08-03-2024 19:21:50 pm
Link: https://ebongalap.org/in-europe-with-bodhi
আমি আর বোধি একসঙ্গে বেড়াতে যাবো—একঘরেই থাকবো, তাতে কারো কোনো হেলদোল নেই! কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু পরম সুহৃদরা কেউ কেউ আমাকে বললেন, “বাবাঃ! বোধিকে সামলাতে পারবি তো?” আর বোধিকে নিন্দুকেরা কানে কানে বলল, “শ্রাবস্তী যা ডিফিকাল্ট—একসঙ্গে তিন সপ্তাহ?! পারবি?” শুধু বোধির মা গদগদ হয়ে বললেন- "এমনি ওকে ছাড়তাম না, কিন্তু তুই সঙ্গে আছিস! চিন্তা নেই!" জীবন ঠিক ওঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে একটি মেয়ের হাতে ছেলেকে ছেড়ে দিলে আর চিন্তা নেই! উনি বললেন টাকাপয়সা পাসপোর্ট সব যেন আমার কাছে থাকে—ছেলে হারিয়ে ফেলতে পারে।
প্যারিস শহর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। আমার ইচ্ছে বাসে ট্রেনে করে যাবার কিন্তু সন্ধে হয়েছে এবং প্রথমবার এত লম্বা সফর সেরে বোধির মধ্যে পুরুষসিংহ জেগে উঠল, "না! আমরা ট্যাক্সি করে যাব। প্রয়োজনে এটা আমি আলাদা করে দিয়ে দেব—তোর ফান্ড তোর কাছে রাখ!"
আমরা মমার্তের রু লেপিকে ঝর্ণামাসীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এর দুটো বাড়ি আগেই একটা দরজায় ভ্যান গখ আর থিও গখের নাম লেখা আছে। ঝর্ণামাসী কলকাতায়, কিন্তু আমাদের জন্য প্রতিবেশীকে দিয়ে চাবির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারের আমাদের দেখে কী মনে হলো আমি জানি না- উনি মুলা রুজের সামনে দিয়ে যাবার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তেজিত গলায় আমাদের বলতে থাকলেন- “টু মাচ সেক্স! টু মাচ সেক্স হ্যাপেনিং হিয়ার!’’ বোধি এবারে খুশী—কলকাতা শহরের বন্ধুবান্ধবদের ফেলে একেবারে শশ্মানে এসে পৌঁছয়নি! রাস্তার দু’ধার দিয়ে সুদৃশ্য নরনারী মদিরা পান করতে করতে চলেছেন—এ একেবারে স্বপ্নসম ঠেকল তার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বোধি সিরিয়াস গলায় বলল, "আমাদের কিন্তু একটা জিনিস দেখতে হবে, কেউ যেন আমাদের কাপল ভেবে না বসে।" অতএব মাঝে মধ্যেই ভিড়ের মধ্যে সে "সিস্টার" বলে চিৎকার করে উঠবে স্থির করল!
সিস্টার চিৎকারটি প্রতিধবণিত হ্ল ফ্লোরেন্স-এর ফিয়েশোলেতে—যেখান থেকে সম্পূর্ণ শহরটিকে দেখা যাচ্ছে উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে। এখানে এক কেনেডিয়ান মা মেয়ের সঙ্গে দেখা—মা রোসেলিন আর মেয়ে ক্লারা। রোসেলিন এর বয়েস ৭০ ছাড়িয়েছে—তিনি একটা টি-শার্ট, কেপ্রি আর স্নিকারস পরে দৌড়ে দৌড়ে উঠেছেন—আমি আমার কলকাতায় রেখে আসা সত্তর পেরনো মায়ের হয়ে একটু হিংসে করলাম তাঁকে। আর মেয়ে টাকা জমিয়ে ৩ মাসের ছুটি নিয়ে মায়ের সঙ্গে ইওরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছে বলে নিজের হয়ে হিংসে করলাম। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমাদের পটে গেল। রোসেলিন বোধির ইংরেজী উচ্চারণের এবং তার হাস্যমুখ মিশুকে স্বভাবের প্রশংসা করায় বোধি বুকে বল পেল। ততদিনে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা বোধির একটু মন্দের দিকে যাচ্ছে—ইতিমধ্যে সে স্যান্ডুইচ খাবার প্রতিবাদে আমার কষ্ট করে ভোর চারটেয় ইয়ুথ হস্টেলের কিচেনে গিয়ে আগের দিনের গ্রসারী থেকে কেনা রুটি হ্যাম আর চীজ দিয়ে বানানো স্যান্ডুইচের কী অপমান করেছিল এই ফাঁকে বলে রাখি। ভোর ছ’টায় বেরিয়ে এরোপ্লেন ধরে মাদ্রিদ থেকে বার্সেলোনা হয়ে আমাদের ভিয়েনা যাওয়া। আমি বোধিকে বাধ্য করলাম যে, স্যান্ডুইচ খেতেও হবে এবং সেটাই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে—ভিয়েনা গিয়ে ঠিকঠাক খাবার আবার দেওয়া হবে। বোধি স্যান্ডুইচ খেল কিন্তু বাকী রাস্তা আমার সঙ্গে কোন কথা বলল না। বার্সেলোনায় দু’ ঘন্টা অপেক্ষা করে আবার এগোচ্ছি ভিয়েনার প্লেনের দিকে—আমি বললাম সেই ভোর ৬ টায় একটা স্যান্ডুইচ খেয়েছিস, এখন আরেকটা খা। বোধি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাতে আমি জোর করলাম—তখন বোধি মুখ খুলে আমাকে সকালের স্যান্ডুইচ দর্শন করাল—খায়নি, মুখের মধ্যে পুরে রেখে প্যাসিভ রেজিস্টেন্স দেখাচ্ছে! আমি রাগে, বিস্ময়ে, বিরক্তিতে বাকরুদ্ধ হয়ে তখন থেকে বোধির সঙ্গে প্রায় মৌন অবলম্বন করেছিলাম। ভিয়েনার বাকী গল্প পরে বলছি। রোসেলিনদের কথায় ফেরা যাক। বোধির প্রশংসার পর উনি আমাকে একগাল হেসে বললেন, "ইউ আর লাকি টু হ্যাভ আ হাসব্যান্ড লাইক হিম!" এরই উত্তরে বোধির গগনবিদারী ভগিনী সম্বোধন! আমি বুঝিয়ে বললাম যে, "নানা, আমরা কেবল বন্ধু। স্বামী-স্ত্রী নই আর জীবনে কোনোদিন হবও না! এরকম বন্ধু আমাদের আরও আছে।" এতক্ষণে মেয়ে ক্লারার উৎসাহ হল আমাদের নিয়ে। ক্লারার একটার পর একটা প্রশ্ন- “তোমাদের বাড়ি থেকে একসঙ্গে এভাবে আসতে দিল? হোটেলে একঘরে থাকছ সবাই জানে? শুনেছি ইন্ডিয়া ভারী রক্ষণশীল দেশ—তুমি তো একজন মেয়ে, তোমার সমস্যা হল না?’’ আমি সগর্বে কলার উঁচু করে বললাম, “না হয়নি। আমাদের দেশে আজকাল আর এসব সমস্যা হয় না।’’ রোসেলিন খুশী হলেও ক্লারা একটু সন্দেহের চোখে আমাদের দেখতে থাকল।
সন্ধেয় ফ্লোরেন্স শহরে ফিরে এসে আমরা একসঙ্গে নৈশভোজ করলাম। বোধি শাসিয়ে রেখেছে- একেবারে ভিখিরির মত বাজেট বাজেট করবি না কিন্তু! ওরা যেখানে যাবে, আমরাও সেখানেই খাব! বোধির উৎসাহ মা না মেয়ে কাকে নিয়ে সেটা আমার বোধগম্য হল না। পরে শুনেছি যে কোনো কেউ হলেই হত—নারী পুরুষ যেকোনো কেউ। একা আমার সঙ্গে থাকার থেকে ওকে মুক্ত করার জন্য।
আমাদের হস্টেল এবং রোসেলিনদের হোটেল দুটই কাছাকাছি। বোধি আর রোসেলিন ওয়াইনের খোঁজে গেল—রাতের রসদ তুলবে দুজনেই। আমি স্থানীয় মনিহারী দোকানের পাকিস্তানী ভাই আফরোজের সঙ্গে গপ্পগাছায় মত্ত। আফরোজ আমাকে বলছে, আমি ইন্ডিয়া মানে প্রায় তার দেশের লোক। তাই মেহমানের কাছ থেকে সে জলের পয়সা তো নিতে পারবেই না বরং দুয়েকটা চিপসের প্যাকেট যদি আমি গ্রহণ না করি তাহলে তাকে ব্রাদার বলে ডাকার কোন অধিকারই আমার নেই। অদ্ভুত এক আবেগে আক্রান্ত হই যথারীতি—এক উপমহাদেশের মানুষ হিসেবে—সাত সাগর আর তেরো নদী পেরিয়ে দেশচেতনা সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। আবেগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় একটা গোলমালে। রোসেলিন কাঁদছেন—ক্লারাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও নেই সে। তার ফোন মেসেজবক্সে চলে যাচ্ছে। ক্লারাকে একটু বিরক্ত দেখছিলাম তাই কি সে রাগ করে চলে গেল? বোধির মধ্যে পৌরুষচেতনা জেগে উঠলো। সে বললো আমি যাতে হস্টেলে গিয়ে বিশ্রাম করি আর সে যাবে রোসেলিনের সঙ্গে কন্যা অন্বেষণে। রোসেলিনের কেঁদে উঠলেন, “হায় রে, আমার কী মতি হয়েছিল? কেন তোমাদের সঙ্গে ওয়াইনের দোকানে গেলাম? তখনই রাগ করছিল। কেন শুনলাম না? এখন আমার জামাইকে আমি কী উত্তর দেব? সে তো আমায় শেষ করে দেবে!’’ এক লহমায় মনে দেশ-কাল-জাতি সব মুছে আমি যেন আমাদেরই দেশের এক মা-কে দেখতে পেলাম। মা আর মেয়ে সব দেশে এক! মেয়েদের জাত।
প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা উফিজ্জি, অ্যাকাডেমিয়া, হোটেল, প্লাজা চত্বরে দৌড়ঝাঁপ করার পর রণক্লান্ত বোধি ফিরে এলো—মেয়েটি নাকি একটা পাবে ঢুকে গান শুনছিল, মা আমাদের সঙ্গে ব্যস্ত আছেন তাই আর বলে যায়নি। বোধি মেয়েটিকে খুব তিরস্কার করে এসেছে—তোমার মায়ের বয়েস হয়েছে। তোমার মত একটি যুবতী মেয়ে হঠাত বিদেশবিভুঁইতে এসে হারিয়ে গেলে তার মনের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যায় তা বুঝতে না পারলে আর মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এস না। মা-মেয়ের বাকী মান অভিমানের কথা আর শোনা হয়নি। কিন্তু বোধির মধ্যে একটা পুরুষালি ব্যক্তিত্ব এসেছিল, যেটা বাকী ভ্রমণে বজায় ছিল!
ইওরোপের রাস্তার গল্প অনেক—২০ দিনে ৬ টি দেশ আর ১০-১২ টি শহর। বলে শেষ করা যাবে না। ভিয়েনার গল্প দিয়ে শেষ করব।
সেই যেদিন রুটি মুখে নিয়ে ভিয়েনা পৌঁছনো হল সেদিনই আমি ফ্রয়েডের বাড়ি দেখতে গেলাম আর বোধি নীচে দাঁড়িয়ে রইল—সে আনন্দ করতে বিদেশে এসেছে—তীর্থ ভ্রমণ করতে না। তাই তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা রেস্টুর্যানন্ট-পাব চত্বরে গেলাম। সেখানে বোধি আবিষ্কার করল কলকাতার এক দম্পতিকে। আলাপের সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিল আমরা স্বামী-স্ত্রী নই! তরুণী স্ত্রী খুব রিলিভ্ড- “তাই বলো, তোমাকে দেখতে স্বামী স্বামী নয় ঠিক।” স্বামীটির আমন্ত্রণে আমরা গেলাম তাঁদের হোটেলে। তিনি আর বোধি হুইস্কি পান শুরু করলেন। স্ত্রী মার্টিনি। আমি বীয়র পান এবং দম্পতির পাঁচ বছরের শিশুপুত্রর সঙ্গে খেলাধূলোয় মাতলাম। ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলেছে—বাচ্চা ঘুমিয়ে কাদা। তরুণী স্ত্রী এবং বোধি পরস্পরকে তুইতোকারিতে নেমে এসে নাচানাচি শুরু করেছেন। দেশে এ সুযোগ হয়তো পান না। স্বামী একটু রক্ষণশীল বাড়ির ছেলে, কিন্তু স্ত্রীর প্রতি ভক্তি ভালোবাসা দুটোই অপর্যাপ্ত। তিনি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন, চোখের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে কিছু। আমি হাসলাম, চিন্তা কোরো না- বোধি খুব হার্মলেস। মেয়েরা ওকে পছন্দ করে। অবশেষে সেই মেয়ে আর বোধি যখন পরস্পরের সঙ্গে আমোদছলে কে কত গালাগালি জানে এই প্রতিযোগিতায় নামল তখন বাধ্য হয়ে আমি আবার অভিভাবকীয় ব্যক্তিত্বে ফেরত এলাম। আমার চোখের ইশারায় স্বামী মানুষটি হোটেলে ফোন করে একটি ট্যাক্সি ডেকে দিলেন।
রাত তখন দেড়টা, বোধিকে হিড়হিড় করে টেনে তোলা হল ট্যাক্সিতে। ভিয়েনার রাস্তাঘাট শুনশান। হঠাৎ মাঝরাস্তায় মত্ত বোধি ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে যাবেই! আমার ধমক ধামকে আর কাজ হচ্ছে না! বোধি বলে চলেছে, "আমার বয়েস চল্লিশের বেশি! নিজের টাকায় বেড়াতে এসেছি- আমি নামবই!" ট্যাক্সিওয়ালা চাপা স্বরে বললেন ভাঙা ইংরেজীতে যে চিন্তা নেই, আমার স্বামী বেয়াদপি করছেন দেখে উনি চাইল্ড লক করে দিয়েছেন। আমি ওঁর প্রত্যুতপন্নমতিত্বে বিমোহিত। কিন্তু ট্যাক্সি থামার সঙ্গে সঙ্গে বোধি অন্ধকার রাস্তার তীরবেগে পলায়ন করল। আমি সম্পূর্ন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পরের দিন আমাদের প্রাগ যাত্রা। সব টিকিট কাটা আছে। আমি নিশ্চিত যে বোধিকে পুলিশে ধরবেই। ওর কাছে পাসপোর্ট নেই। টাকা নেই। বোধও নেই। পুলিশে না ধরলে ও হাসপাতালে যাবে- দ্রুতগামী কিছু গাড়ি চলাফেরা করছে রাস্তায়। আর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ডাকতে থাকলাম, “বোধি!!!” কোন সাড়া নেই। আমি দরদর করে ঘামছি, কী হবে জানিনা। এইসময় পকেটে আমার ফোন বেজে উঠল- বোধির কাছে যে একটা ফোন আছে সেটা ভুলে গেছিলাম- আমি আকুল হয়ে বললাম ফিরে আয়! বোধি জানাল, সে ফিরবে না। কাল রেল স্টেশনে পৌঁছে যাবে। এখন সে নাইট ক্লাবে আনন্দ করতে যাবেই। আমি রাগ দুঃখ অভিমান কিছু দেখিয়েই কোনো লাভ হচ্ছে না! সহসা আমার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ খেলে গেলো! বাঙালী পুরুষ এক জায়গায় ঠান্ডা! আমি বললাম- “যা তুই। তোর মাকে জানিয়ে দিচ্ছি যে তুই আমার সঙ্গে আর নেই!’’ এক মিনিট নিঃস্তব্ধতা। তারপর শান্ত গলা, “আমাদের মধ্যে মা-কে টানার কোন প্রয়োজন নেই! উনি ঘুমোচ্ছেন।’’ আমি বললাম- “আমার দেখার দরকার নেই কে ঘুমোচ্ছেন! আমি ফোন করছি!” বলেই ফোন কেটে দিয়েছি। অন্ধকার ফুঁড়ে বোধিসত্ত্ব উদয় হলেন! এবং সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লেন।
বোধির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিনই এক প্রতিজ্ঞা করেছি—বিদেশ হোক বা জীবন, কোনো সফরেই আর কোনো পুরুষসঙ্গী কভি নেহি!
পুনশ্চ- বোধির উৎসাহেই এই কাহিনী লিপিবদ্ধ হল। আর সে নাকি ঠিক করেছে আমি না নিয়ে গেলে সে আর কোনো বিদেশভ্রমণ করবেই না!
Link: https://ebongalap.org/in-europe-with-bodhi