04-06-2024 12:28:17 pm
Link: https://ebongalap.org/girls-marriage-age
‘আমার দিদির বিয়ে বাবা মোটেও আঠারোয় দেবে না। আঠারোয় তো উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে মাত্র। দিদি নিশ্চয় কলেজে যাবে,’ অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি বলল।
‘দিদি যে স্কুলে যায়, সেই স্কুলে বিয়ে-হওয়া মেয়েরা আসে?’
‘তা আসে৷ আগে আরও বেশি আসত। এখন বিয়ে না করলে, কলেজেও কন্যাশ্রীর টাকা পাওয়া যায় তো! তাই . . .’
‘দিদি কী বলে তার বিয়ে-হওয়া বন্ধুদের দেখে?’
‘দিদি বলে, যাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের শাঁখা-পলা হাতে পরে পরীক্ষার সময় স্পিডে লিখতে খুব কষ্ট৷ আবার শাঁখা-পলা খোলা নাকি অমঙ্গল৷’
‘দিদি খুশি হবে? এই যদি বিয়ের বয়স আঠারো থেকে একুশ হয়?’
‘দিদি বলে, পড়াশোনা করতে হবে। চাকরি করতে হবে। তাহলে নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা বলা যাবে৷ তাহলে নিজের পছন্দ মতো বিয়েও করা যাবে’।
নিজের পছন্দ মতো বিয়ে? অদেখা মেয়েটি আঠারো ছুঁই-ছুঁই। আমার ছাত্রের দিদি৷ প্রাপ্তবয়সের দোরগোড়ায় এসে মফস্বলের মেয়ে বুঝেছে, পড়াশোনায় বাবা-মার সম্মতি যত সহজে মেলে, ‘নিজের পছন্দের বিয়েতে’ তত সহজে মেলে না৷ সে হল ব্যক্তিস্বাধীনতার এক অন্য পরত, যা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেই মেয়েরা ‘ভাল মেয়ে’ হয়। ভাল মেয়েরা নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত লেখাপড়া সেরে, বাবা-মার পছন্দ অনুসারে পাত্রস্থ হলেই সবদিক বজায় থাকে। নিজের যৌন সঙ্গী নির্বাচন সম্পর্কে সরব হতে গেলে তাই তাকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে, এইটা সে সার বুঝেছে।
এতটা পরিণত ভাবনা যার, সে হয়ত বিয়ের বয়স বাড়ানোয় তত প্রভাবিত হবে না। সে হয়ত এমনিতেই বিয়ে করবে কুড়ির পর। কিন্তু তার ‘নিজের পছন্দের বিয়ে’ সংক্রান্ত ভাবনাটা ভেবে দেখার মতো। কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও মনে পড়ে গেল৷ নদীয়ার একটি থানার ওসির তত্ত্বাবধানে ভিডিও হচ্ছে৷ একটি নেহাতই কমবয়সী হিন্দু মেয়ে পালিয়ে একটি মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে। তার বাবা-ভাই ও পাড়ার অন্য পুরুষেরা থানায় দরবার করেছেন। খোদ থানাতেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল চলছে। ‘বাবার কথা একবার ভাবলে না?’ ‘তোমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাও ফিরে যাবে না?’ সর্বোপরি, ‘তুমি জানো না এসব কারণেই গ্রামে গ্রামে দাঙ্গা হয়!’ মেয়েটি আইন-কানুন বিলক্ষণ জানে, তাই ঠাণ্ডা মাথায় বলছে, ‘আমার বয়স আঠারোর বেশি। আমি সজ্ঞানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিয়ে করেছি’। অর্থাৎ, নতুন আইনটি এলে, বিয়ের বয়স বাড়লে, সেক্ষেত্রে সে ঘটনায় পুরুষটি হয়ত অপহরণের দায়ে দোষী হত।
'একবার আমার বন্ধু আর প্রেমিকা বসেছিল স্টেশনে।জিআরপি এসে ধরল। অশ্রাব্য গালিগালাজ। স্কুলে জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাল। তারপর সত্যি বাবা-মাকে খবর দিল।'
এখানেই খটকা থেকে যাচ্ছে। দিল্লির এনজিও পার্টনার্স ফর ল্য ইন ডেভেলপমেন্ট (Partners for Law in Development) বিশ্লেষণ করেছে ২০০৬-এর বাল্যবিবাহ রোধ আইন বা Prohibition of Child Marriage Act (PCMA/পিসিএমএ)-এর আওতাভুক্ত কেসগুলি। তাদের তথ্য বলছে, মাত্র ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ নাকচ করার জন্য আইনটির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সেখানেও বাবা-মার শাস্তি-টাস্তি হয়নি। কিন্তু ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে আইনটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে, এবং সেই সঙ্গে পক্সো আইনেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে, জড়িত ছেলেটিকে ফাঁসাতে, কারণ বিয়েটি মেয়ের বাড়ির মনোমত ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই তার কারণ আন্তঃধর্ম বা আন্তঃবর্ণ বিবাহ।
এইখানে আমাদের পিসিএমএ আইনটিকেও একটু বুঝে নেওয়া দরকার। এই আইন মোতাবেক, ছেলের একুশ আর মেয়ের আঠারোর নিচে বিয়ে হলেই তাদের কান ধরে আলাদা করে দেওয়া হয় না৷ কিন্তু যদি তারা চায়, বা যদি পরিবার চায়, তাহলে বিয়ে নাকচ হয়। আরও বলা হয়, বিয়ের পরে অপ্রাপ্তবয়স্করা সেই বিয়ে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও আরও দু-বছর হাতে পাবে৷ মানে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েটি ও ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেটি বিয়েটি নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যার ভিত্তিতে তারা চাইলে বিয়েটি বাতিল হতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই আইন ব্যবহার হচ্ছে নেহাতই পারিবারিক পছন্দ বাদে অন্য সঙ্গী পছন্দ করা আটকাতে৷ তাহলে একুশে বিয়ে হলে কি প্রেমবিবাহে বাবা-মার অমত থাকলে ছেলেটিকে আইনের জালে ফাঁসানো আরও সহজ হবে না?
ঠিক এই কথাটিই একাদশের ছাত্রটি বলল। জিজ্ঞাসা করল, ‘বিয়ের বয়স বাড়বে৷ ঠিক আছে৷ কিন্তু ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় আপত্তি থাকবে কি? একবার আমার বন্ধু আর প্রেমিকা বসেছিল স্টেশনে। জিআরপি এসে ধরল। অশ্রাব্য গালিগালাজ। স্কুলে জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাল। তারপর সত্যি বাবা-মাকে খবর দিল। জানতে চাইল, ‘তোদের আঠারো হয়েছে?’
অর্থাৎ বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের জগতে এই বিবাহের বয়স সংক্রান্ত প্রশ্নটি অন্য এক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শুধু বিবাহ নামক অনুষ্ঠানটি পিছোচ্ছে, নাকি তাদের সঙ্গী নির্বাচনের বয়সও পিছোচ্ছে? আমাদের দেশে অভিভাবক তথা সমাজ ছেলেমেয়ের প্রেম-ভালোবাসা ও যৌনতার প্রয়োজনকে বিয়ের চেয়ে আলাদা করে দেখতে অক্ষম বলে হয়ত কিশোর বয়সের এই প্রশ্নগুলি অশ্রুত থেকে যাচ্ছে।
‘আচ্ছা এই যে ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স তিন বছর বেশি, মেয়েদের কম, এ নিয়ে কী মনে হয়?’এই প্রশ্নটিও তুললাম ছেলে-ইস্কুলের ছেলেদের কাছে।
‘সমান সমান হওয়া তো ভালই। মেয়েরা তো সবই করছে এখন ছেলেদের মতো। পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি। ভোট দিতেও সবাই পারে আঠারোয়। বিয়ের বয়স আলাদা কেন তবে?’
‘কিন্তু ভেবে দেখ্, তোদের চারপাশে যে বিয়েগুলো হয়, সেখানে ছেলেটির বয়স বেশি হবে, ধরেই নেওয়া হয়। বয়স শুধু না, ছেলেটি শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরি-বাকরি সবেতেই মেয়েটির চেয়ে এগিয়ে থাকবে, এরকমই কি আশা করা হয় না?’
‘তা হয়। তার মানে সেই মানসিকতার কারণেই আগে এরকম নিয়ম হয়েছিল?’
‘ঠিক তাই। তাহলে কী করণীয়? যদি আমরা বিয়েতে আদৌ সমানতা চাই?’
‘বর-বউ বয়সে ও অন্য সব বিষয়ে সমান হতে পারে, এইটা আগে বুঝতে হবে ও মানতে হবে। নাহলে বোধহয় বয়স এক করে লাভ নেই’।
‘এমনকি ছেলেটি, তার স্ত্রীর চেয়ে খানিক পিছিয়েও থাকতে পারে বয়সে বা যোগ্যতায়। তাতেও মুষড়ে পড়ার কিছু নেই। এই বোধটা এলে, তখনই বোধহয় বিয়েতে সবাই সমান সমান হবে। সরকারি ভাবে ন্যূনতম সমান বয়স হলে নয়’।
একুশের ভালোমন্দ কী দাঁড়ালো তবে?
প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ থেকে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর বিষয়ে, তা নিয়ে একটি ছেলেদের স্কুলে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, এইসব আলোচনার সুযোগ ঘটল। ছেলেরা মেয়েদের বালিকা-বধূ হিসেবে আর দেখতে চায় না। খানিক সঠিক দিশা পেলে, তারা বরং অভ্যস্তই হতে চায় বান্ধবী, দিদি, বোনের পড়াশোনা আর চাকরি-বাকরির বাস্তবতায়। প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা শুনতে বেশ যুগান্তকারী। এমনকী, তাঁর দলের বিভিন্ন এমপি ও এমএলএ বিভিন্ন সময়ে বাল্যবিবাহের পক্ষে যা সব সওয়াল করেছেন, তাতে বোঝা যায়, নিজের দলের মধ্যেও হয়ত তাঁকে বিরোধিতারই সম্মুখীন হতে হবে এই প্রস্তাবের। অনেকে বলছেন, এর আসল উদ্দেশ্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। লক্ষ্য হিসেবে সেটাও মন্দ কিছু নয়৷
কিন্তু উলটো দিকের যুক্তিগুলিও ফেলনা নয়। আঠারো বছরকে বিবাহের ন্যূনতম বয়স ধরে ভারত বাল্যবিবাহকে ক্রমশ কমিয়ে প্রায় ৬%-এ নামিয়েছে। এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশের (প্রথম বিশ্বের দেশগুলি সহ) বিবাহের ন্যূনতম বয়স ওই আঠারোই। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য সৎ ধরে নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, নারীর উন্নতিসাধনের জন্য, তাকে পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে আনার জন্য বিবাহের বয়স বাড়ানোটাই আদর্শ পদ্ধতি, নাকি শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানো?
রাজ্য সরকারও কিন্তু চাইছেন, মেয়েরা ঠিক আঠারোতেই বিয়ে না করে ফেলুক। তাই দ্বিতীয় খেপের কন্যাশ্রী পাওয়া যাচ্ছে উনিশে, যার উল্লেখ লেখার শুরুতেই আছে, প্রথম ছাত্রটির বক্তব্যে। একমাত্র অবিবাহিত থাকলে ও কলেজে পড়লে, তবেই এই দ্বিতীয় খেপের কন্যাশ্রী পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাবিজ্ঞানে একে বলে ‘রিওয়ার্ড’ পদ্ধতিতে রিইনফোর্সমেন্ট। আর এই যে কেন্দ্রীয় সরকার একুশের নিচে বিয়েকে ‘ক্রিমিনালাইজ’ করতে চাইছেন, একে বলে ‘পানিশমেন্ট’ পদ্ধতিতে রিইনফোর্সমেন্ট। উদ্দেশ্য একই। কিন্তু পদ্ধতি ভিন্ন। শিক্ষাবিজ্ঞানের মতে, প্রথম পদ্ধতিটি শ্রেয়।
Link: https://ebongalap.org/girls-marriage-age