27-02-2024 06:34:41 am
Link: https://ebongalap.org/dowry-in-bengali-literature-part-two
পণপ্রথাকে মেয়েদের অবমূল্যায়ন এবং বিপন্নতার একটি মৌলিক, গঠনগত কারণ বলে চিহ্নিত করার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে না ইদানিংকালের প্রতিবাদ-আন্দোলনগুলোয়। ‘হিংসা’ একটি বৃহত্তর ফ্রেম তৈরি করছে যার মধ্যে নারী নির্যাতনের প্রায় সব ‘ভ্যারাইটি’ফিট করে যাচ্ছে। হিংসার বিরুদ্ধে আন্দোলন স্বভাবত বহির্মুখী, দাবি-নির্ভর। পুলিশ-চিকিৎসক-আদালতকে দায়বদ্ধ ও সক্রিয় করা তার কাজ। কিন্তু পণপ্রথার বিরোধিতার গতিটা বরাবর ছিল উল্টো দিকে। তা অন্তর্মুখী, সংস্কার-প্রত্যাশী। তার একটা বড় কারণ এই যে, ধর্ষণ-খুনের মতো অপরাধে কে অপরাধী আর কে তার শিকার, তার স্পষ্ট বিভাজন করা চলে। কিন্তু পণ-নির্যাতনে তা নয়। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে বারবার বলা হচ্ছে, কনের বাবা হয়ে যাঁরা নির্যাতিত হচ্ছেন, বরের বাবা হয়ে তাঁরাই নির্যাতন করছেন। প্রধানত ‘অপরাধ’-এর দৃষ্টিভঙ্গীতে পণপ্রথাকে চিন্তা করলে ‘জেন্ডার জাস্টিস’-এর বয়ানে আসাও দুষ্কর, কারণ পীড়নকারীর দলে থাকেন শাশুড়ি, ননদ, জায়েরাও। বধূনির্যাতন-বিরোধী ৪৯৮-ক ধারাটি নিয়ে এটা একটা মস্ত আপত্তি। প্রায়ই দেখা যায়, শ্বশুর-স্বামী-দেবর পলাতক, জামিন-অযোগ্য ধারায় জেলে পচছে পরিবারের মেয়েরা। তারা সকলেই হয়তো দোষী নয়। নির্যাতিতা মেয়েদের অংশগ্রহণে ‘যৌন হিংসার বিরুদ্ধে সমাজজুড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবর্তনা’ পণপ্রথার এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে ধরতে পারবে কিনা, সে প্রশ্নটা খোঁচা দিচ্ছে।
সন্দেহ হয়, ২০১৬ সালে পণপ্রথা যে স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে, আর পাঁচটা অপরাধের সঙ্গে প্রায় একমাত্রিক ভাবে আন্দোলনের কর্মসূচীতে উঠে আসতে পারছে, তার একটা কারণ এই যে তার আগের দশ-পনেরো বছর গল্প-উপন্যাস-আত্মকথায় পণের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সাহিত্যই পারে একটি বিষয়কে মানবসম্পর্কের বহুমাত্রিক ম্যাট্রিক্সের মধ্যে রেখে নেড়েচেড়ে দেখতে। কেন শিক্ষিত, রোজগেরে মেয়েরাও রাজি হয় পণ দিতে, কেন শিক্ষিত, রোজগেরে ছেলেরাও পণ না নিয়ে বিয়ে করতে চায় না প্রেমিকাকে, পণ দিয়ে কী পাওয়ার আশা করেন মেয়ের বাপ-মা, কঠোর আইন সত্ত্বেও কী করে বধূনির্যাতনের ঝুঁকি নেয় ছেলের পরিবার, এই সব প্রশ্নই বিশ্বায়িত বাঙালির বোঝার দরকার ছিল। সে কাজটা সাহিত্য এড়িয়ে গিয়েছে। তাই আজ আর স্পষ্ট নয়, ঠিক কীসের বিরুদ্ধে, কী উদ্দেশে লড়ছি।
পণবিরোধিতার প্রথম যুগে অন্তত এমন গোলমেলে চিন্তা ছিল না। ধর্মবিশ্বাসে সংস্কার, সামাজিক রীতিতে পরিবর্তন, সাম্য ও যুক্তিবাদের উপর সমাজ-জীবনের প্রতিষ্ঠা, এই সব প্রচেষ্টার থেকে পণের বিরোধিতাকে আলাদা করা হয়নি। গত শতকের আশির দশক থেকে নারী আন্দোলন যে চেষ্টা চালিয়েছে, তা হল আর্থিক বিধিব্যবস্থার সংস্কার। বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের উত্তরাধিকার, স্বামীর সম্পদ ও বাসগৃহে স্ত্রীয়ের অধিকার, মেয়েদের উপর অত্যাচার ঠেকাতে এই সব পরিবর্তনের জন্য সওয়াল করেছেন তাঁরা। পুত্রসন্তান স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে, আর কন্যাসন্তানের প্রাপ্যটুকু বরপণ হিসেবে তুলে দেওয়া হবে শ্বশুরবাড়ির হাতে, এই অন্যায্য বিতরণব্যবস্থা রয়েছে পুরুষতন্ত্রের মূলে। এই জন্যই মেয়েদের পরিনির্ভর করে রাখা এত সোজা। এই জন্যই মেয়েদের শরীর ও শ্রমের উপর পুরুষরা অনায়াসে প্রভুত্ব কায়েম করে আসছে। মেয়েরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট সম্পদ স্বাধীন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাই নিজেদের জীবনের উপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটাই তাদের সব অবমূল্যায়নের মৌলিক, প্রাথমিক কারণ।
তাই এক দিকে মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করে স্বাধীন ভাবে রোজগারের সক্ষমতা তৈরি, অন্য দিকে তাদের সম্পত্তির অধিকার দান, এই দুটোর জন্য আশি ও নব্বইয়ের দশকে লড়াই করেছিল নারী আন্দোলন। আজ ছাত্রেরা পণের জন্য যে ‘রাজনৈতিক’ আন্দোলনের কথা বলছেন, তা হয়তো হতে পারত পুরুষ-নারী রাজনীতি বদলানোর আন্দোলন। কিন্তু যখনই তাঁরা বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দেওয়ার কথা বলছেন, যখনই মনে করছেন যে এ দুটোর চরিত্র আলাদা নয়, এ দুটো একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখনই পণপ্রথার বিরুদ্ধে সংস্কার-মুখী লড়াই থেকে তাঁরা সরে যাচ্ছেন। যুদ্ধটা তখন প্রধানত রাষ্ট্রের থেকে সুষ্ঠ ও তৎপর প্রশাসন, আইনের শাসন পাওয়ার সংগ্রাম। ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংগঠন করার স্বাধীনতার উপর সরকারি দমননীতি প্রয়োগের বিরুদ্ধে লড়াই। পুরুষ ও মহিলা, দু’জনের কাছেই ব্যক্তিস্বাধীনতা মূল্যবান। কিন্তু তার জন্য যে রাজনীতি, দ্বন্দ্বময় গার্হস্থ্যজীবনে ক্ষমতার অসাম্য ঘোচানোর রাজনীতি সে নয়। তা ঠিক সংসার-জীবনের ‘পার্সোনাল’-কে ‘পলিটিক্যাল’ করে তোলার কাজটা করে না। অথচ পণপ্রথা আটকাতে হলে সেই রাজনীতিই দরকার। এ কথাটা যেন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সেই ‘অন্যমনস্কতা’-তে তাল দিচ্ছে মেয়েদের সক্ষমতার গল্প। মেয়েরা শিক্ষিত আর রোজগেরে হয়ে নিজেদের বিধিলিপি বদলে ফেলছে, এমন একটা বৃন্দগানে গলা মেলাতে মিডিয়া-কর্পোরেট জগৎ-সরকারি দফতর-এনজিও সকলে উৎসাহী, এবং তা শুনতে মেয়েরাও আগ্রহী। কিন্তু এই ‘উত্তিষ্ঠত-জাগ্রত’ মন্ত্রের উজ্জ্বলতার তলায় সাবেকি অন্ধকার রয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষিতা, চাকুরিরতা কন্যারা নিজের মাইনে জমিয়ে, নইলে লোন করে, প্রেমিক-স্বামীর পণের খাঁই মেটাচ্ছেন, সে সত্যটাও তো মিথ্যে হয়ে যাবে না? কেরলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার সব চাইতে বেশি, কেরলে মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে পণও দিতে হয় অত্যন্ত বেশি। মায়ের রোজগার মেয়ের পণের টাকার জন্য সঞ্চয় করা হলে তাকে কি সক্ষমতা বলে?
যা ফিট করে না, তাকে বাদ দেওয়াই দস্তুর। মেয়েদের উত্তরণের বাঁধা ফর্মুলা ঘেঁটে যায় পণকে ‘ফ্যাক্টর’ করতে গেলে। শিক্ষা, রোজগার, নির্বাচনে আসন সংরক্ষণ, সাইকেল-স্কলারশিপ বিতরণ, ধর্ষণ করলে ফাঁসির আদেশ, কোনও কিছুই পণের প্রকোপ কমাতে পারে না। অতএব চেপে যাও। সব ব্যাপারে কথা বলার দরকার কী? সত্যি, আজকাল পণের কথা তোলাটাই কেমন একটু অভদ্রতা, একটু অশ্লীলতা বলে মনে হয়। ওটা পরিবারগুলোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে টিভি নিল, কে গাড়ি নিল, কে ক্যাশ নিল, তা নিয়ে কথা বলতে যাওয়া লোকের প্রাইভেসিতে নাক গলানো। ও নিয়ে লেখালেখির কী আছে?
তাই আর লেখালেখি হয় না। পণের কোপে মরে-যাওয়া, কিংবা জ্যান্তে মরে-থাকা মেয়েদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না বাংলা সাহিত্যে, সমাজচিন্তায়। ১৮১৮ সালে প্রথম পণবিরোধী চিঠি লেখা হয়েছিল কাগজে। ২০১৮ সালে তেমন চিঠি লেখা হবে কি? দুশো বছরে পণপ্রথাকে জনজীবন থেকে আমরা ঢুকিয়ে দিয়েছি ঘরে।
(শেষ)
Link: https://ebongalap.org/dowry-in-bengali-literature-part-two