12-07-2024 10:27:10 am
Link: https://ebongalap.org/girl-students-in-stem-and-school
গত বছর খুব খুশি হয়েছিলাম আমি। খুশির কারণ নিজেদের কেরিয়ার বেছে নেওয়ার মুখে দাঁড়ানো আমার ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রীদের সাফল্য। আমার বেশির ভাগ মেয়েরাই কী পড়বে ঠিক করে নিয়েছিল – ডাক্তারি, বায়োলজিকাল সায়েন্স, অথবা কম্পিউটার সায়েন্স। আর সেই বিষয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করার জন্য চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা সব কোচিং ক্লাসে নাম লিখিয়ে সেখানে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে এক্সট্রা ক্লাস করছিল। মাত্র দু’জন এমন ছিল যারা ফিসিক্স, কেমিস্ট্রি বা অঙ্ক পড়তে চায়। এদের মধ্যে একজন ক্লাস এলেভেনে ভুল বিষয় নেওয়ার কারণে তাকে আবার ওই একই ক্লাসে ভর্তি হতে হয়। ক্লাস এলেভেনের মাঝামাঝি এসে সে বুঝতে পারে যে ফিসিক্স নিয়ে লেখাপড়া করতে চাইলে অঙ্ক থাকতেই হবে। লেখাপড়ায় খুব ভালো হওয়া সত্বেও এই সাহসী মেয়েটি ওই বছরটি রিপিট করে – ফিসিক্স আর অঙ্ক নিয়ে। এখন সে কলেজে ফিসিক্স পড়ছে। ওর ভাগ্য ভালো যে ওর মা-বাবা ওর পাশে আছেন এবং নিজেদের আকাঙ্ক্ষা ওর ওপর চাপিয়ে দেননি।
"
কোনও মেয়ে যদি অঙ্কে ভালো না হয়
তাহলে সেটাই ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়া হয়।
তাকে ভালো হওয়ার জন্য কোনও উৎসাহ দেওয়া হয় না।
"
যুগ যুগ ধরে এরকম একটা ভুঁয়ো কথা প্রচলিত আছে যে মেয়েরা অঙ্কে আর ফিসিক্সে ভালো না। কোনও মেয়ে যদি অঙ্কে ভালো না হয় তাহলে সেটাই ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই তাকে ভালো হওয়ার জন্য কোনও উৎসাহ দেওয়া হয় না। এছাড়া ইস্কুলে বিজ্ঞান এবং অঙ্ক পড়ানোর ধরনে ফাঁক, শিক্ষকদের বৈষম্যমূলক মনোভাব, পারিপার্শ্বিক চাপ – অঙ্কে খারাপ ফলের কারণ এগুলোও হতে পারে, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না।
বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা বলে যে ক্লাস টেনের পর ছাত্র-ছাত্রীরা কী বিষয় নির্বাচন করছে তার ওপর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলিতে জেন্ডার গ্যাপ নির্ভর করে। যদি আমরা প্রাইমারি স্তর থেকেই মেয়েদের বিজ্ঞান আর অঙ্কে উৎসাহ না দিই, তাহলে এই গ্যাপ থেকে যাবে। এই সমস্যার মূল আসলে আরও গভীরে – আরও ছোট অবস্থায়, বাড়ির পরিবেশ, এবং মা-বাবার আকাঙ্ক্ষাতে – প্রোথিত। শিশু মনে এই স্বপ্ন গেঁথে দেওয়া হয় যে তারা ভবিষ্যতের ডাক্তার, নার্স, অথবা হোম মেকার। অর্থাৎ মূলত এমন ''কেয়ার গিভার' বা সেবাযত্ন করার ভূমিকায়। মহিলা গবেষকরা যে বহু কষ্টে অর্জিত পিএইচডি অথবা পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি’র পর অথবা মাঝপথেই নিজেদের কেরিয়ার থেকে সরে আসেন তার প্রধান কারণ এই। সারা পৃথিবীতে, এস টি ই এম (STEM)-এর তুলনায় ডাক্তারি কলেজ অথবা বায়োলজি সংক্রান্ত বিষয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এর কারণ কিন্তু শুধু এই নয় যে ডাক্তারদের মাইনে বেশি আর নিজের সময় মত কাজ করা যায়। আসল কারণ হল গাইনিকোলজি এবং ডেন্টিস্ট্রির মত বিষয়ে মহিলা ডাক্তারদের চাহিদা বেশ কয়েক বছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গাতেই মহিলা জেনারেল ফিসিশিয়ান, গাইনিকোলজিস্ট এবং ডেন্টিস্টকে পছন্দ করা হয়, কিন্তু হার্ট অথবা ব্রেন সার্জন হিসেবে নয়! আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রায় কখনোই মহিলা কলের মিস্ত্রি অথবা মহিলা ইলেক্ট্রিশিয়ানের দেখা পাই না। মেয়েরা মাউন্ট এভারেস্টের চুড়োয় পৌঁছে গেছেন, কিন্তু আমাদের বাড়িতে ঢুকে এই জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বলে আমরা মনে করি না। মেয়েরা যে নানারকম ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে না তার জন্যে সমাজ, ইস্কুল, এবং বাড়ি সমান ভাবে দায়ী।
"
শিশু মনে এই স্বপ্ন গেঁথে দেওয়া হয় যে তারা
ভবিষ্যতের ডাক্তার, নার্স, অথবা হোম মেকার।
অর্থাৎ মূলত এমন ''কেয়ার গিভার' বা সেবাযত্ন করার ভূমিকায়।
"
প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে বাড়িতে। শৈশব থেকে। গত কয়েক বছরে এই লিঙ্গ বিভাজন দূর করার জন্য গোটা বিশ্বে কিছু পপুলিস্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার একটি উদাহরণ হল কেরিয়ার বার্বি! এই পুঁজিবাদী, লিঙ্গ বৈষম্যবাদী, উপভোক্তা-কেন্দ্রিকতা কোনও কাজেই লাগবে না। মা-বাবারা কেন তাঁদের মেয়েদের মেকানিক্স সেট, লেগো, বিল্ডিং ব্লক বা হট্ হুইল গাড়ি কিনে দেবেন না?
এই বিভাজন নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের শুরু করতে হবে সন্তান পালন এবং শিক্ষকতার ক্ষেত্রে লিঙ্গ সচেতনতা দিয়ে। ইস্কুলে নতুন ধরণের উপায়ে লেখাপড়া, ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, ক্লাসরুমে আলোচনা বাড়ানো – এই জাতীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব যে মেয়েরা কিন্তু কোনও বিষয়েই কম যায় না। বেশির ভাগ সময়ে মহিলা বিজ্ঞানীদের সংগ্রাম এবং সাফল্যের কাহিনী খুবই অনুপ্রেরণা যোগায়। একবার আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের কলকাতার সায়েন্স সিটি-তে নিয়ে গেছিলাম বিখ্যাত মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়াম্স-এর সঙ্গে একটি আলোচনা সভায়। সেখান থেকে ফেরার পরই ইস্কুলে তৈরি হল অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাব – তাতে মেয়েদের সংখ্যা ছিল অনেক। বেশির ভাগ ইস্কুলে নানারকমের ক্লাব ইত্যাদি থাকে। সেখানে অংশগ্রহণ এবং সৃজনশীলতা বাড়ানো যেতে পারে। অনেক সময় এরকম হয় যে ইস্কুলের বই যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক নয় বলে এবং পরীক্ষার ফল খুব একটা ভালো না হলে নানা বাধা তৈরি হয়। কিন্তু যদি বিভিন্ন রকমের ক্লাবে কিছু মজার কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে বোঝানো যেতে পারে যে আপাত ভাবে যে বিষয়গুলি কঠিন বলে মনে হচ্ছে সেগুলো আসলে সহজ আর তার মধ্যেও একধরনের মজা আছে, তাহলে ছাত্রীরা উৎসাহ পেতে পারে।
মা-বাবাদের সঙ্গে মিটিং-এ আমাদের বোঝাতে হয় যেন তাঁরা মেয়েদের বুদ্ধি এবং দক্ষতাকে ছোট করে না দেখেন। নিজেদের একটা লেখাপড়া করার জায়গা আর চিন্তামুক্ত একটু সময় – এই মেয়েদের এটাই প্রয়োজন আর এটা পাওয়ার পথই সবথেকে বন্ধুর। মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েরা নিজেদের জন্য কোনও সময়ই পায় না। নিজেদের একটা পড়ার টেবিল তো নয়ই। ওদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমি নিজের কথা বলতাম। বলতাম যে বম্বেতে আমি ছোটবেলায় যে বাড়িতে থাকতাম তাতে ছিল একটা ঘর আর একটা রান্নাঘর। অনেক সময় আমাকে সিঁড়িতে বসে লেখাপড়া করতে হত। অঙ্ক করার সময় যাতে মন বিক্ষিপ্ত না হয় বা নানারকম আওয়াজে অসুবিধে না হয়, তার জন্য হেডফোন লাগিয়ে মৃদু বাজনা শোনা খুবই সাহায্য করতে পারে। এই গল্পটি বলার পরে মা-বাবারা ইস্কুলে এসে নালিশ করলেন যে বাচ্চারা সারা রাত কানে হেডফোন লাগিয়ে অঙ্ক করছে, কিন্তু রিপোর্ট কার্ড আর নম্বর নিয়ে তাঁরা খুশি! যদি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকে, তাহলে অন্য সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। শিক্ষকদের প্রধান কাজ হল ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে বিষয়ের প্রতি ভালোবাসার বোধ তৈরি করা।
"
মা-বাবারা কেন তাঁদের মেয়েদের
মেকানিক্স সেট, লেগো, বিল্ডিং ব্লক
বা হট্ হুইল গাড়ি কিনে দেবেন না?
"
আমি বিভিন্ন ইস্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে হাইস্কুলে বিষয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছি। এটা জানতে পেরে ভালো লেগেছে যে কিছু ইস্কুলে ক্লাস নাইন এবং টেনের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য কেরিয়ার কাউন্সেলিং এবং বিষয় নির্বাচন সংক্রান্ত সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। কলকাতার সবথেকে সফল কো-এড ইস্কুলে পড়ানোর পদ্ধতির উন্নতি এবং ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে ছাত্রীরা ছাত্রদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। এমনকী মাঝে মাঝে তারা ফিসিক্স আর অঙ্কে ছেলেদের থেকে বেশি নম্বরও পাচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে যে পরবর্তী কালে তারা গবেষক বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সাফল্য লাভ করেছে। জোরালো সঙ্কল্প এবং ইচ্ছে থাকলে এই বিভাজন ঘোচানো সম্ভব।
আরেকটি সমস্যা হল শিক্ষকদের নিজেদের লিঙ্গবৈষম্যমূলক মনোভাব। এর ফলে তাঁরা নিজেরাই ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতায় ভরসা রাখেন না। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীদের বিচার করা হয় তাদের পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে, যা তাদের সৃজনশীলতার পরিচায়ক নয়। হতেই পারে যে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষায় ভালো ফল করল না, কিন্তু তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দুর্দান্ত। আবার উল্টোটাও হতে পারে। অনেক মেধাবী ছাত্রীর দুটোই থাকে — একবার এক খুবই মেধাবী ছাত্রী’র একটি আইডিয়া আমাকে চমৎকৃত করেছিল। সে বলেছিল যে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বা বস্তিতে, যেখানে ঘরের মধ্যে সূর্যের আলো ঠিকমত আসে না, সেখানে দরজা জানলায় বড় বড় আয়না বসানো যেতে পারে যাতে প্রতিফলনের মাধ্যমে সেই ঘরগুলিতে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে।
"
বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীদের বিচার করা হয় তাদের পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে,
যা তাদের সৃজনশীলতার পরিচায়ক নয়।
হতেই পারে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষায় ভালো ফল করল না,
কিন্তু তার উদ্ভাবনী শক্তি দুর্দান্ত।
"
আমি ওকে বলেছিলাম এটার ডিজাইন বানিয়ে একটি জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় সেটা পাঠাতে। ও খুব মন দিয়ে কাজটা করছিল আর মাঝেমাঝে সাহায্যের জন্য আমার কাছে আসত। আমি শুধু ওর কথা মন দিয়ে শুনতাম, ওকে উৎসাহ দিতাম, আর ওকে গাইড করতাম। পরে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই কাজটার কথা ও ভাবল কী ভাবে — ও হেসে আমাকে বলেছিল, ওর নিজের বাড়িতেই তো এই সমস্যাটা আছে! ক্লাস টুয়েলভের পর ব্যাঙ্গালোরের একটি বিখ্যাত ইন্সটিটিউটে ফিসিক্স পড়ার জন্য একটি স্কলারশিপ পায় মেয়েটি। ও যখন সেখানে ভর্তি হল আমি প্রচন্ড খুশি হয়েছিলাম। ছাত্রছাত্রীদের এটাই বলে যেতে হয় যে, কোনও আইডিয়াই অকার্যকরী নয় বা তারা কোনও বিষয় বুঝতে না পারলে সেটা তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ নয়। মেরি ক্যুরি বা আমাদের ঘরের মেয়ে কল্পনা চাওলা-ও একদিন ওদেরই মত সাধারণ ছাত্রী ছিলেন।
পাঠ্যপুস্তক, ক্লাসরুম আর পরীক্ষার বাইরে মেয়েরা যাতে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে, যাতে বিভিন্ন বিষয় নিজেরা অন্বেষণ করে দেখতে পারে, সেই সুযোগ আমাদের তৈরি করে দেওয়া উচিত। তারা স্বাধীন ভাবে শিখুক, আত্মবিশ্বাসী হোক, ওদের ভরসা থাকুক নিজেদের স্বপ্নের ওপর। পল ফ্রিয়ের-এর একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই —
“No one is born fully-formed: it is through self-experience in the world that we become what we are.”
Link: https://ebongalap.org/girl-students-in-stem-and-school