27-02-2024 06:02:17 am
Link: https://ebongalap.org/in-conversation-with-fajila-gaji
কথোপকথনে 'সুন্দরবন বিজয়নগর দিশা'র মেয়েরা
ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে মাটির আলপথ ধরে গ্রামের বাইরে আরেকটা গ্রাম। যার সীমানাতে আছে একটি কালিবাড়ি, এক পাকুড়তলা, তেমাথার মোড়। আর সবজে সুবাসের এলোমেলো লোনা হাওয়া। সেখানে বেশকতক ঘর মুসলমানের বাস। পশ্চিমবঙ্গের অন্য জায়গার মতই এই গ্রামের বাইরে রয়ে যাওয়া এই ‘অপর/আদার(Other)’গ্রাম; যা নিয়ে অসংখ্য অজানা কথা জমে থাকে। যেসব কথা জমে জমে পুঁজ হয়ে যায় আর কোনো এক সময়ে দাঙ্গার সংক্রমণে, সেসব অজ্ঞতার পুঁজ ফেটে বীভৎসতার ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে সময় নেয় না। শ্যামলীদি গ্রামের সীমান্ত এলাকাতে থাকেন, তাঁর বাড়ি থেকে কিছু দূরত্বে এই মুসলমান পাড়াটি। শ্যামলীদি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে এই পাড়ার মেয়েদের সাথে তাঁর ওঠাবসা; তাই তাঁর ব্যবস্থাপনাতেী আমরা ফজিলা গাজীর সাথে আলাপের সুযোগ পাই।
-এই খালেক গাজীর বাড়ি যাবো, কোন রাস্তাটা গো?
পাকুড় তলায় বসা কিছু লোককে প্রশ্ন করতেই উত্তর এলো, ‘কুন খালেক গাজী’?
-যাকে বাঘে নিয়েছে।
-সে তো অনেককাল হল, উনার কোন ছেলের বাড়ি যাবা সেটা বলো।
-আরে খালেক গাজীর বাড়িটা বলো না, উনার বউ এর সাথে কথা বলতে যাবো।
-ও... তা উনার বউয়ের তো কোন বাড়ি নেই। উনার কুন ছেলের সাথে আছেন সেটা জেনে বলতে হবে তাহলে।
শ্যামলীদি ও অন্যরা এখানেই একটা ভারী প্রশ্ন করে বসলো।
-আচ্ছা ফজিলা গাজীর নিজের ঠিকানা নেই কেন? মৃত স্বামী বা জীবিত সন্তান ছাড়া কি কোন নিজের ঠিকানা থাকতে পারে না তাঁর?
মূলত ফজিলা গাজীর সাথে আলাপের কারণ ছিল, তাঁর স্বামীকে বাঘে নিয়ে যাবার পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনসংগ্রামকে জানা। আমার তাঁকে দেখার ও কথা বলার ইচ্ছে প্রবল ছিল, কারণ আমার মৃত দাদির নামও ফজিলা ছিল, ছোটবেলা থেকে আব্বার মুখে তাঁর বর্ণনা শুনেছি; যে মহিলা আকালের সময় দশ ছেলেমেয়ের মুখে দুটো খাবার তুলে দিতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে সারাদিন-রাত ‘ঢেঁকি পারা দিত’ (ধান ভাঙত), একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মারা যান। ‘ফজিলা’ নামের মানুষটির কথা শৈশব থেকে আজ অবধি যতই শুনতাম মনের মধ্যে অনেককিছু তোলপাড় করত। শ্যামলীদি যে বৃদ্ধা ফজিলা গাজীর সাথে পরিচয় করাল, তিনি তীব্র অভাবেও পাগল হয়ে যাননি, মারা যাননি, ম্যানগ্রোভের জীবন যেন তাঁর। প্রতিকূল অবস্থা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, লড়াই করতে পারেন। এই জীবিত ফজিলা দাদির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠারই ছিল যেন। খুব কম সময়ের মধ্যে একটু একটু করে মিশে গেলেন আমাদের সাথে তাঁর অতীত বর্তমান নিয়ে।
- তোমার নাম?
-ফজিলা গাজী।
- তোমার স্বামীর নাম?
- (মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসি, লাজুকভাবে পড়শি মহিলাদের বলে ওঠেন) বলো না তোমরা উনার নাম, স্বামীর নাম মুখে আনতে লজ্জা লাগে যে!
তাপসীদি, শ্যামলীদি বলল, ‘তোমার মুখ থেকেই যদি শুনি বড় ভালো লাগবে সেটা।’ পাশ থেকে পড়শিরা ওনার স্বামীর নাম বললেও তাপসীদি শ্যামলীদি নাছোড়। ফজিলাদাদি একরাশ লজ্জা নিয়ে মৃদু স্বরে বললেন,
- খালেক গাজী, আগে কুনদিন করি নি এই প্রেথেম উনার নাম নিলাম।
তারপর ফজিলা দাদি ও অন্যান্য পড়শিদেরকে তাঁদের নানা প্রশ্নের উত্তরে আমরা সকলে মিলে বললাম; কেন আমরা ফজিলা দাদিকে জানতে চাইছি; তাপসীদি সহজ করে বলল কেন তারা নিজেদের জানবে, নিজেদের কথা লেখার চেষ্টা করবে, কেন তাপসীদি ফজিলাদিদের কথা কোন ইতিহাসে জায়গা পায় না আজ অবধি। শ্যামলীদি আরও অসাধারণ দক্ষতায় নিজেদের এই কথা বলার কারণ হিসাবে দেখাল এই যে, ফজিলা গাজীর বাড়ি যাবো বললে গ্রামেই সবাই চিনতে পারে না, আপনাদের চেনা হয় আপনাদের স্বামীর পরিচয়ে, তাই আপনাদের সংগ্রাম এই পুরুষ লোকেদের কাছে, সমাজের কাছে কি করে গৌণ হয়ে যায়। তাই আমরা আজ এই নতুন আলাপ পর্ব শুরু করছি যেখানে আমাদের কথা, আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস আমরাই বলবো আর লিখবোও।
- ও বুজতি পারিচি, তুমরা আমার জীবনের কঠিন ইতিহাস শুনবা তো, মিত্তি কতা বলবো নিকো । ওর বাবা জকন মরতিচে ১০-১১ ডার মা বলি আমি (পাস থেকে পড়শি বলেন ১১ডা বললি ভুল হবে তেরো ডা) তা হোক সেই তেরো ডাই। আর এই যে ১৩ ডা কি কষ্ট করি মানুষ করিচি বলবার নাই।
- মারা গেছে কজন?
- সে বাচ্চা বয়েসে মারা গেচে চার জন। এই কাশি ডারে লিয়ে পাঁচ জন। তো তখন কষ্ট ছিল অনেক, এখন যেমন ভাত থুইয়ি ভাত খাচ্চি। তখন তো ভুট্টা মাইলো, আটা হেন তেন কতো কি ওইসব খাইয়ে বাচ্চাগুলোক মানুষ, যা হয় হলও। ... এই পর্যন্ত আমি কিচুই পাইনি ধরো (সরকারী সাহায্য) না কি কই না ওসব কি ভাতা কিচ্চু পাইনি। ... তো এক জায়গায় আগলি, বাচ্চাগুলো মানুষ করার পর যখন তাঁরা একটু খুঁটিটা গারতি শিকলে, সেখুনি পর পর সবই হয়িচে, চারটি ছেলি আমার এখন একটা পাগলার কাচে আচি ... যে পাগলার কাচে আচি, তার বউ ওই ছেলে-পিলি ওই, মিত্যি কতা বলতি পারি নি জিগিস করি নাও ওদের।
- এই ছেলে কি করে আপনার ?
- এই ছেলি আমার ফারাকে (শহরে) জেতি পারে না। গে কাজ করবে একটু হেদমত করে কাজ খুজবে সে পারে না। এখানেই চাষবাস করে। আমার আর ছেলিরা আমারে টানবে , কিন্তু আমি বলি না, যে কটা দিন বাঁচবো ওই পাগলার কাচে থেকি যাবো। কাচে পিঠে থাকলি তো খোঁজ নিতে দেখভাল করতি পারবো তার, খেলো কি না খেলো, ইন্তেকাল হলও কি এসব খোঁজ নিতে পারবো না তাই বাইরে থাকি না। ছেলে বলে ও মা তু তো মরে জাবি, তো আমার জন্যি কিছু করি জাবি নে, একটা ঘর করি যা, তো তার জন্যি এই পাকা ঘরটা করছি দেনা পরেচি। ছাঁদ হয় নি এই যো, আড়াই বিঘে জমি বন্দক রেখে এই ঘরের ব্যাবস্থা ।
- ফজিলা দাদি তোমার ছোটবেলা কেমন ছিল?
প্রশ্নটা উত্তর বড় আলগা আবছা স্মৃতি। অনেক ভেবে দাদির যা মনে পড়ে—ছোটবেলায় দাদির বাপও জঙ্গল করতেন, আর দাদির মা সহ সব ভাইবোনেরা মিলে মিন সংগ্রহ, কাঠ কুড়ত। তবে সেসব খুবই অল্পকালের ধোঁয়াশা স্মৃতি, কারন দাদির বিয়ে হয়ে যায় সেই শৈশবেই, সাত বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। ফজিলাদি বলল-
- আগে দুধের দাত ভাঙলেই মেয়েদের বে দিয়ে দিত। সাত কি আট বছর বয়েসে আমার বে হয়। ... আগে মেয়ে দেখতে লোক আসতো গায়ে, পছন্দ হলে ‘খাইখাবা’ করে যেতো আমার দাদা শ্বশুর দেকে পচন্দ করে নাকছাবি দে এসছিল, আগেকার ঘুমটা কি ছেলো জানো এই এতোখানি, ছেলে দেকা তো দূর ছেলের সাতে কতাও বলা যেতো নাকো। ... বে-র পর কত দিন ঘুমটা টেনে তুমার দাদার থেকে আড়ালে থাকতেম; যোগ্যবান না হলে স্বামীর ছায়া মাড়ানো যেতো না। (ফিসফিসিয়ে) মাসিক হবার আগে পরজন্ত তুমার দাদার সাথে কথা হয়নি। মাসিক হলে পরে তুমার দাদার সাথে থাকতি শুরু করি। (হেসে) এই কাপুড়ে জড়িয়ে তখন যে কতো পরি জেতুম তার ইয়াত্তা নেই। তুমার দাদা সেই তখন থেকি জঙ্গল করতু, শেষ দোনে(বঁড়শির দড়ি) পরি মারা গেলো, বাঘে নিয়ে গেলো তাকে কেউ ছারাতে গেলো না। ... তবে তুমার দাদাও আমাকে ছেড়ে গেল তাড়াতাড়ি, কোলে ছোট ছোট বাচ্চা রেখে আমার হাতে একা দায়িত্ব দিয়ে গেল। খুব কষ্টের দিন গ্যেচে। কোলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলাকে এক জায়গাতে ফেলে লোকের বাড়ি ধান ভাঙা, অন্যের বাড়িতে কাজ কইরে দিন পেরুলো। ... তুমার দাদা হোগল পাতা এনে রেখেছিলো, কিন্তু ইন্তেকাল করে গেলে আর ঘর বাঁধতে পারলে না সে আর, উনার ইন্তেকালের পর যে দু-হাজার টাকা পেয়েছিলাম, মিথ্যি কতা বলব না সে টাকার একটুকও নিজে খায়নি, সন্তানেরে খাওয়াই নি। সে টাকা দিয়ে পড়শিরা সবাই ঘর বেঁধে দিল। এই করে ছেলেপুলেগুলো সে ঘরে মানুষ হল।
- ছেলেরা কেউ জঙ্গল করতে যায় না?
- ওদের বাপকে নিল জঙ্গল, তাই ওদের যেতে দিই নে, ফারাকে যায় চাষের কাজ করে কেউ। এই পাগলাডার কাছে থাকি, এ ছেলে আমার একটু ন্যালাখ্যাপা যে তাই অন্যদের মতন ফারাকে গিয়েও কাজ করতে পারে না। তুমরা এসচ কিছু যদি একটা ব্যবস্থা করতে পারো। একটু দেকো এই বয়সে বিধবা ভাতাটাও মেলে না। তবে আইলার পর চাল মেলে, মিথ্যি কতা বলবো নেকো সে কারনে আগের একবেলার খাবার দুবেলা খেতে পাইচি এখন। আইলার টাকা পেয়েচি তবে।
- আচ্ছা দাদা যখন জঙ্গলে জেতেন তখন কি বনবিবির পুজো দিত?
- আমাদের তো বনবিবি মানত হয়। সে জঙ্গলের দেশে তাঁর থান আছে, সেখানে মানত করে ছিন্নি বাতাসা চরায়, মোরগ ছেড়ে আসে কতো কি দিয়ে আসে সেখানে। পৌষ মাসের শেষে বনবিবির থানে গিয়ে তাঁর পুঁথি পরে আসে, হিন্দু মুসলমান সবাই সে পুঁথি পরে আসে।
এই আলাপ পর্বে আমাদের মধ্যে থেকে কেউ জানতে চায় আচ্ছা আপনাদের বিয়ে কেমন হয়, দিনের বেলাতে হয়? কি কি হয় আপনাদের বিয়েতে? দেলমোহরটা কি? তুমাদের নাজেরানা বলে কি একটা শব্দ আছে না! তুমি নাজারানা কত পেয়েছিল?’ ইত্যাদি। স্বভাবতই আমার অস্বস্তি হতে শুরু করে, কারণ এ জাতীয় প্রশ্নগুলো ‘অপর’ এর ধারণাকে তীব্রতর করে। তবুও খুব সহজ করেই প্রশ্নগুলো নেওয়া হল, ‘অপর’পক্ষের উত্তরদাতারা গুছিয়ে খুব উৎসাহের সাথে বলে চললেন তাঁদের বিয়ে কেমন হয়।
- দেলমোহর নয় গো, ওটা দিনমোহর।
এই বিয়ের কথা বলতে বলতে ফজিলা দাদির মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা গেল। গলা ভাঙতে শুরু করল, চোখে বিদ্যা নদীর উপচে পড়া পানি সামলে বলল;
- আমাদের সময় একান্ন টাকা দেনমোহর দিতে, এখন মনে হয় তিন হাজার টাকা হয়েচে। তবে আমাদের কালে অনেকে একটা পান দিয়েও সে শোধ দিতে পারতো, তবে মিথ্যে কথা বলবো নেকি, তুমার দাদা সে শোধ করে গিয়েচে।
- তুমার দাদা আমাকে খুব ভালোবাসতো কিনা। উ জংগলে যেতি কিনা সব সময় বলতু কি জানি বলা যায় কি উপরের ইচ্ছা, যদি জংগলে কিছু হয়, সেখেনে আমার পরে একটা দাবি রেখে যাবি; এই দাবিত তোর ইয়ে করে যাই’। সে বলিলো তোরে তো কিছু দেতি পারিনি, এই অভাবের সংসারে; দিনমোহর এর পাওনাটা তোরে শোধ করি দিলাম। তুমাদের দেকাচ্ছি, এখনো সে জিনিস আমার কাছে আচে। পুরনো মানুষ আমি, যত দুঃখ কষ্ট চলে যাক আমার উপুড় দিয়ে; সেটা কিন্তু আমি আজও রেখে দিয়েচি।
দাদি হঠাৎ উঠে পড়লেন, পুরনো ভাঙা টিনের বাক্সের কোণ থেকে একটা জরানো ছোট্ট চিক খুলে বের হল একটা সোনার আংটি, ‘এই দেখো তুমার দাদা আমার লগে গরিয়ে দিয়েলো’।
আংটিখানায় জড়ানো হাতের স্পর্শ মেখে দাদি বলে চলেছে তখন,
- আমাদের আগেকার লোকিরা স্বামীরে চোখির আরে হতি দিতাম না, ভালোবাসার কি একটা জিনিস, ঘরে না আসলি খেতুম না। কান্না স্বরে সেই স্মৃতি নিয়ে ...
তাপসীদি চট করে অসম্ভব দক্ষতায় সামলে নিল দাদিকে, দাদি বলতে শুরু করলেন,
- পড়শি বলত ওই দেখ সতা সতিন ঘরে এয়েচে। মানে উনি কি তা জানো, আর বাবুদের ধানচাল ভাঙ্গার কাজ করতাম এসে বকতে শুরু করতো, তা বলে বকে আবার ভালোবাসত।
- পান খাও দাদি?
- হ্যাঁ ছোটবেলায় দাদি নানিরা খেতে শিখিয়েছেল, আমার ঘরে উনি সব সময় পানসুপারি মশলা সব এনে রাখতো, তবে একটে আরেক কথা বলি, তুমার দাদার সাথে গোসাবা গিয়েচি, এখন তিনি বলচে পরোটা খেলি ভালো হত, আমি বলচি এতো লোকের মাঝে খাবো, সে বলতো আমি খাবো তুই খাবিনে সে হয় নাকি, আমি বলতাম একটা কাগজে করে নিয়ে চল, তাঁর সাথে না খেলে সে একটু রাগ করতো, আমার সাথে না খেয়ে ঘরে নে যাবি।
তারপর এক এক করে দাদার আরও অনেক ঝগড়া, আদরের আরও স্মৃতিকথারা দাদির মধ্যে উথালপাথাল হাওয়াতে মৃদু অনুরণন সমেত চিকন পানি হয়ে বইছে। আর আমরা ফিরে আসছি সেসব ফেলে গ্রামের সীমান্ত পেরিয়ে, তেমাথা পেরিয়ে, পাকুড়তলা ছাড়িয়ে।
আমার পক্ষে হয়তো সে প্রেম বোঝা সম্ভব নয়। হয়তো সেই আংটি হাতে বিধবা ফজিলা দাদির ভেজা চোখ, দাদার প্রতিটা অনুভব অদৃশ্য স্পর্শের মত ছুঁয়ে থাকার মিঠে ব্যথা আমাদের বোঝা সম্ভব হবে না কোনোদিনও। অনেকের কাছে একজন মানুষের দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাঁর স্মৃতি মুছে দিতে পারে না, ফজিলা দাদি তেমন একজন। দাদার লাশ এসেছিলো কিনা জানা নেই। তাঁকে তো জঙ্গল নিয়েছে, সে জঙ্গলে আছে আর সুন্দরবনের মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জঙ্গল। সেখানে যাবার আগে দাদা দাদির কাছে রেখে গেছে দায়িত্ব, সন্তান, অনেক মুহূর্ত যেগুলো তারা একসাথে কাটিয়েছে, আর আংটিখানা। বৃদ্ধার জর্জর হাত আদরের সেই আংটিতে আলতো হাত বুলোয়। এ আংটিসমেত বৃদ্ধা বহুকাল ধরে সব সামলে, গুছিয়ে তাঁর সাধ্যমতো আগলে রেখেছেন। তীব্র অভাবে দিশাহীন হয়ে মানসিক স্থিরতা হারাননি, সব ছেড়ে পালিয়ে যাননি, লোনা জলের প্রতিকূল আবহাওয়াতে মাটির আঁকড়ে আছেন ম্যানগ্রোভের মতো। জোয়ার ভাটায় আলাদা আলাদা ভাবে শ্বাস নেওয়া শিখে নিয়েছেন। আর টিকে আছেন অনেক কথা, স্মৃতি, মুহূর্তের স্রোতের ভিড়ে।
ফজিলা কখনো পাগলি, ফজিলা কখনো প্রেমিকা। আমি ফজিলা নামের মানুষটিকে কোনোদিন ছুঁতে পারিনি। আমি ফজিলা নামের অনুভব, প্রেম, অপেক্ষা, জীবন, লড়াই এসব কিছুকে কোনোদিনও ছুঁতে পারব না। এই বাঁচা, লড়াই, আর সরলতা আমাকে আরও হীন করে তোলে। আর এই মানুষগুলো যেন আমার মাথার মধ্যে ক্রিটিকাল চিন্তন প্রক্রিয়াকে উপহাস করে বসে। আমাদের চিন্তনের বাইরে যে জীবন আছে তা ছুঁতে গেলে সহজ হতে হয়, শিখতে হয়, চলতে হয় অনেক পথ।
Link: https://ebongalap.org/in-conversation-with-fajila-gaji