24-05-2024 09:26:20 am
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-shimanto
প্রতিদিন সকালে নয়াপুটকে কেন্দ্র করে মোট পাঁচটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন সেবাব্রতী এই শিক্ষকের দল। কোথাও ক্লাবঘরে, কোথাও চণ্ডীমণ্ডপে, কোথাওবা স্থানাভাবে গাছতলাতেই স্কুল বসে।
কথায় বলে, ‘পর্বত যদি মহম্মদের কাছে আসতে না পারে, তবে মহম্মদকেই পর্বতের কাছে যেতে হবে’। চিকিৎসার সামগ্রী, জীবনদায়ী ওষুধ কিংবা দুধের মত শিক্ষাও যে একটি ‘অত্যাবশকীয় পণ্য’ বা পরিষেবা—সে ব্যাপারে কোনোদিনই সংশয় ছিলনা বসন্তবাবুর। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি এক নম্বর ব্লকের নয়াপুট সুধীরকুমার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বসন্তকুমার ঘোড়ইয়ের এই ব্যাপারে বক্তব্য খুবই স্পষ্ট,
-“কখনো কখনো পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থী যদি শিক্ষালয়ে পৌঁছতে না পারে, তবে শিক্ষাকেই শিক্ষার্থীর পাশে পৌঁছে দিতে হবে”।
২০০৭ সালে, পঁচাত্তর বছরের পুরনো এই স্কুলের দায়িত্ব নেবার পরপরই তাই স্কুলছুট ছাত্রদের খুঁজে পেতে স্কুলে ফিরিয়ে আনার কাজে লেগে পড়েছিলেন তিনি। সমুদ্রতীর লাগোয়া স্কুল, ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান। বসন্তবাবু তখনই জানতে পারেন, স্কুলের ফার্স্ট বয়, মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ যাদব মাঝি পড়াশুনা ছেড়ে পারিবারিক মাছ ধরার পেশায় চলে গেছে। অনেক খুঁজেপেতে যাদবকে পাকড়াও করে আনেন তিনি। তারপর তাকে শুধু যে স্কুলের সদ্য চালু হওয়া বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করে নেন তাই নয়, যাদবকে সোজা নিয়ে গিয়ে তোলেন নিজের বাড়িতে। সেখান থেকেই পড়াশুনা চলতে থাকে তার। সেই যাদব মাঝি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ স্কলার। আর বসন্তবাবু এখনো লেগে আছেন এমন আরও অনেক যাদব মাঝিদের গড়ে তোলবার কাজে।
এরই মধ্যে এসে গেল করোনা অতিমারী এবং তজ্জনিত লকডাউন। অন্যদের দেখাদিখি তিনিও অল্প কিছুদিনের জন্য অনলাইন পঠনপাঠন চালু করেছিলেন, কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারেন,
-'আমাদের গ্রামীণ ভারতবর্ষে অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা মোটেই চলে না'।
চলবে কীভাবে? ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকের বেশি পরিবারই তো স্মার্টফোন কী বস্তু তা-ই জানেনা। অতএব আবার শুরু হল শিক্ষাকেই শিক্ষার্থীদের কাছে বয়ে নিয়ে যাবার কর্মযজ্ঞ। শুধু নিজের স্কুলই নয়, আশেপাশের বেশ কয়েকটি স্কুলের আগ্রহী শিক্ষকদের একজোট করা গেল। স্কুলের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্রছাত্রী, যারা লকডাউনের কারণে উচ্চশিক্ষার অঙ্গন ছেড়ে তখন গৃহবন্দী, তাদেরও ডেকে আনা হল। অতিপ্রিয় হেডমাস্টারমশাইয়ের ডাকে তারাও পত্রপাঠ হাজির। স্কুলের বন্ধ পড়ে থাকা হস্টেল খুলে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। তারপর শুরু হল বসন্তবাবুর নতুন কর্মসূচি—‘চলো গ্রামে যাই, শিশু পড়াই’।
প্রতিদিন সকালে নয়াপুটকে কেন্দ্র করে মোট পাঁচটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন সেবাব্রতী এই শিক্ষকের দল। কোথাও ক্লাবঘরে, কোথাও চণ্ডীমণ্ডপে, কোথাওবা স্থানাভাবে গাছতলাতেই স্কুল বসে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জাতি-চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করিনা’। বসন্তবাবু কিন্তু করেন। লকডাউন-জনিত ছুটির প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত। এখনো কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে বসন্তবাবুর সেই গ্রামে গিয়ে শিশু-পড়ানো-র কর্মসূচি।
এখানেই থেমে না থেকে গোটা লকডাউন পর্ব জুড়েই বসন্তবাবু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নানা শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। কখনো সমুদ্রতীরের বালিয়াড়িতে হয়েছে সারাদিনব্যাপী শারদোৎসব, কখনো ঝাউবনের ভিতর প্রকৃতির কোলে নাট্যাভিনয়, কখনো পথের ধারের বীন্দ্রজয়ন্তী, কখনো স্কুল-চত্বরে রক্তদান শিবির— বাদ যায়নি প্রায় কিছুই। শিক্ষা যে শুধুমাত্র ক্লাসরুম-ব্ল্যাকবোর্ড-সিলেবাস-পরীক্ষার মধ্যে আবদ্ধ নিষ্প্রাণ একটা ব্যাপার নয়, বরং, জীবনযাপনের সঙ্গে আপদমস্তক সম্পৃক্ত একটা প্রক্রিয়া, আমাদের শিক্ষক সমাজের খুব মুষ্টিমেয় একজন-দু’জনই সেকথা বোঝেন এবং মানেন। বলাই বাহুল্য, বসন্তবাবু সেই বিরল ব্যতিক্রমীদের একজন।
আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে স্কুলগুলিকে শুধুমাত্র বিদ্যাচর্চাকেন্দ্রের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, বরং স্কুল-সংলগ্ন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে সেগুলিকে সামাজিকতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে—শিক্ষাবিদেরা বারবার একথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথও সেই উদ্দেশ্যেই শান্তিনিকেতনের অঙ্গনকে প্রসারিত করেছিলেন শ্রীনিকেতনে। কিন্তু আমরা সেই সত্যকে উপলব্ধি করিনি। করিনি বলেই আমাদের রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলই স্থানীয় জনসমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক-একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়েই থেকে গেছে।
ইয়াসের পরদিন থেকেই বসন্তবাবু ত্রাণশিবিরে আশ্রিত পরিবারের শিশুদের নিয়ে খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত পাঠশালা বসিয়ে দিয়েছেন বসন্তবাবু, সঙ্গী সেই সেবাব্রতী সহশিক্ষক আর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর দল। প্রতিদিন বিকেলে ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলছে সেই স্কুল। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করছে সেখানে।
লকডাউন চলাকালীন সরকারিভাবে যখন বিভিন্ন স্কুলবাড়িতে কোয়ারান্টাইন সেন্টার বানানো হচ্ছিল, অনেক স্কুল-কর্তৃপক্ষই তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কোয়ারান্টাইন সেন্টার চলাকালীন কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার অভিযোগও ভুরি ভুরি। এর উল্টোবাগে হেঁটে স্বেচ্ছায় বসন্তবাবু স্থানীয় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিভৃতাবাসের জন্য স্কুলবাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, স্কুলে আশ্রিত সেই মানুষগুলোর জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছেন, নিয়মিত তাদের শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন, এমনকী নিভৃতাবাস শেষে যখন শ্রমিকরা বিদ্যালয় ভবন ছেড়ে যাচ্ছেন, তখন তাদের হাতে সাধ্যমত উপহারও তুলে দিয়েছেন। বসন্তবাবুর কথায়,
-‘হাজার হোক, ওরা তো আমাদের অতিথি, আর শাস্ত্রে বলেছে অতিথি দেবো ভবঃ’।
গত ২৬ মে অতি-প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে স্কুলবাড়ি। চিলেকোঠার ঘর, শৌচাগার, মিড ডে মিলের ছাউনি সব ভেঙে চুরমার। সরকারি উদ্যোগে সেই ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ভবনেই তৈরি হয়েছিল ত্রাণশিবির। বসন্তবাবুও ভবন মেরামতির কাজ মুলতুবি রেখে আগে স্কুলচত্বরে সেই আশ্রিত মানুষজনের জন্য কমিউনিটি কিচেন তৈরি করেন। প্রায় পাঁচশো লোককে একটানা পনেরো দিন খাবারের যোগান দেওয়া হয় সেই কমিউনিটি কিচেন থেকে। এহো বাহ্য। ইয়াসের পরদিন থেকেই বসন্তবাবু ত্রাণশিবিরে আশ্রিত পরিবারের শিশুদের নিয়ে খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত পাঠশালা বসিয়ে দিয়েছেন বসন্তবাবু, সঙ্গী সেই সেবাব্রতী সহশিক্ষক আর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর দল। প্রতিদিন বিকেলে ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলছে সেই স্কুল। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করছে সেখানে। সমুদ্রের খাঁড়ির ধারে পড়ে আছে ইয়াস-বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা সব নৌকো, তারই পাশে খোলা মাঠে অনেকটা জায়গা জুড়ে কালো ত্রিপল পেতে সেই স্কুল বসেছে। চার বা ছ’জন ছাত্রছাত্রীর ছোট ছোট বৃত্তের মাঝখানে বসে মাস্টারমশাই বা দিদিমণি পড়াচ্ছেন। ছোট টুলের ওপর দুটো করে থান ইঁট রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসানো হয়েছে ব্ল্যাকবোর্ড। ঠিক যেন এক অভিনব শান্তিনিকেতন। ঘূর্ণিঝড়ে যাদের বই-খাতা ভেসে গিয়েছিল, তাদের প্রাথমিকভাবে কিছু বই-খাতা দিয়ে সাহায্য করেছেন বসন্তবাবুই। পাশাপাশি যদি তাদের জন্য নতুন বই-খাতার ব্যবস্থা করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে জেলার শিক্ষাদপ্তরেও তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
বলেছিলাম না, বসন্তবাবু মনে করেন, শিক্ষা একটি জরুরি পরিষেবা, একদিন, একমুহূর্তের জন্য সেই পরিষেবা বন্ধ হওয়া উচিত নয়। আমাদের শিক্ষা-নিয়ামকেরা কি কিছু শিখবেন তাঁর কাছ থেকে?
Link: https://ebongalap.org/lockdown-in-schools-shimanto