04-06-2024 12:31:07 pm
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-murshida
‘হ্যালো, ম্যাডাম, আমি আয়েশা’৷
ফোনের ওপারে আমাদের মাদ্রাসার একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী আয়েশা খাতুন৷ হ্যালো বলেই আর কথা বলছে না৷ বিরতি দেখেই বেশ ভয় ভয় করছিল৷ বললাম, বলো আয়েশা, আমি শুনছি৷
আয়েশা অসম্ভব লড়াকু একটা মেয়ে৷ ওর বাবা সাইকেলের কেরিয়ারে করে কাপড় ফেরি করে৷ সামান্য রোজগার, তাও এই অতিমারীর ঝাপটায় বন্ধ৷ মাধ্যমিক পাশ করার পরই, যাতে ও নিজে রোজগার করে নিজের খরচ চালাতে পারে, তার জন্য পরম যত্নে চেষ্টা করেছিলাম আমরা৷ বাড়িতে একেবারে ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে, সেলাই মেশিনের কাজ শিখে কিছু রোজগার করে নিজের পড়াশুনা চালায় ও, সাথে কম্পিউটার ট্রেনিংও নিচ্ছে৷ একটা স্বরোজগেরে স্বপ্নালু মেয়ে আয়েশা৷
আয়েশা ফোনে যা জানাল, শুনে চমকে উঠলাম৷
এই মুহুর্তে গ্রামে কটা মেয়ে রয়েছে, না তলে তলে বেশিরভাগটাই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না৷ আয়েশা যা বলল, তা ভাবতে গেলেই শিউরে উঠছি৷
মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় আমাদের দেবকুণ্ড সেখ আব্দুর রাজ্জাক মেমোরিয়াল গার্লস হাই মাদ্রাসা। আমি সেখানকার প্রধান শিক্ষিকা। দীর্ঘ সময় ধরে আমার ছাত্রীদের পরম যত্নে লেখাপড়া-খেলাধূলায়, সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠায় এবং স্বনির্ভর হওয়ায় পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা মাদ্রাসা চলাকালীন দল তৈরী করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রায় জেহাদ ঘোষণা করেছিলাম৷ আমাদের টিমের নাম শুনেই অভিভাবকগণ তটস্থ থাকতো৷ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটা জনমতও তৈরী করা গেছিল৷ কোভিড-এর জন্য দীর্ঘ দেড় বছর মাদ্রাসা বন্ধ৷ আমাদের দলের মেয়েরাও ছন্নছাড়া৷ আমরা মাথার উপর থাকাতে তারা বুকে বল পেত, লড়ে যেত৷ এখন ওরাও অনেকটা দিশেহারা আর আমরাও অসহায়। তাই এই মুহুর্তে গ্রামে কটা মেয়ে রয়েছে, না তলে তলে বেশিরভাগটাই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না৷ আয়েশা যা বলল, তা ভাবতে গেলেই শিউরে উঠছি৷ আমাদেরই হাতে তৈরি বাইশটা মেয়ে একজন স্যারের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়ত৷ গ্রামেরই মাস্টারমশাই৷ কম পয়সায় সব বিষয় পড়ান৷ এই লকডাউনে বাইশজনের মধ্যে একুশজনেরই বিয়ে হয়ে গেল৷ আয়েশা এখন একা৷ মাস্টারমশাই-এর ছাত্রী কম, তাই তিনি পড়াবেন না বলে দিয়েছেন৷ শুনে ওর বাপ-মা বলেছে, খুব হয়েছে এবার তোরও বিয়ে দিয়ে দিই৷ আয়েশার মতো মেয়ে, যারা আর্থিক-সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলো এড়িয়ে না গিয়ে সরাসরি মোকাবিলা করে পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে৷
অভিভাবকরাই মেয়েদের আর পড়াতে নারাজ৷ তাঁদের কথা হল, ‘স্কুলই বন্ধ তার আবার পড়া কী’৷
হাই মাদ্রাসা এলাকার বেশ কিছু টিউটরের সাথে কথা বলছিলাম৷ মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলোতে, বিশেষ করে মুসলিম এলাকাগুলোতে, সরকারী হাই মাদ্রাসাগুলোয় প্রচুর মেয়েরা পড়াশুনা করে—যে মেয়েরা আশেপাশের শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেত৷ করোনা আবহে মাদ্রাসাগুলো বন্ধ৷ অনলাইনে পড়াশুনা করার কোনও পরিকাঠামো এই মেয়েদের নেই৷ এক্ষেত্রে হয়তো তাদের এই প্রাইভেট টিউটররাও কিছুটা সহায়তা করতে পারতেন৷ কিন্তু অভিভাবকরাই মেয়েদের আর পড়াতে নারাজ৷ তাঁদের কথা হল, ‘স্কুলই বন্ধ তার আবার পড়া কী’৷ মেয়েদের বাড়িতে বসে বসে খাওয়ানোর থেকে বিয়ে দিয়ে বোঝা নামিয়ে দিতেই তাঁদের আগ্রহ বেশি৷
ওর নানী আমাদের বলেছিল, ‘আপনার মাদ্রাসায় ওকে দিয়েছিলাম দু’টো লেখাপড়ার সাথে আরবী শিখবে বলে, নাচ করে অধর্ম করতে পাঠাইনি’৷ সেই ফারজানা পরিবারকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে নাচটা চালিয়ে গেছে ৷
বাল্যবিবাহ ছাড়াও মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে আমরা একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম যেটা মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল৷ সেটা এখন ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে৷ মুসলিম পরিবারগুলোতে ধর্মীয় কারণে নাচ, গান, খেলাধূলা প্রায় নিষিদ্ধ৷ দীর্ঘ প্রচেষ্টায় আমরা এমন একটা আবহ তৈরী করতে পেরেছিলাম যেটা আমাদের ছাত্রীদের মূলস্রোতে নিয়ে আসছিল৷ কন্যাশ্রীর কাজে এসে ফারজানা সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিল, ‘আর ভালো লাগছে না ম্যাডাম’৷ এই ফারজানা পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে আমাদের ছাত্রীদের নাচ শেখায়৷ স্বপ্ন দেখে ফারহা খান-এর মতো একদিন ডান্স ডিরেক্টর হবে৷ ওর নানী আমাদের বলেছিল, ‘আপনার মাদ্রাসায় ওকে দিয়েছিলাম দু’টো লেখাপড়ার সাথে আরবী শিখবে বলে, নাচ করে অধর্ম করতে পাঠাইনি’৷ সেই ফারজানা পরিবারকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে নাচটা চালিয়ে গেছে৷ স্কুলের মেয়েদের নিয়ে টিম করেছে৷ কিন্তু দীর্ঘ অতিমারীর আবহে এখন বাড়িতে—না তার পড়াশুনা হচ্ছে, না তার নাচের প্র্যাকটিস৷ ওর যে ক্ষতিটা হচ্ছে, তা পূরণ করবে কে?
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-অনটন সবকিছুকে জয় করে এই মেয়েগুলো মাঠে টিকে থাকছিল৷ অতিমারীতে তাদের মাঠ বন্ধ, টুর্নামেন্ট বন্ধ, প্র্যাকটিস বন্ধ৷ ঘরের মধ্যে যেন তারা অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছে আজ৷
এক একটি মেয়ের উপর যে এই সময়ের কতদূর প্রভাব পড়েছে, তা বুঝতে পারা যাবে খাদিজার গল্প শুনলে৷ খাদিজা আমাদের মাদ্রাসার কৃতী মেয়ে৷ ভাল ফল করে সে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বহরমপুর গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছে৷ অতিমারীতে হোস্টেল, কলেজ সব বন্ধ৷ খাদিজা বাড়িতে আছে, আর বাড়ির লোক প্রায়ই চাপ তৈরী করছে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য৷ চাপ নিতে না পেরে এখন বান্ধবীর বাড়িতে উঠেছে সে৷
তাছাড়াও, যে মেয়েরা খেলাধূলা করে, করোনা আবহে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা৷ মুসলিম মেয়েদের খেলাধূলা করা শরিয়ত বিরোধী—এই বলেই মেয়েদের খেলাধূলা প্রথমেই বাতিল করে দেয় মুসলিম সমাজ৷ যেখানে বোরখা-হিজাব, পাজামা-কুর্তি-ওড়না নিয়ে নিজেদের আব্রু করার নিদান, সেখানে মেয়েরা করবে খেলাধূলা! বহুদিন ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে এই মেয়েদের মাঠে এনেছিলাম আমরা৷ তারপরও ছিল মাঠে প্র্যাকটিসের সমস্যা, কারণ খেলার পোশাকে মেয়েদের দেখলে ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে৷ দূর থেকে দূরবর্তী মাঠে তারা ছুটেছে একটু প্র্যাকটিস করার জন্য৷ এত সংগ্রামের মধ্যেও মেয়েদের জেদ ও অধ্যবসায়ের জেরে তারা নিয়মিত ন্যাশনাল পর্যন্ত খেলে। একে মুসলমান পরিবারের মেয়ে, তার ওপর আর্থিক অনটন—দুয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে এলাকায় তাদের ডাকা হয় ‘বাঁদরী’ নামে৷ কিন্তু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-অনটন সবকিছুকে জয় করে এই মেয়েগুলো মাঠে টিকে থাকছিল৷ অতিমারীতে তাদের মাঠ বন্ধ, টুর্নামেন্ট বন্ধ, প্র্যাকটিস বন্ধ৷ ঘরের মধ্যে যেন তারা অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছে আজ৷
আকুল হয়ে ওরা প্রশ্ন করে, ‘ম্যাডাম, সত্যি সত্যিই এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে না’?
সামাজিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে এক ঝাঁক অল্পবয়সী মেয়েদের জড়ো করে একটা স্বপ্ন গড়ে উঠছিল—তা অতিমারীর ধাক্কায় নিবু নিবু৷ অবিলম্বে তাদের আমরা মাদ্রাসার আঙিনায় ফিরে না পেলে তারা দিশেহারা হবেই৷ ছন্দ পতন হবে৷ দীর্ঘ সংগ্রামে যে স্রোতধারা তৈরী করা গেছিল, তার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে৷
আর তারই জ্বলজ্যান্ত আর এক প্রমাণ রাবেয়া৷ রাবেয়া এক ফেরিওয়ালার মেয়ে৷ অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পড়াশুনা করে৷ সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুব কেন্দ্র থেকে কম্পিউটারের অ্যাডভান্স কোর্সও করে৷ আমাদের মাদ্রাসায় সে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে৷ সাথে চলছিল পড়াশুনা৷ অতিমারীতে এলাকার এক আরব-প্রবাসী ঠিকা-মজদুর নিরক্ষর যুবক ফিরে আসে বাড়িতে৷ বাড়ির লোক প্রায় জোর করে তার সাথে রাবেয়ার বিয়ে দিয়ে দেয়৷ প্রথমেই তার গায়ে চুড়িদার-পাজামার পরিবর্তে চাপানো হয় বোরখা, তারপর শুরু হয় অত্যাচার—বাইরে কাজ করতে দেওয়া হবে না তাকে এখন৷ গর্ভবতী অবস্থায় সে মায়ের বাড়িতে চলে আসে৷ লোন নিয়ে বাড়িতে মেশিনপত্রও কিনে ফেলে, স্বাবলম্বী হবে বলে৷ বিডিও অফিসের অস্থায়ী কাজও শুরু করে৷ লকডাউনে সে সব বন্ধ৷ নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে সদ্য প্রসূতি আমাকে ধরে সেকী কান্না, ‘ম্যাডাম! কাজ ছাড়া আমি কী করে বাঁচবো’৷
এ তো গেল যারা পড়াশুনা করার পাশাপাশি স্বরোজগেরে হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিল তাদের কথা৷ অন্যদিকে বেশ কিছু ছাত্রীকে আমরা নিরলস কোচিং-ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তুলছিলাম যাতে উচ্চশিক্ষার পর্বে তারা মাথা উঁচু করে প্রবেশ করতে পারে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় একটা দৃষ্টান্তমূলক রেজাল্ট যাতে হয়, তার জন্য খেটে যাচ্ছিলাম৷ এই ফলাফলটাই আমাদের এলাকার মেয়েদের শিক্ষার মানচিত্র হয়ত পালটে ফেলত৷ অভিভাবকরাও হয়তো মেয়েদের সম্পদ ভাবতে শিখত৷ সেই সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হল। পরীক্ষা না হওয়া বা বিকল্প মূল্যায়ন ব্যবস্থা তাদের সেই প্রয়োজন মেটাতে পারবে না৷ তাই আকুল হয়ে ওরা প্রশ্ন করে, ‘ম্যাডাম, সত্যি সত্যিই এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে না’? দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ অতিক্রম করতে হবে যে মেয়েগুলোকে, জীবনের শুরুতেই এই ছন্দপতন তাদের নিরাশ করছে তো বটেই৷ যদি অবিলম্বে সরকার বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি চালু না করে, তাহলে যতই চেষ্টা আমরা করি, বালির বাঁধের মতো সব ভেসে যাবে৷
আনিসা, ফাওজিয়ারা সরকার চেনে না। তারা চেনে তাদের মাদ্রাসা, তাদের দিদিমণিদের, যেখানে তারা একটু প্রাণ ফিরে পায়। যেখানে তাদের স্বপ্ন দোলে, সেই মাদ্রাসা আজ প্রায় দেড় বছর বন্ধ৷ করোনা পরিস্থিতি শুধু আমাদের সবাইকে ঘরবন্দী করে রেখেছে তাই নয়, এ যেন এক নতুন সংগ্রামের সূচনালগ্নে আমাদের দাঁড় করিয়েছে ৷
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-murshida