03-03-2024 16:02:13 pm
Link: https://ebongalap.org/gender-and-masculinity-2
আজকাল হাতে অনেক সময় থাকে সমীরের। মনীষার মৃত্যুর পর তার অবসরপ্রাপ্ত জীবনে বিশেষ কিছু করারও যেন থাকে না। সারা দিনটা মোটামুটি যদি বা কেটে যায়, সমস্যাটা হয় সন্ধ্যের দিকটায়। এগারোটার আগে ঘুম আসে না। নটার সময় খাবার গরম করে খেয়ে নেয়। তাতে আর কতটা সময় যায়। সাতটা থেকে এই লম্বা সময়টা কাটানোর কোনও স্ট্র্যাটেজি সে তৈরি করতে পারেনি। বই তো সারাদিনই পড়ে। সন্ধ্যের দিকে চোখটা ঝামেলা শুরু করে। ডাক্তার বলেছেন, ছানিটা আরও পাকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। চোখের জল শুকিয়ে যায় বলে মাঝে মাঝেই একটা ড্রপ নিতে হয়, সেও এক যন্ত্রণা। টেলিভিসনের নিউজে নেতাগুলোকে আর রোজ কথা বলতে আসা লোকগুলোকে দেখলে যেন আরও খারাপ লাগতে থাকে। তবে প্রতি বছরই এপ্রিল-মে মাসটা ভালো কাটে সমীরের, আইপিএল থাকে।এবার আবার তার পরপরই চ্যাম্পিয়নস লিগটাও ছিল, অনেকগুলো দিন সন্ধ্যেবেলাটার ভার তাকে আর নিতে হয়নি। টেলিভিসন খুলে বসলেই কেটে গিয়েছে, দুটো ইনিংসের ফাঁকে খাবার গরম করে নিলেই হল।
এবারে কী যে হয়েছিল তার, খেলার চেয়েও বেশি খুঁজেছে একটা বিজ্ঞাপন। বারবার দেখিয়েছে ওরা কিন্তু আবার আবার দেখতে ইচ্ছে করেছে। সম্ভবত, একেই বলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি, কে জানে। বিজ্ঞাপনটা আমাজন প্রাইম নেটওয়র্কের। কয়েকটা বিজ্ঞাপনের একটা সিরিজ, কিন্তু তার মধ্যে একটাই ওর বেশি পছন্দ। গল্পটা এই: এক অল্পবয়সি দম্পতি, গোটা সিরিজেই বরটা একটু নরম সরম, বৌটা দাপুটে। বরটা মাঝে মাঝে দাপট দেখাবার চেষ্টা করে কিন্তু ঠিক সুবিধে করতে পারে না। এই গল্পটায় দেখায় যে বৌ সোফায় বসে পায়ে নেলপলিশ লাগাচ্ছে। বর ল্যাপটপ নিয়ে এসে বেশ মৌজ করে সোফায় বসে বলছে, শো দেখব কিন্তু তুমি কী আমাজন প্রাইমের পাসওয়র্ডটা বদলে দিয়েছ? নতুন পাসওয়র্ডটা বলো। (পাসওয়র্ড বদলানোটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, সিকিউরিটির জন্য সবাই মাঝেমাঝেই বদলায়, তাই বরের মনে অন্য কোনও সন্দেহ দেখা দেয়নি।) কিন্তু বৌটি খুব সহজ ভাবে বলে, এক সপ্তাহ হয়ে গেল তুমি বারবার বলা সত্বেও বাল্ব বদলাওনি, তাই আমি পাসওয়র্ডটা বদলে দিয়েছি। বাল্ব না বদলালে পাসওয়র্ড বলব না। বরও খানিকটা ছদ্ম মেজাজ দেখিয়ে উঠে যেতে যেতে বলে, ভারি বয়েই গেল, আমি অন্য কোথাও দেখে নেবো। হাওয়ায় চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার মত করে একটা চুমুও ছুঁড়ে দেয় সে। বৌ বলে, সেটা পারবে না, এটা এক্সক্লুসিভ। অতএব বেচারা বরটি গুটিগুটি ফিরে আসে, মিউ মিউ করে জানতে চায় কোন বাল্বটা বদলাতে হবে, বৌ বাল্বটি দেখিয়ে দেয়, আর এবার সেও পাল্টা চ্যালেঞ্জ জেতার চুমু ছুড়ে দেয়, বলে বাজার থেকে চুড়িওয়ালা বাল্ব আনো, (তার মানে সম্ভবত প্যাঁচওয়ালা সিএফএল বাল্ব)। এর পরে আসে আমাজন প্রাইমের প্রডাক্ট উইন্ডো। আর তারপরে আমরা দেখি বৌটি বসে নেলপলিশ লাগিয়ে চলেছে, বরটি (বাল্ব পালটে অবশ্যই) ফিরে আসে, আয়েস করে আবার বসে বলে, এবার পাসওয়র্ডটা বলো দেখি। বৌটি বলে পিঙ্ক। বর সম্ভবত এতো সহজ পাসওয়র্ড শুনে একটু অবাক হয়ে বলে, পিঙ্ক? কিন্তু সেটাই মেনে নিয়ে সে টাইপ করতে যায়। বৌটি তার কোলে পা তুলে দিয়ে পিঙ্ক রঙের নেলপলিশের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে, লাগিয়ে দাও।
কেন যে এই শেষ বয়সে এসে হঠাৎ এই গল্পটা এত ভালো লেগে গেল সমীরের, তা নিয়ে সে অনেক ভেবেছে। এক বন্ধুর বাড়ি বসে টিভিতে একটা আইপিএলের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল একদিন। সেই বন্ধুর খুবই সফল বিয়ে। বৌ বর্তমান, সুখীসংসার। সে এই বিজ্ঞাপনটা দেখে বলেছিল, বৌটা একটু বাড়াবাড়ি করছে। সমীর কিছু বলেনি, কিন্তু তার মনে হয়েছে সেই বাড়াবাড়িটাই তার নিজের জীবনে প্রশ্রয় পায়নি বলেই কী একটা ফাঁক, একটা ফাঁকি থেকে গিয়েছিল, যা আজ ‘না পাওয়ার রঙ’ হয়ে উঠেছে। কী রকম মনে হতে থাকে এই রকম ভাবে হারেনি সে কখনও, আর তাই হারিয়েছে অনেক কিছুই।
মনীষাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল সমীর, সম্পর্ক নিয়ে কোনও অভিযোগের কারণ তার দিক থেকে তো ঘটেইনি, মনীষার দিক থেকেও ঘটেছিল বলে সে শোনেনি। বরং শেষ ক’বছর বিছানায় শুয়ে থাকা মনীষা যেন স্বামীর সেবা নেওয়ার পাপ বোধে বড্ড বেশিই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকতো। সব কিছুই তো ছিল তাদের, ভালোবাসা, অনেক দিনই যৌনতা, আজীবন মায়া। এখনও তো মনে পড়ে সেই হানিমুনে চাঁদিপুর, তারপর ঋজুকে বরফ দেখাতে জানু্য়ারিতে সিমলা। কিন্তু কোনও দিন এই বিজ্ঞাপনের মেয়েটির মত অনায়াসে তার কোলে পা তুলে দিতে পারত মনীষা? বললে পরে বাল্ব সমীর বদলাতো তা নয়, কিন্তু বাল্ব না বদলালে পাসওয়র্ড বদলে দেওয়ার আস্পর্ধা হত মনীষার? বা মনীষার হলেও সেটা মেনে নিতে পারত সমীর? মনীষার এই আর্স্পধা হত না কেন? সমীর মেনে নিতে পারতো না বলে? পেন্ডুলামের মত ‘আস্পর্ধা’ কথাটা দুলতে থাকে সমীরের মাথায়। আচ্ছা মা কখনও ভাবতে পারতো, বাবার কোনও কথায়, ‘ভ্যাট, বাজে বোকো না তো’ বলবে? অসম্ভব! বাবার রাশভারি মুখটা মনে পড়ে হাসি পেল, সমীরের। বাবার কোনও কথার ওপর ‘ভ্যাট’ বলা কারওর পক্ষেই সম্ভব ছিল না, মায়ের তো নয়ই। বাবা যখন কাউকে বকতেন, একটা কথা বারবার ফিরে আসত, “এত বড় আস্পর্ধা তোমার?” মাকে সেভাবে বকতেন না কখনওই। দরকারই হত না?
এখন এই একা ঘরে বসে সমীরের কেমন মনে হয়, যদি মনীষার সঙ্গে তার সম্পর্কে আরেকটু আস্পর্ধার জায়গা থাকত হয়ও আরও অনেক স্বাদ আসতো এই জীবনে। সমীর অবশ্যই তার বাবার মত রাশভারি ছিল না। কিন্তু বাবাও হয়তো মনে করেননি কখনও যে তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সমানে সমানে কথা বলাটা কঠিন, কারণ কোথাও যেন হাওয়ায়, ‘সম্ভ্রম’, ‘সমীহ’, ‘সম্মান’ কথাগুলো ভাসতে থাকে। খেলার ছলেও তাঁকে হারানো যায় না কখনও, সেই খেলাটাই খেলা যায় না আসলে। সমীরকেও কী হারাবার কথা ভাবতে পারেনি মনীষা কখনও? কেন? কী ছিল? বা কী ছিল না তাদের সম্পর্কের ভেতরে?
স্কুল পাশ করে মফস্সল শহর ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে হোস্টেলে সীট না পেয়ে কিছু দিন টুটু বলে একটি ছেলের সঙ্গে একটা ঘর শেয়ারে ভাড়া করেছিল সমীর। টুটুর এক প্রেমিকা ছিল, সে মাঝে মাঝে রাতে এসে থাকত। তখন সমীরকে বাইরে থাকতে হত, মিলন শেষ হয়ে, জল-বাতাস জুড়িয়ে এলে, টুটু এসে ওকে ডেকে ভেতরে নিয়ে যেত। মেয়েটি তখন থাকত আগাগোড়া চাদরে ঢাকা। সমীর ঘরের আরেকপাশে শতরঞ্চি পেতে শুয়ে পড়ত। তখন দু একবার দেখেছে, সকালে উঠেই চাদর জড়ানো মেয়েটি টুটুকে প্রণাম করছে। তারপর সেই চাদর জড়িয়েই বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে চলে যাচ্ছে। মেয়েটির সঙ্গে সমীর কোনও দিন কথা বলেনি। কারণ তাকে দেখেও না দেখাটাই ছিল তার দায়িত্ব। তবুএকবার টুটুকে এই প্রণামের কারণ জিজ্ঞেস করায় টুটু বলেছিল, রাত্তিরে আদরের সময় মেয়েটির পা টুটুর গায়ে লেগে যায় বলে এই প্রথা মেয়েটি মানে। টুটু তাকে বলেনি কখনও এটা করতে, কিন্তু সে করবেই। তখন অবাক হলেও পরে বাংলা গল্পে পড়েছিল সমীর, কুলীনরা যখন নানা গাঁয়ে তাঁদের বৌদের কাছে পালা করে ঘুরে বেড়াতেন, তখনও মিলন রাতের শেষে এই কারণেই স্বামীকে প্রণাম করার প্রথা ছিল। সেই থেকেই কী এই মেয়েটি শিখেছিল এই প্রথা? সে তো বিয়ের আগেই যৌনতার জন্য, অনেকটা হয়তো ঝুঁকি নিয়েই টুটুর কাছে আসত। তবে? টুটুর সঙ্গে অনেক দিন পরে একবার সিনেমা হলে দেখা হয়েছিল সমীরের। টুটুর সঙ্গে তার বৌ ছিল, অন্য একটি মেয়ে। কেন যেন একটা কথাই মনে হয়েছিল ওর, বৌ কি টুটুকে প্রণাম করে? নিশ্চয় না।
সমীরের মনে পড়ে মা অনেক দিক থেকেই বাবাকে উঁচু আসনে বসিয়েছিলেন। সৎ চরিত্রের বাবা, শহরের নামী স্কুলের জাঁদরেল হেডমাস্টার, অবশ্যই সম্মানের যোগ্য ছিলেন, কিন্তু সেই সম্মান কী শুধুই বাবার না স্বামীর/পুরুষের? মা যেন মজা করেই একটা গল্প বলতেন, বাঙাল দেশের গ্রামে মেয়েদের পুকুরের আড্ডায় সহবত আলোচনার গল্প। কার কার সামনে ঘোমটা দিতেই হবে এই নিয়ে কথা উঠেছে, এক জন অল্পবয়সি বৌ বলেছে, পরিবারের বাকি সব পুরুষের সামনে ঘোমটা দিলেও হোয়ামীর (স্বামীর) সামনে দেওয়ার দরকার নেই, সে তো স্বামী। তাতে এক বয়স্কা বলে উঠছেন, তরা যে হোয়ামী, হোয়ামী করস, হোয়ামী বইল্যা কী সে পুরুষ না?
সব পাখি ঘরে ফেরার পর, সব নদী, সমীরের অসীম সন্ধ্যায় মনে হয়, পুরুষ হওয়ার মানে বয়ে না বেড়াতে হলে স্বামী হওয়ার আরও অনেক অন্য মানে বোধ হয় খুঁজে বেড়ানো যেত। কেমন হত যদি মনীষার শীর্ণ পা কোলে নিয়ে সে বলত, অ্যাই এসো নেলপলিশ লাগিয়ে দিই, পিঙ্ক! মনীষা কি পা সরিয়ে নিতে নিতে বলত, ‘ভ্যাট’!
দেওয়ালে আলতা লাগানো পায়ের ছাপটা বড় জ্বলন্ত লাগে, চোখ জ্বালা করে সমীরের।
Link: https://ebongalap.org/gender-and-masculinity-2