23-05-2024 17:42:00 pm
Link: https://ebongalap.org/begum-rokeya-and-love-jihad-ekhon-alap-special-blog
কয়েকদিন আগে একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। দুই বয়স্কা মহিলা, বেশ নিরীহ মা-মা চেহারার, তাঁদের এক-কামরার বস্তির ঘরে মুখোমুখি বসে দাবা খেলছেন। মণিকা আর পূর্ণিমা। তাঁরা বিয়ে করেননি। বন্ধু। একসাথে থাকেন। খেটে খান।
নভেম্বরের শেষে দৃশ্যটি দেখেছিলাম কলকাতার Dialogues ফিল্ম ফেস্টিভালে একেবারে অন্যরকমের একটি ছবিতে। নাম ‘তুরুপ’। তৈরি করেছেন ‘একতারা কালেকটিভ’ গোষ্ঠী।
ছবিতে একটি ছোট শহরের রাস্তায় ছেলেদের দাবার আড্ডাগুলোয় জাত-ধর্মকে ঘিরে নানারকমের রেষারেষি চলতে থাকে। চারিদিকে ‘বিরাট হিন্দু সম্মেলন’-এর পোস্টার আর WhatsApp-এ মুসলমান-বিদ্বেষী মেসেজের ছয়লাপ। এরই মধ্যে লতা আর মজিদের প্রেম। লতাকে আগলে রাখেন পূর্ণিমা। তিনি ও মণিকা তাঁদের আশেপাশে যে দু-একজন নাতনির বয়সি মেয়ে ‘অজাত-কুজাত’ আর ‘বিধর্মী’দের ছেলেদের সাথে ‘লটঘট’ করবার জন্যে মহল্লার মোড়লদের তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের আশ্রয় দেন লুকিয়ে নিজেদের ঘরে। সাংবাদিক নীলিমার বাড়িতে কাজ করেন মণিকা। যে নীলিমা বিয়ের আগে দাপুটে সাংবাদিক ছিলেন আর এখন বিবাহিত জীবনের নানা হতাশায় ক্লান্ত। নীলিমার হাতে ঠাণ্ডা ফলের রসের গ্লাস তুলে দিতে দিতে জোট বাঁধেন মণিকা। হিন্দু মেয়েকে ‘অপহরণ’ করার মিথ্যে অভিযোগে মহল্লার একটি অন্য ধর্মাবলম্বী ছেলের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে। মণিকা-নীলিমা-লতা-পূর্নিমার জোট উলটে দিতে চায় ‘লাভ জেহাদ’-এর ছক।
মণিকার নির্বিরোধী চেহারাটা মন থেকে এখনো মুছে ফেলতে পারি নি আমি। তাঁর শান্তভাবে পিতৃতন্ত্র ও জাতধর্মের নামে বিভেদ রোখার জেদ দেখতে দেখতে মনে পড়েছে দীনতারিণী সেন নামে এক প্রৌঢ়া ব্রাহ্মিকার কথা। ব্রাহ্ম, হিন্দু, মুসলমান, এমনকী সাদা চামড়ার খৃষ্টান—সব ধর্মের পরিবার/সমাজ/স্বামী পরিত্যক্ত মেয়েদের ঠাঁই ছিল দীনতারিণীর ‘তারিণী ভবনে’-এ। ঠিকানা একটি অণু উপন্যাস। নাম ‘পদ্মরাগ’। লেখিকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বেরিয়েছিল ১৯২৪-এ। ‘তারিণী ভবন’-এর মেয়েরা ছিলেন পরস্পরের সহায় আর দীনতারিণী-পরিচালিত স্কুলে পড়ানো ও অন্যান্য কাজের ভার ছিল এঁদের ওপর।
দীনতারিণীর সৃষ্টিকর্ত্রী রোকেয়ারও ছিল একটি স্কুল আর তাঁর নিজের পরিবার ও স্কুলের পরিবারে সদস্য ছিলেন নানা সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মহিলা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যাঁদের সে অর্থে যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিল না। যদিও রোকেয়া-প্রতিষ্ঠিত ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ বাংলার মুসলমান মেয়েদের জন্যই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১১ সালে, যে মেয়েদের সমাজ তখনো পর্যন্ত বাধ্য করেছিল অন্ধকূপে বন্দি থাকতে, তাঁর স্কুলের শিক্ষিকারা বেশিরভাগই ছিলেন খৃষ্টান, হিন্দু, ব্রাহ্ম ও অ্যাঙলো-ইণ্ডিয়ান সম্প্রদায়ের। এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে সে সময়ে ক’জন শিক্ষিকা পাওয়া যেত মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে যে রোকেয়া তাঁদের নিয়োগ করবেন তাঁর স্কুলে? কথাটা ঠিক। আবার এও ঠিক যে জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিল রোকেয়ার আর মেয়েদের ধর্ম পরিচয়ের নিরিখে স্কুলে তাদের কাজ দেওয়ার কোনো প্রবণতা সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে দেখা যায়নি।
১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে যখন বাংলার কিছু কিছু মুসলমান মহিলা স্কুল-কলেজের পাঠ নিয়ে বেরোতে লাগলেন, তখন এবং তারপরেও রোকেয়ার স্কুলে নানা ধর্মাবলম্বী মমতাময়ী শিক্ষিকাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। কয়েকবছর আগে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ১৯৩০-৪০-এর দশকের কয়েকজন প্রাক্তনীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটে। সেই সূত্রেই স্কুলের বাংলা এবং উর্দুভাষী মুসলমান ছাত্রীদের কাছে জেনেছিলাম যে উচ্চশিক্ষিত হিন্দু-ব্রাহ্ম-খৃষ্টান শিক্ষিকাদের আচরণে কখনো ছাত্রীদের প্রতি কোনো বৈষম্য তাঁরা অনুভব করেন নি। বরং শিক্ষিকাদের কাছেই তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রথম পাঠ পেয়েছিলেন। তাঁদের স্কুলে রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদের গান গাওয়া, নজরুল ও গালিভের কবিতা পাঠ, গোলাম মোস্তাফার লেখা স্কুলসঙ্গীত, সুকুমার রায়ের নাটক অভিনয়—সবই হতো। বড় হয়ে তাঁরা বোধ করেছেন নিজেদের পরিবারে, পাড়ায়, বৃহত্তর সমাজে অনেক সময়েই যে চেতনার অভাব ছিল, স্কুলে সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাই তাঁদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া হয়।
এটাও উল্লেখযোগ্য যে রোকেয়া ছিলেন ১৯২৭ সালে গঠিত Bengal Women’s Education League-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং তাঁর সঙ্গে সম্প্রদায়-নির্বিশেষে বেশ কয়েকজন অগ্রগণ্য সমাজসেবিকা একত্র হয়েছিলেন সার্বিকভাবে বাংলার মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের লক্ষে। লক্ষ করবেন যে সময়ে এঁরা নারীশিক্ষায় ঔপনিবেশিক নীতির পরিবর্তন আনতে চেয়ে জোট বেঁধেছিলেন সেই সময়ে কিন্তু অবিভক্ত বাংলার রাজনীতি-অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত হিন্দু-মুসলমান রেষারেষি ও ক্ষমতা দখলের লড়াই বেশ তীব্র। সেই সঙ্গে হিন্দু মেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে ‘কামাতুর’ বিধর্মীরা ‘অপহরণ’ করে নিয়ে যাচ্ছে, বিয়ে করে তাদের ধর্মান্তর করিয়ে হিন্দুধর্মের ওপর আঘাত হানছে, হিন্দু জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে, এই জিগিরে বাংলার অধিকাংশ কাগজ-পত্রিকা ছিল মুখর। ‘লাভ-জেহাদ’ না থাকলেও ‘নারীরক্ষা’র নামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক অবশ্যই ছিল এবং হিন্দু নারী অপহরণের মামলাও নিয়মিত কোর্টে উঠত।
রোকেয়ার সঙ্গে যে শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবিকারা Bengal Women’s Education League-এ সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে রোকেয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরলা রায়ের কথা তুলছি একটা বিশেষ কারণে। রোকেয়া নিজে কোনোদিন স্কুল-কলেজে না পড়ে মেয়েদের জন্য স্কুল করবার বাসনা নিয়ে যখন কলকাতায় আসলেন, তখন সরলার সাহায্যেই দিনের পর দিন তিনি পর্দা-ঘেরা ঘোড়ার গাড়ি করে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়’-এ গিয়ে সেখানকার পঠন-পাঠনের ধরন মনযোগ দিয়ে লক্ষ করতেন। আর সরলা ছিলেন ব্রাহ্ম স্কুলটির নব-নিযুক্ত ‘লেডিজ কমিটি’-র পুরোধা। সরলার নেতৃত্বে ওই লেডিজ কমিটি ১৯০৬-০৭ সাল নাগাদ চেষ্টা করছিল স্কুলটিকে ব্রাহ্ম বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী কিছু গোঁড়া পুরুষ সদস্যের প্রভাবমুক্ত করতে যাঁরা চাইছিলেন না ব্রাহ্ম নন এমন কোনো ব্যক্তি ওই শিক্ষালয়ের অধ্যক্ষ হোক। বিশুদ্ধবাদী ব্রাহ্ম নেতাদের মধ্যে ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র—যিনি পরে ১৯২০-র দশকে হিন্দু নারীরক্ষা আন্দোলনের একজন প্রাণপুরূষ। কিছু নেতার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও কিন্তু ওই লেডিজ কমিটি ‘ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়’-এ একটা খোলা হাওয়া বইয়ে দিতে পেরেছিল।
অবহেলিত মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো আর নিজের স্কুলে মেয়েদের জন্য আলো-বাতাস আর মনের খোরাকের ব্যবস্থা করবার অপরাধে রোকেয়াকেও যে তাঁর সমাজের একটা বড় অংশ ছেড়ে কথা বলেন নি, তা বলাই বাহূল্য। শেষ জীবনে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর, সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি; উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগর তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের, বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের পঁচিশ বৎসর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি’।
১৯৩২-এর ৯ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে রোকেয়া যখন মারা যান তখন তাঁর স্মরণসভায় সরলা রায় বলেন, ‘She was a woman with a very large heart which bled only for the improvement of the education of her own sex in the country. To her, Hindu and Muslim had no difference and I too, from childhood knew no difference.’
রোকেয়া আর সরলা দুজনেই ছিলেন উদারপন্থী সমাজসংস্কারক নারী। ধর্মবিশ্বাসী হয়েও সবরকম ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে এবং জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়গত কারণে মেয়েদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার। আজ যখন ‘লাভ জেহাদ’-এর নামে মুজাফফরনগরে দাঙ্গা হয়, মালদার এক মুসলমান প্রৌঢকে রাজস্থানে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, হাদিয়াকে আটকে রাখা হয় নিজের বাড়িতে, তখন একালের মণিকা-পূর্ণিমা আর সেকালের রোকেয়া-সরলার কথা মাথায় রেখে আমরা কি করতে পারি, সেটা আলোচনা করব কি?
Link: https://ebongalap.org/begum-rokeya-and-love-jihad-ekhon-alap-special-blog