছিল না। একটা নামহীন গলি, তার ফাঁকফোকর দিয়ে ফতেপুর ফার্স্ট লেন বা রামদাসহাটীর দিকে চলে যাওয়া যেত। পাহাড়পুর রোডের ওপর বাঁধাবটতলা একটা তেমাথা মোড়, সেখান থেকে ফতেপুর হরিসভার দিকে ঢুকে গেলে বাঁহাতে বিজনদার চপের দোকান আর হোটেলের গা ঘেঁষে একটা পাতলা গলি। একসময় এই গলির মুখে ছিল বাবুল সেনের ঠেক, সেই থেকে নামহীন গলির ডাকনাম বাবুলের গলি। কিছুটা সিমেন্ট বাঁধানো সরু পথ পেরিয়ে পঞ্চানন মন্দির, তারপরই কাঁচা মেঠোপথ, তার একপাশে প্রকাণ্ড এক তেঁতুল গাছ। ওই তেঁতুলতলার সামনেই ছিল আমাদের আস্তানা।
চারপাশে শ্রমজীবী পরিবৃত আমি এক বুদ্ধিজীবী, ‘বিপ্লবী’ শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী। রামনগরে হিন্দুস্তান লিভার কারখানা। তখন সেই কারখানার শ্রমিকেরা ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে লড়ছে, আমি সেই আন্দোলনে সহযোগী একজন কর্মী। এদিকে ইট আসছে, ধুমধাম করে ইট-পুজো হচ্ছে, তোড়জোড় চলছে, অযোধ্যায় রামমন্দির গড়া হবে। রামনগরে মোড়ের ওপর মন্দির আকার-প্রকারে বাড়ছে। এইসব সমারোহে শামিল কারখানা-শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের ছেলেপুলেরা।
প্রথমে আমাদের ধারণা ছিল শ্রেণীসংগ্রাম সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শ্রেণীসংগ্রামেরই প্রাথমিক ধাপ। অতএব শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তোলার কাজে অবিচল থাকাই শ্রেয়। কিন্তু যেভাবে হিন্দু ও মুসলমান খেটে খাওয়া মানুষ পরস্পরের প্রতি নানান ধরনের ঘৃণা ও বিদ্বেষে আলোড়িত হয়ে উঠল, আমরা বুঝতে পারলাম যে শুধু শ্রেণীসংগ্রামের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে হবে না। শ্রমিকের মনে যদি পরস্পরের প্রতি জাতগত ঘৃণা এইভাবে বেড়ে চলে, তবে সংগ্রামই বা কীভাবে গড়ে উঠবে? তাই আমরা তাদের ধারণাগত ভ্রান্তি দূর করার কিছু কার্যক্রম নিলাম। যেমন, গরুকে মাতা জ্ঞান করা এবং গরুর মাংস খাওয়া, মুসলমানদের একাধিক বিয়ে, মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অযোধ্যায় রামমন্দির ছিল কিনা, ইত্যাদি বিষয়ে ছোটো ছোটো পুস্তিকা ছাপিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করার কর্মসূচি নিই। কিন্তু যেভাবে ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ ধ্বনি জোরালো হয়ে উঠল এবং শ্রমিকাঞ্চলেও তা প্রতিধ্বনিত হল, বিশেষত যুবকদের মধ্যে, আমরা শঙ্কিত হলাম। ১৯৯২ সালে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের জড়ো করে একটা সভাও করা হল মুদিয়ালির নুটবিহারী স্কুলে। সেখানে শ্রমিক-শ্রোতাদের সামনে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ভাষণ দিলেন কলকাতা থেকে আসা ‘অসাম্প্রদায়িক’ বুদ্ধিজীবীরা। এখনও যেটুকু মনে পড়ে, গীতেশ শর্মা এসেছিলেন।
৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙা হল। রাতে আমাদের আগুয়ান শ্রমিক কমরেডরা জড়ো হলেন আমাদের নেতার বাড়িতে। ঠিক হল যে পরদিন সকালে আমরা শান্তি রক্ষার আবেদন করে এলাকায় একটা মিছিল করব। কানে এল যে ফতেপুর থেকে কয়েকজন হিন্দিভাষী যুবক অযোধ্যার মসজিদ ভাঙার কর্মসূচিতে গিয়েছিল, তাদের একজন সম্ভবত মারা গেছে।
পরদিন ৭ ডিসেম্বর আমাদের উদ্যোগে শ্রমিকদের মিছিল বেরোল। কিন্তু ফতেপুর থেকে বাঁধাবটতলা-মুদিয়ালি হয়ে রামনগর লেনের মুখে যেতেই কিছু মানুষ আমাদের আর এগোতে দিলেন না। অগত্যা আমরা মিছিল ঘুরিয়ে নিয়ে ধানখেতির দিকে চললাম। দূরে কাচিসড়কের মুখটাতে তখন ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। লিচুবাগান আর কাশ্যপপাড়ার ঘটনার কথা পরে শুনলাম।
বিকেলের পর থেকেই কার্ফু জারি হল আর লম্বা লম্বা লাঠি হাতে প্যারামিলিটারি জওয়ানেরা টহল দিতে শুরু করল বড় রাস্তায়। আর বাইরে থাকা যাচ্ছে না, আমরা কোনোরকমে ঘরে ফিরলাম। এসে শুনলাম, পাড়ায় উৎকন্ঠা, রাতে নাকি অ্যাটাক হতে পারে। অ্যাটাক হলে কীভাবে প্রতিরোধ হবে? পাড়ায় চাঁদা তুলে জোগাড়যন্তর করা হল আর সেগুলো রাখা হল আমাদের বাড়ির পিছনের দিকে জলার আশপাশে। সিপিএমের একজন কর্মী, জিইসির এক কন্ট্রাক্টর, আমাদের প্রতিবেশী, আমাকে ডেকে বললেন, ‘দাদা, আপনি তো তিনতলায় আছেন, একটু লক্ষ্য রাখবেন, ওদিক থেকে ওরা এলে আপনি আগেই টের পাবেন।’ সিপিএমের আর এক প্রবীণ কর্মী, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আমাদের গলির মুখে হাতপাখা বিক্রি করতেন, তাঁর সক্রিয়তাও লক্ষ করলাম। অর্থাৎ সেই মুহূর্তে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের অন্য সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয় ঘুচিয়ে হয়ে উঠলাম হিন্দু অথবা মুসলমান। রাতে পাহারা বসল সামনের বাড়ির দাওয়ায়। আমাদের বাড়িওয়ালা, জিইসি শ্রমিক, যিনি কোনো সাতেপাঁচে থাকতেন না, তিনিও আমার সঙ্গে রাত জেগে পাহারা দিলেন। মাঝরাতে আমি আর পাড়ার এক যুবক চারপাশে একটু টহল দিতে বেরোলাম। দেখলাম, পাশের মুসলমান পাড়াতেও সজাগ পাহারা রয়েছে। সেখানেও ভয়, ‘ওরা’ অ্যাটাক করতে পারে। পরে জেনেছিলাম, ওইসময় যারা বোমা বাঁধত, তারা বোমা বিক্রি করে বেশ লাভ করেছিল। বেশিরভাগ বোমাই কাজে লাগেনি, কারণ সেই মাত্রায় দাঙ্গাহাঙ্গামা মেটিয়াবুরুজে হয়নি। আর কমে গিয়েছিল দুধের দাম। কারণ গোয়ালারা কার্ফুর জন্য দুধ বেচতে বেরোতে পারছিল না, পাড়াতেই কম দামে বেচে দিচ্ছিল।
২
আমাদের গোষ্ঠী থেকে শ্রমিকদের জন্য যে পাঁচটি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী পুস্তিকা বেরিয়েছিল, তার দু’টি মেটিয়াবুরুজে বিলি করতে দেননি আমাদের স্থানীয় নেতা। তিনি মনে করেছিলেন যে ওগুলো বিলি হলে হিন্দুদের মধ্যে খারাপ প্রতিক্রিয়া হবে। আমি এবং অন্য বুদ্ধিজীবী কমরেডরা কেউ কেউ তাঁর এই সিদ্ধান্তে একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। পুস্তিকার উদ্দেশ্য ছিল আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক উসকানিকে মোকাবিলা করা। কিন্তু সবগুলো বিলি হলেই বা সেই উসকানিকে কতখানি স্পর্শ করা যেত? আমাদের একটা সমালোচনা ছিল, সিপিএম বা বামফ্রন্ট সরকার বিজেপিকে যথাযথ প্রতিরোধ করছে না। তারা ৬ ডিসেম্বরের পরের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াকে প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলা করেছে, পার্টিকে পথে নামায়নি। আমরা এও বলতাম, সিপিএম আন্দোলন-বিমুখ। কিন্তু আন্দোলনমুখী যারা—এসইউসি, নকশাল বা মাওবাদী ইত্যাদিরা—সেই পরিস্থিতিতে কতখানি কার্যকর ভূমিকা নিতে পেরেছিল? আজ নিজেকে প্রশ্ন করি, খোদ শ্রমিকেরা কি আন্দোলনমুখী হতে পেরেছিল সেদিন? আমার মনে হয়, একদমই পারেনি। কেন পারেনি, সে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, ভিন্ন পরিসরে তা নিয়ে কথা হতে পারে।
কিন্তু ১৯৪৬-এর যে দাঙ্গায় মেটিয়াবুরুজে শত শত মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, সেদিন তো শ্রমিকেরা আন্দোলন-বিমুখ ছিল না। সম্প্রতি এ নিয়ে কথা বলছিলাম প্রবীণ সুতোকল শ্রমিক পরশনাথ প্রসাদের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি, ১৯৪৩ সালে কেশোরামের শ্রমিকেরা ছয় সপ্তাহ লাগাতার ধর্মঘট করেছিল। সেইসময় ধর্মঘটী মিল-শ্রমিকেরা তাদের পরিবার বালবাচ্চা নিয়ে রওনা হয়েছিল বিড়লাবাড়ির উদ্দেশ্যে, সাত মাইল পথ হেঁটে বালিগঞ্জের হিন্দুস্তান পার্কে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত বিড়লাবাড়ির সামনে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে! কিন্তু ওই ধর্মঘট সফল হল। কেশোরামের শ্রমিকেরা আদায় করলেন ১১.৪৫% বোনাস, যা এতদিন কেউ পায়নি। তার চেয়েও বড় কথা ছিল এই যে এবার শ্রমিকেরা তার একতার শক্তিকে চিনতে পারল। মালিক বিড়লারা একভাবে সেই শক্তিকে স্বীকার করে নিল বটে, কিন্তু সেই শক্তিকে ভাঙবার চেষ্টারও কসুর ছিল না।
১৯৪৬ সালের আর এক ধর্মঘটের বিবরণ পাওয়া যায় কমিউনিস্ট পার্টির ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায়। ৪৬ দিন একটানা ধর্মঘট চলেছিল। ৩ জানুয়ারি ১৯৪৬ ‘স্বাধীনতা’ লিখছে : “২রা জানুয়ারি ভোর সাড়ে পাঁচটায় ৫০/৬০ জন কোম্পানির দালাল পিকেট লাইনের ওপর ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনি করিতে করিতে লাঠিসোঁটা লইয়া আক্রমণ করে। ধর্মঘটীরা তবুও স্থানচ্যুত হইল না। ইতিমধ্যে হট্টগোলের ফলে আকৃষ্ট হইয়া আশেপাশের বস্তি হইতে শত শত শ্রমিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইলে গুণ্ডার দল পলায়ন করে। তারপর একবার পুলিশ বোঝাই কেশোরাম কোম্পানির বিএলএল ৪৪৫৫ নং লরিখানি শ্রমিক পিকেটের ওপর চালাইবার উপক্রম হয়। এঞ্জিনের শত গর্জন সত্ত্বেও পিকেটিংরত শ্রমিকেরা এতটুকুও বিচলিত হইল না দেখিয়া অবশেষে পুলিশ বোঝাই লরিকে পিছু হটিতে হয়।” ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে কেশোরাম কটন মিলের ধর্মঘটী শ্রমিকের মা-বউ ও মেয়েরা বিড়লা পার্কের (বিড়লা ভবনের দরজায়) সামনে সত্যাগ্রহ শুরু করে। সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের জুলুম চলে। ...[1]
১৯৪৬ ছিল মেটিয়াবুরুজ সহ বিভিন্ন শ্রমিকাঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক বিদ্রোহের বছর। আর সেই বছরই ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট কলকাতা ভেসে গিয়েছিল উন্মত্ত দাঙ্গা আর হত্যাকাণ্ডে। ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকাঞ্চলে দাঙ্গা এড়ানো যায়নি। শ্রমিকের বিরুদ্ধে শ্রমিক ছুরি তুলল, হত্যা করল শয়ে শয়ে। লিচুবাগানের যেসব ওড়িয়া শ্রমিক পালাতে পারেনি তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। পরশনাথ প্রসাদের কাছ থেকে জানতে পারি, হিন্দু শ্রমিক যারা কেশোরামের লাইনবাড়িতে এসে আশ্রয় পেয়েছিল, তারা বেঁচে গিয়েছিল। বিড়লাদের লাইনবাড়িতে হিন্দু শ্রমিকেরাই থাকতে পারত, মুসলমানদের ঢোকার অনুমতি ছিল না। বাঙালিবাজারে মাছ বিক্রি করত যে ইউপি-বিহারের মুসলমানরা, তারা কিছু হিন্দুকে রক্ষা করেছিল, ২৮নং ফাঁড়িতে ধাঙড়রা কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে নিয়েছিল। শোনা যায়, মসজিদতলাবের মুসলমান শ্রমিকেরা দুশো হিন্দু শ্রমিককে আশ্রয় দিয়েছিল। ঘটনার ব্যাপকতার বিচারে এগুলো ছিল নেহাতই ব্যতিক্রম। লিচুবাগান, ইলিয়াস বিল্ডিং, রাজাবাগানে বহু মানুষকে সেদিন বাঁচানো যায়নি।
কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঝুনু পাকড়াশী বলেছিলেন : ‘কেশোরামে সুতাকল শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা বাধায় বিড়লা।’ রণেন সেনের মতে, মেটিয়াবুরুজে দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল নোয়াখালির শ্রমিকেরা। কিন্তু উর্দুভাষী মুসলমান শ্রমিক বস্তিতে কেষ্ট ঘোষ, মাধব মুন্সী ও ফারুকি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিলেন। তবে তাঁরা এটাও স্বীকার করেছিলেন যে প্ররোচনা যে-মহল থেকেই আসুক না কেন, মেটিয়াবুরুজের সেদিনের ঘটনা শ্রমিক আন্দোলনের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা![2]
কেন এরকম হল? শ্রেণীসংগ্রাম কেন সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে পারল না? এই প্রশ্নের জবাবে সেদিন সোমনাথ লাহিড়ী বলেছিলেন, ‘শ্রেণীসংগ্রাম! লালঝান্ডার প্রভাব! সে আর কতটুকু! কতদিন সময় পেয়েছি আমরা কাজ করার! কতটুকু অংশের মধ্যেই-বা আমাদের কাজ! তার পাশে সাম্প্রদায়িকতাবাদের জন্ম যে ১৯০৫ সাল থেকে। হাজার বছরের পুরোনো ধর্মসংস্কার! তাদের জোর যে অনেক বেশি।’[3]
১৯৪৬ থেকে ১৯৯২, বারবার দেখা যাচ্ছে, কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরা সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে দাঙ্গার সময়ে। মেটিয়াবুরুজে ছোটখাট দাঙ্গা বহুবার হয়েছে। ১৯৪৬ সালে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। দীর্ঘ শাসনক্ষমতায় থেকেও কিন্তু বামপন্থীদের এই অসহায়ত্ব দূর হয়নি। আমরা দেখলাম, ১৯৯২-তে মেটিয়াবুরুজে কাশ্যপপাড়ায় ঘর জ্বলল, লিচুবাগানে কেশোরাম শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি বিশ্বনাথ তেওয়ারি সহ চারজনকে হত্যা করা হল। সিপিআই নেতা মানস সোম আমাকে জানান, ৭ ডিসেম্বর সকালে তিনি এবং পরিতোষ ভুঁইত সাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছিলেন ভাঙাখালি-কাঞ্চনতলা হয়ে, কিন্তু কেশোরামের ওখানে যেতে পারেননি, তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। কলকাতার দিক থেকে আর এক নেতা কমলাপতি রায় এসেছিলেন মেটিয়াবুরুজ হাইস্কুল অবধি, তিনিও ঘটনাস্থলে যেতে পারেননি। সবচেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সিপিআইয়ের শ্রমিক-নেতা আবদুল মান্নান।
৩
আমি অবশ্য শ্রমিকদের ওপর তার আন্দোলন বা শ্রেণীসংগ্রামের প্রভাবকে একেবারে নস্যাৎ করার পক্ষপাতী নই। হিন্দুস্থান লিভারের ছাঁটাই-বিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ ছ’ বছরে দেখেছি, ছাঁটাই শ্রমিকদের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। রামরাজ, রামানন্দ, শমীম, সাহাবুদ্দিন, সদাব্রিজ প্রসাদ ইউনিয়ন-কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলেন, আর্থিক অনটনের সময়ে একে অপরের পাশে দাঁড়াতেন। রামানন্দ সিং একটা গল্প বলেছিলেন, ছাঁটাই থাকাকালীন একবার রামানন্দের বাড়িতে সাহাবুদ্দিন বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে নেমন্তন্ন খেতে এসেছেন। সাহাবুদ্দিনের বউ রামানন্দদের ওঁদের ঘরে একদিন দাওয়াত দিতে চাইলেন। সাহাবুদ্দিনের ছোটো ছেলেটা হঠাৎ বাবাকে বলে বসল, ‘আব্বু বহলোগ হামলোঁগোকে ঘর নেহী আয়েগি, কিঁউকি হমলোগ মুসলমান হ্যাঁয়।’ শুনে রামানন্দ আর ওঁর বউ খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। অতএব তখনই সাহাবুদ্দিনের ঘরে ওঁদের নেমন্তন্ন পাকা করতে হল। নেমন্তন্নের দিন সাহাবুদ্দিনের ঘরে পৌঁছে রামানন্দ আরও অবাক হয়ে গেলেন। সাহাবুদ্দিনের বউ একদম নতুন হাঁড়ি কড়াই থালা আগেভাগে রেডি করে রেখেছেন রামানন্দদের জন্য। সেই নতুন বাসনে রান্না-খাওয়া হল সেদিন।
এই গল্পটার মধ্যে দুটো জিনিস ছিল লক্ষ্যণীয়। একদিকে রাজপুত রামানন্দের সঙ্গে মুসলমান সাহাবুদ্দিনের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব, অন্যদিকে দুজনের মধ্যে পরস্পরের সংস্কার ও অভ্যাসের প্রতি খেয়াল। রামানন্দ সিং এসেছিলেন বিহারের বৈশালী জেলার ঝিটকহিয়া গ্রাম থেকে। ওঁর শ্বশুর হিন্দুস্তান লিভারে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে চাকরিটা পেয়েছিলেন। থাকতেন মেটিয়াবুরুজের মুসলমান বস্তি মেহেরমঞ্জিলে, অথচ নিজের রাজপুত স্বভিমানে ভরপুর। আর সাহাবুদ্দিন ছিলেন মুঙ্গেরের উচ্চবংশীয় মুসলমান। হিন্দুস্তান লিভারে ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের দাবির লড়াইয়ে খুবই আগুয়ান ভূমিকা নিয়েছিলেন। লড়াইয়ে জিতে স্থায়ী হওয়ার পর আবার লড়তে গিয়ে ছাঁটাই হলেন। এক ধরনের জেদ আর মাথাউঁচু ভাব ওর চলাফেরায় ছিল। রিয়াজ, আসরাফের মতো কমবয়সি ঠিকা ছাঁটাই শ্রমিকেরা ওঁকে ঠাট্টা করে ‘খানসাহেব’ বলে সালাম করতেন।
৪
১৯৯৭ সালে আমি রাজনৈতিক গোষ্ঠী তথা আমার শ্রমিক আন্দোলনের কাজ থেকে সরে আসি। ক্রমশ আমার নজর সরতে থাকে কারখানার গেট থেকে শিল্পাঞ্চলের বসতির দিকে। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘মন্থন সাময়িকী’ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করি। পাঁচ বছর পর আমরা বাসস্থান বদল করে চলে আসি মেটিয়াবুরুজের এক প্রান্তে আকড়া ফটক লাগোয়া রবীন্দ্রনগরে। রবীন্দ্রনগর মহেশতলা এলাকার অন্তর্গত একটা হিন্দুপাড়া, দু-পাশে বিস্তীর্ণ মুসলমান বসতি অঞ্চল। এই মুসলমানেরা প্রধানত বাঙালি এবং দর্জি পেশায় যুক্ত। এবার আমি মেটিয়াবুরুজের জনবিন্যাস কিছুটা আন্দাজ করতে শুরু করি। ১৯৯০ সালে যেদিন প্রথম মেটিয়াবুরুজে এসেছিলাম, তখন তা ছিল আমার কাছে একটা শ্রমিকাঞ্চল। ১৯৯৭-এর পর ক্রমে আমার কাছে উন্মোচিত হল মেটিয়াবুরুজের কৌমজীবন, শ্রমিকের কৌম-পরিচয়।
মেটিয়াবুরুজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। মুসলমানকে যদি বাঙালি এবং উর্দুভাষী দুভাগে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেটিয়াবুরুজবাসী বাঙালি মুসলমান। সংখ্যার বিচারে এরপরে রয়েছে বাঙালি হিন্দু এবং উর্দুভাষী মুসলমান। এরপরে হিন্দিভাষী হিন্দু, ওড়িয়া, তেলেগু, পাঞ্জাবি ইত্যাদি জাতির মানুষ। ওড়িয়া ইত্যাদি অন্য ভাষাভাষী মুসলমানও রয়েছে।
১৮৫৬ সালে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী মেটিয়াবুরুজে এসে বাস করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন শিয়া মুসলমান, সঙ্গে তাঁর আত্মীয়স্বজন কিছু ছিল আর এসেছিল প্রায় ত্রিশ হাজার উর্দুভাষী। ওঁর কর্মচারীদের মধ্যে বহু সুন্নি ছিল। এছাড়া ১৮৫৬-র আগে মুসলমানদের মধ্যে মূলত সুন্নিরাই মেটিয়াবুরুজে বসবাস করত। ওয়াজেদ আলী উদার মনের মানুষ ছিলেন বলেই এখানে সকলে মনে করে। তিনি সুন্নিদের আপন করে নিয়েছিলেন। এমনকী যাত্রায় কৃষ্ণ সেজে নেচেছেন।[4]
গ্রাম মেটিয়াবুরুজ থেকে শিল্পাঞ্চল মেটিয়াবুরুজের পত্তন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। শোনা যায়, মেটিয়াবুরুজে প্রথম সুতোকল তৈরি হয়েছিল ১৮৩৯ সালে ওয়েন জন ইলিয়াস নামে জনৈক ব্যবসায়ীর মালিকানায়।[5] তারপর সেই মিল দু’ বার হাত বদল হয়ে ১৯২০ সালে ঘনশ্যামদাস বিড়লা মিলটা কেনেন এবং তখনই নামকরণ হয় কেশোরাম কটন মিল। এছাড়া পুরোনো মেটিয়াবুরুজে ছিল ইউনিয়ন সাউথ জুটমিল, এরপর হল লরেন্স মিল, ক্লাইভ জুটমিল, ভিক্টোরিয়া জুটমিল। এইসব মিলে পুরুষদের পাশাপাশি ছিল বেশ কিছু মহিলা-শ্রমিক।
মেটিয়াবুরুজে শ্রমিকেরা এসেছিল মূলত গ্রাম থেকে। স্থানীয় বাঙালি মুসলমানেরা কারখানায় যেত না, বাঙালি হিন্দুরা কিছুটা যেত। অনেক ক্ষেত্রে একই গ্রাম থেকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এবং বহু মানুষ মেটিয়াবুরুজে এসে শ্রমিক হয়েছে। যেমন, কেশোরামের ডাইহাউসের শ্রমিক দয়ারাম প্রসাদ ১৯৩০ সালে এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার মঙ্গলশি গ্রাম থেকে। ওঁর ছেলে পরশনাথ প্রসাদের জন্ম কেশোরামের লাইনবাড়িতে ১৯৩৯ সালে। ১৯৫৬ সালে তিনি উইভিং ডিপার্টমেন্টে বদলি শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। ওঁর কাছ থেকে জানতে পারি, মঙ্গলশি গ্রাম থেকে প্রায় পঞ্চাশজন শ্রমিক কেশোরামে এসেছিল। মেটিয়াবুরুজে অতীতের ‘ডন’ হিসেবে পরিচিত আইয়ুব আনসারী এসেছিলেন পাশের দরিয়াবাদ গ্রাম থেকে। উইভিং ডিপার্টমেন্টের আবদুল মান্নান এসেছিলেন আজমগড় থেকে। আরও জেনেছি, কেশোরামের উইভিং ডিপার্টমেন্টে উত্তরপ্রদেশের মুসলমান শ্রমিক বেশি ছিল, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ের শ্রমিকও ছিল; বয়লার, ডাইহাউস, ওয়্যারহাউসে ছিল বেশি ফৈজাবাদের লোক; স্পিনিং-এ উড়িষ্যার কেন্দাপাড়া, বালেশ্বরের ওড়িয়া আর কিছু অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা তেলেগু শ্রমিক; ওয়াইন্ডিং-এ ছত্তিশগড়, অন্ধ্র আর ইউপি-র বেনারসের লোক; ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্থানীয় বাঙালি।
মিল থেকে বেরিয়ে শ্রমিকদের আলাদা আলাদা বসতি। বেশ কিছু হিন্দু শ্রমিক থাকত সামনেই কেশোরামের লাইনবাড়িতে। অবাঙালি মুসলমান শ্রমিকেরা থাকত মসজিদতলাব, মিঠাতলাবে। লিচুবাগানে থাকত তেলেগু, ওড়িয়া আর হিন্দিভাষী হিন্দু শ্রমিকেরা। ওড়িয়া শ্রমিকদের অনেকে ইলিয়াস বিল্ডিংয়েও থাকত। স্থানীয় বাঙালি হিন্দুরা আসত বদরতলা, কাঞ্চনতলা, ভাঙাখালি, মুদিয়ালি থেকে। মিলের বাইরে এসেই তাদের ভিন্ন ভিন্ন কৌমজীবন। তখন তাদের পরনে বয়লার স্যুট নেই, কোম্পানির ইউনিফর্ম নেই, মিলের কালিঝুলি নেই। কেউ হয়তো বাবু সেজে চায়ের দোকানে, কেউ ধুতি পরে মন্দিরে কিংবা গায়ে কুর্তা-পাজামা চাপিয়ে মাথায় টুপি পরে নামাজে। গ্রাম থেকে আসা শ্রমিকদের অনেকেরই গ্রামের শেকড় ছিন্ন হয়নি। আর ছিন্ন হলেও তাদের পারিবারিক জীবনে পুরোনো কৌমজীবনের রীতি-রেওয়াজ মুছে যায়নি। এই রীতি-রেওয়াজের সঙ্গেই জুড়ে ছিল তাদের ধর্মপালন।
রবীন্দ্রনগরে বসবাসের সূত্রে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যাতায়াত শুরু হল। এর আগে আমাদের শ্রমিক আন্দোলনের কাজ ছিল অনেকটাই উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যে। দেখলাম, মহেশতলা-মেটিয়াবুরুজে এক বিশাল দর্জি শিল্পের সঙ্গে বংশানুক্রমিকভাবে যুক্ত বাঙালি মুসলমানেরা। এরা সামাজিকভাবে কিছুটা আবদ্ধ, যৌথ পরিবার টিকে রয়েছে, বিয়ে-থা নিজেদের মধ্যে, এমনকী নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও হয়। একটা সময় পর্যন্ত এরা ছিল বেশ দরিদ্র, একসময় রোজগারের জন্য রেঙ্গুন পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে অনেকে। ১৯৮০-র দশক থেকে এই শিল্পে একটা তেজিভাব আসে। আগে এরা কাঁচামাল কিনত বড়বাজারের মাড়োয়ারি কাপড় আর সুতোর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। জামাকাপড় বানিয়ে বেচতে যেত হাওড়ার মঙ্গলাহাটে। পরবর্তীতে কারবার বেড়ে ওঠায় এরা মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের মেটিয়াবুরুজে নিয়ে আসে। বটতলাকে ঘিরে গড়ে ওঠে নতুন নতুন তৈরি-জামাকাপড়ের (রেডিমেন্ট গার্মেন্টসের) হাট।
৫
২০০১ সালের ৩১ মার্চ মেটিয়াবুরুজ বদরতলার গঙ্গার পারে বিবেকানন্দ শিশু উদ্যানে এক সভার আয়োজন করা হয়েছিল মন্থন পত্রিকা থেকে। আফগানিস্তানের বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের নিন্দা করে সেই ছোট্ট সভায় এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে লিট্ল ম্যাগাজিনের কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। আমন্ত্রিত পত্রিকাগুলির নাম করলে সেটা বোঝা যায় : সপ্তপর্ণী (বদরতলা পাবলিক লাইব্রেরির মুখপত্র), মৈত্রী (আকড়া), ভাস্বর (বদরতলা), চিন্তন (বদরতলা), অনুভব (হাজি রতন), দূরবীনের চোখ (কানখুলী), কাণ্ডারী (বদরতলা), নবদিশা (বদরতলা), ভোরের সূর্য (মুদিয়ালি), মাটির দুর্গ (মুদিয়ালি), এ বাংলার মুখ (কলকাতা), মৌ (কলকাতা), সহজ (সন্তোষপুর), আহ্বান (বদরতলা)। সেই সভার উষ্ণ অংশগ্রহণ থেকেই ক্রমশ লিট্ল ম্যাগাজিনগুলির একটা উদ্যোগ দানা বেঁধে ওঠে। ‘মাটির কেল্লা’ নামে একটা মঞ্চ গড়ে ওঠে। লিট্ল ম্যাগাজিনের মঞ্চ হলেও এতে জড়ো হয়েছিলেন পঁচিশ-ত্রিশ জন বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যানুরাগী। বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দাদের মধ্যে যে ছেদ সৃষ্টি করেছিল, সেদিক থেকে এই ছোট্ট উদ্যোগটার একটা গুরুত্ব ছিল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল ইরাক আগ্রাসনের সময়। আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে, সম্ভবত পরদিন শুক্রবার, মেটিয়াবুরুজে ইরাকের ওপর হামলার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে আওয়াজ উঠল, ‘দুনিয়াকা মুসলিম এক হো’। মাটির কেল্লার পক্ষ থেকে আমরা তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করলাম উর্দু সাহিত্যিকদের সঙ্গে। মেটিয়াবুরুজের পাহাড়পুর রোডে মৌলানা আজাদ গার্লস স্কুলে সকলে জড়ো হয়ে ১ এপ্রিল থেকে মেটিয়াবুরুজে ইঙ্গ-মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হল। মনে আছে, শুভেন্দু দাসগুপ্ত এসেছিলেন সেই সভায়। তিনি আমাদের অনুরোধে চটজলদি ইঙ্গ-মার্কিন পণ্যের একটা তালিকা তৈরি করে দিলেন। সেই তালিকা লিফলেটের আকারে ছাপা হল। নিমেষে হাজার হাজার লিফলেট বিলি হয়ে গেল। লিফলেট পেয়ে কেউ কেউ নিজেরাই উর্দুতে আরও ছাপিয়ে বিলি করতে শুরু করল। সমস্ত দোকান থেকে কোকাকোলা-পেপসির বোতল আর ক্রেটগুলো সরিয়ে নেওয়া হল। দোকানের মাথায় সাইনবোর্ডে কোক-পেপসির বিজ্ঞাপনগুলো লোকে নিজেরাই সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল।
মাটির কেল্লা শুরু হয়েছিল বাঙালিদের নিয়ে, এবার উর্দুভাষীদের সঙ্গে একটা সংযোগ স্থাপন হল। লিট্ল ম্যাগাজিন উৎসব আর সমাবেশে উর্দু শায়েরদের আমন্ত্রণ জানানো হল। ২০০৫-এ এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা ‘প্রগতি’র ওপর আক্রমণ নেমে এল। ওই পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় আকড়া হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মহম্মদ মোরসালিন ‘সত্য মিথ্যা’ নাম দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে সাহিত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের তুলনা এবং সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কথা পড়ে ক্ষুব্ধ হলেন গুটিকয়েক মানুষ। সেই ক্ষোভ থেকে গুঞ্জন, গুঞ্জন থেকে রোষ, রোষ থেকে রোষানলে দগ্ধ হল আকড়া ভাঙিপাড়ায় প্রবন্ধ-লেখকের বাড়ি, বইপত্র, আসবাব, বিছানা, লুঠ হল টাকাপয়সা। পত্রিকা সম্পাদকের বাড়িতেও ভাঙচুর হল। ঘটনার খবর পেয়েই মাটির কেল্লার প্রবীণ কর্মীরা সেখানে হাজির হলেন। মাটির কেল্লা সেই ঘটনার নিন্দা করল এবং নিন্দা-প্রস্তাবের স্বপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হল।
সেইসময় আমি আমন্ত্রিত হলাম ‘নতুন গতি’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যার প্রকাশ অনুষ্ঠানে কলকাতা প্রেস ক্লাবে। শুনলাম যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ পত্রিকার উদ্বোধন করবেন। আমি ওঁর ফোন নাম্বার জোগাড় করে ওঁকে ফোন করে অনুরোধ করলাম, মোরসালিনের ওপর হামলার নিন্দা করতে। উনি ঘটনাটা ইতিমধ্যেই জেনেছেন, সরাসরি বললেন যে সেটা তিনি পারবেন না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন পারবেন না? উনি বললেন, ‘আমার বউমা (ছেলে অমিতাভ সিরাজের স্ত্রী) আকড়ায় মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়ায়, আমি প্রতিবাদ করলে ওঁর ক্ষতি হতে পারে।’ ... তবে আমাকে অনুরোধ করলেন, ‘বাংলা একাডেমিতে এই বিষয়ে একটা সভা করুন, সেখানে আমি যাব।’ আমি বললাম, ‘আকড়ায় যা চলছে তার প্রতিকার বাংলা একাডেমিতে সভা করে হবে না। এই তো গতকাল ওখানে স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব একটা জমায়েতে বলেছেন, মোরসালিন যে কাজ করেছে তার জন্য ওর বুকে যে তরবারি ঢুকিয়ে দেবে সে জন্নতে যাবে, ইত্যাদি। যাই হোক, আমি তবুও প্রেস ক্লাবে গেলাম। মীরাতুন নাহারকে দেখতে পেয়ে তাঁকে আমাদের নিন্দা-প্রস্তাবে সই করতে বললাম। উনি প্রথমে একটু ইতস্তত করে চারদিকে চাইলেন, তারপর অবশ্য সই দিলেন। আমাদের স্থানীয় মুসলমান বন্ধুরাও প্রায় সকলেই ভয় পেয়েছিল এবং সই দিতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকেই সই দিলেন। ইতিমধ্যে লেখক মোরসালিন এবং সম্পাদক মহম্মদ আলীকে ডাকা হল মহেশতলা পুলিশ স্টেশনে। সেখানে এসপি-র উপস্থিতিতে আমাদের তৎকালীন এমএলএ মোরসালিন মোল্লা ওঁদের দুজনকে লিখিতভাবে আল্লার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন এবং প্রবন্ধটি ফিরিয়ে নিতে বললেন। ওঁরা তাতে রাজি হলেন। সেই লিখিত মুচলেকা খবরের কাগজের সঙ্গে ওই এলাকায় বিলি করে দেওয়া হল। মোরসালিন পালিয়ে গিয়েছিলেন ওঁর গ্রামের বাড়িতে। আমরা মাটির কেল্লার পক্ষ থেকে সেখানে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। উনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলেন, আমাদের সামনেই কাঁদছিলেন। আমরা ওঁকে মাদ্রাসায় ফিরে আসতে বললাম। উনি ফিরে এলেন। এর বেশ কিছুদিন পরে আমরা কয়েকশো মানুষের স্বাক্ষর করা ওই নিন্দা-প্রস্তাব নিয়ে গেলাম এমএলএ মোরসালিন মোল্লার কাছে। ওঁকে অনুরোধ করলাম, লেখক মোরসালিনের বাড়িটা মেরামত করার দায়িত্ব নিন, আমরা আপনার পাশে থাকব। উনি আমাদের ওপর প্রচণ্ড চটে গেলেন।
৬
এর প্রায় নয় বছর পরে ৩ এপ্রিল ২০১৪ গণপ্রহারে আক্রান্ত হন মাটির কেল্লার সদস্য ফারুকুল ইসলাম। ফেসবুকে ওঁর পেজে একটা পোস্ট হয়েছিল নবীর জীবন নিয়ে। সেই পোস্ট বটতলায় ওঁর পাড়ার একজন দেখতে পায়। তারপর সেই পোস্টটা ছাপিয়ে বিলি করে দেওয়া হয়। আওয়াজ ওঠে, ফারুক নবীকে গাল দিয়েছে। একদিনের মধ্যে দল বেঁধে তলোয়ার হাতে যুবকেরা ওঁর বাড়িতে চড়াও হয়, ওঁকে মারতে মারতে নামিয়ে নিয়ে আসা হয় রাস্তার ওপর। কিছুটা দূরে একটা মসজিদে অবশ্য ফারুক আশ্রয় পান, নাহলে ওইদিন তাঁর মৃত্যুও হতে পারত। রাতে পুলিশ ওঁকে গ্রেপ্তার করে লালবাজার লকআপে নিয়ে যায়। ওঁর জামিনের জন্য মাটির কেল্লা থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওঁর স্ত্রীর অনুরোধে সেই উদ্যোগে আমি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়েছিলাম। ফারুক জামিন পান, কিন্তু আদালত রায় দেয় যে ফারুক মেটিয়াবুরুজে ফিরতে পারবেন না। ফারুক ছাড়া পেয়ে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু এর পরের ঘটনা উলটো খাতে বইতে শুরু করে। মাটির কেল্লার সদস্যদের একটা অংশ ফারুকের ঘটনাকে নিন্দা করেন এবং আমি ওঁর জামিনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলাম বলে আমারও সমালোচনা করা হয়। ফারুককে মাটির কেল্লা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
‘নবীকে গাল দেছে’ প্রচারে ফারুকের ওপর শত শত যুবকের সশস্ত্র উন্মত্ত তাণ্ডব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। একবছর পর ২৬ মার্চ ২০১৫ ফের আক্রান্ত হয়েছিলেন তালপুকুর আড়া হাই মাদ্রাসার হেডমাস্টার কাজি মাসুম আখতার। রাজাবাগান থানার আইসি-র উপস্থিতিতেই তাঁর মাথা ফাটিয়ে তাঁকে এলাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বারবার আসছিল ইসলাম বা নবীকে অপমান করার অভিযোগ। তুচ্ছ ঘটনা বা বিবাদে শত শত যুবক-কিশোর একত্রিত হয়ে ভাঙচুর, হামলায় নেমে পড়ছে।
মেটিয়াবুরুজে এলাকাগুলির এক ধরনের সম্প্রদায়গত বিন্যাস রয়েছে। বটতলাকে ঘিরে বাঙালি দর্জি মুসলমানদের অঞ্চল, কাচি সড়ককে ঘিরে উর্দুভাষী মুসলমানদের অঞ্চল, রাজাবাগান-কেশোরাম সুতাকল ঘিরে ওড়িয়া, তেলেগু, হিন্দিভাষী শ্রমিকদের কতকগুলো পকেট, বদরতলায় মুসলমান বেষ্টিত কিছু হিন্দু পাড়া, আমাদের রবীন্দ্রনগরে মুসলমান বেষ্টিত হিন্দুপাড়া, পদীরহাটি-মাকালহাটি-রামদাসহাটি হয়ে বাঁধাবটতলা পর্যন্ত বাঙালি হিন্দুদের কিছু পাড়া, ফতেপুরে হিন্দিভাষী হিন্দুদের অঞ্চল। তবে মুসলমান বেষ্টিত হিন্দুপাড়া থেকে স্বচ্ছল হিন্দুরা ক্রমশ বাস গুটিয়ে বেহালা বা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করছে হিন্দিভাষী হিন্দুরা। ৬ ডিসেম্বরের পর সাতঘরা, কাশ্যপপাড়া থেকে বহু হিন্দু পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বদরতলার ডা. খবির রোডে আগেই এই ঘটনা ঘটেছে। মেটিয়াবুরুজের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নিজেদের অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতায়াত করে না। তাদের অধিকাংশের গতিবিধি কলকাতা বা শিয়ালদা-মুখী।
আমাদের রবীন্দ্রনগরে দেখতে পাই মুসলমানদের প্রতি অনেক মানুষের, বিশেষত কমবয়সি ছেলেমেয়েদের তীব্র ঘৃণার মনোভাব। যুবকদের অনেকের মধ্যে একটা নিষ্ফলা ক্রোধ, মুসলমান কিশোর-যুবকদের মতো তারা এক ডাকে জড়ো হতে পারে না। অথচ রবীন্দ্রনগর স্কুলে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে পড়াশুনো করে। কখনো কখনো তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়, প্রেম-ভালোবাসাও হয়, এমনকী বিয়েও হয়। চোখের সামনেই দেখেছি, মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। উলটোটা হলে, অর্থাৎ হিন্দু ছেলে মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে অবশ্য মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। যদিও সেরকম ঘটনা কমই ঘটে।
কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনগরে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। ২৬ এপ্রিল ২০১৭, চারটে মন্দিরে গরুর মাংসের প্যাকেট পাওয়া গেল। আকড়া ফটকের মন্দির, রবীন্দ্রনগর ডি ব্লকের মন্দির, কালীমন্দির আর কানখুলি হরিসভার রাধাগোবিন্দ মন্দিরে সম্ভবত ভোরের আগেই প্যাকেটগুলো ফেলা হয়েছে এবং পুলিশের কাছে খবর গেছে। পুলিশ সকাল সকাল প্যাকেটগুলো সরিয়ে ফেলেছে যাতে কোনো গণ্ডগোল না হতে পারে। আরও একটা কথা শুনলাম, ওইদিন নাকি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা অমিত শাহের সভায় রবীন্দ্রনগর থেকে বহু লোক মিছিলে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা আটকাতেই নাকি ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে যাতে মিছিলে লোক যেতে না পারে—ইঙ্গিতটা ছিল তৃণমূলের দিকে। দিনটা ছিল বুধবার, দর্জি শিল্পের ছুটির দিন। সারা দিন মুসলমান যুবকেরা বাইক নিয়ে আমাদের পাড়ার ভিতর দিয়ে ছোটাছুটি করে। প্রায়ই বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়, লোকে আহত হয়, মারাও যায়। এর মাসখানেক আগেই এক রবিবার রাত সাড়ে ন-টার সময় ন্যাশনাল স্টুডিওর মালিক সোমনাথ মাঝিকে রাস্তার ওপর ধাক্কা মারে একটি মোটরবাইক। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার কিছুদিন পর তিনি মারা যান। ঘটনাস্থলে স্থানীয় মানুষ ওই বাইকে আগুন লাগিয়ে দেয়। মোটরবাইক আরোহী ছিলেন মুসলমান। মন্দিরে গরুর মাংস ফেলার ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে একটা ভিডিও পেলাম, বিবেক সিং নামে একজনের পোস্টে। ইতিমধ্যে ৫৭৯৬ জন ওই পোস্ট দেখেছে। পোস্টটা দেখলেই বোঝা যায়, গরুর মাংস ফেলা হয়েছে, অতএব মুসলমানেরাই সেটা ফেলেছে ধরে নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার দিন দুপুর একটা নাগাদ আমার পরিচিত একজন স্থানীয় যুবকের ফেসবুক পোস্ট থেকে শুরু হল দীর্ঘ এক কথাবার্তা। দু-একজন বাদ দিয়ে, এঁরা প্রায় সকলেই রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দা, প্রায় সকলেই একসময় আকড়া শক্তিগড় রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা করেছেন, বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। সবটাই চলছিল মুসলমানদের দায়ী করে নানারকম মন্তব্য। একজন একটু বেসুরে মন্তব্য করে, ‘এটা যে সবসময় ওই নির্দিষ্ট ধর্মের লোকেদের কাজ তা ধরে নিলে একটু ভুল হবে... বীরভূমের রাজনগরে কিছুটা একইরকম ঘটনা ঘটে... সেখানে স্থানীয় মানুষ ওই লোকগুলোকে ধরে ফেলে... পরে দেখা যায় ওই লোকগুলো আরএসএস নামক উগ্রপন্থী দল তার সাথে যুক্ত... এগুলো খুব সেনসিটিভ ইস্যু, কেউ বা কারা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এগুলো ঘটাচ্ছে... একতরফা দোষারোপের আগে আমাদেরও সজাগ থাকা উচিত।’ তার কথা উড়িয়ে দেয় অন্যরা। ক্রমশ এটা মুসলমান-বিদ্বেষী মন্তব্যের এক প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত হয়। একজন লেখে, ‘চল ভাই আমরা শুয়োর ফেলি... ইটের জবাব পাটকেলে।’ আর একজন লেখে, ‘রবীন্দ্রনগর মাঠে মাঝে মাঝেই পর্ক ফেস্টিভাল করলে কেমন হয়?’ এক যুবতী লেখে, ‘যে অ্যাকসিডেন্টটা হল ওতে বাইক জ্বলেছে সেটা ভুল করেছে। ওই ছেলেটাকে সুদ্ধ জ্বালিয়ে দিলে তবে ঠিক হত। প্রাণের বদলে প্রাণ।’ যদিও এইসব যুবক-যুবতীদের কাউকেই ঘটনার দিন সকালে রবীন্দ্রনগর আর ঘোষপাড়ার মোড়ে যে দুটো পথ অবরোধ হয়েছিল সেখানে দেখা যায়নি। সেখানে মূলত ভিড় করেছিল অবাঙালি হিন্দু ছেলেপুলেরা। বাঙালি হিন্দু ছেলেমেয়েদের এখানে সাহস কিছুটা কম, বিদ্বেষ কিন্তু ষোলোআনা! পরে জানা যায়, গরুর মাংস ফেলার ঘটনায় মুসলমানেরা মোটেই ছিল না।
৭
এরকম ছোটোখাটো ঘটনা, ঠোকাঠুকি প্রায়ই ঘটতে থাকে। সেসবের মেজাজের মধ্যে তীব্রতর হয়ে ওঠা জাতগত ঘৃণা অনুভব করতে পারি। এটা ঠিকই যে গরুর মাংস ফেলার মতো ঘটনাগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, যাকে আমরা এক কথায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বলতে পারি। আর এক ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও মেটিয়াবুরুজে দেখা যায়, সেটা হল প্রত্যেক সেকুলার দলের মধ্যেই হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে পার্টি-ক্ষমতা দখলের লড়াই আর ওপরে ওপরে এক সাজানো-গোছানো ধর্মনিরপেক্ষতার ভঙ্গি। এটা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সিপিএমের মধ্যেও ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল।
সাম্প্রদায়িকতার ওপরের স্তরটার নিচে চোখ মেললেই দেখতে পাই সমাজের ভিতরে আমাদের কৌম-মনের গহীনে একটা দ্বেষ—অপরকে এবং অপরের চালচলন-অভ্যাস-খাওয়াদাওয়াকে সহ্য করতে না-পারা। এখানে কেউ কম নয়, কেউ বেশিও নয়। হিন্দু-মুসলমান উভয়ই এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদেশে হিন্দুদের জোর বেশি, তাই এই ঘৃণার কোপ মুসলমানের ওপর বেশি বর্তায়। সারা দেশে মার খেতে খেতে মেটিয়াবুরুজে এসে মুসলমানের সেই অপমানিত-লাঞ্ছিত সত্তা প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
১৯৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর কাশ্যপপাড়ায় হিন্দুদের ঘর জ্বলেছিল। কাশ্যপপাড়া থেকে বাস উঠিয়ে রবীন্দ্রনগরে আসা একজন স্মৃতিচারণ করছিলেন আমার কাছে : ঠিক সকালবেলায় একদম আটটা থেকে শুরু হল। আটটা থেকে বারোটা, পাক্কা চারঘণ্টা। অল্পবয়সি ছেলেগুলোকে ওরা কাজে লাগিয়েছে। বাঙালি মুসলমান ছেলে, পরস্পর গালিগালাজ করছে, কিন্তু কাউকে মারছে না। আমার দাদার ঘরটা ছিল সামনে। তার ঘর থেকে সব কিছু নিয়ে নিল। আলমারি-টালমারি, টাকাপয়সা সব নিয়ে ঘরটা জ্বালিয়ে দিল। ... কাশ্যপপাড়ায় রাস্তার এপারে হিন্দু ছিল, ওপারেও হিন্দু ছিল। একসময় আমরা গুনে দেখেছিলাম হিন্দুদের ১৪০ খানা বাড়ি। কাশ্যপীদের পুরোনো বাড়ি। জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল। এত আন্তরিকতা ছিল সকলের মধ্যে, পাড়ার মধ্যে আমার বাড়ির পিছনে এক মুসলমান পরিবার থাকত। যে কোনো অনুষ্ঠান ইত্যাদি হলে আসাযাওয়া ছিল আমাদের মধ্যে। ... ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরেই ব্যবসাগুলো বেড়ে উঠল। এইভাবে আস্তে আস্তে মার্কেট বাড়তে লাগল। ... ১৯৮১-৮২ নাগাদ ... আগে যেমন ওরা হাওড়া হাটে যেত... কষ্ট করে রাত্রি জেগে জেগে যেত... মার্কেট দু-চারটে হয়ে যাওয়ার পরে মাড়োয়ারিরা কী করল মার্কেটের দোকানগুলো কেনা শুরু করল। ওরা দেখল ওস্তাগররা তো ওখান থেকেই বড়বাজারে আসছে, আমরা যদি ওখানেই গিয়ে শেল্টার নিতে পারি তাহলে আমাদের ব্যবসাটা বাড়বে। আর হলও তাই। মাড়োয়ারিরাই তো প্রথম ওইসব শুরু করে। ওরা ঢুকে গেল। ... ১৯৮৪ সালে জব্বার হাট শুরু হওয়ার আগে ওখানে একটা ফ্যাকট্রি ছিল, রেলের লোহার চাকা তৈরি হত। ১৯৮৫-৮৬ নাগাদ ভিআইপি মার্কেট তৈরি শুরু হয়। একজন মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের ওখানে জায়গা ছিল। যেখানে তখন একটা পেট্রোল পাম্প ছিল, এখন ভিআইপির পরে আর একটা মার্কেট হয়েছে। বড়ো করে স্ট্রাকচার করে কনস্ট্রাকশন করতে গিয়ে ওই পাম্পটাতে সাতজন লোক মারা যায়। পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর ছেলের বয়স হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর নাতি ওই জায়গাটাতে ভিআইপি মার্কেট করা শুরু করে। তাঁর এক ছেলে ছিল। স্থানীয় বাঙালি মুসলমান এক যুবক মার্কেটটা দেখভাল করত। তখন ওদের পয়সাকড়ি নেই। সে বেশি পড়াশুনো করেনি। দেখভাল করতে করতে ওই মাড়োয়ারি ছেলেটার সঙ্গে এই যুবকের খুব অন্তরঙ্গতা হল। মাড়োয়ারি ছেলেটা পয়সা নষ্ট করে ফেলে, মুসলমান যুবকটির সঙ্গে মিশে সে আরও খারাপ হয়ে গেল। তাতে এ সুযোগটা নিল, ওদেরকে ডমিনেট করে মার্কেটটার একটা শেয়ার নিয়ে নিল। ওই হল ওই যুবকের উত্থান। আমি বড় হয়ে দেখেছি, যুবকের বাবা ছিলেন মদ্যপ, রাস্তায় পড়ে থাকতেন, আমরা ধরে রিকশায় তুলে দিতাম, বলতাম, সোজা বাড়ি নিয়ে যা। কারবালার ওদিকটা, যেখানে ওরা থাকত, ওদিকটায় তখন সবার মাটি আর বেড়ার ঘর। ... ঘর জ্বলল, তারপর তো কার্ফু হয়ে গেল। প্যারামিলিটারি চলে এল। দুদিন পরে ডিজি, কী এক মজুমদার, পুলিশ নিয়ে ঢুকছে। আমরা ওই রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েছি। হয় আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, আর নয় আমাদের মেরে আপনাদের যেতে হবে। প্রায় শ-দেড়েক আমরা ছিলাম। সবচেয়ে বড় জিনিস, আমরা অবাক হয়েছি, তিনদিন আমরা কোনো কিছু খাইনি, এমনকী বাচ্চা পর্যন্ত, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য... আতঙ্কে... রাত্রে ভিআইপি মার্কেটের নীচে আমাদের শেল্টার হয়েছিল। সব তো পুড়িয়ে দিয়েছে, যাবে কোথায়? দু’ রাত্রি আমরা ছিলাম। তারপর বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম। যখনই সুযোগ পেয়েছি ঘরে এসে থেকেছি। আমাদের দশা দেখে মাড়োয়ারিরা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। ওস্তাগররা নিজেদের স্বার্থেই ওদের নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। ওদের ব্যবসাটা তখন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ...’ সেই যুবক পরবর্তী দশকে মেটিয়াবুরুজের প্রথম সারির একজন ওস্তাগর। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও অসামান্য।
কাশ্যপপাড়ার ঘটনাতেও কয়েকটা বিষয় ছিল লক্ষ্যণীয় : প্রথমত, বাঙালি হিন্দুদের ঘর জ্বালানো হলেও মাড়োয়ারিদের সম্পত্তির ওপর হামলা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ঘর জ্বলেছে, লুঠপাট হয়েছে, কিন্তু কারো গায়ে হাত তোলা হয়নি। তৃতীয়ত, প্রতিবেশী মুসলমান পরিবার ঘটনার সময় নীরব থেকেছে, হামলাকারীদের বাধা দেয়নি। চতুর্থত, কাশ্যপপাড়া ছিল মুসলমান বেষ্টিত হিন্দুদের ছোট্ট একটা পাড়া, সেখানকার জমিগুলো দখল করার একটা ব্যবসায়িক স্বার্থ পিছনে কলকাঠি নেড়েছে, নিছক চ্যাংড়া ছেলেদের বুদ্ধিতে কাজটা হয়নি। তা যদি হত, তাহলে মেটিয়াবুরুজে দাঙ্গা আরও ব্যাপক আকার নিত। তার চরিত্র হতে পারত সত্যিই সাম্প্রদায়িক। ১৯৪৬-এর বীভৎসতা ছিল অনেকটা সেই চরিত্রের। পঞ্চমত, ১৯৯২-তে প্রথম বাঙালি মুসলমান এরকম হিংস্র হয়ে উঠল, অতীত দাঙ্গাহাঙ্গামায় সেটা তেমনভাবে দেখা যায়নি।
মেটিয়াবুরুজের মতো এত বড় একটা অঞ্চলে কাশ্যপপাড়ার ঘটনা অবশ্যই ব্যতিক্রমী। এখানকার বাসিন্দাদের কৌম-মনে যেমন দ্বেষ রয়েছে, রয়েছে সহনশীলতা, অপরকে সহ্য করে চলা। আজও বিদ্বেষী রাজনীতির স্বাভাবিক প্রতিরোধ সেখান থেকেই আসে। এক সময় হিন্দুরা বদরপীরের মাজার, হাজি রতনের মাজার, পীরডাঙার মাজারে যেত। আজ আর কাউকে যেতে দেখি না।
১৯৯০ থেকে ২০১৭, মেটিয়াবুরুজ নিয়ে আমার কিছু ছেঁড়া-ছেঁড়া উপলব্ধির কথা লিখে ফেললাম। জানি না তা কতটা আলাপযোগ্য, নাকি নেহাতই এক পাগলের প্রলাপ। মাটির কেল্লায় এসেছিলেন মেটিয়াবুরুজের প্রবীণ পোস্টমাস্টার নিখিল রঞ্জন জোয়ারদার, এখানকার সমস্ত ফুটবল খেলার সাথি প্রয়াত মানিক লাল মান্না, গার্ডেনরীচ শিপবিল্ডার্সের শ্রমিক-সাহিত্যিক অঞ্জন পাল, সুপরিচিত মেয়েদের চিকিৎসক কৃষ্ণা সেন, দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গ থেকে মেটিয়াবুরুজে আগত প্রয়াত সাহিত্যিক অনিল তপাদার। মেটিয়াবুরুজকে এঁরা প্রত্যেকে চিনতেন অনেক গভীরভাবে, অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছেন নিজের বাসভূমিকে।
১ সূত্র : উত্তাল চল্লিশ, অসমাপ্ত বিপ্লব, অমলেন্দু সেনগুপ্ত, ১৯৮৯।
৪ কিছুদিন আগে স্টেট্সম্যান পত্রিকায় ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স এগো’ কলামে একটা খবর পেলাম, ১৯১৭ সালে মেটিয়াবুরুজের কাচিসড়কে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা হয়েছিল এবং কাছেপিঠের কারখানা থেকে শ্রমিকেরা বেরিয়ে এসে তাতে যোগ দিয়েছিল।
৫ ১৯৮৭-৮৮ সালে কেশোরাম বন্ধ থাকাকালীন বদরতলা নিবাসী হৃষীকেশ পাল শ্রমিক-নেতা অরুণ সেনের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে ‘বাঙলাদেশ’ পত্রিকার ২২ জুলাই ১৯৮৮ সংখ্যায় একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেখানে এই তথ্যগুলি ছিল।
Link: https://ebongalap.org/babri-masjid-riot-and-its-aftermath-in-metiabruj