04-06-2024 12:30:48 pm
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-nilanjana
ডিজিটাল ডিভাইডের কাঁটাতার জাঁকিয়ে বসে আমার একলা মনে
মোবাইল তার অভ্যস্ত ছন্দে অ্যালার্ম বাজায়। আমার স্বামী-সন্তানরাও দ্রুতগতিতে প্রাত্যহিক কর্ম সেরে যার যার বরাদ্দ কোণটিতে বসে পড়ে। জ্বলে ওঠে মোবাইল অথবা ল্যাপটপের স্ক্রিন। মুহূর্তেই তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলা ডিজিটাল ইন্ডিয়ার অংশ হয়ে যায়। তাদের এই আবর্তন গতিতে এতটুকুও বিচ্যুতি চোখে পড়ে না। তাদের কনফারেন্স-অ্যাপ্রেইসাল-প্রোমোশন-রবীন্দ্রজয়ন্তী-প্রোজেক্ট-পরীক্ষা সব চলছে। শুধু আমি, সরকারি স্কুলের এক দিদিমণি, কক্ষচ্যুত হয়ে ঘরের কোণে দিনপাত করতে থাকি। নিজের সংসারেই নিজেকে কেমন ব্রাত্য বলে মনে হয়। আমি উপার্জনহীন নই অথচ আমি কর্মহীন—মাথার ভেতরে এই বোধ অবিরত কাজ করে। নিজের মুদ্রাদোষে আমি কেবল একা হতে থাকি আর ডিজিটাল ডিভাইডের কাঁটাতার জাঁকিয়ে বসে আমার একলা মনে।
সাধারণ কনফারেন্স কলে যেখানে পাঁচজনকে সংযুক্ত করা যায়, এই কনফারেন্স ব্রিজের মাধ্যমে ৫০ জনকে একই কলে নেওয়া যেত। তুলনামূলকভাবে খরচও যৎসামান্য। এমনকী একই ব্রিজ ব্যবহার করে সব বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই একটি শ্রেণিকে পড়াতে পারতেন।
নিজেকেই নিজে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলি,
-নিজের পেশার প্রতি সৎ থাকার যথেষ্ট চেষ্টা কি আমি করেছি?
-সংখ্যা মিলিয়ে মিড ডে মিলের পুঁটুলিগুলো তুলে দেওয়া আর তিন-চারবার অ্যাক্টিভিটি টাস্কের খাতা দেখা ছাড়া আমরা সেই অর্থে পরিমাপযোগ্য কাজ কিছু করেছি কি?
-আমার সন্তানদের স্কুলেও এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আমি কি আদৌ মেনে নিতাম?
মনের গোপন দুয়ার ঠেলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুর শোনা যায়—
-হ্যাঁ, চেষ্টা তো করেছিলাম। প্রথমে ‘হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ’ করে অডিও বা ছবির মাধ্যমে স্টাডি মেটিরিয়াল দিয়েছিলাম। প্রক্রিয়া আদৌ উভমুখী হচ্ছে না বুঝে ‘গুগল মিট’-এ পড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। তাতেও বিশেষ সাড়া না পেয়ে একটা ‘কনফারেন্স ব্রিজ’-এর বন্দোবস্ত করেছিলাম। সাধারণ কনফারেন্স কলে যেখানে পাঁচজনকে সংযুক্ত করা যায়, এই কনফারেন্স ব্রিজের মাধ্যমে ৫০ জনকে একই কলে নেওয়া যেত। তুলনামূলকভাবে খরচও যৎসামান্য। এমনকী একই ব্রিজ ব্যবহার করে সব বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই একটি শ্রেণিকে পড়াতে পারতেন।
-সবই তো বুঝলাম, কিন্তু কাজের কাজ হল কতটুকু?
গোপন দরজায় আবার কড়া নাড়ি। একবার নয়, বারবার। কিন্তু সে আশ্চর্যজনকভাবে নিরুত্তর থাকে। এত কিছু করেও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সেই অর্থে সাড়া পেলাম না। কিন্তু কেন?
-ম্যাডাম আমাদের তো একটাই ফোন। ঐ সময় দাদারও ক্লাস থাকে। ও ফোন দেয় না আমাকে।
এই ‘কেন’-র উত্তর খুঁজতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি অভিভাবকদের সঙ্গে। আমাদের দশম শ্রেণির সেকেন্ড গার্ল সুপ্রিয়া। খুবই শান্তশিষ্ট। একান্ত অনুগত বলতে যা বোঝায়, তাই আর কী। হোয়াটসঅ্যাপ বা গুগল মিট কোনওটাতেই অংশ নিতে না দেখে তার বাবাকে ফোন করি একদিন।
-দিদিমণি আমাদের নতুন ফোন নেই। পুরোনো দিনের টেপা ফোন। ওতে তো ক্লাস-টাস করা যায় না!
নবম শ্রেণির ছাত্র অম্বর। বেশ চটপটে ছেলে, খেলাধূলায় ভালো, সপ্রতিভ। তাকেও কোনওদিন ক্লাসে না পেয়ে ফোন করি।
-এতদিন ক্লাস করাচ্ছি, অম্বর কোনওদিন জয়েন করে না তো!
-ও আপনারা ক্লাস নিচ্ছেন? জানিনা তো! ছেলে তো কিছু বলেনি। আচ্ছা কাল থেকেই স্কুলে যেতে বলব।
-না দাদা, স্কুলে নয়। মোবাইলে ক্লাস করাচ্ছি। এগারোটা থেকে করাই। ওকে জয়েন করতে বলবেন।
-কিন্তু এগারোটার সময় তো আমি বাড়ি থাকি না। ফোন নিয়ে বেরিয়ে যাই। সন্ধেবেলা করলে হবে না?
দশম শ্রেণির আর এক ছাত্রী বিশাখার সমস্যা অন্য জায়গায়। তাকে ফোন করলে খুব সংকোচে সে জানায়,
-ম্যাডাম আমাদের তো একটাই ফোন। ঐ সময় দাদারও ক্লাস থাকে। ও ফোন দেয় না আমাকে। আপনি হোয়াটসঅ্যাপে কিছু পাঠালে পরে দেখে নিতে পারব। কিন্তু জয়েন হতে পারব না।
বিশাখার ফোনটা রেখেই মুহূর্তে মন চলে যায় ‘পথের পাঁচালী’-র পাতায়—
“সর্বজয়া একবাটি দুধ হাতে ঘরে ঢুকিয়া বলিল – এসো, খেয়ে নাও দিকি। অপু দ্বিরুক্তি না করিয়া বাটি উঠাইয়া দুধ চুমুক দিয়া খাইতে লাগিল।
সর্বজয়া বলিল—ওকী? নাও সবটুকু খেয়ে ফেলো—ওইটুকু দুধ ফেললে তবে বাঁচবে কী খেয়ে—অপু বিনা প্রতিবাদে দুধের বাটি পুনরায় মুখে উঠাইল।”
সর্বজয়া তার সোনালী সংসারের যে চিত্র দিবাস্বপ্নে কল্পনা করে সেখানেও কেবল—
“অপু সকালে উঠিয়া বড় মাটির ভাঁড়ে দোয়া এক পাত্র সফেন কালো গাইয়ের দুধের সঙ্গে গরম মুড়ির ফলার খাইয়া পড়িতে বসে।”
সর্বজয়া কী বাস্তবে কী কল্পনায় বাটিভরা দুধ দুর্গার হাতে তুলে দেয় নি। গ্রামীণ নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারে শিশুপুত্র এবং শিশুকন্যার মধ্যে এই বিভাজন অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও রূঢ় বাস্তব। দুর্গাদের না থাকে দুধে অধিকার, না পাঠশালায়। যুগ পালটেছে, কিছুটা পালটেছে সর্বজয়াদের মানসিকতাও। কিন্তু ঘরে ঘরে দুর্গাদের পাঁচালীর মূল সুর আজও একই রয়ে গেছে।
তবে এটাও ঠিক যে আমাদের মত স্কুলে লিঙ্গবৈষম্যের জন্য শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া একটা কারণ হলেও, তা প্রধান কারণ কখনই নয়। প্রধান কারণ, বলাই বাহুল্য, নগ্ন দারিদ্র্য। পেটের খিদে যে সংসারগুলোর বড় বালাই, সেখানে ডেটা প্যাক?—বিলাসী প্রলাপ ছাড়া তা আর কিছুই নয়। অভিভাবক যে আমি, সে আমার বাচ্চাদের হাতে হাই স্পিড ইন্টারনেট-স্ক্যানার-প্রিন্টার-মোবাইল-ল্যাপটপ ইত্যাদি ইত্যাদি আধুনিক ডিজিটাল বিশ্বকে জয় করার যাবতীয় আয়ুধ তুলে দিয়েছে। কিন্তু এতগুলো ছেলেমেয়ের দিদিমণি যে আমি, সে কী করতে পারলাম! একটা টিনের তলোয়ারও তাদের হাতের সামনে এগিয়ে দিতে পারলাম না।
ইউনিসেফ তার গত বছরের রিপোর্টে পেশ করেছে যে, মাত্র ২৪ শতাংশ ভারতীয় পরিবারে ই-এডুকেশন চালানোর উপযোগী নেট-ব্যবস্থা আছে। আর বাকি ৭৬ শতাংশ হল অবর্ণনীয় এক নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। এই দুস্তর ব্যবধান ঘোচাবো কী করে!
কিন্তু দেব কাকে? তারা যে স্মার্টফোন-ডেটাপ্যাক-রিচার্জ-এর প্রাচীর পেরিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না।
আসলে আমাদের কাছে ছাত্রছাত্রীরা তো শুধু বাংলা-অংক-ইতিহাস-ভূগোলের বইয়ের পাতায় লেখা কালো অক্ষরগুলো শিখতে আসতো না, তাদের মনের পাতায় পাতায় গজিয়ে ওঠা অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নমালারও সমাধানসূত্র খুঁজে পেত। বহু ঘরেই, বহু পরিবারের পরিসরেই তাদের এই প্রশ্নগুলো অর্থহীন। সেগুলো শোনার ইচ্ছা, সময় বা মনন তথাকথিত আপনজনদের নেই।
আমাদের এই দেওয়া-নেওয়া আজ বন্ধ হতে বসেছে। আমরা তো আমাদের সকল নিয়ে বসে আছি, কিন্তু দেব কাকে? তারা যে স্মার্টফোন-ডেটাপ্যাক-রিচার্জ-এর প্রাচীর পেরিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না।
এই প্রক্রিয়াকে পুনরায় উজ্জীবিত করার জন্য কি কিছুই করার নেই? সরকারি স্তরে কিছু কিছু পদক্ষেপ হয়ত কিছুটা হলেও এই বদ্ধ জলাশয়ে দোলা দিতে পারে। যেমন,
-শিক্ষার্থীদের জন্য সাবসিডাইজড রেটে ডেটাপ্যাক দেওয়া যেতে পারে।
-সরকার থেকেই ইন্টারনেট প্রোভাইডারদের বরাত দেওয়া যেতে পারে যে একটা স্কুলভিত্তিক অধিকাংশ শিক্ষার্থী যদি তাদের কাছ থেকে পরিষেবা চায় সেক্ষেত্রে তারা কম দামে ব্রডব্যান্ড-এর সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবে।
-কিছু কিছু অঞ্চল চিহ্নিত করে ‘ফ্রি ওয়াইফাই জোন’ তৈরি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পাড়ার ক্লাবগুলোকে ব্যবস্থাপনা ও দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
-‘কন্যাশ্রী’ বা ‘শিক্ষাশ্রী’-র মতো একাউন্টে টাকা না দিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচের পরিবার থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের মোবাইলে টাকা রিচার্জ করে দেওয়া যেতে পারে।
-‘ফ্রি কনফারেন্স ব্রিজ’কে আরো সহজলভ্য ও ব্যবহারের পক্ষে আরো সুবিধাজনক করে তোলা যেতে পারে।
জানি এবং বুঝিও যে এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা আছে অনেক। কোনও ব্যবস্থাতেই আমাদের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একশ শতাংশ অন্তর্ভুক্তিকরণ এই পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। কিন্তু কাঁটার ভয়ে কমলের কাছেই যেতে না চাওয়ার অজুহাত দিয়ে আর কতকাল নিজেকে ভোলাব? মনের আয়নায় যেভাবে ধুলোর পরত জমেছে, এরপর তো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দিদিমণির প্রতিবিম্বই সেখানে ধরা পড়বে না! এখনই সময়, প্রাণপণে এই ধুলো সরানোর।
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-nilanjana