28-05-2024 01:35:08 am
Link: https://ebongalap.org/foremothers-5
জলের কলসিগুলো রাখা থাকে একটা লাল সিমেন্টের তৈরি পিঁড়ির মত বেদীর ওপর। সেই দুটো পাশাপাশি বসানো কলসির মাঝখানের ফাঁকটার সমান সে উঁচু। ওখানে তাকে এমন ঠিকঠাক এঁটে যায় যে কেউ চট করে খেয়াল করতেই পারে না যে ছোট মেয়েটা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভর দুপুরে ওইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখছে সামনে খাবার বারান্দা — আসলে সেটা তিনদিকে ঢাকা একটা ঘরই, কেবল সবাই বলে বারান্দা। সেইখানে মাটিতে পিঁড়ি পেতে জেঠিমাকে ভাত বেড়ে দিয়েছেন মা। থালা সামনে কিন্তু জেঠিমা খাচ্ছেন না। চুপ করে বসে আছেন, মুখোমুখি মা। মায়ের পিঠ তার দিকে বলে মা তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। সে খেয়াল করে জেঠিমার থালার পাশে মেঝের ওপর ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে টুপ টুপ করে। একটুখানির মধ্যেই বুঝতে পারে ওগুলো জেঠিমার চোখের জল। জেঠিমা কাঁদছেন। বড়দের কখনো কাঁদতে দেখেনি তার আগে। ভয় করে, কীরকম যেন মনে হয় তার এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়, কিন্তু চলে যেতেও পারে না। মা কী যেন বলছেন আস্তে আস্তে। জেঠিমা সবুজপাড় সাদা শাড়ির আঁচল তুলে চোখ মুছছেন।
চার-পাঁচ বছর বয়সে দেখা এই ছবিটা মনের মধ্যে গাঁথা রয়ে গেল আজীবন। সারাজীবনে ওই একজনকেই জেঠিমা বলেছি। আমার বাবা পরিবারে সবচেয়ে বড় তাই বাকি সক্কলে আমার কাকা। জেঠিমার স্বামী শ্রী শ্রীনিবাস ভট্টাচার্য ঠিক আমাদের পরিবারের সদস্য ছিলেন না। বস্তুতপক্ষে তিনি তাঁর নিজের পরিবারেরও যথেষ্ট সদস্য ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে সংশয় হতে পরে। তাঁকে আমাদের বাড়ির, কিংবা হয়ত পরিচিত সব বাড়িরই সকলে বলতেন ‘মাস্টারমশাই’। তৎকালীন কাশীর নামকরা বিদ্বান ছিলেন তিনি। চল্লিশের দশকে ইতিহাসে ডক্টরেট করা গবেষক। জেঠিমা কোনো প্রাচীন সংস্কৃত বিদ্বান পরিবারের কন্যা। বাড়ি থেকে কখনো বাইরে যান নি। কাশীতে তখন এরকম মহিলা অনেক ছিলেন যাঁরা ঘরের বাইরে যেতেন কেবল কোনো ঘনিষ্ঠ পরিবারের বাড়ি, তাও সবসময়ে নয়।
জ্যেঠিমার সন্তানসংখ্যা ছিল ছয়। পাঁচটি কন্যার পর এক পুত্র। তাঁর স্বামী সুখ্যাত পন্ডিত কিন্তু বিদ্যা বিক্রি করায় বিশ্বাস করতেন না। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পেয়েও করেন নি সেই কারণে। কোথাও শিক্ষা দিয়ে পয়সা উপার্জন করাকে হীন কাজ বলে মনে করতেন। মাঝে মাঝে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। একমাস, এমন কি তিনমাস পরেও ফিরেছেন এমন ঘটত। গরুর গাড়িতে চাপিয়ে প্রচুর দামী চাল, ঘি, গুড়, ধুতি ইত্যাদি মূল্যবান উপহার বা ‘সিধা’ নিয়ে আসতেন এক একবার। কোনো সম্ভ্রান্ত ধনীগৃহে থেকে তাদের বিদ্যাদান করেছেন হয়ত। মাঝখানের দিনগুলিতে জেঠিমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে অর্ধাশন থেকে রক্ষা পেতেন আমাদের পরিবারটির স্নেহের আশ্রয়ে। আমরা ছোটরা জেঠিমা ও তাঁর ছোট চার ছেলেমেয়েকে আমাদের বাড়ির লোক বলেই জানতাম। তারা কখনো দুজন, কখনো তিনজন আমাদের সঙ্গেই থাকত। বড় দিদিরা আমাদের বাড়ি অথবা কারো বাড়িই প্রায় যেতেন না। যাবার কোনো অবস্থাও থাকত না। বড় দুই কন্যা আর তাদের মা একটা সায়া ভাগাভাগি ক’রে পরে দিন কাটাচ্ছেন, এমনও ঘটেছে। স্বামী বাড়ি ফিরে এসব তুচ্ছ কথা শুনতে পছন্দ করতেন না। ‘এইতো অত জিনিস দিয়ে গেলাম, গুছিয়ে চললে তো অভাব হবার কথা নয়!’ এরকমই ছিল তাঁর বক্তব্য।
আমাদের পরিবার কোনোমতেই ধনী তো দূরস্থান, খুব সচ্ছলও ছিল না — আমার বাবা একমাত্র উপার্জনকারী, কাকা-পিসিরা প্রায় সকলেই ছাত্রাবস্থায়। ঠাকুমা, আমাদের মা, আমরা ভাইবোনেরা, আরো দু-চারজন যাঁরা রক্তসম্পর্কে আত্মীয় নন কিন্তু অতি অবশ্যই স্বজন। তখন এরকম বহু পরিবার ছিল। অনেক পরিবারের মতই আমাদের সেই পরিবারেও মা-ঠাকুমার নিয়ম ছিল দুপুরে কেউ এলে ভাত না-খেয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠবে না। সাধারণ যা রান্না হবে, তাই খেয়ে যাবে। ঠাকুমা বলতেন, মানুষ কি আবার কোনোদিন বেশি হয়! ফলে তার মধ্যেই আরো দু-তিনজন কুলিয়েই যেত। মায়েদের নিশ্চয়ই বাস্তব অসুবিধে হত।
সেই প্রসঙ্গেই ঠাকুমার বলা একটা গল্পের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে, সেটা এরকম —
“অনেককাল আগে এক গেরস্তঘরে দুই বৌ ছিল। তাদের ছিল বড় ভরভরন্তি সংসার। আসো জন বস’ জন। এবার হয়েছে কী, সকলকে খাইয়ে মাখিয়ে শেষবেলায় দুই বৌ যখন নিজেদের ভাতের থালা নিয়ে বসে, তখনই কোনো-না-কোনো অতিথজন এসে পড়ে। নিজেদের ভাতটুকু তাকে ধরে দিয়ে দুই বৌ কেবল একঘটি করে জল খায়। রোজ এমন চলতে চলতে একদিন শেষে দু-জনের মনে বড় দুঃখ হল যে রোজ রাঁধি রোজ বাড়ি আর রোজ শুধু জল খেয়ে থাকি! ‘আহা’ বলতেও কেউ নেই! মনের দুঃখে দুইজনে ভাতের হাঁড়িটি মাথায় নিয়ে পুকুরে গিয়ে ডুবে মরেছে। দুঃখ নিয়ে মরেছে বলে ভগবান তাদের পাখি বানিয়ে দিলেন যে ‘যেখানে খুশি যাও, যেমন খুশি কর’। হলুদবর্ণ গায়ের রঙ হল তাদের আর ওই যে কালোচুলের ওপরে পোড়া ভাতের হাঁড়ি মাথায় নিয়েছিল, তাই ওদের মাথায় আর পিঠে কালো কালো পালক। ওদের নাম ইষ্টিকুটুম পাখি। সবসময়ে দুইজনা একসঙ্গে থাকে। যেই গেরস্তের বাড়ি অতিথ আসবার থাকে তাদের বাড়ির বৌকে বলে দিয়ে আসে ‘ই-ষ্টি কুটুম’ ‘ই-ষ্টি কুটুম’, যেন দুটি চাল বেশি নেয়।”
ভাবি, অতিথিকে অবশ্যই খাইয়ে দেওয়া আর এই গল্প — দুটোই মেয়েদের দান। নিজেদের অবস্থানের মধ্যেই এই সাবভার্শান-এর কৌতুক?
চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে, দুবেলা খাবার জোটা থেকেও যখন তীব্র হয়ে উঠেছে দুটি মেয়ের আব্রুর সংকট, মা একদিন জেঠিমাকে সঙ্গে নিয়ে ভর্তি করে এলেন বেনারসের উপান্তে সরকারি নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে সামান্য কিছু যোগাযোগ ছিল। তখনও সেইসব জায়গায় ভর্তি হবার সুযোগ পেতেন কেবল বিধবারা। সেই সারাজীবন বাড়ির গন্ডীতে, প্রথা মেনে থাকা কারো-মুখের-দিকে-তাকিয়ে-কথা-বলতে-না-পারা মহিলা সিঁদুর মুছে সাদা কাপড় পরে ভর্তি হয়ে এলেন। কেবল ‘বাড়িতে ছেলে খুব ছোট, একা থাকতে পারবে না’ বলে প্রতিদিন ছয়-ছয় বারো মাইল হেঁটে যাতায়াত করতেন, ছেলেমেয়েদের কাছে রাত্রিটুকু থাকার জন্য। গম ফুটিয়ে, চাল ফুটিয়ে যাহোক কিছু তাদের মুখে ধরে দেবার জন্য।
সেরকমই একটি তাড়াতাড়ি ছুটি পাওয়ার দুপুরে জেঠিমাকে আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম। অনেকদিন পর, সাহস করে মাকে জিগ্যেস করার মত যখন বড় হয়েছি, তখন মা বলেছিলেন, ‘আমি তো এখানে খেতে বসেছি, বাড়িতে ওরা তো ভাত খায়নি’ —এই ভাবনা ছিল সেই মেঝেতে পড়া ফোঁটা ক’টির উৎস। বাড়ি গিয়ে রাঁধতেও তো সময় লাগবে।
বন্ধুজনদের চেষ্টায়, সহায়তায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল জেঠিমার বড় তিন মেয়ের। ছোট দুই মেয়ে আর ছেলে পড়াশোনা করেছিল প্রয়োজন মত। অনেক পরে মেট্রন নার্স হয়েছিলেন জেঠিমা। তখন আমরা বেনারস ছেড়ে এসেছি কিন্তু ওদের সঙ্গে বাড়ির যোগাযোগ রয়েই যায়। ছেলে ডাক্তার হয়ে মাকে যত্ন করে কাছে রেখেছিল। সেইটুকু স্বস্তি নিয়ে মারা যান জেঠিমা।
Link: https://ebongalap.org/foremothers-5