04-06-2024 12:30:34 pm
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-jinat
শোনা যায় ফিনল্যান্ডে এক জোর ভূমিকম্প হয়েছিল একবার। তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে বন্ধ ছিল স্কুল কলেজের পড়াশোনা। সেই জন্য তড়িঘড়ি আহ্বান করা হয়েছিল ন্যাশনাল সেমিনার। তার ভিত্তিতে দ্রুত তৈরি হয়েছিল নানারকম এডুকেশনাল টুল। ছাত্রদের কাছে পৌঁছতেই হবে। কেননা বিদ্যালয়েই রয়েছে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। নেশন বিল্ডিং-এর যাবতীয় উপাদান। সারা দেশের সম্পদই বিদ্যালয়ের উঠোনে। কিন্তু আমাদের দেশের রাকিব,ইমনরা অত ভাগ্যবান নয়। প্রায় দেড় বছর বিদ্যালয়ে আসতেই পারল না ছেলেগুলো, কিন্তু এদের সকলের হাতে না আছে কোনও টুল, না আছে শিক্ষাবিদদের ভিডিও স্পিচ। আছে শুধু অনিশ্চয়তা আর ভয়ের এক বাতাবরণ! যদি পরীক্ষা হয় তবে? পড়া তো হয়নি! আর যদি না হয় তবে? পরের ক্লাসে কী করে জায়গা হবে?
এখন আর বই খোলে না। মাঝে মাঝে স্নানও করে না। সারাদিন কানে একটি হেডফোন। বলে, ক্লাস চলছে।
রাকিব সেখ। এখন অষ্টম। সপ্তমের সিলেবাসটাই জানা হয়নি। কোভিড-১৯ এর দাপটে বদলে গেছে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার। পরীক্ষা ছাড়াই নতুন ক্লাস। ভর্তি হয়েছে। বইও নিয়েছে। স্কুলের মুখটাই দেখা হয়নি। মায়ের দাবি—‘বই এনেছি। মাষ্টারও দিয়েছি। কিন্তু এখন আর বই খোলে না। মাঝে মাঝে স্নানও করে না। সারাদিন কানে একটি হেডফোন। বলে, ক্লাস চলছে। কখনও বলে প্রাইভেট মাষ্টার, কখনও স্কুলের স্যার।‘
মিলন দাস। সারাদিন ঘর থেকে বেরোয় না। কী করছে জিজ্ঞাসায় উত্তর আসে, ‘পড়ছি। মোবাইলে সব হয়। পড়াশোনাও।‘
কোভিড -১৯ এর প্রথম প্রবাহ ছাত্রদের জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের মেরুদন্ডটি—মানে বই খুলে পড়াশোনার অভ্যাস। বিকল্প পদ্ধতি অনলাইনের সুযোগ যারা পেয়েছে, তারা যে বেজায় খুশি, এমনটাও নয়। শিক্ষক-ছাত্র দূরত্বে ছাত্ররা অনেকেই বিব্রত। ই–লার্নিং এর একটা অস্বস্তি ছাত্রদের তাড়া করছেই। স্বাভাবিক বিদ্যালয় যাপনের দিনে ফেরার ইচ্ছা লালন করেই চলেছে তারা। কোভিডের দ্বিতীয় প্রবাহ ছাত্রদের পরীক্ষার চাপে পড়ার ভয় থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। স্কুলে ফেরার তাড়াটাও উধাও হচ্ছে। আবার ‘তোদের স্কুল খুলছে না’ এই ব্যঙ্গে আর মনটাও টনটন করছে না এতদিনে। কিন্তু সাত থেকে বারো এই বয়সের বাচ্চাদের উপর গভীর একটা মানসিক ধাক্কা দিয়েছে বন্ধ স্কুলের দরজা।
টিফিনের ঘণ্টা, ফুচকা, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম সব কিছুর জন্যই ইমনের চোখে জল ভরে আসে।মাথা নীচু করে বলে, ‘আমি প্রতিদিন ঠিক দশটার সময় ছাদে গিয়ে একা একা জাতীয় সংগীত গায়। কেউ জানে না।'
প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক বন্ধ। আশা ছিল, এক বছর পরে খুলেই যাবে। নবমের দাদাদের জন্য খুলেও ছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সেটুকুও কেড়ে নিল।
পঞ্চমের বাচ্চাটার হাইস্কুলের নতুন পোশাক, টাই,মনিটরের ব্যাজটাও পড়ে রইল। টিফিন বক্স ও ব্যাগ টেবিলে অপেক্ষমান। মাত্র ক’দিনের স্মৃতি হাতড়ে মন কেমন করত তার।
ইমন সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের খুদে এক ছাত্র। সে চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখছে রাস্তায় জনসমুদ্র। পাড়ায় ভোটের প্রচার। সার বেঁধে বড় দাদাদের রাস্তায় আড্ডা। মানুষের বাজার-হাট। উৎসব, আনন্দ, পুজো, বিয়ে, অন্নপ্রাশন—এলাকায় সব চলছে নাগাড়ে। এমনকী দাদারা টিউশনিতেও যাচ্ছে। শুধু স্কুলের দরজাটাই মুখের উপর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই অনুভব দেশের হাজার ইমনের। যাদের মুখে ভাষা নেই। কিন্তু মন খারাপ করা দুপুর আর যন্ত্রণার সকাল আছে। ফার্স্ট বেঞ্চে বসার জন্য নটার ভোঁ-পু বাজতেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। বন্ধ গেটের সামনে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করা। জাতীয় সঙ্গীতের পর প্রথম ক্লাস। স্যারের কাছে অফিসঘর থেকে চক ডাস্টার নিয়ে আসার আবদার। টিফিনের ঘণ্টা, ফুচকা, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম সব কিছুর জন্যই ইমনের চোখে জল ভরে আসে।মাথা নীচু করে বলে, ‘আমি প্রতিদিন ঠিক দশটার সময় ছাদে গিয়ে একা একা জাতীয় সংগীত গায়। কেউ জানে না।'
দেশের সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে। বাবা-মায়ের ঘুম ছুটেছে। কিন্তু দেশ বিচলিত নয়। কোভিড-২ এ পৌঁছেও ছাত্রদের নিয়ে আলাদা কোনও পরিকল্পনা নেই।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছাত্রদের মধ্যে সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। যারা স্কুলে পৌঁছেও আবার গৃহবন্দী হল সেই নবম–দ্বাদশ দেখছে মাস্ক পরার জন্য বিদ্যালয় নিয়ম শেখাচ্ছে। সরকারি নিয়ম পালনের নির্দেশ দিচ্ছে। সেই সরকারেরই একাংশ অনায়াসেই নিয়মের বাইরে পড়ে রয়েছে। সে ছাত্রটি সংবিধান, সংসদ ও নির্বাচন পড়ছে। সে আশ্চর্য হয়ে দেখছে কত গরমিল! যে গণতন্ত্রের কথা শিখছে বই পড়ে তার সঙ্গে বাস্তব যে মেলে না! দ্বিতীয় দফায় একের পর এক পরীক্ষা বাতিলের খবর। কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তে ছাত্ররা বেজায় খুশি, এমনটাই প্রচার। মিষ্টির অর্ডার মিলেছে অ্যাপ নির্ভর ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের। ধরে নেওয়া হয়েছে ব্যাক বেঞ্চাররাই এই সেলিব্রেশনে মেতেছে। আগে ভালো করে পাশ করলে মিষ্টির অর্ডার মিলত। এখন পরীক্ষা বাতিল হলে। কিন্তু কথা হল এই সেলিব্রেশনের মূল কী? ছাত্ররা কী চায়? সেটা তাদের মুখ থেকে শোনার সময় এসেছে।
দেখা যাচ্ছে, অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি গাইডলাইন মেনে নেওয়া হয়নি । ফলে সীমিত আদানপ্রদান ও অসম্পাদিত সময়ের টানাপোড়েন ছাত্রদের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারেনি। ডিজিট্যাল স্কিল সেটের ব্যাপারেও ছাত্র-শিক্ষকের ষ্ট্রাকচারাল অদক্ষতা রয়ে গেছে। আগ্রহের জায়গাটাও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। স্থায়ীভাবে বদলেছে সেলফ স্টাডির সময়। ঘুমানোর সময়। ৭-১৭ বছরের বাচ্চারা সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় অনলাইন ক্লাসে ব্যস্ত থাকছে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সার্ভে বলছে ছাত্রদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি ওজন বেড়েছে এই এজ গ্রুপের ছাত্রদের। ব্যবহারেও এসেছে পরিবর্তন। অভিভাবকরা তা খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। এদিকে সরকারের এই বিষয়ে অদ্ভূত এক নীরবতা। দেশের সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে। বাবা-মায়ের ঘুম ছুটেছে। কিন্তু দেশ বিচলিত নয়। কোভিড-২ এ পৌঁছেও ছাত্রদের নিয়ে আলাদা কোনও পরিকল্পনা নেই। অনলাইন ক্লাসের বাধ্যতার প্রশ্নটিও গায়েব। দ্বাদশের ট্যাব পেল কি সবাই? তারপর ক্লাসের তাড়াটা? কোনও নির্দেশ? না, শুধু এক আশ্চর্য রকমের উদাসীনতা প্রকট হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ ফল বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বার থেকে বেঞ্চ, বোর্ড, ল্যাবরেটরিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিদিন জুড়ে থাকার যে নিয়মানুবর্তিতা সেটি হারিয়ে এখন বেনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার ঢেউ। নিজেদের নতুন করে সাজিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে কচি হাতগুলো বড় ক্লান্ত। এক আচ্ছন্নতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে শিশুগুলো। যা পড়া হল না। যা শেখা হল না। তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছেই। আবার আগামীতে কী হবে তাও জানা নেই। শুধু বিদ্যালয়ের প্রধান গেটটা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। কিছু ছাত্রের জন্য খুলছে। কিছু ছাত্রের জন্য খুলছে না। আবার মা-বাবাদের জন্যও খুলছে। কিন্তু ইমনরা বাড়ির ছাদে গিয়ে লুকিয়ে একা একা জাতীয় সংগীত গেয়ে চোখের জল মুছে নীচে নেমে আসে। মায়েরা ছেলের মন খারাপের হদিস জানে না। ইমন জানে, ভালো উপস্থিতির জন্য বিদ্যালয় থেকে দেওয়া পুরস্কারটা তার আর মিলবে না। দাদাকে দেখিয়ে দেওয়াটা আর হবে না। মায়ের কাছে আদর মিলবে না ইউনিট টেস্টে ফুল মার্কস পাওয়া মার্কসিটটার জন্য। তারপর মাকে নিয়ে আনন্দ করে কেনা হবে না নতুন ক্রিকেটের ব্যাটটাও। ঝরে পড়ে যাওয়া এই স্বপ্নগুলো ইমনদের মনের স্বাস্থ্যকে ঠিক কতটা ভাঙছে তা অধরাই থেকে গেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের কাছে।
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-jinat