30-05-2024 11:56:49 am
Link: https://ebongalap.org/gender-in-schools
প্রশ্ন একই সঙ্গে সরল ও জটিল; সত্যিই তো, মেয়েদের স্কুল আর ছেলেদের স্কুল বলে আলাদা দুটো প্রতিষ্ঠান তৈরিই হয়েছে দুই দলকে আলাদা রাখার জন্য। সেই প্রাথমিক শর্তটাই বানচাল হয়ে যায় এদের স্কুলে ওরা ঢুকে পড়লে। এদের আর ওদের মিলতে দেওয়া হবে না বলেই তো এমনকী যেসব স্কুল কো-এডুকেশন বলে চলে তাতেও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের আলাদা সেকশন হয়, ছেলেদের আলাদা। কিম্বা এক সেকশনে সবাই পড়লেও বসার বেঞ্চি আলাদা, মানে ছেলেদের আর মেয়েদের মধ্যে এলাকাভেদ করতেই হয়। এত কাণ্ড করে আলাদা কেন করা হয় সে আমরা সবাই বেশ জানি। স্কুল শিক্ষক, কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক, আমজনতা সবাই মিলেই এসব ব্যবস্থাপনা করি, ছেলেদের আর মেয়েদের সম্পর্ক ঘি আর আগুন বলে ভাবি, কিম্বা মেয়েদের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে ছেলেরা তাদের ওপর দৌরাত্ম্য করবে, মেয়েরা নিজেদের বাঁচাতে পারবে না, সেই অমোঘ ভায়লেন্স-এর লেন্স দিয়েই জগতটাকে দেখি। অর্থাৎ শুরুই করি এই ধারণা থেকে যে মেয়েরা আর ছেলেরা আলাদা। খুবই গভীর, খুবই বেসিক জায়গা থেকে তারা আলাদা। একেবারে অলঙ্ঘ্যনীয় সেই পার্থক্য, এবং এক সময় নারীশিক্ষার আয়োজনের প্রথম যুগে সেই পার্থক্যকে জায়গা দিতে গিয়ে মেয়েদের পাঠ্যবিষয়কে পর্যন্ত আলাদা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বহু দূরদর্শী মানুষের কল্যাণে, যাদের বেশিরভাগই পুরুষ, বিষয়ভিত্তিক ভেদ থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা বেরিয়েছে বটে, তবে অবস্থানভিত্তিক ভেদ এখনও ঘোচেনি।
নারীশিক্ষার আয়োজনের প্রথম যুগে
সেই পার্থক্যকে জায়গা দিতে গিয়ে
মেয়েদের পাঠ্যবিষয়কে পর্যন্ত আলাদা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল
এত কথা লিখছি কেবল এইটা আরেকবার ঝালিয়ে নেবার জন্যে যে এমনকী পড়াশোনার মতো মহৎ বিষয় নিয়ে হলেও আর ইশকুলের মতো পবিত্র জায়গায় ঘটলেও, মেয়েরা মেয়েই থেকে যায়, আর ছেলেরাও ছেলে হয়ে উঠতেই শেখে। না পাঠ্যবিষয়ে, না তার বাইরের পরিসরে, দু’য়ের মধ্যেকার অলঙ্ঘ্যনীয় পাঁচিল টপকে যাবার অবকাশ কারোই থাকে না। আবার এইরকম একটা পাঁচিলের সামনে দাঁড়িয়েই কারো কারো মনে হয় ডিঙোতে পারি আর না পারি, নাড়া দিতেই হবে। সেভাবেই আমরা কয়েকজন মানুষ, স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি নামক একটা দলের হয়ে যারা লিঙ্গ-যৌনতা, লিঙ্গ-যৌনসাম্য ও প্রথাবিরোধী লিঙ্গ-যৌন পরিচয়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করি, আমরা বছর দু-এক ধরে স্কুলের ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের সঙ্গে একধরনের ওলটপালট আলাপআলোচনা চালাবার চেষ্টা করছি যেখানে জেন্ডার এবং সেক্সুয়ালিটি দুটো বিষয়ই নাড়াচাড়া খাচ্ছে। পাঁচিল টপকানো সহজ নয় জানি, কিন্তু অন্তত পাঁচিল বিষয়ক আলোচনা তো শুরু করতেই হবে কাউকে না কাউকে।
বাচ্চারা স্কুলে আসে ছোটবেলায় বটে,
কিন্তু তারা চিরশিশু হয়ে থাকে না তো,
বড় হয়ে ওঠে স্কুলে থাকার সময়টার মধ্যেই
স্কুল, আমরা সবাই জানি, বেড়ে ওঠার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পরিবারের সঙ্গে টক্কর নিতে পারে এতোটাই গুরুত্ব তার অবস্থানের। সেখানে অংক, বাংলা, ভূগোল, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদির সঙ্গে জেন্ডার-পাঠ বলেও যে কিছু একটা থাকা উচিত সেটা নিয়ে এখন অনেক শিক্ষকই সচেতন। আমাদের কাজের সূত্রে অনেকেরই দেখা পেয়েছি, যাঁরা নিজেদের মতো করে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে লিঙ্গসাম্য নিয়ে কথা বলেন, কাজ করেন। একদিকে এটা যেমন আশার কথা তেমনি, এই শিক্ষকরা যে নিজেদের দায়িত্বে কাজটা করছেন, প্রায় সময়ই ওপরতলার সাহায্য ছাড়া, এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা সহ্য করে, এইটা ভাবনার বিষয় বলে মনে হয়েছে। মুশকিল এইটা যে বাচ্চারা স্কুলে আসে ছোটবেলায় বটে, কিন্তু তারা চিরশিশু হয়ে থাকে না তো, বড় হয়ে ওঠে স্কুলে থাকার সময়টার মধ্যেই এবং কৈশোর, যাকে আজ সাংঘাতিক টিন এজ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে সারা পৃথিবীর মনস্তত্ত্ব চর্চার মধ্যে, সেই সময়টাও কাটায় তারা এই স্কুলের মধ্যেই। কৈশোরের মধ্যে বিকশিত হয় আমিত্বের ধারণা, আত্মের বোধ, যার মধ্যে লিঙ্গস্বারূপ্য আর যৌনতা, দুটোই হাতে হাত মিলিয়ে চলে, যা প্রথাগত নারীপুরুষের খোপে বিষমকামিতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হতে পারে যেমন, তেমনি প্রথাবিরোধী অন্যকিছুও হতে পারে। কাজেই লিঙ্গসাম্যের ধারণার সঙ্গে লিঙ্গবৈচিত্র্য, যৌনতার সঙ্গে যৌনপরিচয়ের বিভিন্নতা এসব নিয়ে কথা বলার সময়ও এইটাই, ভূগোল-বিজ্ঞানের ফাঁকে ফাঁকেই চালাতে হবে এই চর্চাও।
তুই কে? মেয়ে নয় তো কী? ছেলে? মেয়েদের স্কুলে ছেলে কেন?
এক দঙ্গল মেয়ের মধ্যে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি মেয়ে। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির একটি বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলে। একটা মজার খেলা খেলছিলাম সবাই মিলে, যাদের নাম ‘স’ দিয়ে তারা একদিকে দাঁড়াও, যারা সাইকেল চেপে স্কুলে আসো তারা একদিকে দাঁড়াও, যারা শাহরুখ খানকে পছন্দ কর তারা একদিকে দাঁড়াও ইত্যাদির ফাঁকে গুঁজে দিয়েছিলাম যারা নিজেদের মেয়ে বলে মনে করো তারা একদিকে দাঁড়াও। এই নির্দেশ পেয়ে সবাই একদিকে চলে গেল, যাবেই, কারণ এটা মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট করা স্কুল, কিন্তু তারই মধ্যে একজন একটু এদিকওদিক তাকাতাকি করে, উলটোদিকে গিয়ে দাঁড়াল।
তুই কে? মেয়ে নয় তো কী? ছেলে? মেয়েদের স্কুলে ছেলে কেন? ওপাশের সমবেত নারীচিহ্নিত দল থেকে এই প্রশ্নগুলো ভেসে আসছিল, আর আমরা ভাবছিলাম আমাদের দলের মধ্যে ও বাইরে থাকা পরিচিত একাধিক মানুষের কথা যারা নারীচিহ্নিত শরীর নিয়ে জন্মানোর পরেও নিজেকে মেয়ে বলে মানতে পারে না বলে স্কুল-কলেজ বা কাজের জায়গায় কতদূর হেনস্থা হয়েছে, কী পরিমাণ অত্যাচার হয়েছে তাদের ওপর পরিবারের মধ্যেও। এদের মধ্যে অনেকেই পড়াশোনায় ইতি টেনেছে কম বয়সে, নিছক শাড়ি বা স্কার্ট পরে স্কুলে যাবে না বলে, ক্লাশের অন্য মেয়েদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না বলে, কিম্বা এমনই কোনও আপাততুচ্ছ কারণে, যা তার বাড়ির লোক, স্কুলের শিক্ষক বা বন্ধুরা কেউই বুঝে উঠতে পারেনি।
মেয়েদের মাসিক হয় যখন সেই সময়টা তারা স্কুলেই থাকে। ১১ থেকে ১৩ যদি ধরি তবে সেভেন থেকে নাইন, শরীর বদলায় তখন, মনও বদলায়। লিঙ্গ-যৌনতার অনুভুতি, আবেগ, কামনা, না-বোঝা বা আধ-বোঝা শিরশিরানি সেই সময়ই তো তৈরি হয়, এসব আমরা জানি, কারণ নিজেদের জীবনেও তো এইসব পেরিয়েই এসেছি। তবু এই অপূর্ব সম্ভাবনাময়, রহস্যময় সময়টাকে অংক আর ইতিহাস আর কবিতা মুখস্থ করিয়ে কাটিয়ে দিই আমরাই। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যে কাজের কথা বলছিলাম সেই সূত্রে ছেলেদের স্কুলে যাবার সুযোগ হয়েছিল যেমন, তেমনি সহশিক্ষা স্কুলেও। এইসব স্কুলই বাংলা মধ্যমের, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, ছাত্রছাত্রীরা মধ্যবিত্ত/নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী ও কালচারের অন্তর্ভুক্ত হলেও স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদির দৌলতে সবাই স্মার্ট, বুদ্ধিমান, ঝকঝকে। তেমনি একটি ছেলেদের স্কুলে হস্তমৈথুন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিষয়টা সবাই জানলেও নিষিদ্ধ বস্তু হিসাবে একেবারেই সিরিয়াস আলোচনায় জায়গা পায় না, অথচ মিথ হিসাবে প্রায় দৈব অবস্থান পেয়ে গেছে। অর্থাৎ একদিকে হস্তমৈথুনের সঙ্গে পৌরুষের অবিসংবাদী সম্পর্ক টেনে যে করে না সে নেহাতই এলেবেলে বলে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে কাজটা কি সত্যিই ভালো হচ্ছে, কারণ ১০০ ফোঁটা রক্ত = ১ ফোঁটা বীর্যের অপচয় ঘটানো কু-অভ্যাসের ফলে কি সেই পৌরুষই বৃথা হয়ে যাবে, এই জাতীয় ভাবনাও ভরপুর রয়েছে।
এদের মধ্যে অনেকেই পড়াশোনায় ইতি টেনেছে কম বয়সে,
নিছক শাড়ি বা স্কার্ট পরে স্কুলে যাবে না বলে
শিক্ষকদের গ্রুপে একজন অত্যন্ত সচেতন, দক্ষ, সহমর্মী বায়োলজির মাস্টার মশাই-এর দেখা পেয়েছিলাম, যিনি প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলেছিলেন - যে কোনও প্রেমঘটিত সমস্যায় সবাই আমাকেই আগে ঠেলে দেয়, বায়োলজি পড়াই বলে কি প্রেমটাও আমারই বিষয়? প্রজনন বোঝাতে পারি, কিন্তু প্রেম কি শুধু প্রজনন দিয়ে বোঝানো যায়? এই স্কুলটি সহশিক্ষামূলক, অতএব ঘি-আগুন তত্ত্ব এখানে গনগন জ্বলছে, এবং যাবতীয় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এসে পড়ছে জীবনবিজ্ঞানের ঘাড়ে, বিশেষত যিনি আবার ছাত্রছাত্রীদের কাছের মানুষও বটে।
ছেলে আর মেয়ের যে খোপ
আমরা স্কুল ড্রেসের সঙ্গে সেলাই করে জুড়ে দিই,
সেই খোপে এরা পড়ে না
যে মেয়েটি মেয়ে নয়, তারই মতো সেই ছেলেটিরও দেখা পেয়েছি যে ঠিক ছেলে নয়। অর্থাৎ ছেলে আর মেয়ের যে খোপ আমরা স্কুল ড্রেসের সঙ্গে সেলাই করে জুড়ে দিই, সেই খোপে এরা পড়ে না। না-মেয়েটি একধরনের কষ্টে ভোগে, সে দেখে তার চারপাশের মেয়েদের গল্পের মধ্যে তার গল্প নেই। কলেজ, চাকরি-র সঙ্গে প্রেম বিয়ে সন্তানের গল্পগুলো তার সঙ্গে মিলছে না, আর না-ছেলেটির জন্যে সবটাই গরমিল — সে যে শুধু বন্ধু পায় না তাই নয়, ‘ঠিকঠাক ম্যাচো’ ছেলে না হতে পারার দরুন ঠাট্টা, তামাশা, অপমান ইত্যাদির সঙ্গে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে নানাবিধ হিংসা, যার মধ্যে বড় হল যৌনহিংসা, এমনকি ধর্ষণও।
এমন তো হবার কথা নয়, স্কুল মেয়েদের হোক বা ছেলেদের বা সহশিক্ষার, সেইসব স্কুলে সবার নিরাপদে, আনন্দে, স্বাধিকারে শিখতে পারার কথা, জানতে ও বুঝতে পারার কথা। সেখানে যে নারীচিহ্নিত বা পুরুষচিহ্নিত শরীরের অধিকারী মানুষটার বলতে পারার কথা আমি মেয়ে নই, বা পুরুষ নই, আমি কী তা এখনো জানি না, তাই খুঁজে-বুঝে দ্যাখার চেষ্টা করছি, আমাকে সাহায্য কর। স্কুলে জেন্ডার শিক্ষার এই চেহারাটাও যেন আমরা দেখতে চাই, তাহলে স্কুলছুটের সংখ্যাও হয়ত কিছুটা কমবে আর গায়ের জোরে কিছু মানুষকে নারী বা পুরুষের খোপে ঢুকিয়ে দেবার হিংস্রতাও একটু কমবে। নারী আর পুরুষের দুটো মিথিক্যাল অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে যদি শুরু না করি তবে সাম্য চাইলেও আসবে কি? এবং এই অমোঘ অবস্থানকে প্রশ্ন করতে হলে স্কুলই হচ্ছে সঠিক জায়গা, যেটা নারী বা পুরুষ তৈরির কারখানা নয়, মানুষ তৈরির বাগান।
Link: https://ebongalap.org/gender-in-schools