04-06-2024 12:31:15 pm

print

 
Ebong Alap / এবং আলাপ

এবং আলাপ

জেন্ডার | সমাজ | নাগরিকত্ব

Ebong Alap

Gender | Society | Citizenship

 

স্কুলের সময়টুকুই ছিল ওদের জিয়নকাঠি


Chandra Sadhu
https://ebongalap.org/author/chandra-sadhu/
July 06, 2021
 

Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-chandra

অবসরে এরা গল্পের বই হাতে পায়না, সামান্য রঙপেন্সিল দিয়ে মনের ভাবনাকে রাঙিয়ে তোলাটাও এদের কাছে বিলাসিতা। সকালে ওদের বড়ি শুকোতে দিয়ে স্কুলে আসতে হয়। আবার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বড়ি প্যাকিং

এক অতি সাধারণ প্রান্তিক স্কুলে পড়াই। অবস্থানগতভাবে এলাকাটি প্রান্তিক না হলেও স্কুলের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই ছিন্নমূল শরণার্থী পরিবারভুক্ত। অধুনা এদের একটা বড় অংশ বড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাই রামপ্রসাদ সেনের স্মৃতিধন্য হালিসহরে স্কুলটি অবস্থিত হলেও ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু অঞ্চলটির সামান্যতম উন্নয়নকেও ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। এহেন সামাজিক পরিসর থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েগুলোর কাছে মালঞ্চ স্কুল একটু আকাশ, একটু প্রাণের আরাম। আর পাঁচটা স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মতো রঙিন শৈশব এদের নেই। অবসরে এরা গল্পের বই হাতে পায়না, সামান্য রঙপেন্সিল দিয়ে মনের ভাবনাকে রাঙিয়ে তোলাটাও এদের কাছে বিলাসিতা। সকালে ওদের বড়ি শুকোতে দিয়ে স্কুলে আসতে হয়। আবার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বড়ি প্যাকিং বা ডাল বাটা-র কাজ করতে হয়। তাই স্কুলের সময়টুকুই ওদের কাছে জিয়নকাঠি। এখানে এলেই তো ওরা পড়াশোনা, নাচ-গান, ছবি আঁকা, লাইব্রেরি ক্লাসে গল্পের বই পড়ার সুযোগ পায়। আমার ছাত্রী দশম শ্রেণির কবিতা বলত,

-‘ম্যাডাম, একদিনও স্কুল কামাই করতে ইচ্ছে করেনা। জানেন তো, বাড়ি থাকলেই শুধু একের পর এক কাজ করতে হয়। তাই আমার স্কুলই ভালো।’

কবিতাকে সত্যিই ঝড়, তুফান, বৃষ্টি, বনধ্ উপেক্ষা করেই রোজ স্কুলে আসতে দেখেছি। সর্বোচ্চ উপস্থিতির জন্য স্কুলের তরফ থেকে ওকে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। কিন্তু সেসব এখন ক্রমশ: গল্প হয়ে যাচ্ছে। প্রায় বছর দেড়েক এই অতিমারী তাদের ঘরবন্দি করে রেখেছে। আমরা যদিওবা মিড ডে মিল দিতে বা অন্যান্য কাজে বিভিন্ন সময়ে স্কুলের মুখ দেখেছি, ক্লাস ফাইভ থেকে এইট—এই ছেলেমেয়েরা তাদের প্রিয় স্কুলের স্মৃতি, বন্ধুবান্ধব সবই একটু একটু করে ভুলতে বসেছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের বিষয়ে যা বললাম তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এইধরনের স্কুলে অনলাইন টিচিং অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অতিমারীর কোপে আমরা সকলেই বুঝতে পেরেছি, শিক্ষার চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। প্রাণে বাঁচলে তবেই তো শিক্ষা! সেই প্রাণধারণের তাগিদে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখন দশ, এগারো কী বারো বছর বয়স থেকে সংসারের হাল ধরতে ব্যস্ত। দিনের পর দিন লকডাউন ওদের বাবা-মায়ের রোজগারে থাবা বসিয়েছে।  আর এই প্রসঙ্গেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে ছাত্রদের কথা ভাবাচ্ছে।

একরকম বাধ্য হয়েই সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া বয়:সন্ধির ছেলেগুলো সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতে স্থানীয় ছোট ছোট কারখানা বা কুটিরশিল্পের সস্তা শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। এদের আর শিক্ষাঙ্গনে ফেরা হবেনা জানি। তবে আরও বেশি চিন্তার বিষয় যেটা, এইসব ছেলেগুলো কারখানায় কাজ করতে গিয়ে তাদের চেয়ে বেশি বয়সী দাদা বা কাকাদের দেখাদেখি কাজের ফাঁকে বিশ্রামের অছিলায় একটু একটু করে বিভিন্ন তামাকজাত দ্রব্যের নেশায় বুঁদ হয়ে উঠছে।

সেদিন ফোনে কথা হচ্ছিল গ্রামেরই এক বিজ্ঞানকর্মী ত্রিদিবদার সাথে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে নিঃস্বার্থভাবে এই অঞ্চলের মানুষদের জন্য নানারকম সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। উনি স্থানীয় হওয়ার সুবাদে এবং এলাকাটিকে খুব ভালো চেনেন বলে আমাদের ছেলেমেয়েদের আর্থসামাজিক, মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। ত্রিদিবদার সঙ্গে সেই কথোপকথনেরই কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি এখানে।

ত্রিদিবদাকে জিজ্ঞেস করলাম,  আপনি তো আপনার কাজের জন্য গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করেন, আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর গতিপ্রকৃতি কেমন বুঝছেন?

-ম্যাডাম, আমি নাম ধরে ঠিক বলতে পারছিনা, তবে ওরা একেবারেই পড়াশোনা বিমুখ হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ওদের বাবা-মায়েরা অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে, বরং পরিবারের অর্থসংস্থানে ওদের কাজে লাগাতে চাইছে।

ধরে নিন, চল্লিশ থেকে ষাট শতাংশ ছেলে আর স্কুলে ফিরবে না।

এতো খুব একটা অজানা কিছু না। আসলে পেটে ভাত না থাকলে তো সত্যিই পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি বলে মনে হবে। ত্রিদিবদাকে বললাম, আচ্ছা আমাদের ছেলেগুলোর কী অবস্থা? এই সব কেটে গেলে ওদের ফিরে পাবো তো?

-ধরে নিন, চল্লিশ থেকে ষাট শতাংশ ছেলে আর স্কুলে ফিরবে না। এরা দীর্ঘদিন স্কুলের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত থাকায়, আর্থসামাজিক সর্বোপরি যে মানসিক দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে অধিকাংশই বিপথগামী হচ্ছে। মাঝেমাঝে তো ওদের প্রকাশ্যেই স্মোক করতে দেখি, আমাকে দেখে কেউ লজ্জায় মুখ লুকোয়, আবার কেউ সেটুকুরও প্রয়োজন মনে করেনা। এইতো সেদিন একটা ছেলেকে দেখলাম রেললাইনের ওপারে রেলের ইয়ার্ডের ফাঁকা জমিতে ডেনড্রাইট শুঁকছে। আমাকে দেখেই ছুটে পালালো। ওর কিছু সহপাঠীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি ও এমন করছে।

স্কুলের ছাত্ররা কেউ বাইরে কাজে যাচ্ছে, কেউ নেশার ফাঁদে পড়ছে, আর যাদের হাতের নাগালে আছে ইণ্টারনেট বা স্মার্টফোন, তারা জড়িয়ে পড়ছে আরেক অন্য বিপদের জালে।

সমস্যা শুধু এই একটা নয়। স্কুলের ছাত্ররা কেউ বাইরে কাজে যাচ্ছে, কেউ নেশার ফাঁদে পড়ছে, আর যাদের হাতের নাগালে আছে ইণ্টারনেট বা স্মার্টফোন, তারা জড়িয়ে পড়ছে আরেক অন্য বিপদের জালে। কিছু ছাত্রী মারফত খবর পেয়েছি অনলাইন ক্লাসের নামে চালিয়ে অনেকেই ক্লাসের সময়ে মোবাইল নিয়ে নানারকম গেম যেমন পাবজি বা ফ্রি-ফায়ারে মেতে উঠছে। ত্রিদিবদা আমার আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিলেন, বললেন

-হ্যাঁ সেটাতো আছেই, তাছাড়া মোবাইল পেয়ে কিছু ছেলে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে

ক্লাসের নাম করে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে সেগুলো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা, তাই নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠছে। এককথায় ওদের শৈশব-কৈশোর অতল অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে ম্যাডাম।

আসলে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ফোন ও ইণ্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাস নিতে উদ্যোগী হলেও সেভাবে ছাত্রছাত্রীদের পাওয়া যায়না স্বাভাবিক কারণেই। অভিভাবকদেরও এব্যাপারে জানানোর বা অভিযোগ করার কিছু থাকে না। মিড ডে মিল দেওয়ার দিনগুলোতে ছেলেমেয়েদের খবর জানতে চাইলে বাবা-মায়েরা আজকাল আর সবসময় সত্যিটা বলেনই না। বরং ত্রিদিবদাকে বললাম, আপনি এবং অন্যান্য স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে মিলে যদি আমরা কিছু করতে পারি, এমন ভাবা যায় কী না। হয়ত খুব সামান্য হলেও পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতেও পারে।

ত্রিদিবদা এককথায় রাজি। বললেন, আমরা এই অতিমারীর সময়ে সবাইকে একসাথে করতে পারব কিনা জানিনা ঠিকই, কিন্তু ছোট ছোট দলে ভাগ করে কিছু সৃষ্টিশীল কাজে ওদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা তো করতেই পারি।

ব্যর্থতা আমাদের। আমরা তো উদয়ন পন্ডিত হয়ে উঠতে পারলাম না।

সত্যি কথা বলতে কী, ধাপে ধাপে লকডাউন ও দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায়, ছাত্রীদের জন্যই চিন্তা বেশি হচ্ছিল। অনেক মেয়ের পরিবার থেকেই বিয়ের জন্য চাপ আসবে, অনেকের বিয়ে হয়ে যাবে, ফলত মেয়েদের একটা বড় অংশকে আমরা হারাব, এই আশঙ্কায় দিন গুনছিলাম। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ছেলেদের মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো প্রতিদিন ফুটে উঠছে, সেদিক থেকে স্কুলছুটের তালিকায় বয়ঃসন্ধির ছাত্রদের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও নতুন করে ভাবনার জট পাকিয়ে উঠছে। ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের দুষ্টচক্রে, স্কুলের আকাশটুকু থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়ে, অভাব-অনটনে পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেভাবে এরা ক্লিষ্ট হচ্ছে, অনেক অনেক পিছিয়ে পড়ছে প্রতিদিন, সেই লজ্জা শিক্ষক হিসেবে আমারও। এর দায় থেকে ব্যক্তি আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারিনা। তবে প্রশাসন কেন এতটা নির্বিকার? এই ঘুণ ধরা সমাজের ফসল হিসেবে এইসব ছেলেরাই কি একদিন হয়ে উঠবে তথাকথিত নেতা-নেত্রীর মূর্খ স্তাবকমাত্র? যারা নিজেদের অধিকারটুকু আদায়ের স্বপ্ন দেখতেই অপারগ। অধিকারের লড়াই শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দেওয়ার জন্যই এই হীরক রাজার দেশের সরকার-প্রশাসনের না-বলা বীজমন্ত্র বুঝি ‘এরা যত বেশি পরে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।’

ব্যর্থতা আমাদের। আমরা তো উদয়ন পন্ডিত হয়ে উঠতে পারলাম না। আমাদের হাতে রয়েছে নানা বিধিনিষেধের হাতকড়া। একটা নির্দেশ অমান্য করলেই আসবে তলব। নিজেদের সাজানো বাগানকে এভাবে শুকিয়ে যেতে দেখে মন ভারি হওয়া ছাড়া আর কি কিছুই করতে পারবনা? জানিনা আবার কবে সুদিন আসবে, কবে আমার স্কুলের মালঞ্চ নামটা সার্থক হবে।

Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-chandra

print

 

© and ® by Ebong Alap, 2013-24