06-02-2024 19:39:30 pm
Link: https://ebongalap.org/first-women-qazis-in-india
[মূল ইংরেজি নিবন্ধটি ১৮/৮/২০১৭ তারিখে huffingtonpost.in –এ প্রকাশিত। লিখেছেন হাফপোস্ট-এর তৎকালীন সোশ্যাল মিডিয়া এডিটর অদৃজা বোস। অদৃজা বর্তমানে CNN-NEWS18-এর এসোসিয়েট এডিটর। ইংরেজি থেকে বাংলায় লেখাটি অনুবাদ করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য। সর্বজয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত। অনুবাদ করতে এবং চিনি ছাড়া লাল চা খেতে পছন্দ করেন]
ছ’মাসের ভিতরে ভেঙে পড়ল ইক্রা-র দুনিয়া।
ওর নিজের বয়ানে, এর সূত্রপাত ঘটেছিল ওর বিয়ের মধ্যে দিয়ে, যেমন ঘটে আর কী! তেইশ বছরের এই মেয়েটির সাথে আলি’র বিয়ে ছিল একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মত। আলি ওর দাদা – খালা’র (মাসি) ছেলে। ইক্রা-র ভাইয়ের বিয়ে হয় সেই মাসির মেয়ের সাথে। ইক্রা-র মাসিই ওর শাশুড়ি। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমান সমাজে ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে বেশ প্রচলিত।
দু’মাস পরে, ইক্রা-র ননদ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওর মা-বাবা নাকি জোর ক’রে ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছিল।
ননদের মুক্তি ইক্রা-র বন্দীদশার সূচনা ঘটাল। নিজের মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় ইক্রা-র শাশুড়ির যে রাগ, তা এসে পড়ল ইক্রা-র ওপর।
- “সুযোগ পেলেই খালা আমার ওপর অত্যাচার করত। আমি ভেঙে না পড়া অব্দি আমাকে গালাগাল করে যেত। ওনার মেয়ের ওপর যে রাগ সেটা উনি আমার ওপর দেখাতেন।”
বলছে ইক্রা।
একদিন ইক্রা-র স্বামী ওকে নিজের মা-বাবার ঘরে ফিরে যেতে বলে। ইক্রা বলছে, “ও আমাকে বলেছিল যে ওর মা একটু শান্ত হলে ও আমাকে এসে নিয়ে যাবে।”
এর কিছুদিনের মধ্যে ইক্রা বুঝতে পারে যে ও অন্তঃসত্ত্বা। ও নিজের স্বামীকে ফোন করে এই ‘সুসংবাদ’ দেওয়ার জন্য। ছেলেটির গলা শুনেও মনে হয় যে সে খুশি হয়েছে। ইক্রা-র স্বামী ও শাশুড়ি ওকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় যিনি ওকে একটি ওষুধ দেন এবং বলেন যে যেহেতু ইক্রা-র এখন স্বামীর সাথে সঙ্গম থেকে বিরত থাকা উচিৎ তাই ও ওর মা-বাবার কাছেই থাকতে পারে।
এর কয়েক সপ্তাহ পরে ইক্রা-র গর্ভপাত ঘটে।
- “আমি জানি না এতে ওনাদের কোনো হাত ছিল কিনা, কিন্তু আমার স্বামী আর আমাকে নিতে আসেনি। ও আমার ফোন তোলা আর মেসেজের উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দেয়।”
জানাচ্ছে ইক্রা।
যখন ইক্রা তার গর্ভপাত এবং স্বামীর বিশ্বাসঘাতকার আঘাত সামলানোর চেষ্টা করছিল, তখন তার পাশে এসে দাঁড়ান দু’জন বোর্খা-পরিহিতা মহিলা। জয়পুরের ব্যস্ত এলাকা জোহ্রি বাজারে তাঁদের দপ্তরে বসেই ইক্রা শুনিয়েছে তার এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কাহিনি।
এই দুই মহিলা, আজ যাঁরা এখানে রয়েছেন, তাঁরা হলেন রাজস্থানের প্রথম মহিলা কাজী - ৪৫ বছরের জাহান আরা এবং ৪৩ বছরের আফ্রোজ বেগম। এঁরা সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ের বিচারক এবং পারিবারিক সমস্যায় মধ্যস্থতা করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন।
জাহান আরা বলছেন, “আমাদের কাছে আসার আগেই ও পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ নথিভুক্ত করেছিল। তাই আমরা পরিবারের ভেতরে কোনো মধ্যস্থতা করতে পারিনি। নইলে আমরা ওর স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে ডেকে পাঠিয়ে বলতাম যে বাড়ির বউ-এর সাথে এরকম আচরণ করা যায় না।”
মুসলমান, মহিলা, কাজী
কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতে শুধুমাত্র পুরুষরাই কাজী হতেন। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, মুসলমান সমাজের ভেতরেই বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজকর্মীরা কাজী হিসেবে মহিলাদের নিযুক্ত হওয়ার প্রশ্নকে সামনে এনেছেন। পুরুষতন্ত্র এবং গোঁড়ামির প্রাচীরে ধাক্কা দিয়ে কিছু মহিলা বিগত কয়েক বছরে এই কাজ করতে এগিয়েও এসেছেন।
‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’(বিএমএমএ) নামের একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে স্থাপিত মুম্বই-এর দারুল উলুম-ই-নিসওয়ান নামক প্রতিষ্ঠান থেকে দু’বছর শিক্ষানবিশীর পর জাহান আরা এবং আফ্রোজ বেগম তাঁদের ‘কাজিয়ৎ’ সার্টিফিকেট পেয়েছেন। এই দু’জনের সাথে এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন আরো ১৩ জন মহিলা, যাঁরা এখন মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, তামিল নাডু, কর্ণাটক, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, এবং উড়িষ্যায় কাজী হিসেবে নিযুক্ত।
জোহ্রি বাজারে বিএমএমএ-এর দপ্তরটি দশ বছর আগে তৈরি করেছিলেন সংগঠনের রাজস্থানের কনভেনর নিশাত হুসেন। দপ্তরে প্রায় রোজই ইক্রা-র মত মেয়েদের দেখা পান এই মহিলা কাজীরা। ইক্রা-র মতই তারাও উপদেশ চায়। চায় সুবিচার।
- “আমরা নিজেরাই ছোটবেলা থেকে মহিলাদের অত্যাচারিত হতে দেখেছি। আমার বাবা আমার মা’কে মারতেন, ... “মা’কে সাহায্য করার মত কেউ ছিল না। পুরুষ কাজীরা, মুসলমান সমাজে বিচারক হিসেবে যাঁদের কাজ উপদেশ দেওয়া এবং সাহায্য করা, আখেরে তাঁরা সবসময় পুরুষদেরই পক্ষ নিতেন। ওঁরা বলতেন, ‘এটা আল্লার ইচ্ছা’। না, এটা আল্লার ইচ্ছা নয়। এবং আমাদের সমাজের মেয়েদের এটা আমরা জানাব যে কোরানে পুরুষ এবং নারীকে অসাম্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়নি।”
বললেন জাহান আরা।
জাহান আরা বড় হয়েছেন জয়পুরে। তিনি নিজে তাঁর দাম্পত্য জীবনে ধারাবাহিক ভাবে অত্যাচারিত হওয়ার পর দশ বছর আগে তাঁর স্বামীকে ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানাচ্ছেন, ডিভোর্সের পর তাঁর স্বামী তাঁকে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে দিতেন না, তাঁকে খোরপোষ দিতেন না, এবং বিয়ে ভেঙে গেলে মুসলমান সমাজের প্রথা অনুযায়ী যে পনেরো গ্রাম সোনা স্বামীর থেকে তাঁর পাওয়ার কথা, সেটাও তাঁকে দিতে অস্বীকার করেন। জাহান আরা জানালেন, “স্থানীয় কাজী আমার অধিকারের প্রশ্নে আমাকে কোনরকম সাহায্য করেননি।”
জাহান আরা জানতেন যে তাঁকে নিজেকেই নিজের অবস্থা বদলাতে হবে। নারীর অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনে তিনি কাজ করতে আরম্ভ করেন এবং তাঁর এলাকায় বাচ্চাদের জন্য একটি মাদ্রাসা শুরু অরেন।
- “আমি ভাবতে শুরু করলাম, কোনটা ঠিক ইসলাম? যেটা কোরানের শিক্ষা, নাকি আমরা যা দৈনন্দিন জীবনে পালন করি?”
বলছেন জাহান আরা। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার তাগিদেই তিনি কাজী হওয়ার কোর্সে ভর্তি হন।
জাহান আরা এবং আফ্রোজ বেগম পুরুষ কাজী এবং মুসলমান সমাজের অন্যান্য মানুষের থেকে বহু প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। তবে সম্প্রতি কিছু পরিবর্তন ঘটছে।
- “কয়েক দিন আগে একজন কাজী এসে জাহান আরা-কে তাঁর কাজের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। এটাও প্রগতি। আস্তে আস্তে সমাজ এটা মেনে নেবে যে মহিলারাও ক্ষমতাশালী হতে পারেন,”
বললেন নিশাত হুসেন।
পুরুষরা যখন মেয়েদের ভয় পায়
“কাজীদের ভূমিকা হল বিয়েতে, ডিভোর্সে, আর অবিচারের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতায়। পুরুষ কাজীদের একধরণের দৃষ্টিভঙ্গী আছে – তাঁরা আমাদের বিশ্বাস করাতে চান যে স্বামীদের বেশি অধিকার আছে। কিন্তু কোরানে তো তা বলা নেই। মহিলারা কাজী হলে এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটবে।”
এমনটাই মনে করেন বিএমএমএ-র এক প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য জাকিয়া সোমান। তাঁর মতে, তিন তালাক প্রথার ফলে বহু মুসলিম মহিলার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। জাকিয়ার মতে, এই প্রথা অসাংবিধানিক এবং কোরান দ্বারাও স্বীকৃত নয়। “বছরের পর বছর ধরে আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা আর আমাদের মেনে নেওয়ার দরকার নেই,” সাফ কথা জাকিয়া-র।
কাজী আফ্রোজ বেগমেরও এক কথা। ৪৩ বছরের এই মানুষটির পাশে আছে তাঁর পরিবার – তাঁর স্বামী এবং পাঁচ ছেলে; তবু, তিনি মনে করেন রাজস্থানে মহিলাদের কাজী হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার রাস্তা এখনও বন্ধুর। তাঁর মতে, পুরুষ কাজীরা তাঁদের কাজকে ‘দোকানদারি’ বা ব্যবসা হিসেবে দেখে, কিন্তু মহিলা কাজী হিসেবে তাঁরা মুসলমান সমাজের নিজস্ব আইনের উপেক্ষিত দিকগুলির প্রতি বিশেষ নজর দেবেন।
নিকাহ্’র এক মাস আগে মহিলা কাজীদের নোটিশ দিতে হবে। তাঁরা সমস্ত কাগজপত্র – বর-কনে’র যোগ্যতা, আয়ের প্রমাণ, মেডিকাল রিপোর্ট, এবং ডিভোর্স সার্টিফিকেট(যেখানে প্রযোজ্য) দেখে, তার পরেই বিয়েতে সম্মতি দেবেন। কাজী আফ্রোজ বলছেন, “মহিলারা তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হলে তাঁরা অধিকার দাবী করবেন কী ভাবে?”
আফ্রোজ যখন বোঝাচ্ছেন তাঁরা কী ভাবে পরিবর্তন আনার কথা ভাবছেন, সেই সময়েই জাহান আরা’র একটি ফোন আসে। “আপ কাল তশ্রিফ লায়েঙ্গে?” (আপনি কি কাল আসবেন?), কিছুটা রূঢ় ভাবেই জিজ্ঞেস করেন জাহান আরা।
ফোন করেছেন এক পুরুষ যাঁকে এঁরা কিছুদিন আগে নোটিশ পাঠিয়েছেন। এই ভদ্রলোকের স্ত্রী মহিলা কাজীদের কাছে এসে স্বামীর মদ খাওয়া নিয়ে নালিশ করেন। তিনি জানান যে বেশির ভাগ রাতে তাঁর স্বামী বাড়ি ফেরেন না। ওনার সন্দেহ যে তাঁর স্বামী অনেকগুলি সম্পর্কে জড়িত। “আমরা ওকে একটা নোটিশ পাঠিয়েছিলাম। এখন ও ভয় পেয়েছে,” বলছেন জাহান আরা।
এপ্রিল মাসে সার্টিফিকেট পাওয়ার পর থেকে জাহান আরা এবং আফ্রোজ বেগম প্রায় ৬০টি কেসের সমাধান করেছেন। এর মধ্যে ২৫টি কেস তিন তালাক সংক্রান্ত।
জয়পুরে স্থানীয় এক সাংবাদিক, ২৯ বছরের দুর্দানা খান বললেন, এই দুই মহিলার থেকে ধারাবাহিক ভাবে সমর্থন পাওয়ার ফলে তিনি এখন আর কাউকে ভয় পান না। ২০০৮ সালে যোধপুরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয় দুর্দানার। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে তাঁর শ্বশুর তাঁর সাথে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করতে আরম্ভ করেন। দুর্দানা বলছেন, “উনি আমার গায়ে হাত দিতেন আর আমাকে ওনার ঘরে যেতে বলতেন।” দুর্দানা যখন স্বামীর কাছে অভিযোগ করেন তখন তাঁর স্বামী বলেন, “নিজে বুঝে নাও। আমাদের পরিবারে এরকম হয়।” দুর্দানা আকাশ থেকে পড়েন। তিনি অনেকবার পালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রত্যেক বার তাঁর স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে খুঁজে বের করে এবং শারীরিক নির্যাতন করে। ২০১২ সালে তাঁর স্বামী তাঁকে তালাক (ডিভোর্স) দিতে রাজি হন।
- “আল্লা কখনো চাননি যে আমরা মহিলারা বঞ্চনার মধ্যে দিন কাটাই। আল্লার চোখে মহিলা ও পুরুষ সমান। তাহলে কেন আমাদের পুরুষের পায়ের তলায় থাকতে হবে?”
এই প্রশ্ন দুর্দানার। ডিভোর্সের পরও দুর্দানার সমস্যা শেষ হয়নি। যখন তিনি জয়পুরে এসে তাঁর মা-বাবা’র সাথে থাকতে শুরু করেন, তাঁর ভাইরা সম্পত্তির অংশ হারানোর ভয়ে তাঁর এবং তাঁদের বাবা’র ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে। জাহান আরা এবং আফরোজ বেগম দুর্দানার পরিবারের সাথে কথা ব’লে এই সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেছেন।
“একজন পুরুষ কাজী অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষ সদস্যকেই সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেন। আমরা তা পাল্টানোর চেষ্টা করছি,” বললেন তিনি।
মহিলা কাজীরা ১৫-২০ জন মহিলাকে নিয়ে একটি দল তৈরি করেছেন যেটি জয়পুর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কাজ করে। “একেকজন নেত্রী একেকটি অঞ্চলের দায়িত্বে আছেন। কোনও নির্যাতনের ঘটনার কথা জানতে পারলে তাঁরা আমাদের খবর দেন। আমরা নির্যাতিতার সঙ্গে যোগাযোগ ক’রে তাকে সাহায্য করি,” জানাচ্ছেন তিনি।
প্রথম নিকাহ্-এর অপেক্ষায়
সম্পত্তি আর বিয়ে সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করা এই কাজের সহজতর অংশ। বিয়ে দেওয়া হল কঠিন। এপ্রিল মাসে সার্টিফিকেট পাওয়ার পর থেকে এখন অব্দি কেউ তাঁদের কাছে আসেনি।
৬১ বছরের সাফিয়া আখতার ভোপালের একমাত্র মহিলা কাজী। তিনি জাহান আরা এবং আফ্রোজ বেগমের সাথে পাশ করেছেন। সাফিয়ার মতে কেউ তাঁদের কাছে আসেনা কারণ পুরুষরা এখনো মনে করে যে মেয়েদের পর্দার আড়ালেই থাকা উচিৎ। ফলত, মসজিদে গিয়ে বিয়ে দেওয়া তাদের একেবারেই উচিৎ নয়। “মুসলিম বিয়ে পুরুষ-শাসিত। আমরা সার্টিফিকেট পাওয়ার পর ওরা আমাদের জিজ্ঞেস করেছে কী করে আমরা ঘর ভর্তি পুরুষের মধ্যে গিয়ে বিয়ের প্রক্রিয়া পরিচালনা করব।”
সাফিয়া বললেন তিনি পুরুষদের থেকে অনবরত খুনের হুমকি পান। “আমাকে একজন এ-ও বলেছে যে কাজী হওয়ার কারণে আমি ইসলাম থেকে বিতাড়িত হব,” বললেন সাফিয়া। কিন্তু ৬১ বছর বয়সী এই মহিলা ভীত নন। “ওরা চায় আমি চুপ করে যাই। কিন্তু আমি চুপ করব না। যদি ওরা আমাকে ভুল প্রমাণ করতে পারে, আমি নিজেই ইসলাম ছেড়ে চলে যাব,” সাফিয়া জানালেন।
৩২ বছরের নাসরীন সম্প্রতি কর্ণাটকের প্রথম মহিলা কাজী হয়েছেন। তিনি বলছেন যে মূলত মেয়েরাই তাঁর কাছে সমস্যা নিয়ে আসে।
- “অনেকেই এটা মেনে নিতে চান না যে আমি কাজী। তাঁরা আমাকে সারাক্ষণ জিজ্ঞেস করেন যে একজন মেয়ে কী করে কাজী হতে পারে। আমি তাদের বলি, ‘তোমরা কি কোরান পড়েছ?’”
নাসরীনের মতে, একমাত্র একজন মহিলা কাজীই বুঝতে পারেন সমাজে মেয়েরা কীভাবে বিভেদের শিকার হয়। “পুরুষরা যে সাধারণত আমাদের কাছে আসে না সেটাই তাদের মানসিকতার পরিচয়,” বলছেন ৩৫ বছরের আসলাম বানু, যিনি উড়িষ্যার মহিলা কাজী।
এদেশে যখন প্রথম পনেরো জন মহিলা কাজীর খবর ছড়িয়ে পড়ল, সেই সময় সারা ভারত মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড (এআইএমপিএলবি) এই বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। তারা বলেছিল যে ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মহিলারা কাজী হতে পারেন না এবং তাঁদের এই পদে নিয়োগ করা সম্ভব নয়। ভারতের আইন কমিশনের (যেটি মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর ভিত্তিতে বিচারের বিষয়টি দেখে) প্রাক্তন সদস্য তাহির মাহ্মুদ এআইএমপিএলবি-র এই মতকে সমর্থন করেননি। সমর্থন জানায়নি দারুল উলুম দেওবন্দ – উত্তর প্রদেশের দেওবন্দের প্রভাবশালী ইস্লামিক প্রতিষ্ঠান।
ইসলামবিরোধী?
রাজস্থানের প্রধান কাজী খালিদ উসমানির মতে মহিলা কাজীরা ইসলামবিরোধী। “আমি যদি আপনাকে বলি আমি ভগবান রাম, আপনি কি বিশ্বাস করবেন?” উনি জিজ্ঞেস করলেন। উসমানি বলছেন যে মহিলা কাজীরা কোরান এবং মুসলমান আইন বিষয়ে কিছু জানে না। “মহিলারা কী করে কাজী হবে? এসব ওদের করার কথা নয়। সমাজে ওদের বিশেষ ভূমিকা আছে। ওদের উচিৎ পুরুষদের নিজেদের কাজ করতে দেওয়া,” বলছেন উসমানি। উনি এও বলছেন যে মানুষ এই সমস্ত মহিলাদের কাজী হিসেবে ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছে। “ওরা মসজিদে যেতে পারবে না। ধর্মে বারণ রয়েছে। ওরা মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। আর সেই কারণেই কেউ ওদের কাছে যায় না,” উসমানি বললেন।
উসমানি আর যাই বলুন, এই শেষ কথাটায় উনি একেবারেই ভুল। মানুষ মহিলা কাজীদের কাছে যায়। আরা এবং আফ্রোজের জয়পুরের দপ্তর একদিনও ফাঁকা থাকে না। মহিলারা আসেন বধূ নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে, অনেকে আসেন সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে, অনেক মহিলা আসেন যাঁদের স্বামীরা তিন তালাক উচ্চারণ করে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। অনেক মহিলা আসেন যাঁরা শুধু ওখানে বসে শুনতে চান, শিখতে চান কীভাবে স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর নিজের দু’পায়ে দাঁড়াবেন। প্রধান কাজীর বক্তব্য সর্বজনগৃহীত নয়। আখতারুল ওয়াসি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া-তে ইসলামিক স্টাডিজ-এর শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি যোধপুরের মৌলানা আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। তাঁর মতে, কোরানে কোথাও বলা নেই যে মহিলারা কাজী হতে পারবেন না। “আমাদের ধর্মগ্রন্থ মহিলা ও পুরুষের মধ্যে বিভেদ করে না। যিনি বলছেন যে মহিলাদের কাজী হওয়া ইসলামবিরোধী, তিনি ভুল বলছেন,” জানালেন ওয়াসি।
আখতারুল ওয়াসি বলছেন যে নবী মহম্মদের স্ত্রী আয়েশার কাছেও মানুষ পরামর্শ ও সাহায্য নিতে যেত। “এমন কি, শারিয়া আইনের এক তৃতীয়াংশের কৃতিত্ব আমরা আয়শাকেই দিই। যদি আয়েশা পেরে থাকেন, তাহলে মহিলারা কেন কাজী হতে পারবেন না? উসমানি সাব-এর কাছে আমার এটাই প্রশ্ন।”
ওনার মতে, যদি মহিলারা শিক্ষিত হন, যদি ইসলামের আইন এবং সংবিধান সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে তাঁদের কাজী হওয়ার পথে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। “বিয়ের কথা বাদ দিন,” বলছেন ওয়াসি, “আরো অনেক ব্যাপারে কাজীদের ভূমিকা থাকে, এবং এই সমস্ত কাজই মহিলাদের পক্ষে করা সম্ভব।”
কাজী আফ্রোজ বলছেন, “একদিন মহিলারা মুফ্তিও হবে। কোরান পড়াবে। আমরা জানি এখনো অনেক পথ বাকি।”
Link: https://ebongalap.org/first-women-qazis-in-india