24-05-2024 08:30:19 am

print

 
Ebong Alap / এবং আলাপ

এবং আলাপ

জেন্ডার | সমাজ | নাগরিকত্ব

Ebong Alap

Gender | Society | Citizenship

 

একটি আবাসিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় থেকে বলছি


Ajay Das
https://ebongalap.org/author/ajay-das/
July 06, 2021
 

Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-ajay

করোনার প্রথম তরঙ্গের সময় একটা ঘটনায় চমকে গিয়েছিলাম। একটি এটিএমের সামনে লম্বা লাইন। ক্রাচে ভর করে এক ভদ্রলোক এটিএম থেকে বের হলেন। সামনেই খাড়াই সিঁড়ি। একটু সাহায্যের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। লাইনে দাঁড়ানো সামনের ভদ্রলোক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়েও থমকে গেলেন। হাতের স্পর্শ! যদি কিছু হয়ে যায়!

করোনা যে মানুষের শরীরে-মনে আঘাত হেনেছে তাই নয়, চিরায়ত মূল্যবোধের মূলেও আঘাত হেনেছে। আর এই আঘাতে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় যেসব মানুষ কিছুটা অপূর্ণতা নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল, আর সেই লড়াইয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার পরিবার, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধু-বান্ধব সহকর্মীরা থেকে সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, সেখানেও আঘাত হেনেছে এই ভাইরাসজনিত ত্রাস। আর শিশুদের ক্ষেত্রে শুধু যে শিক্ষার উপর প্রভাব ফেলেছে তাই নয়, তাদের মানসিক বিকাশেও গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রযুক্তি আর পিআর গ্রুপের সহযোগিতায় এই সমস্যা কিছু শিশু কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছে।

আনন্দ ভবন ডেফ এন্ড ব্লাইন্ড স্কুল, উলুবেড়িয়া, হাওড়া

আশি জন দৃষ্টিহীন ও মূক-বধির শিক্ষার্থী নিয়ে আমাদের আবাসিক বিদ্যালয় আনন্দ ভবন ডেফ এন্ড ব্লাইন্ড স্কুল। আমি তার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। আর পাঁচটা সাধারণ বিদ্যালয়ের থেকে আবাসিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের অনেক পার্থক্য। সাধারণ বিদ্যালয়ের কর্মকান্ড দশটা-পাঁচটার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আবাসিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়ে এক একটি শিশু বারো মাসের মধ্যে প্রায় দশ মাস বিদ্যালয়ে থাকে। ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দীর্ঘ দেড় বছর লকডাউনে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিয়োগব্যাথা তাই অনেক বেশি গভীর। শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে অনেকটা সন্তানকে ছেড়ে থাকার মতো। অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে অসহায় ভাবে প্রানপ্রিয় সাথীদের ছেড়ে, শিক্ষক শিক্ষিকাদের ছেড়ে এই শিশুরাও ভালো নেই। তবু নানান কাজে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। আর বিশাল প্রাঙ্গণকে মনে হয় এক হিংসুটে দৈত্যের বাগান, যা অপেক্ষা করে আছে এক করোনা মুক্ত বসন্তের।

একজন সাধারণ শিশু যখন 'অ' বর্ণের সাথে পরিচিত হয়, তখন অজগর সাপের ছবি দেখতে দেখতে বর্ণপরিচয় ঘটে তার। কিন্তু একজন দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীর অন্ধকারময় জগতে শিক্ষা পদ্ধতি অনেকটাই স্পর্শ-নির্ভর। সমস্ত জগতটাকে স্পর্শের মধ্যে নিয়ে আসতে না পারলে তার বিষয়বস্তুর ধারণাই  অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর আজকের পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞা সেই স্পর্শের উপরেই। এই সমস্ত শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত আবাসিক বিশেষ বিদ্যালয়গুলি তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে। ধাপে ধাপে লকডাউনে দীর্ঘ সময় ধরে সেগুলো বন্ধ। আর বলাই বাহুল্য, আমাদের মত দেশে অন্তত এই শিশুদের বিশেষ চাহিদাগুলো অভিভাবক, গৃহশিক্ষক বা অনলাইনে কোনভাবেই সম্ভব নয়।

অন্যদিকে আমাদের দেশে শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম সাঙ্কেতিক ভাষা এবং ওষ্ঠপাঠ(লিপ রিডিং)। করোনাকালে মাস্ক বাধ্যতামূলক হওয়ার ফলে এদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ব্যাহত হচ্ছে তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগের ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একই ভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী, সেরিব্রাল পলসি, পেশীজনিত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশু যাদের প্রতিনিয়ত ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন, কোভিডের সামাজিক দূরত্ববিধির ফলে তা সম্ভব হচ্ছে না। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি যা লকডাউন উঠলেও পূরণ করা আর সম্ভব হবে না।

সাধারণ বিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব হলেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা প্রত্যন্ত অঞ্চলের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এই শিশুদের কাছে অনলাইন ক্লাসের প্রযুক্তি বা আরও স্পষ্ট করে বললে স্মার্টফোন ও নেট সংযোগের সামর্থ্য নেই। তবু কথা হয়। প্রায় প্রতিদিনই। কখনও কখনও ভয়েস কলে, কখনো বা সাঙ্কেতিক ভাষায়। ভাষাহীন, দৃষ্টি-প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুদের অবস্থা বড় করুণ। পড়াশোনা নেই, নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে তারা। আমরাও কী এক অমোঘ আকর্ষণে প্রতিদিন স্কুলে যাই। কখনও কখনও নিজেদের মনে হয় ‘জলসাঘর’-এর ছবি বিশ্বাস।

স্মার্টফোনের স্ট্যাটাসে দেখলাম জিয়ার বিয়ের ছবি। জিয়ার বাবা ঘাড় থেকে প্রতিবন্ধী মেয়ের 'বোঝা' নামিয়েছে!

একদিন দুপুরে হঠাৎ দেখি বীরভূমের নলহাটি থেকে পঞ্চম শ্রেণীর রকবুল তার বাবাকে নিয়ে হাজির। বাবার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘স্যার, ছেলে স্কুলে আসার জন্য আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আর পারলাম না তাই একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে এলাম’। সেদিন রাতে হস্টেলে রকবুলরা থাকতে বাধ্য হল, কারণ নলহাটি ফিরে যাবার মতো আর সময় নেই। প্রতিদিন অভিভাবকদের ফোনে আকুল আবেদন, স্কুল কবে খুলবে?

আসলে আমরাও তো স্কুল খোলার জন্য ওঁদের মতই ব্যাকুল। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠার ঘন্টা পড়ত। তারপর ছটায় প্রার্থনার, টিফিনের, স্নানের, মধ্যাহ্নের, ক্লাসের, আবার টিফিন, খেলা থেকে ওঠার, আর শেষ ঘন্টা পড়ত রাত ন’টায়—ডিনারের ঘন্টা। সদামুখর সেই ঘন্টাটা ঘরের এককোণে নীরবে নিঃশব্দে পড়ে আছে। অভিভাবকদের ফোনে ছেলেদের দুষ্টুমির নালিশ—‘স্যার, আর পারছি না। আপনি একটু বকে দিন’। কপট গাম্ভীর্যে ছাত্রকে ফোনেই বকাবকি করে দিয়ে মনে মনে ভাবি, আপনি একটা সন্তানে অতিষ্ঠ আর আমরা আশিটা সন্তানকে সামলাই! তবু সেই দুষ্টুমি, ক্ষণে ক্ষণে নালিশ—যেগুলোতে অতিষ্ঠ লাগত—আজ দেড় বছর ধরে লকডাউনে উপলব্ধি করতে পারছি সে কত সুখের ছিল। স্কুলের বিশাল প্রাঙ্গনে অসংখ্য আম, জাম, জামরুল, পেয়ারা ভরে আছে। রামপুরহাট থেকে তসিরউদ্দিনের কিম্বা  পুরুলিয়ার কৈলাসপতির ফোন,

-স্যার, গাছে আম জাম হয়েছে?

-হ্যাঁরে প্রচুর, ডাল ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, হনুমানে আর পাখিতে খাচ্ছে।

-স্যার, আপনার আশিটা হনুমান এবার খেতে পেল না বলুন?

খিল খিল করে হাসতে থাকে তসিরউদ্দিন। এই হাসিটা শোনার জন্যই গত দেড় বছর তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে মন।

লকডাউনে যে শুধু হাসি হারিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক কান্না। পূর্ব বর্ধমান থেকে জিয়ার বাবার ফোন, স্যার জিয়াকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিতে হবে। বাড়ির কাছের স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করাবো। বললাম, আপনার যখন ইচ্ছা তখন তাই হবে, চলে আসুন। জিয়ার বাবা এসে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে গেলেন। এক সপ্তাহ পর ওদের স্মার্টফোনের স্ট্যাটাসে দেখলাম জিয়ার বিয়ের ছবি। জিয়ার বাবা ঘাড় থেকে প্রতিবন্ধী মেয়ের 'বোঝা' নামিয়েছে!

হারিয়ে গেছে জিয়ার ‘দিদিমণি’ হবার স্বপ্ন। লকডাউনে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য জিয়ার স্বপ্ন। আশঙ্কা হয়, পৃথিবীর অসুখ ভালো হবার পর এই সব জিয়া, সাজিলা, সুমিত্রা, কিস্কুদের মনে স্বপ্নের বীজ নতুন করে আবার রোপণ করতে পারব তো?

Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-ajay

print

 

© and ® by Ebong Alap, 2013-24