03-06-2024 17:30:53 pm

print

 
Ebong Alap / এবং আলাপ

এবং আলাপ

জেন্ডার | সমাজ | নাগরিকত্ব

Ebong Alap

Gender | Society | Citizenship

 

অতিমারী ও আমাদের হ য ব র ল


Ritacheta Goswami
https://ebongalap.org/author/ritacheta-goswami/
July 06, 2021
 

Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-ritocheta

দ্য ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুলচত্বর

আমার বয়স বাড়ে না। হ্যাঁ, টেনেটুনে তিরিশ হয়েছিল বটে, তারপর সেই কবে থেকেই পনেরো আর আঠারোর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। বিশ্বাস করুন, এর একচুলও মিথ্যে কথা নয়। আজ অনেক বছর হল দক্ষিণ কলকাতার একটা বেসরকারি স্কুলে পড়াই। বর্ষে বর্ষে দলে দলে সন্তান-সন্ততির সংখ্যা নেহাৎ কম হয়নি। আমার এই ছেলে-মেয়েরা বড় হয়, কলেজে পড়ে, চাকরি-বাকরি করে সংসারে থিতু হয়। আজকাল তো ফেসবুকে নাতি-নাতনির মুখও দেখি। কিন্তু ওই, আমার বয়স বাড়ে না। বয়স বাড়ার যেমন কিছু সমস্যা আছে, বয়স না বাড়ারও তেমনি। তবে তা নিয়ে আমি কোনও কালে মাথা ঘামাইনি, দিব্যি চলছিল আমার, কিন্তু বাদ সাধল করোনা ভাইরাস! ২০২০ সালের মার্চ মাসে সারা পৃথিবীর মতো আমাদের সামনেও এল নতুন চ্যালেঞ্জ। অতিমারীর ধারণা খুব স্পষ্ট না থাকায় সকলের মনে আতঙ্ক। লকডাউন বস্তুটা কী? লকডাউন ভালো না খারাপ? এর ফলে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষদের কী হবে? সংবাদমাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের ছবি দেখে উদ্বিগ্ন মানুষ নানা আলোচনায় মগ্ন। সোশাল মিডিয়া উত্তপ্ত।

সবচেয়ে কঠিন মনে হল অনলাইন ক্লাস। প্রাথমিক প্রস্তাবে টেকনোলজিতে লবডঙ্কা আমি বেজায় ফাঁপরে পড়লাম। শুরু হলো অনলাইন ক্লাসের প্রস্তুতি।

আমিও তখন বিষম বিপাকে। বাড়ির সহায়িকাদের সবেতন ছুটি দিয়েছি। খবরের কাগজ বন্ধ করেছি। ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সকলে ওঠা-নামা করে সুতরাং যত কম সম্ভব ঘরের বাইরে যাই। কিছু ছুঁই বা না ছুঁই, সাবান দিয়ে হাত ধুই। বাড়িতে একজন শিশুসহ দুই বৃদ্ধ সদস্যকে নিয়ে আতঙ্কের দিনযাপন। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন মনে হল অনলাইন ক্লাস। প্রাথমিক প্রস্তাবে টেকনোলজিতে লবডঙ্কা আমি বেজায় ফাঁপরে পড়লাম। শুরু হলো অনলাইন ক্লাসের প্রস্তুতি। জুম ডাউনলোড করা হল। প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমানে স্কুলের কম্পিউটার টিচার তথাগত তার একদা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কীভাবে নতুন পদ্ধতিতে ক্লাস নিতে হবে শেখাতে শুরু করলো। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা –

-ওরে, কী বললি? আর একবার বল বাবা।

-জুম মিটিং তো শেডিউল করলাম, এবার ক্লাস শুরু করবো কী করে?

-ও তথাগত, স্ক্রিনে যে ‘এরর’ লিখে দিয়েছে রে!

বয়স নিয়ে মাথা না ঘামালেও মস্তিষ্কের সরসতা যে সর্বদা এক রকম থাকে তা তো নয়! সুতরাং কিসের পর কী আর কোন বাটনের পর কোন বাটন বুঝতে না বুঝতেই এসে গেল ক্লাসের টাইমটেবল। শুরু হল ক্লাস। এতদিন বাচ্চারা পড়া জিজ্ঞেস করেছে। কিছু বুঝতে না পারলে আবার দেখিয়ে দিতে বলেছে। আর এখন ক্লাসে ঢুকে আমিই জিজ্ঞেস করি,

-হ্যাঁ রে আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?

-আমার হেডফোনটা কাজ করছে না কী করব রে?

-এইরে, স্ক্রিনে কে যেন হিজিবিজি কেটে দিল! এবার কী করি?

ওরা উৎসাহিত হয়ে আমায় একের পর এক শিখিয়ে চলেছে।

প্রথম কদিনের হোঁচটের পর বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। এক ঘরে মেয়ে, অন্য ঘরে মা সকাল থেকে ক্লাস করতে বসে যাই। দুটো ক্লাসের ফাঁকে বাড়ির সবাইকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ানো, ভাতের ফ্যান ঝরিয়ে আসা, এঁটো বাসন মাজা ক্রমে জলভাত হয়ে উঠতে থাকে। কেবল সমস্যায় পড়েন বাড়ির দুই বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা। পুজো করবেন কিন্তু শঙ্খ-ঘন্টা বাজানো চলবে না। জোরে হাসা যাবে না, কাশা যাবে না। মা এঘর থেকে ওঘরে যেতে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমায় দেখা যাচ্ছে না তো? বাবা বলেন, বাথরুমের কল খুললে কি তোমার ক্লাসে আওয়াজ যাবে? অন্যদিকে ছাত্রীর মা খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে যান। বেচারা লজ্জা আর রাগ মেশানো মুখে ভিডিও অফ করে দেয়। আমি চেঁচিয়ে উঠি, ওরে তুই খেতে খেতেই লেখ। আর এক ছেলে কিছুতেই ভিডিও অন করছে না দেখে বারবার ডাকতে থাকি। সে সাড়া দেয় না। কে জানে হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে অথবা ভিডিও গেম খেলছে।

এখন আর আড়াল করবার কোন পথ নেই। সবটাই উন্মুক্ত। যা কিছু ব্যক্তিগত ছিল তার সমস্তটার উপরেই ক্যামেরা বসানো হয়ে গিয়েছে। 

এতদিন স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে নিজের ব্যক্তিত্ব, ভাবমূর্তি ইত্যাদি নিয়ে আমরা যারা মাথা ঘামিয়েছি, তাদের আজ সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। শিক্ষালয় কর্মজগৎ আর ক্লাসরুম পারফরমেন্সের জায়গা। কে না জানে কাজের জায়গায় যা কিছু ব্যক্তিগত তা সবই আড়ালে রাখতে হয়! ঘর কৈনু বাহির আর বাহির কৈনু ঘর, শ্রীরাধিকা বলেছিলেন শ্যামপ্রণয়ে। ঘর আর বাহিরের ফারাক আমাদের ঘুচেছে নেটপ্রণয়ে। এখন বাইরে যাওয়া নেই, অথচ ঘর বলেও আর কিছু নেই। এখন ঘরই বাহিরে  যোগাযোগের রাস্তা আর বাহির মানে সোশাল ডিসট্যান্সিং। তাই কেবলমাত্র স্কুলের ম্যাম নয়, আমাদের মধ্যেকার মা, কাকি, পিসি, স্ত্রী যাবতীয় পরিচয় সর্বসমক্ষে প্রকাশিত, কারণ এখন আর আড়াল করবার কোন পথ নেই। সবটাই উন্মুক্ত। যা কিছু ব্যক্তিগত ছিল তার সমস্তটার উপরেই ক্যামেরা বসানো হয়ে গিয়েছে। 

এতদিন শুনেছি নিজেদের ফোন না থাকলে নাকি বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাবার যো নেই! তা এবার তো বাবা-মা পড়াশোনার জন্যই ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ সাধ্যমতো ব্যবস্থা করেছেন। স্কুলের পরামর্শে বাড়ির ইন্টারনেটের গতি বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং, পড়তে বসে স্ক্রীনের ভেতর লাল-নীল জানালা খুলে যাচ্ছে। আমি জানালার এপারে বসে যতই হাত বাড়াই না কেন, তাদের ছুঁতে পারছি না। ক্লাসরুমে যেমন অন্যমনস্ক বাচ্চার পাশে গিয়ে কথা বলে পড়ায় মন ফিরিয়ে এনেছি এতদিন, আজ সে পদ্ধতি কোনও কাজেই লাগছে না। অসহায় লাগে।

তাগাদা আসে, অ্যাসেসমেন্ট নাও। মার্কস এনট্রি করো। আবার তোড়জোড় শুরু হয়। নতুন সফ্টওয়ার নিয়ে যুদ্ধে নামি। কলিগদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে,

-তুই এনট্রি করতে পারলি? আরে আমারটা তো খুলছেই না!

এই খোলা-বন্ধের বাঘবন্দী খেলায় আটকা পড়ে আমরা ছটফট করতে থাকি। দেখতে দেখতে একটা টার্ম শেষ হয়ে আসে। খাতা খুলে বসে দেখি কোন কোন বাচ্চা কাজ জমা করেনি। তা কী করে সম্ভব? ছিল তো সে ক্লাসে! মেইল করো। ফোন করো বাড়িতে। হয়তো ছাত্রের মা আকাশ থেকে পড়েন,

-সেকী! রোজ সকাল থেকে ক্লাস করে ছেলে। রাত জেগে প্রজেক্ট করে। তাহলে সেসব যায় কোথায়?

আমরাও ভেবে কুলকিনারা পাই না। সত্যিই তো, যায় কোথায়? এরই মাঝে মেইল ভেসে আসে, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই আমাদের ছাত্রী, দশম শ্রেণীর...

কোভিড? না, অবসাদ। অবসাদ কেড়ে নিলো তাকে। হাহাকার করে ওঠে মন। ক্লাসে পেলে চোখ দেখলেই বুঝতে পারতাম। ইস্  একবার কথা বলতে পারলেই ঠিক সারিয়ে দিতে পারতাম ওর মনের অ-সুখ! আমরা যে সবাই এখন ডাকঘরের অমল হয়ে দিন কাটাচ্ছি। সুযোগ পেলেই দইওয়ালার সঙ্গে আমরাও ওই বাঁকা পথ ধরে হারিয়ে যেতে পারি। কিন্তু কবে? আর কতদিন?

ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। মাথায় কী যেন একটা পড়ল। তাকিয়ে দেখি কাক্কেশ্বর কুচকুচে শ্লেট দিয়ে আমার মাথা ঠুকে দিয়ে বলছে, পাঁচ নয়ে কত হয়? আমি মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললাম পনেরো মানে আঠেরো, না না পঁয়তাল্লিশ। কাক্কেশ্বর মহা রেগে বললো, তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি? যাও যাও শিগগিরি টিকেটা নিয়ে এসো। বলেই আবার ঘাড় গুঁজে কী সব হিসেব কষতে লাগল। আমিও আর দেরী না করে ছুট লাগালাম।

Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-ritocheta

print

 

© and ® by Ebong Alap, 2013-24