06-02-2024 10:01:27 am
Link: https://ebongalap.org/in-conversation-with-subarna-singh
কথোপকথনে 'সুন্দরবন বিজয়নগর দিশা'র মেয়েরা
ফিরে যাবার আগের গ্রীষ্মের সঞ্চিত তেজটুকু যখন মাটি শুষে নিচ্ছিল, বিদ্যার উথালপাথাল স্রোত নিয়ে এক সুবিস্তৃত আরশি হয়ে উঠেছিল। বহমান সে আরশিতে সূর্যের কড়া রোদ প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ম্যানগ্রোভের বনাঞ্চলসহ বালি দ্বীপের জনবসতিতে। আর সাথে আছে লোনা হাওয়ার ঝাপটা। এসবের মাঝে দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা সবুজ ক্ষেত, আর মাঝিদের পরিত্যক্ত আসমানি রঙের জালগুলো মেঘ হয়ে যেন মাটিতে পড়ে রয়েছে। অপেক্ষমান রাঙা পাখিগুলো চোখে তখন শান্তি দিয়ে চলেছে, রোদে পুড়ে যাওয়া চোখেদের। হঠাৎ একটি পাখি পানি থেকে ঝুপ করে ছোঁ মেরে একটা দ্বিগুণ প্রায় মাছ উড়িয়ে নিয়ে গেল। অফুরন্ত সৌন্দর্যের সাথে ঝুঁকিপূর্ণ হিংস্রতা ভরপুর। বালি দ্বীপের যে রাস্তা ধরে দিশা অফিসে এলাম, সেই অপূর্ব প্রকৃতির মাঝে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় মোটর ভ্যানের উত্তাল টাল সামলে পাঁজরে হালকা ব্যথা। কেন যেন মনে হল, আচ্ছা সন্তানসম্ভবা প্রসূতি, অসুস্থ রোগী, বৃদ্ধরা কি এই পথে চলতে চলতে এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন? নাকি তাঁরা রাষ্ট্রকৃত অনুন্নয়নের হিংসাকে মাছরাঙা পাখির মতো চোখে-সওয়া-ঘটনা বলে মেনে নিয়েছেন?
এসব মনে হওয়া তো হতেই থাকে আমাদের; তবে সেখানকার মানুষের মনে হওয়াগুলো কেমন? আমরা কীভাবে ছুঁতে পারবো সেগুলোকে? খুব কঠিন খুব কঠিন, আমার মতো বহিরাগতার জন্য তো আরও কঠিন। তবে তাপসীদি, শ্যামলীদি, মৌমিতা, অয়ন্তিকা, সুমনা, অন্নপূর্ণাদের জন্য কাজটা কিছু সহজ। নন্দিতাদি (অধিকারী) সুবর্ণ সিং-কে এনেছেন, দিশার অফিসে। আটপৌরে, মায়ের মতন অনেকটা এই মানুষটা ঘামে ভিজে প্রায় হাঁপাচ্ছেন। তাঁর বাড়ি থেকে দিশা অফিসের দূরত্ব পারাপারে বাইরের তীব্র আলো তাঁর যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে, সুবর্ণদির চোখ ঝাপসা ঘরের আলো চোখে সামলে নিতে নিতে দেখলেন, ঘরভর্তি অনেকে বসে তাঁর অপেক্ষা করছেন। একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঘরের কোনা নিলেন। চুপচাপ সকলকে দেখতে থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ সময়। আমি এগিয়ে যেতেই একটু কুঁকড়ে গিয়ে বললেন, ‘আমি তো কিছুই জানি না, আমি মূর্খ মানুষ, আমার কাছে আপনারা কি জানবেন! আমার কোনো কথা লেখা যায় নাকি আবার?’ সুবর্ণদির হাতটা মুঠোয় নিতে বুঝতে পারলাম তাঁর সাময়িক অবস্থাটা। একটা ঠাণ্ডা হয়ে আসা হাত তাঁর স্নায়বিক অবস্থা কিছুটা হলেও মাপতে সাহায্য করেছিল। আড়ষ্ট স্বরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “আচ্চা বাবু তোমরা কি প্রশ্ন করবে সেগুলো লিখে এনেচ, আমি কি তাঁর উত্তর দিতে পারবো? যদি ভুল কিছু বলে ফেলি...!” স্বভাবতই আমার সাথে সুবর্ণদি যে দূরত্ব তা আমরা এতো কম সময়ে কোনোভাবেই মুছে ফেলতে পারব না। তবুও আমরা একটু একটু করে নানা কথার জাল বুনে একে অপরকে কিছু জানতে জানতে কাছে আসতে থাকি।
মৌমিতার বাড়ি থেকে আসা মধ্যাহ্নভোজন সকলে একসাথে মিলে সারতে সারতে, এই বিষয়টা আরও কিছুটা সহজ হতে শুরু করে। ক্রমে সুবর্ণদি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেন। তাপসীদি, শ্যামলীদি, মৌমিতা, অয়ন্তিকা, সুমনা, অন্নপূর্ণাদের স্বভাবজাত আন্তরিকতা আর সুবর্ণদির সরলতা সবই একটা নতুন আলাপের প্রেক্ষাপট তৈরি করে নিলো। সে ‘আলাপপর্ব’ থেকে উঠে এলো এমন কিছু প্রশ্ন-উত্তর।
আপনার নাম সুবর্ণ সিং কেন?
- তা কি করে বলবো, আমার দাদাশ্বশুরের নাম ছিল গ্যাম্বলার সিং, আমার দাদাশ্বশুররা বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন, আমরা হিন্দুস্থানি থেকে খ্রিস্টান হয়েছি। তবে আমরা বাঙালি খৃষ্টান এখন।
- আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন। কেমন ছিল? আপনি কি করতেন? ভাইবোন ক’জন ছিলেন?
- বাবার বাড়ি গোসাবা। আমরা ১১ ভাই বোন ছিলাম, পাঁচ বোন, ছয় ভাই; আমি ছোটবেলায় কাজকাম করতাম লোকের বাড়ি, কোলকাতাতে, বছরে একবার আসতাম। আর তেমন কিছু বলার নেই ছোটবেলা সম্পর্কে। ছোটবেলায় লোকের বাড়ি কাজকাম করতাম, তারপর বড় হতেই বিয়ে হয়ে গেলো।
- আর কোন স্মৃতি তোমার ছোটবেলা নিয়ে?
- ছোটবেলার কথা, কি আর স্মৃতি? কাজকাম করতাম ওইটুকু।
- যেখানে কাজ করতে কেমন ছিল, তারা কেমন ছিল।
- তাঁরা ভালোই ছিল, বছরে একবার বাড়ি আসতাম, নিয়ে যেতো দিয়ে যেতো। তাঁদের বাড়ি থালাবাসন মাজা ঝাঁট দেওয়ার কাজকাম করতাম।
- বিয়ে হল কত বছরে?
- পনেরো-ষোল বছর বয়সে।
- এখন কত বয়স ?
- (হেসে) আমি তো তা ঠিক বলতে পারছি না।
- বার্ধক্য ভাতা পান?
- বিধবা ভাতা হ্যাঁ।
- বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি সকলেই খ্রিস্টান ছিল?
- হ্যাঁ।
- ছেলে মেয়ে?
- (একটু সময় নিয়ে) চার ছেলে মেয়ে, এক মেয়ে তিন ছেলে।
- তাদের বয়স কেমন?
- তা বয়স কে জানে, বলতে পারবো না।
- সবার বিয়ে হয়ে গেছে?
- হ্যাঁ; না একটা ছেলে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে খোঁড়া হয়ে গিয়েছে। তাকে পায়খানা স্নান সব করাতে হয়, একা কিছু পারে না।
- আপনার স্বামী কবে মারা যান?
- ছোট ছেলের বয়স যখন এক বছর মতো বয়স তখন মারা গিয়েছে।
- ছোট ছেলের বয়স কত এখন?
- দুই ছেলের বাপ, তাঁর বড় ছেলেটা (হাত মেপে) তার এতোখানি।
- এখন আপনি থাকেন কার কাছে?
- ওই খোঁড়া ছেলেটা, আর আমার একটা ননদ আছে তাকে নিয়ে থাকি।
- এখন আপনার কি করে চলে?
- পঙ্গু, হাঁটাচলা করতে পারে না যে ছেলে, তার কাছে থাকি। সাথে একটা পাগলি ননদ থাকে। তিনজনের সংসার আইলার কন্ট্রোলের চালে, ছেলে যে ৬০০ টাকা, আর আমি ৬০০ টাকা করে পাই তাতে চলে যায়। আগে জলে মাছ ধরা যেতো, এখন মাছও তো কমেছে।
- স্বামী মারা যাবার পর কি করে চলতো?
- লোকের বাড়ি আবার কাজকাম করে, নিজের আর সন্তানদের পেট চালাই।
- ক্ষতিপূরণ মেলেনি তো ?
- না; কোন সরকারী টাকা পাইনি, ‘নিষিদ্ধ জায়গাতে’ মাছ ধরতে গিয়েছিলো তো আমার স্বামী। তাই। গল্প করেছে লোকে তাই শুনি, সীমানা পেরিয়ে নিষিদ্ধ বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল, ওখানে বাঁধ উঁচু মাছ বেশী মেলে, তাই ওখানে গিয়েছিল শুনি। নইলে তার কাগজপত্র সবই ছিল, তবু নিষিদ্ধ জায়গা হওয়াতে সরকারী টাকা মেলে নি।
- সুবর্ণদি সুন্দরবনকে কেমন দেখছেন?
- আগের থেকে ভালো, আগে রাস্তায় এক হাঁটু কাদা, এখন গাড়ি চলে। আগের থেকে এখন ভালো, আইলার চালে দু’বেলা হাড়িতে ভাত চড়ে। আগে আরও কষ্ট ছিল।
- আচ্ছা আপনারা আনন্দ করেন, কোন উৎসব?
- হ্যাঁ আগে পুতুলনাচ, যাত্রা দেখতে যেতাম।
- আপনাদের বাড়িতে পুজোটুজো হয়?
- হ্যাঁ যীশুর কীর্তন হয়। শ্বশুর মারা গেলে, স্বামী মারা গেলে যিশুর কীর্তন হয়েছিলো।
- বড়দিনের অনুষ্ঠান হয়?
- গোসাবাতে হয়। বাড়িতে হয় না, না পারলে কি করে করবো বলো?
- যিশুর কীর্তন কেমন হয় একটু শোনাবেন? আমরা যেতে পারি না; আপনি এসেছেন যখন একটু শুনি!
- কীর্তন তো করতে পারি না, ওটা অন্যরা করেন, ওঁদের ভাড়া করে আনতে হয়, আমরা প্রার্থনা করি।
- একটু করেন না!
- (খানিক অপ্রস্তুতি সমেত) ‘যীশু এই সুন্দর জীবনের জন্য ধন্যবাদ জানায়, তোমার আশীর্বাদ আমাদের উপর বর্ষিত হোক’ ...
- এগুলো বাবা মা শিখিয়েছিলেন?
- না ফাদার ; আরেকটা করি? ‘আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি .........’
- আচ্ছা বলছি কি এই যে চারিদিকে অনেক অনুষ্ঠান হয়, আগে হত, এখন হয় এর মধ্যে আপনার কি ভালো লাগে বেশি?
- মনসা পুজো, মনসা গান।
- আচ্ছা আপনারা কি বনে যাবার আগে বনবিবিকে মানেন?
- না আমরা যীশুবাবাকে মানি; বনে যাবার আগে যীশুবাবার প্রার্থনা করে বেরোই।
- আপনার স্বামী যখন বনে যেতেন তখন কি বনবিবির থানে পুজো দিতেন?
- উনি বাইরে কি করত জানবো কি করে? তবে যাবার আগে উনারা প্রার্থনা করে বেরতেন।
- গোসাবার বড় গির্জার ওখানে যে অনুষ্ঠান হয় যান?
- বিল কাটতে এলে দিই, আর এখানে প্রতি রোববার প্রার্থনা হয়, যারা বই পড়তে জানে তারা বাইবেল পাঠ করে। আগে গির্জা থেকে কম্বল, শাড়ী, বাচ্চার খেলনা পাওয়া যেত, এখন পাই না। আর কি বলবো বলো!
- আরও তো কত অনুষ্ঠান হয় গির্জায়, যান না?
- একটা ছেলে এমন অবস্থায়, মন ভালো থাকে না, লোকে বলে মা বেঁচে আছে এখন দেখভাল হচ্ছে, চলে গেলে তাকে কে দেখবে। সবই যিশুর কৃপা। যদি সময় হয় চলে যেতে হবে।
- মেয়ের বিয়ে কোথায় হয়েছে।
- মেয়ের বিয়ে হয়নি, নিজেই করে নিয়েছে। হিন্দুস্থানি ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। ওর বাবা বলেছিল ফিরে আসলে কেটে ফেলবে, মেরে ফেলবে।
- তোমার মেয়ের কথা মনে পড়ে, তোমার সাথে যোগাযোগ হয়নি আর?
- হ্যাঁ মনে পড়ে তো, উনি যাবার পর দু’বার তিনবার গিয়েছিলাম দেখা করে আসতে। বলেছে ছেলে বড় হয়ে গেলে আসবে দেশে।
- আপনি কি মনে করেন, ও চলে গেছে বলে?
- আমার কি মনে হবে, চলে গেছে কাঁদতাম। আমি গেছি তারপর।
- সেজো ছেলে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আপনার কাছে থাকে; তা ননদ আপনার কাছে কেন?
- ওর বে’ দেয়নি। দেখতে একটু খারাপ, আমার শাশুড়ি বলত ‘ও মা দেখতে খারাপ আধা-পাগলী কোথায় বে’দেবো! ঠেঙিয়ে তারে মেরে ফেলে দেবে, আমার পাঁচটা ছেলে, ওকেও আমার ছেলে মনে করব। ননদ আমার বয়সী প্রায়, আমার সাথেই ঘরদোরের কাজ করে।
এই সাক্ষাৎপর্বের প্রশ্নসমূহ অধিকাংশই তাপসীদি, শ্যামলীদি, মৌমিতা, অয়ন্তিকা, সুমনা, অন্নপূর্ণার দিক থেকে আসে। আমি হুটহাট কিছু বোকাবোকা অংশগ্রহণ করেছি মাত্র। তবে সম্পূর্ণ আলাপপর্ব থেকে যেটুকু সুবর্ণদিকে জানতে পেরেছি তা হল অনন্তকাল ধরে এই ‘ভারতে মায়েরা জন্মায়, যাঁদের কোন শৈশব নেই, তাঁরা কাজের মানুষ হয়ে জন্মায়’, কাজ করে সন্তানপালনের সংগ্রাম চালায়, আর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সন্তানের বল হয়ে থেকে যায়। কিন্তু সন্তানদের স্বীকৃতি নিয়ে এই সময়ের প্রেক্ষিতে বেশ কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে।
সুবর্ণদি জানে না তার বয়স কত। সন্তানদের বয়স কত হল। কোনো শৈশব ছিল না সুবর্ণদির, স্মৃতি তো অনেক দূরের কথা। সুবর্ণদির আছে সন্তান প্রতিপালন, পঙ্গু সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখা। বিয়ে না হওয়া ননদের আশ্রয়ের জায়গা হয়ে ওঠা। কিশোরী মেয়ে ভিন রাজ্যে পালিয়ে গেলেও, মমত্বের টানে তাকে খুঁজে তাকে দেখে আসা।
প্রশ্ন করো আবার সুবর্ণদি, তোমার বয়স কতো হল?
উত্তর পাবে ‘অনন্ত’। অনন্তকাল ধরে সুবর্ণদিরা আছেন। মায়ের মতো, নাকি ‘ভারতমায়ের’ মতো? একটু চোখ বুজে ভারতমাতাকে কল্পনা করুন না। কি দেখলেন জানান।
ইদানীং একটা ভারতমাতার মূর্তির পুজো শহরের কিছু কোনে দেখা যায়। উগ্রবাদীদের নির্মাণে সেই ভারতমাতা স্বর্গের দেবী, যিনি ভগবানের মতো আমাদের দেশের ভালোমন্দ দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছেন (কার কাছে, কোথা থেকে জানা নেই) এই ‘ভারতমাতা’ দীর্ঘকেশী গোলাপি কপোল-যুক্তা, সুন্দর শাড়ি পরিহিতা, সোনার অলংকারে ভূষিতা ঝকঝকে মহারানী। এনাকে কিছু প্রতিমা, নাটক, সাহিত্য, আর মূর্খদের অপরিমিত ভাবাবেগের মধ্যে দেখা যায়।
তাহলে সুবর্ণদি কে?
রেশনের চাল না পেয়ে খিদে পেটে মরে যাওয়া শিশুর, গায়ে পেট্রোল দিয়ে প্রশাসনের অফিসের সামনে পুড়তে থাকা মানুষের, ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করা কৃষকের, এমন একবেলা-খেতে-পাওয়া অসংখ্য ভারত সন্তানের মা কেমন দেখতে হবে একটু ভাবুন না। আটপৌরে আমার ভারতমায়ের কথা কতটুকু শোনা আর বলা হয় আমাদের। ক্ষমতা যে ফর্সা সাজুগুজু দেবীর নির্মাণ করেছে সে কি আমাদের মা?
Link: https://ebongalap.org/in-conversation-with-subarna-singh