04-06-2024 12:31:51 pm
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-seema
২০২০-র মার্চ৷ স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে৷ সেই সমস্ত দায়িত্ব শেষ করে আমরা তখন ব্যস্ত বোর্ডের খাতা দেখায়৷ আইএসসি বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে খাতা দেখা আর রোজই খবরে শোনা—ভারতেও নানা প্রান্তে কোভিড-১৯র সংক্রমণ শুরু হয়েছে৷ খাতা দেখার মাঝেই বোর্ডের নির্দেশ—বাকি কাজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে করতে হবে৷ সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে না হতেই শুরু হল লকডাউন ২০২০৷ পুরো শহর চলে গেল গৃহবন্দী জীবনে৷ এই হঠাৎ নির্বাসন ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির করে তুলেছিল আমাদের৷ দেখতে দেখতে চলে এল এপ্রিল মাস৷ স্বাভাবিক নিয়মে স্কুলে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা৷ স্কুল তখনও দোলাচলে—কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ এমন সময় ক্লাস টুয়েলভ-এর ছাত্ররা আমায় বললো, ‘ম্যাম, আপনি জুম-এ আমাদের ক্লাস নেবেন’?
এর আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম৷ স্কুলের জ্যেষ্ঠ ছাত্ররা বরাবরই আমার বন্ধু হয়ে ওঠে৷ নানা বিষয়ে তাদের থেকে সাহায্য, শিক্ষা, পরামর্শ—সবই পাই৷ কিন্তু জুম শুনে একটু ঘাবড়ে গেলাম। আশি ও নব্বই-এর দশকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাংলা মাধ্যমের ছাত্রী আমি৷ কম্পিউটার সম্পর্কিত যেকোনও কিছুই আমার কাছে আমার ছাত্রদের ভাষায় বেশ ‘চাপের’৷ চাকরির দায়ে বাংলা টাইপ এবং ফাইল-ফোল্ডার খোলা শিখেছি৷ অগত্যা শরণাপন্ন হলাম ক্লাস টুয়েলভ পড়ুয়া আমার মেয়ের৷ জুম ডাউনলোড হল, ক্লাস নেওয়াও শুরু হল৷ প্রথমদিন তো বারবার মিউট হয়ে যাচ্ছি৷ ছাত্ররা কেউ না কেউ বলছে অন্যরা তাদের মিটিং থেকে বার করে দিচ্ছে৷ ওরাই শেখালো কীভাবে প্রেজেন্ট হতে হয় আর এই অসুবিধাগুলোও কীভাবে দূর করা যায়৷ দেখলাম ব্যাপারটাকে যতটা জটিল মনে হচ্ছিল, ততটা নয়৷ তবে একথাও ঠিক, আমার ছাত্ররা যে ধৈর্য্য ও সহানুভূতিতে (কখনও হয়ত বা করুণায়!) আমাকে সবটা শিখিয়েছে, তার তুলনা নেই৷
অনেক সময় পড়ানোর মাঝে মহিলাকণ্ঠ—‘ম্যাম, এই জায়গাটা আর একবার বলুন৷’ প্রথম প্রথম অবাক হতাম৷ আমি কি অভিভাবকদেরও শিক্ষকতা করছি? এমন নজরদারির মধ্যে পড়ানোর অভিজ্ঞতা একেবারেই ছিল না৷
‘ম্যাম তুমি মিউট হয়ে গেছ’—স্কুলের উদ্যোগে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস শুরু হবার পর, সিক্স-সেভেন এর ছাত্রদের এই কথাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি হতাশ করত৷ ভাবতাম যাঃ, আবার বলতে হবে! তারপর শিখলাম কীভাবে আমাকে কখনোই মিউট করা যাবে না৷ ক্লাস নিতে নিতে অনেক সময়ই কোনও কোনও ছাত্রের নাম ধরে ডেকে প্রশ্ন করলে সাড়া পাই না৷ বুঝি, সে ক্লাসে উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত৷ অনেকক্ষণ পর সাড়া আসে—‘ম্যাম, আমায় ডাকছিলেন? আমার নেটওয়ার্ক চলে গেছিল৷’ বা ‘ম্যাম, আমি জল খেতে গেছিলাম৷’ এই অমনোযোগ ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, বোঝার উপায় নেই৷ শাসন করতে দ্বিধা বোধ করি৷ অনেক সময় পড়ানোর মাঝে (ছোটদের ক্লাসে এটা বেশি হয়) মহিলাকণ্ঠ—‘ম্যাম, এই জায়গাটা আর একবার বলুন৷’ প্রথম প্রথম অবাক হতাম৷ আমি কি অভিভাবকদেরও শিক্ষকতা করছি? এমন নজরদারির মধ্যে পড়ানোর অভিজ্ঞতা একেবারেই ছিল না৷ তারপর যথাসম্ভব ভদ্র ও দৃঢ় গলায় অনুরোধ জানাতে হয়, পড়ানোর সময় অভিভাবক যেন ঘরে না থাকেন৷
একটি বিখ্যাত মিশনারী ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষক আমি৷ প্রায় সব ছাত্রদের কাছেই অনলাইন ক্লাস করার যাবতীয় পরিকাঠামো সহজলভ্য৷ তবু নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য কোনও কোনও দিন কেউ ক্লাস করতে পারে না৷ কেউ হয়ত সময়মত প্রোজেক্ট বা পরীক্ষার খাতা জমা দিতে পারল না৷ সারাদিন চলতে থাকে কাতর অনুরোধ, ‘ম্যাম, আমাকে একটু বেশি সময় দেবেন’?
প্রিবোর্ড-এর পরীক্ষা দিতে ওদের স্কুলে ডাকা হলেও ফেয়ারওয়েলটা দেওয়া হয়নি৷ সারাজীবন এই ব্যথা ওদের বয়ে বেড়াতে হবে৷
স্কুলের নিয়মের বাইরে যেতে পারি না কিন্তু মন মানতে চায়না৷ গত শিক্ষাবর্ষে সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল ক্লাস টুয়েলভ-এর ছাত্রদের জন্য৷ স্কুলজীবনের শেষ বছর, স্বাভাবিক সময়ে এই বছরটা ওরা স্কুলের সমস্ত কাজকর্মে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। প্রতিটি মুহূর্ত নিংড়ে উপভোগ করে৷ রোজ ওদের ব্যথিত কণ্ঠস্বর—
-‘ম্যাম স্কুলে কবে যাবো’?
-‘ম্যাম, আমাদের ফেয়ারওয়েলটা অন্তত স্কুলে ডেকে দেবেন তো’?
বলাই বাহুল্য প্রিবোর্ড-এর পরীক্ষা দিতে ওদের স্কুলে ডাকা হলেও ফেয়ারওয়েলটা দেওয়া হয়নি৷ সারাজীবন এই ব্যথা ওদের বয়ে বেড়াতে হবে৷
রোজ নিয়মমত স্ক্রিনের সামনে বসি৷ সিলেবাস অনুযায়ী পড়াই৷ কখনও কখনও ভিডিও অন করে হোয়াইট বোর্ড-এর সাহায্যে ওদের বোঝাই৷ হোয়াটসঅ্যাপে প্রয়োজনীয় নোটস্ পাঠাই৷ কারুর বই না থাকলে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিই৷ পরীক্ষাও নিই—তবু মনে হয় কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে৷ ক্লাসের সব ছাত্ররাই যে একাগ্রচিত্তে পড়া শোনে, এমন তো নয়৷ কে শুনছে, কে শুনছে না—আর না শুনলে কেন শুনছে না সেটা তো জানার উপায় নেই! কত ছাত্রের হাতের লেখা পড়তে পারি না বলে ক্লাসে বসে লিখিয়ে দিতাম, বানান ভুল ঠিক করতাম৷ ওদের লিখতে দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতাম কে কেমন লেখে, কটা বানান ভুল করে৷ ক্লাসে অমনোযোগীদের মনোযোগ ফেরানোও একটা বড় কাজ ছিল৷ এই যন্ত্রমাধ্যমে সে সুযোগ নেই৷ কতদিন এমন হয়েছে—ক্লাসে গেছি, বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে, ছাত্ররা বলল—‘ম্যাম, আজ পড়ব না, একটা গল্প বলবেন’? আমিও ওদের সেই স্বেচ্ছা ছুটির আনন্দে মেতে উঠতাম৷ ক্লাসে ঢুকে অনেকদিন শুনতে পাই—‘ম্যাম, অমল আজ সকাল থেকে কাঁদছে৷ কোনও ক্লাসে মন নেই’। তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করি—‘কেন রে? কী হয়েছে’? দু-একটা কথা বলে একটু হালকা করার চেষ্টা৷
স্কুলজীবন যে পারস্পরিক সাহচর্য শেখায়, একসঙ্গে কাজ করার আনন্দ দেয়, এই যন্ত্রমাধ্যম তার থেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে রেখেছে আমাদের৷
এই সবই তো আমার শিক্ষকতার অঙ্গ৷ পড়ানো মানে কি শুধু সিলেবাস শেষ করা? একসঙ্গে রবীন্দ্র-জয়ন্তীর রিহার্সাল, স্কুল ফেস্টের আয়োজন৷ কী উৎসাহ আমার ছাত্রদের৷ কত নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তা৷ ওদের সঙ্গে গান শোনা, নতুন সিনেমা বা বইয়ের আলোচনা৷ কত ছাত্র বলে স্কুলে আসলেই ওদের মন ভালো হয়ে যায়৷ বাড়ির নানা ঝামেলা, মায়ের বকুনি, বাবার রক্তচক্ষু থেকে রেহাই! ওদের বলি না, কিন্তু আমারও তো তাই। ওই ক্যাম্পাস, ওই করিডোর তো শুধু কর্মস্থল নয়৷ ও তো আমার বেঁচে থাকার রসদ—তারাভরা আকাশের মতো, একফালি রোদের মত৷ অনলাইন ক্লাসে সে আনন্দ কোথায়? স্কুলজীবন যে পারস্পরিক সাহচর্য শেখায়, একসঙ্গে কাজ করার আনন্দ দেয়, এই যন্ত্রমাধ্যম তার থেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে রেখেছে আমাদের৷ একটা শূন্য পর্দার দিকে তাকিয়ে (নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য বেশিরভাগ সময়ই ভিডিও অফ রাখতে হয়) একটানা কথা বলে যাবার অভিজ্ঞতা যে একজন শিক্ষকের কাছে কী যন্ত্রণার তা বলে বোঝানোর নয়৷ সামনে সারি সারি কচিকাঁচাদের কৌতুহলী-উজ্জ্বল-আগ্রহী-মনোযোগী-নিরাসক্ত-অনাগ্রহী মুখ নেই৷ নেই বোর্ডে বানান বা ইংরেজী শব্দের বাংলা অর্থ লিখে দেবার বায়না৷ নেই ওদের হাসি, ওদের মন খারাপ, ওদের দুষ্টুমি—ওদের সঙ্গে প্রতিদিন একবার করে কিশোরবেলায় ফিরে যাওয়ার আনন্দ! এখন শুধু একটাই আশা—কবে পৃথিবী সুস্থ হবে, কবে ফিরব সেই চেনা ছন্দে, কবে আবার ছাত্ররা সামনে দাঁড়িয়ে বলবে—আজ পড়ব না ম্যাম, একটা গল্প বলবেন?
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-seema