04-06-2024 07:31:56 am
Link: https://ebongalap.org/delay-in-daughters-marriage-what-is-the-real-thing
স্বাধীনতা দিবসের সকাল। লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রত্যাশিত ছিল। প্রতিবছর তো এমনই হয় — জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে গোটা দেশ তাকিয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে, তিনি বলেন, এবং চারপাশের সমস্ত কোলাহল ঢেকে যায় মুহুর্মুহু হাততালিতে। এবারেও সেই ছবির ব্যতিক্রম হল না। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে করা হবে ২১। এতে করে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার কমবে, মেয়েরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে, বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কমে যাবে বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতনের মতো ঘটনাও।
ভারতীয় সংবিধান ১৮ বছর বয়সে মহিলাদের ভোটদানের অধিকারকে স্বীকৃতি দিলেও, দেশের সমাজ, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনও তা মানতে নারাজ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার নিজের পছন্দ-অপছন্দ, মতামত থাকতে পারে, তিনি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন — একথা মেনে নিতে নারাজ।
তবে কিনা, প্রদীপের নিচেই থাকে জমাট অন্ধকার। আমাদের রাজনীতিক ও নীতি-নির্ধারকরা বরাবরই উচ্চকোটির মানুষ — শ্রমজীবী, প্রান্তিক মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর খবর প্রায় রাখেন না বললেই চলে। না হলে, মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা যায়? লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যখন রাস্তায় অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, হারানো সন্তানের ছবি বুকে জড়িয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে হাজার মাইল দূরের রাস্তায় আটকে পড়া অসহায় পিতা, তখন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিতে পারেন ঢাক-ঢোল নিয়ে রাস্তায় নামতে, হাততালি দিতে, মোমবাতি জ্বালাতে?
‘ধান ভানতে শিবের গাজন’ ভাববেন না মোটেই। অতিমারীর কারণে খোলামেলা আলোচনার জায়গা অনেকটাই এখন সঙ্কুচিত। রাস্তাঘাটে বাঙালি রাজনীতি বা সমাজ-চর্চার চেয়ে কোভিশিল্ড কবে বাজারে আসছে তা নিয়েই ব্যস্ত! এদিকে পার্লামেন্টেও ক্ষমতাগুরুরা একচেটিয়া — সংখ্যার দাপটে কোনও রকম তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই পাশ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বিল। তাতে কার লাভ কতটা হল সে সব থোড়াই কেয়ার! স্বাভাবিক ভাবেই মিডিয়াতে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর প্রস্তাবটি ততটা গুরুত্ব পায়নি। ফলে বুদ্ধিজীবীদের চায়ের কাপে ঝড় ওঠেনি। বিরোধীরা আটকে থাকলো টুইটার ও ফেসবুকে। এদিকে আইটি সেল অবাধে দাপিয়ে বেড়ালো সামাজিক মাধ্যম। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কী?
হাদিয়া মামলার কথা থেকেই শুরু করা যাক তাহলে। কেরালার ২৪ বছরের মেয়ে হাদিয়া বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করেছিলেন সাফিন জাহান নামে এক মুসলমান যুবককে। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন হিন্দু, এবং বিয়ের মাস খানেক পূর্বে ধর্মান্তরিত হন। এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ আখিলা, হাদিয়ার সেনাকর্মী বাবা, মেয়ের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। লাভ জেহাদের তত্ত্ব খাড়া করার পাশাপাশি তিনি হাদিয়ার স্বামী সাফিন জাহানের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্রবের অভিযোগ আনেন। অনেক জলঘোলার পরে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত বিষয়টির নিষ্পত্তি হলেও, এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ভারতীয় সংবিধান ১৮ বছর বয়সে মহিলাদের ভোটদানের অধিকারকে স্বীকৃতি দিলেও, দেশের সমাজ, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনও তা মানতে নারাজ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার নিজের পছন্দ-অপছন্দ, মতামত থাকতে পারে, তিনি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন — একথা মেনে নিতে নারাজ। মেয়েদেরকে এখনও পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করা হয়। বিয়ের বয়স বাড়ানোর এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে মেয়েদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জায়গা আরও সঙ্কুচিত হবে, তাদের ওপর বাড়বে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ।
মনে করা যাক অঞ্জলি মোদকের কথা। উত্তর চব্বিশ পরগনার স্বরূপনগরের মেয়ে, ১৮ পূর্ণ করার আগেই পরিবারের অপছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে বাড়ি ছাড়ে সে। এতে অঞ্জলির পরিবার ছেলেটিকে উচিত শিক্ষা দিতে তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন। এই মিথ্যে মামলার জেরে ছেলেটি ও তার পরিবার প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় অঞ্জলি নিজেও। আমাদের দেশে নাবালিকা বিয়ে সংক্রান্ত যেসব মামলা হয়, তার বেশির ভাগের পিছনে রয়েছে বাবা-মায়ের পছন্দের বিরুদ্ধে যাওয়া। পরিবার প্রতিশোধ নিতেই আদালতের দ্বারস্থ হয়।
সরকার যদি সত্যি সত্যি নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করে, তবে এই আইনের বাইরে এমন অনেক পথ আছে যার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
কথা হচ্ছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী প্রদীপবাবুর সঙ্গে। দীর্ঘদিন ধরে উত্তর চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে নাবালিকা বিয়ে ও নারী পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছেন তাঁরা। তিনি এই আইনকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলে অভিহিত করলেন। তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বললেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের ঘটনা দেখা যায় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলির মধ্যে। পাশাপাশি রয়েছে লিঙ্গবৈষম্য। প্রদীপবাবুর মতে, বাল্যবিবাহ, প্রসূতি মৃত্যু, শিশুমৃত্যু কিংবা অপুষ্টি — সব কিছুর উৎস কিন্তু কোথাও না কোথাও এই বৈষম্যগুলোই। সরকারের আগে সেদিকে মনযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এই প্রস্তাব পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে ছেলে এবং মেয়েদের বিয়ের বয়সে বর্তমানে যে ব্যবধান (ছেলেদের ২১, মেয়েদের ১৮) রয়েছে, সেটায় একটা সমতা আসবে। কিন্তু এর বেশি কিছু প্রাপ্তি ঘটবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সমাজের সর্বস্তরে লিঙ্গবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দুম করে আইন চালু হলে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। সরকার যদি সত্যি সত্যি নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করে, তবে এই আইনের বাইরে এমন অনেক পথ আছে যার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন ব্যাপকভাবে সচেতনতার প্রসার ও সুপরিকল্পিত নীতি-নির্ধারণ।
আমাদের সমাজে এখনও ব্যাপকভাবে ‘হাইপারগ্যামি’(সমান বা উঁচু ঘরে বিয়ে)-র অনুশীলন চলে — বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে যদি ১৮ হয় তবে মেয়েকে হতে হবে ১৫, ছেলের পরিবারের তুলনায় মেয়ের পরিবারের উপার্জন কম হতে হবে, ছেলে যদি মাধ্যমিক পাশ হয় মেয়েকে হতে হবে অষ্টম শ্রেণি পাশ। একইভাবে, এ রকম ধারণাও রয়েছে যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা একটু তাড়াতাড়ি পরিণত হয়, তাই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়া উচিত কম। বস্তুত, এগুলি এক ধরনের অতিকথন, এবং একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। ‘কিন্তু আমাদের চারপাশে প্রতিদিন এত রকমের অবৈজ্ঞানিক প্রথার চর্চা হয় — সেলিব্রিটি থেকে রাজনীতিকরা গো-মূত্র খেলে করোনা সেরে যাবে বলে নিদান দেন — যে মানুষ অনেক সময় ভালো-মন্দের বিচারবোধ হারিয়ে ফেলে’, বললেন হালিশহরের একজন বিজ্ঞানকর্মী।
দিনে দিনে শিক্ষার ব্যয়বহুল হয়ে ওঠা এই তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ার একটি কারণ
মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার অন্যতম কারণ কি স্কুলছট হয়ে যাওয়া? পুরোপুরি একমত হলেন না বিজাপুরের একটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা সুলগ্না ঘোষাল। বললেন, কিছু ক্ষেত্রে এরকম ঘটছে সেটা যেমন সত্যি, তেমনি মেয়েদের সম্মানজনক কর্মসংস্থানের অভাব একটা কারণ। শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বংশ পরম্পরায় চলে আসা অভাব-অনটনের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা যে সম্ভব, তা এখনও অনুধাবন করতে অক্ষম দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা মনে করেন ঘরের কাজে অভিজ্ঞ হলে মেয়েদের সংসারজীবন অনেক সুখের হবে। অর্থাৎ বিয়েটাই তাঁদের কাছে হয়ে দাঁড়াচ্ছে জীবনের প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া দিনে দিনে শিক্ষার ব্যয়বহুল হয়ে ওঠা এই তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ার একটি কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেই সঙ্গে অন্য একটি কারণের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুলগ্না দেবী —
স্কুল ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগ, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বাল্যবিবাহের ঘটনা আগের চেয়ে অনেকটাই কমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তা পুরোপুরি বন্ধ না হওয়ার পেছনে অন্য নানা কারণের সঙ্গে রয়েছে বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীদের নবলব্ধ যৌনতার উপলব্ধি ও তার প্রকাশ।
তাঁর স্কুলের ছাত্রী স্বাতীলেখা-র উদাহরণ দিলেন তিনি। স্বাতীলেখার বাবা-মা যথেষ্ট সচেতন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে স্কুলের সব রকমের সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন, নিজেরাও বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক গুলি নিয়ে কথা বলতেন প্রায়শই। উৎসাহ দিতেন মেয়ের পড়াশোনার বিষয়েও। কিন্তু একটি ঘটনা তাঁদের মনোভাবকে পাল্টে দেয় — ক্লাস টেনে পড়াকালীন অবস্থাতেই স্বাতীলেখা একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
ফেসবুক ভিডিও দেখুন : https://www.facebook.com/ebongalapngo/videos/686538538965564
সুলগ্না বললেন, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাতীলেখার বাবা-মায়ের মধ্যে এর ফলে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাঁরা মেয়ের ওপর প্রথমে চাপ তৈরি করেন, পরে লোকলজ্জার ভয়ে নিজেরাই বাড়ি থেকে ছেলেটির সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। স্বাতীলেখার ক্ষেত্রে বাড়ির সম্মতিতে বিয়ে হলেও, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের বাধার কারণে ছেলেমেয়েরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে, বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। আইন করে এই ধরণের ঘটনাকে বন্ধ করা অসম্ভব, বরং এতে আইন লঙ্ঘনের ঘটনাই বেশি ঘটবে। সুলগ্নার মতে, তার চেয়ে কীভাবে এই সমস্যা থেকে ছেলেমেয়েদের বের করে আনা যায়, বয়ঃসন্ধিতেই তাদের চিন্তা-ভাবনাকে কাঙ্খিত পথে চালনা করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবা উচিত।
কিন্তু কথা হল, দেশের শাসক এসব দেখেও চোখ বুজে থাকে। তারা বুঝেও ভান করে না বোঝার। ফলে দিনের পর দিন একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। বাস্তবিক অর্থেই, শাসকের কাছে নৈতিকতার প্রত্যাশা মানে আগুনের কাছে জলের প্রার্থনা।
Link: https://ebongalap.org/delay-in-daughters-marriage-what-is-the-real-thing